text
stringlengths
8
24.4k
দুর্গাপুজায় মহিষাসুর বধ্যে মধ্য দিয়ে অশুভর ওপর শুভর বিজয় দেখানো হয়। কিন্তু সেটা বিজয়ীর লেখা ইতিহাস বলেই গবেষকরা এখন বলছেন। তাদের লোককথা অনুযায়ী, আর্যদের দেবী দুর্গা এই সময়েই তাদের রাজা মহিষাসুরকে ছলনার মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন। রাজাকে হারানোর শোক হাজার হাজার বছর ধরেও ভুলতে পারেননি আদিবাসী সমাজ। 'অসুর' ভারতের একটি বিশেষ আদিবাসী উপজাতি। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড আর বিহার - এই তিন রাজ্যের সরকারি তপশিলী উপজাতিদের তালিকার একেবারে প্রথম নামটিই হল অসুর। তবে এখন 'অসুর' ছাড়া অন্য আদিবাসী সমাজও মহিষাসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে 'মহান অসুর সম্রাট হুদুড় দুর্গা স্মরণ সভা'র আয়োজন প্রতিবছরই বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন আদিবাসী সমাজ-গবেষকরা। "২০১১ সালে গোটা পশ্চিমবঙ্গে ২০০-র কিছু বেশি এরকম স্মরণসভা হয়েছিল, ২০১৮ সালে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০-র কিছু বেশি," বলছিলেন মহিষাসুর তথা ভারতের আদিবাসীদের উৎস সন্ধানে এক নির্মীয়মাণ তথ্যচিত্রের পরিচালক সুমিত চৌধুরী। মহিষাসুরের স্মরণে পূজা। আরও পড়তে পারেন: রামকে নিয়ে রসিকতা: অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা অযোধ্যা নেপালে, রাম নেপালি রাজপুত্র: নেপালের প্রধানমন্ত্রী যখন হিন্দু রীতিতে বিয়ে হলো মসজিদের ভেতরে আর এবছর পশ্চিমবঙ্গের শুধু তিনটি জেলা - মালদা, উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরেই সাড়ে ৩৫০০ জায়গায় এই স্মরণ সভা হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন আদিবাসীদের সামাজিক সংগঠন মাঝি পারগানা গাঁওতার নেতা চরন বেসরা। মহিষাসুরের নাম হুদুড় দুর্গা কেন হিন্দুদের বিশ্বাস মতে, তাদের দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। আবার আদিবাসী সমাজ মনে করে, দুর্গা আসলে তাদের 'সম্রাট মহিষাসুর'-এর নাম, যেখানে তিনি পরিচিত হুদুড় দুর্গা বলে। গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপনের ব্যাখ্যা, "হুদুড় শব্দটার অর্থ হল ঝঞ্ঝা, বিদ্যুৎ বা বজ্রের ধ্বনি। এক্ষেত্রে মহিষাসুরের প্রভাব আর শক্তি ছিল বজ্রের মতো। আর দুর্গা শব্দটা দুর্গের রক্ষক অর্থে ব্যবহৃত। এটা পুংলিঙ্গ। প্রবল শক্তিশালী এক দুর্গের রক্ষক, অর্থাৎ রাজাই ছিলেন মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গা।" বুন্দেলখণ্ডে এই মন্দিরে মহিষাসুরের পূজা হয় থাকে। "তিনি ছিলেন অত্যন্ত বলশালী এবং প্রজাবৎসল এক রাজা। আদিবাসীদের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী এক গৌরবর্ণা নারীকে দিয়ে তাদের রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল।" "এক গৌরবর্ণা নারীই যে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, তা হিন্দু পুরাণেও আছে। দেবী দুর্গার যে প্রতিমা গড়া হয়, সেখানে দুর্গা গৌরবর্ণা, টিকলো নাক, যেগুলি আর্যদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। দুর্গার আরেক নাম সেজন্যই গৌরী। অন্যদিকে মহিষাসুরের যে মূর্তি গড়া হয় দুর্গাপূজায়, সেখান তার গায়ের রঙ কালো, কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট। এগুলো সবই অনার্যদের বৈশিষ্ট্য," ব্যাখ্যা তথ্যচিত্র নির্মাতা সুমিত চৌধুরীর। মি. উদ্দীপন আরও বলছিলেন যে আর্যরা ভারতে আসার পরে তারা কোনোভাবেই মহিষাসুরকে পরাজিত করতে পারছিল না। তাই তারা একটা কৌশল নেন, যাতে এক নারীকে তারা ব্যবহার করেন মহিষাসুরকে বধ করার জন্য। মহিষাসুর বধের দুই বিপরীত কাহিনী মহিষাসুরকে স্মরণ করছে আদিবাসী সম্প্রদায়। হিন্দু পুরাণে যেমন মহিষাসুর আর দেবী দুর্গার যুদ্ধের কাহিনী আছে, আদিবাসী লোকগাথাতেও সেই কাহিনী রয়েছে, কিন্তু দুটি কাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত। "রাজা মহিষাসুরের সময়ে নারীদের অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হত। এবং এরকম একজন রাজা কোনও নারীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না, বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না, এরকমটাই ধারণা ছিল আর্যদের। তাই তারা দুর্গাকে এই কাজে ব্যবহার করেছিলেন বলেই আদিবাসী সমাজ মনে করে," বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন। আর হিন্দুদের পুরাণে মহিষাসুরকে একজন 'ভিলেন' হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। মহিষাসুরকে সাধারণত দানব হিসেবে তুলে ধরা হলেও এবারের দুর্গাপূজায় তাকে করোনাভাইরাস হিসেবে দেখানো হয়েছে। অসুর এবং অন্যান্যা আদিবাসী সম্প্রদায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। উনবিংশ শতকে প্রথম পৌরাণিক কাহিনীগুলির বিশ্লেষণ ও সমালোচনামূলক পর্যালোচনা করেছিলেন সামাজিক কর্মকর্তা ও ইতিহাসবিদ জ্যোতিরাও ফুলে। হিন্দুদের অবতার ও দেবদেবীদের আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন ভারতের আদিবাসীদের লোকগাথা ও ইতিহাস। তারপরে মি. ফুলের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান ভারতের সংবিধান রচয়িতা বি. আর. আম্বেদকর। পুরাণ ও লোককথার ওপরে ভিত্তি করে তিনি আর্য ও অনার্যদের সংঘাতকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তার লেখাতেই প্রথম বলা হয় দানব, রাক্ষস, দৈত্য, কিন্নর, নাগ, যক্ষ এরা সব মিলে যে 'অসুর' সম্প্রদায়, তারা আসলে মানুষই ছিলেন। তিনিই প্রথম এই অসুর সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরেন। কীভাবে মহিষাসুরের জন্য শোক পালন করা হয় খাজুরাহোর মন্দিরে মহিষাসুরের মূর্তি। চিরাচরিত ভাবে দুর্গাপূজার সময়টাতেই মহিষাসুরের জন্য শোক পালন করে থাকে আদিবাসী সমাজ। কোথাও অরন্ধন পালন করা হয়, কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন আদিবাসীরা, যাতে দুর্গাপূজার যে উৎসব, সেই মন্ত্র বা ঢাকের শব্দ যাতে তাদের কানে না যায়। দুর্গাপূজার এই সময়ে তারা অশৌচ পালন করেন এবং ভুয়াং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নাচ হয়। দাসাই নাচ করেন তারা, যেখানে পুরুষরা নারী যোদ্ধার ছদ্মবেশ ধারণ করে কান্নার সুরে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। "তাদের গানটা এরকম : 'ওকার এদম ভুয়াং এদম জনম লেনা রে, ওকার এদম ভুয়াং এদম বছর লেনা রে'। তারা বিশ্বাস করে এই গানের মধ্যে যে প্রশ্ন আছে, তার উত্তর একমাত্র জানে হুদুড় দুর্গা। সে যদি এই গান শুনতে পায়, তাহলে জবাব দেবে এবং হুদুড় দুর্গাকে তারা চিহ্নিত করতে পারবে," বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন। "তারা 'বিন্দি বা মাকড়সাকে বলে, 'ও বিন্দি, তোমরা কি কেউ আমার রাজাকে দেখেছ? আমাদের রাজাকে কোনও এক গৌরবর্ণা নারী চুরি করে নিয়ে গেছে'," আদিবাসী সমাজের লোকগাথা বিশ্লেষণ করে বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন। মহিষাসুর স্মরণের ধরণ পাল্টাচ্ছে আদিবাসী সমাজের নেতা চরন বেসরা জানাচ্ছেন, এবছর করোনা মহামারির কারণে তাদের মূল কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানটি হয় দুর্গাপূজা শেষ হওয়ার পরের দিন। কিন্তু গ্রামে গ্রামে মানুষ মহিষাসুর স্মরণ করছেন নিজেদের মতো করে। "ষষ্ঠী, সপ্তমী থেকেই শুরু হয় শোক পালন। দাসাই, ভুয়াং এগুলো চলতে থাকে পাড়ায় পাড়ায়। আর দশমীর দিন হয় বড় অনুষ্ঠান। আমরা এগুলো করতে শুরু করেছি ২০১২ সাল থেকে। আর প্রতিবছরই সংখ্যাটা বাড়ছে। "আমরা চেষ্টা করছি আর্য সভ্যতা-সংস্কৃতির বিপরীতে ভারতের আদি বাসিন্দাদের সংস্কৃতি পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে," বলছিলেন চরণ বেসরা। বছর দশেক আগে থেকে সংগঠিতভাবে মহিষাসুর স্মরণ অনুষ্ঠান করা হলেও আদিবাসী সমাজ কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে তাদের রাজার জন্য শোক ব্যক্ত করে আসছে। নতুন করে যেভাবে শোক পালন অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে, তার সঙ্গে চিরাচরিত প্রথায় শোক পালনের একটা ফারাক আছে বলে মনে করেন মহিষাসুর গবেষক প্রমোদ রঞ্জন। মি. রঞ্জন এখন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, কিন্তু তার বড় পরিচয় হল ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে মহিষাসুর সম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক প্রমাণ যোগাড় করেছেন তিনি। "তফাৎটা হল যে চিরাচরিত প্রথায় যেভাবে শোক পালন হত, তার ভিত্তি ছিল লোকগাথা আর এখন যেটা হচ্ছে সেটা একটা ইতিবাচক সাংস্কৃতিক রাজনীতি। যেটা একদিকে মনুবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের রুখে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা অন্যদিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস," বলছিলেন মি. রঞ্জন। মহিষাসুরের খোঁজে গবেষকদের মতে মহিষাসুর সংক্রান্ত যে লোকগাঁথা রয়েছে, তা প্রায় ৩০০০ বছর পুরনো, যখন আর্যরা ভারতবর্ষে আসেননি। এমন কি বুদ্ধেরও আগের যুগের ইতিহাস এটা। আর মহিষাসুর সম্বন্ধীয় লোকগাঁথা গোটা দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই পাওয়া যায়। উত্তর ভারত থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্য, বর্তমানের নেপাল - বাংলাদেশেরও নানা জায়গায়। প্রমোদ রঞ্জনের কথায়, "বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই অসুর জাতির ইতিহাস আর্যদের পূর্ববর্তী যুগের ইতিহাস। আমরা যেমন মহিষাসুরকে খুঁজে পেয়েছি বর্তমান উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডে, আবার এখনকার যে মহীশুর বা মাইসোর শহর, সেই অঞ্চলেও মহিষাসুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আবার খাজুরাহোর যে বিশ্বখ্যাত মন্দির, সেখানেও মহিষাসুরের মূর্তি পেয়েছি আমরা। অর্থাৎ শুধু যে লোকগাঁথায় মহিষাসুর আছেন, তা নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও খুঁজে পেয়েছি আমরা।" 'অসুর' নামের যে জনজাতি, তারা ছাড়াও ভারতের আদিমতম আদিবাসী বলে পরিচিত ছত্তিশগড়ের গোন্ড সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহিষাসুরের লোকগাঁথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত বলে জানাচ্ছিলেন মি. রঞ্জন। দু'হাজার চৌদ্দ সালে তার কাছে কতগুলি ছবি আসে, যেগুলি ছিল উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ড এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহিষাসুরের কয়েকটি প্রত্ন নিদর্শনের ছবি। প্রমোদ রঞ্জন সেই সময়ে দিল্লির ফরোয়ার্ড প্রেস নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা, যারা মূলত দলিত সম্প্রদায়ের সাহিত্য নিয়ে কাজ করে, সেটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তার মধ্যে এমন একটি ছবি ছিল, যেটি ভারত সরকারের আর্কিওলজিকাল সার্ভের সংরক্ষিত একটি নিদর্শন, যার নাম মহিষাসুর স্মারক। প্রমোদ রঞ্জনের কথায়, "শুধুমাত্র ওই কয়েকটি ছবি সম্বল করে আমি এবং আমার এক সহকর্মী ট্রেনে চেপে দিল্লি থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে মাহোবা রেল স্টেশনে নেমেছিলাম এক রাতে। স্টেশনের আশেপাশে অনেককে দেখিয়েছিলাম ছবিগুলো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি যে ওই জায়গাগুলো কোথায়।" দিন দুয়েক পরে তারা খুঁজে পেয়েছিলেন মহিষাসুর স্মারক। "একজন আমাদের পাঠায় কুলাপাহাড় নামের এক জায়গায়, কিন্তু সেখানেও কিছু পাইনি আমরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে কুলাপাহাড় থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চাউকা নামের একটা জায়গার কথা বলে একজন। সেখানে পৌঁছিয়ে আমরা নিশ্চিত হলাম যে সঠিক জায়গায় এসেছি। পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটি বোর্ড দেখতে পেলাম," বলছিলেন প্রমোদ রঞ্জন। ওই স্মারকটি ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করে রেখেছে। পরে মি. রঞ্জনের এক প্রশ্নের জবাবে পুরাতত্ত্ব বিভাগ জানায় যে ওই স্মারকটি একাদশ শতকের। দিন দুয়েক পরে মাহোবায় ফিরে এসে কাছাকাছি মহিষাসুরের আরও নিদর্শন খুঁজতে থাকেন তারা। গোখর পাহাড়ে আলাপ হওয়া এক সাধুর কাছে তাঁরা জানতে পারেন যে ওই অঞ্চলে মহিষাসুর ব্যাপকভাবে পূজিত হন। কোথাও ভৈঁসাসুর, কোথাও মাইকাসুর আবার কোথাও মহিষাসুর নামে তাঁর পুজা দেন দলিত শ্রেণীর যাদব আর পাল বংশীয় মানুষ। মহিষাসুরকে তাঁরা গরু, মোষের মতো গৃহপালিত পশুর রক্ষাকর্তা বলে মনে করেন। মি. রঞ্জন বলছেন, গ্রামগুলিতে মহিষাসুরের মন্দির থাকে না, তবে বাঁধানো চাতাল মতো একটা জায়গায় পূজা করেন স্থানীয় মানুষ। আবার খাজুরাহোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটেও তিনি মহিষাসুরের মূর্তি দেখতে পেয়েছেন। গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন বলছিলেন, সম্রাট অশোকের আমলে মহিষাসুরকে বর্তমানের মহিশুর বা মাইসোর অঞ্চলটি শাসন করতে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সব নিদর্শনগুলি দেখে প্রমোদ রঞ্জনের মত হল, "মহিষাসুর নানা যুগেই ছড়িয়ে ছিলেন। তাই এটা সম্ভবত কোনও এক ব্যক্তি নন, এটা একটা উপাধি। যার পরম্পরা দক্ষিণ এশিয়ার নানা এলাকায় ছড়িয়ে আছে। যে পরম্পরা হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে আসছেন আদিবাসীরা।" বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর: ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে রুখতেই ভারত-আমেরিকার 'দুই আর দুই' বিদেশি মদ রাখার দায়ে ইরফান সেলিমের কারাদণ্ড পর্নোগ্রাফি আসক্তি যেভাবে সব ধারণা বদলে দেয়
হিন্দু বাঙালীরা যে সময়ে তাদের সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন করেন, সেই সময়েই শোক পালন করেন অসুর বংশীয় আদিবাসীরা।
গত ২০ বছরে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক সংকট যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসর অর্থাৎ বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে রাশিয়া। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি'র একজন এজেন্ট ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯৯৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেনের পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেছেন। বৈশ্বিক সংঘাত, দেশের অভ্যন্তরে নানা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে খেলাধুলার আসর আয়োজন এবং নিজের প্রচারণার জন্য নানা ছবি - এ সবকিছুই আছে মি: পুতিনের এই ২০ বছরে। তাঁর ক্ষমতার ২০ বছরে সেসব দিকে দৃষ্টি দিয়েছে বিবিসি। আরো পড়ুন: উদারপন্থা 'অচল' হয়ে পড়েছে: পুতিন কেন র‍্যাপ সঙ্গীতের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান পুতিন ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠক: কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ? ১৯৯৯ সালের অগাস্ট মাসে ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বরিস ইয়েলেতসিনের বিদায়ের পর ৩১ শে ডিসেম্বর মি: পুতিন প্রেসিডেন্ট হন। কেজিবি'র সাবেক এ কর্মকর্তা ১৯৯৯ সালে যখন ক্ষমতাসীন হলেন তখন দ্বিতীয়বারের মতো চেচনিয়া যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। কিছু এপার্টমেন্টে বোমা হামলার জবাবে সে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট হিসেবে মি: পুতিনের সূচনা হয়েছিল রাশিয়ার অস্থির দক্ষিণাঞ্চলে সংঘাতের মধ্য দিয়ে। চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি অবরোধ করে রাখে রাশিয়ার সৈন্যরা। ২০০৩ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে গ্রোজনিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ২০০০ সালের মার্চ মাসে মি: পুতিন চেচনিয়া সফর করেন। এরপর কয়েক বছর ধরে জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হয় রাশিয়া। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০০৪ সালে বেসলান স্কুলে হামলা, যেখানে ৩৩০ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল শিশু। ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পুতিন চেচনিয়াতে যুদ্ধ শেষ করেননি। ২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো সে পদে আসীন হন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ইমেজ সংকটে পড়েন। ২০০৪ সালে বেসলাস স্কুলে হামলায় নিহতদের প্রতি শোক করতে রাশিয়ার মন্ত্রীসভা এক মিনিট নিরবতা পালন করে। কার্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয়ে ১১৮ জন নাবিক মারা যায়। ২০০০ সালের অগাস্ট মাসে যখন কার্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয় ঘটে তখন নিহত নাবিকদের পরিবারকে বিষয়টি অবহিত করতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে। তখন মি: পুতিন তখন অবকাশ যাপনে কৃষ্ণ সাগরে ছিলেন। কিন্তু সাবমেরিন বিপর্যয়ের পর প্রথমদিকে তিনি অবকাশ যাপন থেকে ফিরে আসেননি। কার্স্ক সাবমেরিন কমান্ডারের পরিবারের সাথে দেখা করেন মি: পুতিন। ক্ষমতার প্রথম দশকে মি: পুতিনের সাথে পশ্চিমা নেতাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। যদিও তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির সমালোচক ছিলেন। ২০০৬ সালে রাশিয়া প্রথমবারের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট 'জি এইট' সম্মেলনের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে সে জোটে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিও ঘটে। ২০০১ সালে ভ্লাদিমির পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী মি: পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরপর তিন মেয়াদে থাকতে পারতেন না। সেজন্য ২০০৮ সালে তিনি চার বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। সে সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন দিমিত্রি মেদভেদেভ। কিন্তু অনেকে মনে করতেন, মি: মেদভেদেভ ছিলেন মি: পুতিনের হাতের পুতুল। ২০০৩ সালে ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকুনি রাশিয়া সফর করেন। সে সফরে ইরাক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ২০০৩ সালে মি: পুতিনকে ব্রিটেনে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানান। ১৮৭৪ সালের পর সেটাই ছিল রাশিয়ার কোন নেতার ব্রিটেন সফর। ২০০৬ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত জি এইট সামিটে জর্জিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সাউথ ওশেটিয়া অঞ্চলের কর্তৃত্ব ফিরে পাবার জন্য ২০০৮ সালে জর্জিয়া যখন সেখানে সৈন্য পাঠায়, তখন রাশিয়া জর্জিয়ার ভেতরে আক্রমণ করে। স্বল্প সময়ের যুদ্ধ ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মি: পুতিন সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন পশ্চিমা নেতাদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ইউক্রেন থেকে ক্রাইমিয়া দখল করে নেবার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করে। এছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন 'জি এইট' থেকে রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। জর্জিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরু হলে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আহতদের দেখতে যান মি: পুতিন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হবার চার বছর পরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে রক্ষার জন্য রাশিয়া সে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ প্রায় পতনের মুখে চলে গিয়েছিলেন। সিরিয়াতে রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান এবং সরঞ্জাম পাঠানোর কারণে সেখানকার ভারসাম্য বদলে যায়। মি: পুতিন যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দেয়া শুরু করেন, তখন সিরিয়ার যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে যায়। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করার পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলে যে, দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ সালে রাশিয়ার সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সার্গেই স্ক্রিপালকে ব্রিটেনের মাটিতে বিষ প্রয়োগে হত্যার জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে ব্রিটেন। মার্কিন গোয়েন্দারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে। সার্গেই স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগে হত্যার পর ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে'র সাথে সম্পর্ক শীতল হয়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া দখল করার পর দেশের ভেতরে মি: পুতিনের জনসমর্থন বাড়ে। ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে মি: পুতিন ক্রাইমিয়ায় মোটর সাইকেল র‍্যালিতে অংশ নেন। এটিকে সার্বভৈৗমত্বের লংঘন হিসেবে বর্ণনা করেছে ইউক্রেন। ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পাঁচ বছর পর এ মাসে আলোচনা শুরু হয়। ক্ষমতায় থাকার পুরো সময় জুড়ে মি: পুতিন তাঁর নিজের এবং দেশের ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নিজের কিছু ছবি দিয়ে প্রচারণার মাধ্যমে মি: পুতিন নিজেকে একজন শক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ২০০৭ সালে মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে স্নাইপার হাতে হাঁটছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৩ সালে পোষা কুকুকদের নিয়ে তুষাড়ের উপর খেলছেন মি: পুতিন। খেলাধুলায় নিজের পারদর্শিতা দেখানোর চেষ্টাও করেছেন মি: পুতিন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় আইস হকিতে অংশ নিয়েছেন। ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিক এবং ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের মাধ্যমে মি: পুতিন ক্রীড়াঙ্গনে রাশিয়ার ভালো অবস্থান তুলে ধরতে চেয়েছেন। সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক ছিল সফল। কিন্তু ডোপ কেলেঙ্কারির জের এখনো চলছে। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সি বা ওয়াডা রাশিয়াকে চার বছরের জন্য খেলাধুলার বড় আসরগুলোতে নিষিদ্ধ করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ডোপিং এর অভিযোগ ওঠে ২০১৫ সালে। সে বছরের নভেম্বরে রাশিয়ার অ্যান্টি ডোপিং সংস্থা 'রুসাডা' মাদক বন্ধে সহযোগিতা করছে না বলে ঘোষণা করে ওয়াডা। সংস্থার এক রিপোর্টে তখন বলা হয়েছিল, রাশিয়ায় সরকারি মদদেই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলেটিক্সে ব্যাপকভাবে মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে। এরপর ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চার বছর ধরে ডোপিং কর্মসূচি চলেছে যাতে করে তাদের প্রতিযোগীরা গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন অলিম্পিকসে অংশগ্রহণ করতে পারে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তারা ল্যাবরেটরি পরীক্ষার যেসব তথ্য হস্তান্তর করেছিল, তাতে কারসাজি করা হয় বলে অভিযোগ করছে ওয়াডা। তবে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনে রাশিয়া ছিল সফল। ডোপিং কেলেঙ্কারির জন্য ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকস এবং ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে রাশিয়া অংশ নিতে পারবে না।
ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর ক্ষমতায় থাকার ২০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছেন।
বরিশাল সদরে চলছে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। যদিও প্রায় সব আসনেই প্রচার প্রচারণা বেশি চোখে পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদেরই। তারপরেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পাশাপাশি আলোচনায় রয়েছেন বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের নিয়ে। এমনকি মাঠে তেমন দেখা না গেলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী কিংবা নেতাকর্মীরা তাদের প্রচারে বারবারই তুলে আনছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের প্রসঙ্গ। বরিশালে ছয় আসন কিন্তু সবার দৃষ্টি সদর ও গৌরনদীতে আরও পড়তে পারেন: রাজশাহীতে নির্বাচনী পরিবেশ 'ভালো', কিন্তু বাইরে? সাংবাদিকদের চোখে মোটরসাইকেল নিষেধাজ্ঞা হিন্দু ভোটারদের ঘিরেই নাসিরনগরে যত সমীকরণ রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ সদর আসন: বরিশাল-৫ আসনটিই জেলায় সদর আসন এবং এই অঞ্চলের রাজনীতি এ এলাকাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। আসনটিতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মজিবর রহমান সরওয়ার নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের জাহিদ ফারুক শামীমকে হারিয়ে। এবারও তারা দুজনই একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। এর আগে ৯১ ও ৯৬ সালেও বিএনপি প্রার্থী এ আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন আর ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জিতেছিলেন উপ নির্বাচনে। কিন্তু ২০১৪ সাল ছাড়া এ আসনে ১৯৯১ সাল থেকে পরবর্তীতে সব নির্বাচনই এখানে জমজমাট হয়েছিল। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যেমন জিতেছিলেন তেমনি আওয়ামী লীগ আমলে জিতেছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী। এবং সেটা সর্বশেষ মেয়র নির্বাচনে। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। শহরের আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহিদ ফারুককে সমর্থনে ব্যাপক প্রচার চোখে পড়লেও বিএনপি প্রার্থী মজিবর রহমান সরওয়ারের প্রচার চোখে পড়ছে কমই। অথচ শহরেই নৌকা প্রতীকে পাশাপাশি অসংখ্য পোস্টার চোখে পড়ে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী সৈয়দ মোঃ ফয়জুল করিমের। আসনটিতে আরও প্রার্থী আছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও আব্দুস সাত্তার, এনপিপির শামিমা নাসরিন, জাতীয় পার্টির একেএম মুরতজা আবেদীন ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির এইচ এম মাসুম বিল্লাহ। নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী। কি বলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি? মহানগর বিএনপির সহসভাপতি মহসিন মন্টু বলছেন গণ-গ্রেপ্তার আতঙ্কে গাঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন তার দলের নেতাকর্মীরা। "বাধার কারণে সভা সমাবেশ করা যাচ্ছেনা। পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। এমনকি পোস্টার লাগাতে গেলে হুমকি দেয়া হচ্ছে"। তিনি বলেন, "সেনাবাহিনী নামলে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে"। তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি আফজালুল করিম বলছেন বিএনপির অভিযোগ সত্যি নয় কারণ প্রতিদিনই তাদের প্রচারণার ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। মিস্টার করিম বলেন গ্রেফতারের বিষয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই কারণ এটি আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত বিষয়। "যাদের ধরা হচ্ছে তারা একাধিক মামলার আসামী"। ধানের শীষের পক্ষে চলছে প্রচারণা। আসনটির ইস্যু কি? শহীদুল ইসলাম নামে একজন দোকানী এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, "এখানে ইস্যু রাজনীতি"। তার মতে আসনটি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জন্য মর্যাদার আসন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আর সে কারণেই কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ এবার। এ আসনে ভোটারদের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি বোঝা মুশকিল তবে অনেকেই বলছেন শহরের রাস্তাঘাট প্রশস্ত করা দরকার, বেকারত্ব অনেক তীব্র আর শিল্প কারখানা না থাকায় কর্মসংস্থান বাড়ছেনা। তবে তরুণ ভোটার অনেকের মধ্যেই ভোট সঠিক ভাবে হবে কি-না তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। তারিন তাসনিম জুঁই নামে একজন নতুন ভোটার বলছিলেন, "এবার ভোট দিবো এবং এটি নিয়ে আমি খুবই উচ্ছ্বসিত। তাই চাই ভোটটা যেন ঠিক মতো হয়"। জান্নাতুল ফেরদৌস কানিজ বলেন, "আমরা যেন ভোট দিয়ে বলতে পারি যিনি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি আমাদের ভোটেই হয়েছেন।" ভোটারদের অনেকেই জানিয়েছেন ভোট নিয়ে এমন উদ্বেগ আছে অনেকের মধ্যেই আর এর কারণ হল চলতি বছরেই হওয়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। যে নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। তরুণদের একজন অপূর্ব কুমার বলছিলেন, "সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন"। বরিশাল এখন তুমুল নির্বাচনী প্রচারণায় সরগরম 'ইলেকশন যেমন অওয়ার অইবে' সদরের বাইরে জেলার যে আসনটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেটি হল বরিশাল-১। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। মিস্টার আব্দুল্লাহর ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ্ই বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের এখনকার মেয়র এবং গত জুলাইয়ের যে নির্বাচনে জিতে তিনি মেয়র হয়েছেন সে নির্বাচন নিয়েই ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। যদিও তিনি ও আওয়ামী লীগ তা বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন, যিনি দলটির সংস্কারপন্থী অংশটির সাথে গিয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। পরে অনেকদিন নিষ্ক্রিয় থেকে সম্প্রতি বিএনপিতে ফিরে এসে তিনি সক্রিয় হয়েছেন। কিন্তু এবার মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকে নিজের এলাকায় এসে ঘর থেকেই বের হতে পারছেননা বলে দাবী করছেন তিনি। সোমবার বিকেলে গৌরনদীর সরিকল নামে একটি গ্রামে তার নিজের বাসায় বসে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "আমাকেই হুমকি দেয়া হচ্ছে। নেতাকর্মীদের ওপর গণহারে মারধর চলছে। মিছিলে হামলা হচ্ছে। এসব কারণে বের হতে পারছিনা"। জহির উদ্দিন স্বপন বলেন সেনাবাহিনী নামার পর পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে আশা করছেন তিনি। বরিশালে ছয় আসন কিন্তু সবার দৃষ্টি সদর ও গৌরনদীতে তবে তার এসব অভিযোগ মানতে রাজী নন প্রতিদ্বন্দ্বী আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর প্রধান সমন্বয়ক গৌরনদীর মেয়র হারিছুর রহমান হারিছ। মিস্টার রহমান বলেন, "বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এ এলাকায় যে নির্যাতন করেছিলো সেজন্য তারা এখন মানুষের কাছে যেতে পারছেনা"। তবে দল দুটির নেতারা যাই বলুন স্থানীয় ভোটারদের অনেকেই নির্বাচন বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। সোমবার বিকেলেই জহির উদ্দিন স্বপনের বাড়ির কাছেই সড়কে বিপুল সংখ্যক নৌকা সমর্থককে লাঠিসোটা হাতে দেখা গেছে। যদিও হারিছুর রহমান বলছেন তারা বিএনপিকে কোন বাধা দিচ্ছেনা। স্থানীয় একটি মার্কেটের সামনে মোহাম্মদ মনোয়ার নামের একজন ভোটার বলেন এখানে ভয়ে আসলে অনেকে নির্বাচন নিয়ে কথাই বলতে চাননা। তবে এই ভয় কিসের সে প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজী হননি তিনি। যদিও আরেকজন ভোটার বলেন, "যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে এখানে সব তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বোঝাই যায় কেমন হবে নির্বাচন"। বরিশাল-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর প্রধান সমন্বয়ক গৌরনদীর পৌর মেয়র হারিসুর রহমান হারিস। অন্য আসনগুলোর কি অবস্থা? বরিশাল-২ আসনে আওয়ামী লীগের মোঃ শাহ আলম ও বিএনপির সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুসহ সাতজন প্রার্থী রয়েছেন। সোমবারও দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে বিএনপি প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুর নেতৃত্বে হামলা ও গুলি হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা মনিরুল ইসলাম মিঠু। সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু জানিয়েছেন তার ওপর হামলা হয়েছে আর সে কারণেই আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি করেছেন তিনি। বরিশাল-৩ আসনে বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু সুলতান মহাজোট প্রার্থী। আবার ওয়ার্কার্স পার্টির আরেকজন নেতা আতিকুর রহমানও নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপুও রয়েছেন মাঠে, যিনি ২০০৮ সালে মহাজোট প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বরিশাল-১ এর বিএনপি প্রার্থী জহিরুদ্দিন স্বপন। এ আসনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোন নেতা প্রার্থী হননি বরং এই তিনজন দলটির নানা দল-উপদলের সমর্থন পাচ্ছেন। ওদিকে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন। বরিশাল -৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি পংকজ নাথ ও বিএনপি জোটের জে এম নূরুর রহমানসহ মোট প্রার্থী সাতজন। মিস্টার রহমান নাগরিক ঐক্যের নেতা ছিলেন। তবে নির্বাচনী প্রচারে এসে একবার হামলার শিকার হওয়ার পর থেকে তিনি আর এলাকায় নেই। আর বরিশাল-৬ আসনে আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থী হয়েছেন জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান আমিন। অন্যদিকে এখানে বিএনপির প্রার্থী হলেন আবুল হোসেন খান। এ আসনে প্রচার প্রচারণা তুলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বরিশাল এখন তুমুল নির্বাচনী প্রচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে। প্রচারণার পাশাপাশি কোথাও কোথাও সংঘর্ষের ঘটনায় বাড়ছে উত্তেজনাও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির কাছে বিশেষ একটি নাম। বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তাঁর বিশাল সাহিত্য কীর্তির জন্য তিনি বহু বাঙালির রক্তস্রোতে আজও মিশে আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতকার, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। এক কথায় বহুমুখী প্রতিভার সম্বন্বয় ঘটেছিল তাঁর বর্ণময় দীর্ঘ কর্মজীবনে। তবুও তাঁর কবি পরিচিতিই তাঁকে বিশ্ববরেণ্য করে তুলেছিল আর তাই রবীন্দ্রনাথকে ভূষিত করা হয়েছিল 'বিশ্বকবি' বা 'কবিগুরু' নামে। আর তাঁর কবিতাগুচ্ছের জন্য তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক ধনী ও সংস্কৃতিবান পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬১ সালের ৭ই মে। বাবা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদাসুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর বাবামায়ের চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটবেলায় প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা তিনি নেননি। বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্কুলের বাঁধাধরার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর অনাগ্রহ। তাঁর 'জীবনস্মৃতি' বইয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, যে অল্পকাল তিনি স্কুলে পড়েছিলেন সেসময় স্কুলের পাঠ ও পরিবেশ এবং স্কুলের দিনগুলো তাঁর কাছে কেমন "মুখবিবরের মধ্যে প্রাত্যহিক বরাদ্দ গ্রাসপিণ্ডের মত" লাগত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বা কলকাতার বাইরে পারিবারিক বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মাকে হারিয়েছিলেন তাঁর চোদ্দ বছর বয়সে। তাঁর বাবা অনেক সময় কাটাতেন দেশের বাইরে। ফলে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল গৃহভৃত্যদের শাসন ও সান্নিধ্যে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন তাঁর থেকে বয়সে বড় তাঁর এক ভাগিনার উৎসাহে। সে কবিতা পরে ছাপাও হয়েছিল একটি পত্রিকায়। তাঁর যখন এগারো বছর বয়স তখন তিনি কয়েকমাসের জন্য বাবার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। এর মধ্যে পাঞ্জাবে হিমালয় পাহাড় ঘেরা ডালহাউসি শহরে থাকাকালীন বাবার কাছে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতেন। ওই পাহাড়ি শৈলাবাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৩ সালে লিখেছিলেন তাঁর প্রথম গান "গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বালে"। বলা হয় এটি ছিল পাঞ্জাবি একটি ভজনের অনুবাদ। ওই সময় অমৃতসরে এক মাস যখন তিনি বাবার সঙ্গে ছিলেন, তখন বাবা ও ছেলে নিয়মিত যেতেন স্বর্ণমন্দিরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছেন, সেসময় ওই মন্দিরের ভজন সঙ্গীত তাঁর ওপর বড়ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। আট বছর বয়স থেকে শুরু করে লিখে গেছেন তাঁর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত। ৫২কাব্যগ্রন্থ ৩৮ নাটক ১৩উপন্যাস ৩৬প্রবন্ধ ৯৫ছোটগল্প ২০০০গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যারিস্টারি পড়তে ১৮৭৮ সালে সতের বছর বয়সে ইংল্যান্ডে যান। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তিনি আইনজ্ঞ হন। প্রথমে তিনি সমুদ্রতীরের শহর ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এক বছর পরে লন্ডনে আসেন আইনবিদ্যা নিয়ে পড়তে। কিন্তু সাহিত্যচর্চ্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি শেষ করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন এই সময়ে তিনি শেক্সপিয়র সহ অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে আইনের পড়া শেষ না করেই তিনি ফিরে যান কলকাতায়। বিয়ে করেন ১৮৮৩ সালে ১০ বছরের কিশোরী মৃণালিনী দেবীকে। জন্মকালে তাঁর নাম ছিল ভবতারিণী এবং তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক অধস্তন কর্মচারীর মেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর পাঁচজন সন্তান জন্মেছিল, যদিও দুই সন্তান তাদের বাল্যবয়সেই মারা যায়। বাবার আদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০-৯১ সাল থেকে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, সেইসঙ্গে পাবনা, রাজশাহী ও উড়িষ্যায় পৈত্রিক জমিদারিগুলোর তদারকি শুরু করেন। এর মধ্যে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ পরিবার নিয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন। শিলাইদহে 'পদ্মা' নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে যেতেন তিনি। তবে গবেষকরা বলেন তিনি প্রজাদের কাছ থেকে নামমাত্র খাজনা নিতেন। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, যেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন বহু বিখ্যাত কবিতা। ১৯০১ পর্যন্ত তিনি কাটিয়েছিলেন শিলাইদহে। সেখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, ক্ষণিকা ও চৈতালির অসংখ্য কবিতা। গীতাঞ্জলি কাব্যের অনুবাদের কাজও তিনি শুরু করেছিলেন শিলাইদহে। রবীন্দ্র গবেষকদের অনেকেই বলেন এসময় প্রজাদের কল্যাণে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেখানে থাকাকালে তিনি দেখেছিলেন তাঁদের জমিদারিতেই প্রজারা কীভাবে শোষণের শিকার হয়েছেন। প্রজাদের কল্যাণে তিনি সেখানে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রও স্থাপন করেছিলেন। ওই সময় তিনি তাঁর গল্পগুচ্ছ বইয়ের প্রায় ৫০টির মত গল্প লেখেন। এসব গল্পে তিনি মূলত গ্রাম বাংলা দারিদ্র ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম ছোট গল্প ছিল 'ভিখারিনী'। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের কাছে শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় বা ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯০১ সালে যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯২১ সালে। এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫১ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে একটি স্কুল স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই স্কুল স্থাপনের কিছুকাল পরের ছবি। শান্তিনিকেতনে থাকাকালেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাকে হারান। তাঁর পিতৃবিয়োগও ঘটে ১৯০৫ সালে। এসবের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছিলেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক লর্ড কার্জন যখন দেখলেন বাঙালিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন তারা ওই আন্দোলন রুখতে সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাকে দুভাগে ভাগ করে দিতে। এর প্রতিবাদে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, তার পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রিটিশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলার নেতারা ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে কলম ধরে যে গানগুলো লিখেছিলেন, তা তখন এক অভিনব উন্মাদনা তৈরি করেছিল। তবে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বেশিদিন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকেননি। রাজনৈতিক নেতারা উত্তেজনাপূর্ণ আন্দোলন-সর্বস্ব, গঠননীতি-বর্জিত যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা তিনি সমর্থন করেননি। কিন্তু তাঁর কিছু কিছু জীবনীকার লিখেছেন রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর সায় না থাকলেও, যেহেতু তাঁর মন জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ছিল এবং তিনি ছিলেন খুবই সংবেদনশীল, তাই বিদেশি শাসকরা বড় রকম অন্যায় করছে দেখলে তিনি চুপ করে থাকতে পারতেন না। জালিয়ানওয়ালা বাগের বিক্ষোভে জমায়েত মানুষরা ছিলেন নিরস্ত্র গ্রামবাসী। তাদের হত্যাকাণ্ডের ছবি রয়েছে শহীদদের স্মৃতিসৌধে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৫ সালে তাঁকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজ শাসকের প্রবর্তিত এক বিল, যার আওতায় বিনা বিচারে যে কোন লোককে আটক রাখার বিধান পাশ করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী প্রায় দুহাজার নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে। তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে তাঁর প্রতিবাদপত্রে লিখেছিলেন, "একদল অসহায় মানুষকে যে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়েছে এবং যেভাবে সে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তার কঠোরতা অপরাধের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। কোন সভ্য সরকার যে একাজ করতে পারে তার কোন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই।" ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার যার নির্দেশে চলেছিল জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাযজ্ঞ পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ওই মর্মান্তিক গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ইংরেজ সরকারের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম অ-ইউরোপীয় যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল তার ভাবগভীরতায়। তাঁর সাহিত্যে বিশ্বপ্রেম ও মানবপ্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা আর প্রগতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে। কথা সাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধেও তাঁর মতামত তুলে ধরেছিলেন। সমাজকল্যাণ, গ্রাম উন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন। শান্তিনিকেতনের কাছে সুরুল গ্রামে আমেরিকান কৃষি অর্থনীতিবিদ লেনার্ড এলমহার্স্ট এবং শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও ছাত্রদের সহযোগিতায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন শ্রীনিকেতন নামে পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পরিবৃত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, সমবায় প্রথা চালু করা এবং গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল সাহিত্যসম্ভারের যেসব হিসাব পাওয়া যায় সে অনুযায়ী তিনি লিখেছিলেন ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ এবং অন্যান্য আরও গদ্য, ৯৫টি ছোটগল্প এবং দুহাজারের ওপর গান। প্রায় ৭০ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেন। ছবি আঁকায় তাঁর কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। লেখার কাটাকুটিকে একটা চেহারা দেবার চেষ্টা থেকে তাঁর ছবি আঁকার শুরু। তারপরেও তিনি প্রায় দু হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু যে নিজের দেশে বসেই সাহিত্যসৃষ্টি করেছিলেন তা নয়, সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। মোট বারোবার তিনি বিশ্বভ্রমণে বেরন। পাঁচটি মহাদেশের তিরিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাবার পর। সেসময় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় তিনি বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ইংল্যান্ডে ডাটিংটন হল স্কুল নামে শ্রীনিকেতনের আদর্শে একটি প্রগতিশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তাঁর ব্যাপক অবদান ছিল। অনেক জাপানি সাহিত্যিক তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা ইংরেজি, ডাচ, জার্মান, স্প্যানিশসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। তাঁর সমসাময়িক বহু বিদেশি কবি, সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিককে তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে জাপান ও উত্তর আমেরিকায় এবং এক অর্থে বাংলার বাইরে তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছিল। জীবনের শেষ চার পাঁচ বছর ধারাবাহিকভাবে নানা অসুস্থতায় ভুগেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু লেখা তিনি কখনও থামাননি। মৃত্যুর সাতদিন আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই তাঁর জীবনাবসান হয়। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। সুস্থ হয়ে তিনি আর ফেরেননি। রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানই তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর রচিত গান 'আমার সোনার বাংলা' বাংলাদেশের আর 'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে' ভারতের জাতীয় সঙ্গীত।
দু'হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ তাঁর জীবন-কথা।
আর কুমিল্লা থেকে বাস ভাড়া করে অনেকের সাথে নিজেও ভাষণ শুনতে এসেছেন বাহার উদ্দিন রেজা। কিশোর বয়সে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধ করবেন। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণে পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সেসময়কার ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ দেবার ৫০ বছর পূর্ণ হলো আজ। ৫০ বছর আগের এই দিনে মুজিবের ভাষণ শুনতে এসে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তা বর্ণনা করেছেন এই দুই প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের অভিজ্ঞতা জানতে দেখুন এই ভিডিওটি। ভিডিওটি দেখতে পারেন বিবিসির ইউটিউব চ্যানেলেও:
'ভাষণ শুরু আগে মাথার উপর দিয়ে বিমান আর হেলিকপ্টার উড়ছিলো, আর পুরো রেসকোর্স মাঠে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে'- ৭ই মার্চের ভাষণ শুনতে এসে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হারুন হাবীব।
শুধু নিম্ন নয়, মধ্য আয়ের মানুষের রোজগারেও করোনাভাইরাসের 'লকডাউনের' প্রভাব পড়েছে। একদিকে খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারে টান পড়ছে, অন্যদিকে বাইরে বেরুলে সংক্রমণের ঝুঁকি - এ যেন উভয় সংকট! ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষজন - বিশেষ করে পোশাক কারখানার শ্রমিক, গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও পরিবহন শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষ - কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তবে শুধু নিম্ন নয়, মধ্য আয়ের মানুষের রোজগারেও করোনাভাইরাসের 'লকডাউনের' প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কাটছে কিংবা অর্ধেক বেতন দিচ্ছে, এমনকি বেতন দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠছে। যদিও সরকার বেশ কিছুদিন ধরেই কর্মীদের বেতন না কাটা এবং কর্মী ছাটাই না করার জন্য নিয়োগদাতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। বেজি, নেউল নাকি কচ্ছপ? হদিশ নেই কে ছড়ালো এই ভাইরাস মার্কেট খুললে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়বে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হুশিয়ারী মধ্যপ্রাচ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে ইরানের একটি ফ্লাইট নিজেকে যেভাবে নিরাপদ রাখবেন করোনাভাইরাস থেকে করোনাভাইরাস ঠেকাতে যে সাতটি বিষয় মনে রাখবেন নতুন করোনাভাইরাস কত দ্রুত ছড়ায়? কতটা উদ্বেগের? কোথায় কতোক্ষণ বেঁচে থাকে কোভিড-১৯ এর জীবাণু, নির্মূলের উপায় অনেক স্কুলের শিক্ষকই জানিয়েছেন যে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তাদের পূর্ণ বেতন দেয়া হচ্ছে না ‘অনলাইনে ক্লাশ নিই, তবু বেতন অর্ধেক’ ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক চিত্রা পেরেইরার স্কুল বন্ধ মার্চের ১৮ তারিখ থেকে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয় সেই স্কুলে। কিন্তু এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, যতদিন স্কুলের কার্যক্রম স্বাভাবিক না হবে ততদিন শিক্ষক ও অন্য কর্মীদের পুরো বেতন দেয়া সম্ভব হবে না। স্কুলের সব শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে। “এখন আমাদের স্কুলে যেতে হয় না ঠিকই, কিন্তু সিলেবাস ধরে টপিক ম্যাটেরিয়াল বানানো ও অনলাইন লেকচার তৈরি করার কাজ নিয়মিত করছি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক দেয়া এবং সেগুলো আবার মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর পর চেক করে ফিডব্যাকও দিচ্ছি আমরা নিয়মিত।” কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে, লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে স্বাভাবিক বেতন দেয়ার ক্ষমতা নেই তাদের, কারণ শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছে না, বেতন দিচ্ছে না। “আবার আমি বাসায় বাচ্চাদের ব্যাচে পড়াতাম, মূলত ওই রোজগারটা দিয়েই আমার সংসারটা চলে। কিন্তু গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সেটা বন্ধ। ফলে সংসার চালানোর জন্য আমাকে আমার সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়েছে।” মিস পেরেইরা বলছেন, জমানো টাকা দিয়েও বড়জোড় দুয়েক মাস চলা যাবে। ‘চেম্বার বন্ধ, আয় নাই, কিন্তু স্টাফ তো আছে’ আইনুন্নাহার সুলতানা একজন আইনজীবী। এটি তার আসল নাম নয়। বলছিলেন, প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হবার পর থেকেই তার চেম্বারে মক্কেলদের আসা কিছুটা কমে যায়। এরপর সাধারণ ছুটিতে আদালত বন্ধ হলে তিনি নিজেও মগবাজারে নিজের চেম্বারে যাওয়া বন্ধ করে দেন। “আদালত বন্ধ, মামলার কার্যক্রম বন্ধ, সুতরাং আমার তো ইনকাম বন্ধ। কিন্তু আমার একজন সহকারী আছে, একজন কেয়ারটেকার আছে। বিদ্যুত-পানির জন্য মাসে নির্দিষ্ট অর্থ দিতে হয়। বাসা ভাড়া দিতে হয়, ড্রাইভার আছে, গৃহকর্মী আছে। অথচ আমার রোজগার বন্ধ।” “আমার স্বামী এখন উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এখন আমি কার কাছে সাহায্য চাইবো? উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকে আমার একটা ডিপিএস ছিল, সেটা ভাঙাতে হল।” পরিবহণ শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িতদের জন্য দিনযাপন রীতিমতো কষ্টকর হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে হাত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ উভয় সংকটে পড়েছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে কাধ্য হচ্ছে অনেক মানুষ। “এর মধ্যে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের বিপদ অনেক বড়, সংকটে এরা পথেও নামতে পারবে না আবার কারো কাছে হাতও পাততে পারবে না।” তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে হাত পড়বে। “তবে এখুনি সেটা অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে কমই দেখা যাবে। কারণ, মানুষের সাধারণ প্রবনতা হিসেব করলে দেখা যাবে প্রথমদিকে নিজেদের হাতে থাকা সঞ্চিত অর্থ খরচ করবে তারা, এরপর দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ে হাত দেবে।" "সবেশষে কোন বিনিয়োগ থাকলে সেটা খরচ করে ফেলবে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে, আগামী দুয়েক মাসের মধ্যেই সেটা প্রবলভাবে দৃশ্যমান হবে।” বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউনের ফলে প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ পরিবার ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়বে। সংস্থাটি বলছে, এই পরিস্থিতির কারণে দারিদ্র সীমার ঠিক ওপরে যারা আছেন, অর্থাৎ নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী, তারাও দারিদ্রসীমার মধ্যে পড়ে যাবে বর্তমান অবস্থার কারণে। সঞ্চয় কি কমছে? ইতিমধ্যে ব্যাংকে নিয়মিত সঞ্চয়ে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কমছে নতুন বিনিয়োগের হারও। সেই সঙ্গে নতুন করে সঞ্চয়ী কোন প্রকল্পে মানুষের আগ্রহ কমেছে বলে জানাচ্ছেন ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট মানুষেরা। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম মনে করেন, লকডাউন পরিস্থিতির কারণে সারাদেশেই মানুষ সঞ্চয় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। “সঞ্চয় কমেছে কারণ মানুষের ইনকাম কমেছে। আমাদের এখানে যেসব আমানতকারী ছোট ছোট সঞ্চয়ী স্কীমগুলো চালান, বিশেষ করে তাদের সঞ্চয়ে এর প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ব্যাংক থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার হারও কমেছে গত এক দেড় মাসে, বিশেষ করে যারা কম টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতেন।” এদিকে, বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসি’র একজন কর্মকর্তা হাবিবা সুলতানা বলছিলেন, গত এক মাসে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলেছে। “কী কারণে ভাঙছে, তাতো জানি না। কিন্তু সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভেঙে নতুন করে কেনে। কিন্তু এবার নতুন করে কেনার হার অনেক কম।” আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান মনে করেন, করোনাভাইরাসের আতংক এবং সাধারণ ছুটির কারণেও মানুষ ব্যাংকিং কম করেছে। “তবে সাধারণভাবে সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে কিছুটা ধীর গতি দেখছি আমরা। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন ব্যবসা শুরু করা কমেছে বলে মনে হচ্ছে।” তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বলে এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি প্রদানের কাজ করায় ব্যাংকটি বড় কোন সংকটে পড়েনি বলে মনে করেন মি. রহমান। ব্যাংকগুলো বলছ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে, তবে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর দাবি করছে বিক্রি অপরিবর্তিত রয়েছে এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেনি বলে দাবি করেছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালক মহিনুর ইসলাম জানিয়েছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার আগের মতই আছে। তবে তিনি জানিয়েছেন, সম্প্রতি মুনাফা তোলার হার বেড়ে গেছে, বিশেষ করে পেনশনার এবং পরিবার সঞ্চয়পত্রের, অর্থাৎ যারা সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর নির্ভরশীল বিনিয়োগকারী বয়স্ক ও নারী, তাদের মধ্যে। এদিকে আয় কমে যাওয়ার ধারা দীর্ঘায়িত হলে একদিকে মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের সঞ্চয় কমে তলানিতে ঠেকলে, সেটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বিআইডিএসের নাজনীন আহমেদ। “অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে সমাজে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটনা ঘটে। ফলে সেটা থামাতে হলে সরকারকে সচেতন হতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সরকার একা সেটা সামাল দিয়ে উঠতে পারেব না।” এজন্য সমাজের বিত্তবান মানুষেরও এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মনে করেন, “যেমন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কর্মী ছাটাই না করে, বেতন না কমায় এবং প্রয়োজনে কারো অর্থ কষ্টে পাশে দাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে গত ২৬শে মার্চ থেকে চলছে সাধারণ ছুটি, যে কারণে স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সব বন্ধ রয়েছে।
আডামা তার গ্রামে ফিরে গেছেন। তিনি বলছেন, ''জীবন তার জন্যখুবই কঠিন''। আডামার বাবা মা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তার জীবন অনেক সহজ ছিল, তিনি বলছেন। তাদের পরিবার স্বচ্ছল ছিল না, চাইলেও সবকিছু করার সামর্থ্য ছিল না, কিন্তু তারপরেও জীবনে একটা শৃঙ্খলা ছিল। তিনি স্কুলে গেছেন, স্কুলজীবন আনন্দে কেটেছে। কোন কিছু নিয়ে তাকে চিন্তা করতে হতো না। বাবা মারা গেলেন তার ১২ বছর বয়সে। কয়েক বছর পরে মাও মারা গেলেন। ''জীবন খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াল,'' কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে এক গ্রামে বসে কথা হচ্ছিল আডামার সাথে। ''আমাকে স্কুল ছেড়ে দিতে হল জীবিকার তাগিদে।'' আডামার যখন ২২ বছর বয়স এক পুরুষের সাথে তার পরিচয় হয়, আডামা অন্ত:স্বত্তা হন। কিন্তু তাদের কন্যা সন্তান জন্মানোর তিনদিন পর সন্তানের বাবাও মারা যান। তার একাকীত্বের যন্ত্রণা গভীর হয়। বাচ্চাটা ১৮ মাস বয়স হওয়া পর্যন্ত নানা অসুখে ভুগত। এরপর মেয়ের অবস্থা স্থিতিশীল হবার পর তাদের দুজনের বেঁচে থাকার জন্য আয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। আডামা বাচ্চাকে তার বৃদ্ধা নানীর কাছে রেখে নাইরোবি গেলেন কাজের খোঁজে। ''মনে রেখো, বাচ্চাটার জন্যই তুমি কাজের খোঁজে ছুটে যাচ্ছ,'' নানী বলেছিলেন। আডামা নাইরোবি পৌঁছে প্রথমে রাস্তায় তরমুজ বিক্রির কাজ নেয়। এতে আয় হত খুবই সামান্য। যার সাথে ভাগাভাগির বন্দোবস্তে সে বাসা ভাড়া নিয়েছিল, আডামা বাসায় না থাকলে ঘরে রাখা তার আয়ের অর্থ সেই মেয়েটি চুরি করে নিত। শহরের জীবন খুবই কঠিন ছিল। তার কপালে একটা ক্ষত ছিল। আডামা বলছিলেন নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন, "কিছু পুরুষ আমার সাথে অসদাচরণ করার চেষ্টা করেছিল, নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলাম।" আডামা এরপর নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যান, কিন্তু সেখানে কোন বেতনই পেতেন না। এরপর একটি নাইটক্লাবে তার কাজ জোটে। প্রথমে তিনি তার বসকে বলেছিলেন তার বেতনের পুরো অর্থ সরাসরি গ্রামে তার নানীর কাছে পাঠিয়ে দিতে। পরে তিনি বেতনের কিছু অর্থ নিজের জন্য রাখার সিদ্ধান্ত নেন। নাইরোবিতে একটি বাসা ভাড়া নেন। আর একটু ভাল বেতনের কাজ জোগাড় হয় আরেকটি নির্মাণ সাইটে। সেখানে এক পুরুষের সাথে আলাপ হয়। দুজনে মেলামেশা শুরু করেন। পুরুষটি তাকে বলে সে বাচ্চা চায়। আডামা একটা শর্ত দেন। বলেন ওই পুরুষ যদি তার কন্যা সন্তানকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারে রাজি হয়, যাতে তারা একসাথে থাকতে পারে, তাহলে ওই পুরুষের সাথে আরেকটি সন্তান নিতে তিনি রাজি আছেন। পুরুষটি রাজি হন। আডামা অন্ত:স্বত্তা থাকার প্রথম পাঁচ মাস তিনি বাসাভাড়া, ও যাবতীয় খরচ দিয়েছেন, খাবারদাবার কিনেছেন। আডামা তখনও তার মেয়েকে গ্রাম থেকে শহরে আনার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। এরই মধ্যে পুরুষটি একদিন তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে আর কখনও ফিরে আসেনি। কেনিয়ার দরিদ্র নারীরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে পাচারকারীদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেক নারীই জানে একজন সন্তানকে পৃথিবীতে আনার আগে তার খাওয়াপরা জোগানোর চিন্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর দুজন হলে তো সে চিন্তা আরও বেড়ে যায়। কেউই অপরিচিত লোকের কাছে নিজের সন্তান বিক্রি করার কথা কখনই ভাবে না। কিন্তু কেনিয়ার দরিদ্র কিছু নারী অভাবে পড়ে বাঁচার শেষ উপায় হিসাবে পাচারকারীদের কাছে তাদের শিশুসন্তানদের বিক্রি করছে। পাচারকারীরা এর বিনিময়ে এসব নারীকে এত কম অর্থ দেয় যা অভাবনীয়। আরেকজন নারী সারা, যখন দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করেন, তার বয়স ছিল ১৭। বাচ্চার ভরনপোষণের সামর্থ্য তার ছিল না। এক মহিলার কাছে সে বাচ্চাকে বিক্রি করে দেয় ৩০০০ কেনিয়ান শিলিং-এর বিনিময়ে- পাউন্ডের হিসাবে যার অর্থমূল্য মাত্র বিশ পাউন্ড। "আমার বয়স ছিল কম, আমি যে কী ভুল করছি, তখন বুঝিনি," তিনি বলেন। "পাঁচ বছর পর আমি বুঝেছিলাম কী করেছি। আমি মহিলাকে ওই অর্থ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।" তিনি বলেন, আরও কয়েকজন নারীর কথা তিনি জানেন যারা প্রায় একই অর্থের বিনিময়ে সন্তানকে বেচে দিয়েছে। "চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে মেয়েরা সন্তান বিক্রি করছে। অনেকে মায়ের দাবি মেটাতে না পেরে সন্তান বেচেছে, অনেকে আবার স্কুলে পড়তে পড়তে অন্ত:স্বত্তা হয়ে গেছে ১৫/১৬ বছর বয়সে, যা নানাধরনের সমস্যা তৈরি করেছে। একমাত্র পথ তখন সন্তানকে বিক্রি করে দেয়া।" "এসব মেয়েদের পরামর্শ দেবার বা তাদের সাথে কথা বলার কেউ নেই।" আরও পড়তে পারেন: সন্তানকে বৈধ পথে দত্তকের জন্য দেবার প্রক্রিয়ার কথা আডামাকে কেউ বলেনি। ''আমি কখনও এ বিষয়ে কিছু শুনিনি,'' আডামা জানান আফ্রিকার মধ্যে যেসব দেশে কিশোরীদের মধ্যে গর্ভধারণের হার সবচেয়ে বেশি, তার অন্যতম হল কেনিয়া। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এই সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। মহামারির কারণে কিছু নারীকে বাধ্য হয়ে যৌন কর্মীর কাজ করতে হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক মেয়ের জন্য স্কুল নিয়মের শৃঙ্খলও ভেঙে পড়েছে। "আমি বহু নারী ও মেয়ের এধরনের পরিস্থিতিতে পড়ার কাহিনি শুনেছি। অল্পবয়সী মেয়েরা কাজের খোঁজে শহরে আসছে, পুরুষদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, অন্ত:স্বত্তা হচ্ছে, তারপর সন্তানের বাবা তাদের পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছে," বলছেন কেনিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী প্রুডেন্স মুটিসো। তিনি শিশু সুরক্ষা এবং প্রজনন অধিকার নিয়ে কাজ করেন। "সন্তানের পিতা যদি এসব নারীদের অর্থ না দেন, তাহলে আয়ের জন্য তাদের বিকল্প পথ খুঁজতেই হয়। আর তার থেকেই সন্তান বিক্রিতে তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। তারা ভাবছে এভাবে নিজেদের এবং হয়ত গ্রামে রেখে আসা আগের সন্তানদের ভরনপোষণের জন্য হাতে কিছু অর্থ আসবে। লোকে এসব নিয়ে কথা বলে না, কিন্তু এটা একটা সমস্যা।" আডামা যে নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করত, সেখানে তার গর্ভধারণের খবর যতদিন পর্যন্ত সম্ভব লুকিয়ে রেখেছিল। যতদিন না সিমেন্টের ভারী বস্তা তার পক্ষে আর বহন করা সম্ভব হয়নি বা তার পেটের আকৃতি আর গোপন করা সম্ভব হয়নি, সে বলে নি সে অন্ত:স্বত্তা। বললে ঘর ভাড়ার অর্থ হাতে আসত না। তিন মাস তার বাড়িওয়ালা সময় দিয়েছিল। তারপর তাকে তাড়িয়ে দেয় এবং ঘরে কাঠের দেয়াল তুলে ঘর বন্ধ করে দেয়। আট মাসের অন্ত:স্বত্তা আডামা কোন বাড়ির পেছনে লুকিয়ে ঢুকে রাতটুকু ঘুমতেন, ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বেরিয়ে যেতেন। "ভাগ্য ভাল থাকলে কোনদিন কিছু খাবার জুটত," তিনি বলেন। "কখনও কখনও শুধু পানি খেয়ে কাটত।" কেনিয়ায় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কিশোরী মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেড়ে গেছে কেনিয়ায় কোন একজন নারী আডামার পরিস্থিতিতে পড়লে, তাদের পাচারকারীদের কব্জায় পড়তে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করে। দেশটিতে গর্ভবতী মা বা শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়লে তবেই গর্ভপাত বৈধ। ফলে এসব ক্ষেত্রে গর্ভপাতের জন্য বিকল্প হল ঝুঁকিপূর্ণ হাতুড়েদের শরণাপন্ন হওয়া। এছাড়াও সমস্যা হল বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যৌনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষাদানের অভাব, বিশেষ করে গ্রাম এলাকায়। তাছাড়া বৈধ পথে শিশুকে দত্তক দেয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কেও সচেতনতার বড় অভাব রয়েছে। "কোন নারী বা কিশোরী গর্ভের সন্তান না চাইলে সরকারের দিক থেকে তাকে সাহায্য করার কোন ব্যবস্থা নেই," বলছেন হেল্থ পভার্টি অ্যাকশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কেনিয়া শাখার পরিচালক ইব্রাহিম আলি। "এসব নারী প্রায়শই গ্রামাঞ্চলে অবস্থার শিকার হয়ে পড়েন এবং তাদের একঘরে করার প্রবণতা থাকে, ফলে তারা পালানোর পথ বেছে নেন, এবং শহরে গিয়ে তারা ঝুঁকির মুখে থাকেন।" তার সন্তানকে বৈধভাবে ও নিরাপদে কারো হাতে তুলে নেবার যে পথ আছে আডামা তা জানতেনই না। দত্তক প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। "আমি জানতামও না, কখনও এ বিষয়ে শুনিওনি," তিনি বলেন। তিনি হাতুড়েকে দিয়ে গর্ভপাতের কথা ভেবেছিলেন, তিনি বলেন। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের কারণে তা তিনি করতে পারেননি। তিনি এরপর আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। "আমার মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল, ভাবছিলাম পানিতে ডুবে কীভাবে আত্মহত্যা করা যায়, যাতে মানুষ আমার কথা পুরো ভুলে যায়।" তার সন্তান প্রসবের কয়েক সপ্তাহ আগে একজন তার সাথে মেরি আওমা নামে এক মহিলার আলাপ করিয়ে দেয়। তিনি বলেন গর্ভপাত বা আত্মহত্যা কোনটাই করো না। তিনি নাইরোবির বস্তি এলাকা কেওলে রাস্তার ধারে একটি অবৈধ ক্লিনিক চালাতেন। তিনি আডামাকে ১০০ শিলিং (স্থানীয় মুদ্রা) দেন এবং বলেন পরেরদিন তার ক্লিনিকে যেতে। মেরি আওমা, কেওলে একটি অবৈধ ক্লিনিক চালান, সেখানে তিনি মুনাফা রেখে শিশু কেনা বেচা করেন। মেরি আওমার অস্থায়ী ক্লিনিকটি আসলেই কোন ক্লিনিক নয়। কেওলের রাস্তার পাশে একটা সন্দেহজনক দোকানঘরের পেছনে লুকানো দুটি ঘর নিয়ে এই ক্লিনিক। দোকানের ভেতর কয়েকটি খালি তাক, তাতে ছড়ানো ছেটানো কিছু পুরনো ওষুধপত্র। তার পেছনে রয়েছে দুটো ঘর, যেখানে নারীদের প্রসব করানো হয়। ভেতরে বসেন মেরি তার সহকারীকে সাথে নিয়ে। মুনাফা রেখে বাচ্চা কেনাবেচা করেন। যারা বাচ্চা কিনছেন তারা কে বা কেন কিনছেন সেসব খোঁজ নেবার কোন দরকার তিনি দেখেন না। আডামাকে তিনি বলেছিলেন তার খদ্দেররা সবাই মমতাময়ী পরিবার, তারা বাচ্চা নিতে পারেন না, তাই তারা বাচ্চা কেনেন। কিন্তু রাস্তার যে কেউ তার হাতে ঠিক ঠিক নগদ অর্থ তুলে দিলেই আওমা খুশি- তিনি সদ্যোজাতদের বেচে দেন। মেরি আওমা গর্ভবতীদের বলেন তিনি আগে নার্স ছিলেন। কিন্তু শিশু প্রসবের সময় বড়ধরনের সমস্যা হলে তা মোকাবেলার জন্য কিন্তু তার কাছে না আছে চিকিৎসা বা অন্যান্য সরঞ্জাম বা তার নিজের বিষয়ে কোন দক্ষতা। "তার ওই ঘরটা নোংরা। রক্তের জন্য তিনি একটা ছোট পাত্র ব্যবহার করেন, ঘরে কোন বেসিন নেই, বিছানাও অপরিষ্কার," আডামা বলেন। "কিন্তু আমার তখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমার কাছে আর কোন বিকল্প ছিল না।" আডামা যখন সেই ক্লিনিকে পৌঁছন, মেরি আওমা তাকে দুটি ট্যাবলেট খেতে দেন। তিনি বলেননি প্রসববেদনা তাড়াতাড়ি ওঠানোর জন্য তাকে ওই ট্যাবেলট দেয়া হয়েছে, জানান আডামা। আওমার হাতে একজন খদ্দের ছিল এবং তিনি চাইছিলেন তাড়াতাড়ি বাচ্চাটা তার কাছে বিক্রি করে দিতে। আডামা যখন একটি ছেলে সন্তান প্রসব করলেন, জন্মের পর তার বুকের সমস্যা দেখা দিল। মেরি আডামাকে বললেন বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর শিশুটিকে যখন ছেড়ে দেয়া হল, তখন সে সুস্থ হয়ে গেছে। তার বাড়িওয়ালা, যিনি তাকে বের করে দিয়েছিলেন, তিনি তাকে ঘরে আবার ঢুকতে দেন, এবং আডামা বাচ্চাটিকে সেখানে দেখাশোনা শুরু করেন। মেরি আওমার সাথে আবার আডামার বাজারে দেখা হয়ে যায়, আওমা তাকে আবার ১০০ শিলিং দেন এবং বলেন পরদিন তার ক্লিনিকে যেতে। "আরেকটি শিশু জন্মেছে," আওমা তার খদ্দেরের কাছে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে বলেন, দাম "৪৫,০০০ শিলিং।" আডামার তার সন্তানকে কোলে করে আদর করছেন, তাকে বিক্রি করে দেবার কয়েক মুহূর্ত আগে মেরি আওমা কিন্তু আডামাকে ৪৫,০০০ শিলিং দেবার প্রস্তাব দেননি- পাউন্ডের হিসাবে যা ৩০০ পাউন্ডের সমান। যে অর্থ তিনি খদ্দেরের কাছে দাবি করেছিলেন। তিনি আডামাকে ১০ হাজার শিলিং (প্রায় ৭০ পাউন্ড) দিতে চান। কিন্তু মেরি আওমা জানতেন না যে, যে খদ্দেরকে তিনি ঠিক করেছেন তিনি ছদ্মপরিচয়ে বিবিসির সাংবাদিক। বিবিসি শিশু পাচার নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য এক বছর ধরে তাদের অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। আডামা যখন পরদিন মেরির ওই ক্লিনিকে গেলেন, তিনি পেছনের ঘরে বসলেন, কোলে ছিল তার পুত্র সন্তান। তিনি যখন বসেছিলেন তার শিশুর কথিত খদ্দের তার কানে ফিসফিস করে তার কাছে আর কী বিকল্প আছে সে বিষয়ে কিছু বললেন। আডামা সেদিন ছেলে কোলে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে যান। শিশুকে নিয়ে যান সরকার পরিচালিত একটি শিশু আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে তার শিশুর যত্ন নেয়া হবে যতদিন না বৈধ পথে তার দত্তকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিবিসি মেরি আওমাকে বলেছিল তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে তার কিছু বলার আছে কিনা, মেরি এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। আডামার বয়স এখন ২৯। তিনি ফিরে গেছেন তার গ্রামে যেখানে তিনি বড় হয়েছিলেন। এখনও তিনি অনেক সময়ই অভুক্ত ঘুমাতে যান। জীবন এখনও তার জন্য সংগ্রামের। কাছের একটা হোটেলে মাঝেমধ্যে তার কাজ জোটে। কিন্তু সেই আয় যথেষ্ট নয়। তার স্বপ্ন তার গ্রামে তিনি একটা জুতার দোকান খুলবেন। নাইরোবি থেকে জুতা এনে বিক্রি করবেন। কিন্তু এটা তার অনেক দূরের স্বপ্ন। ছেলের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু তার কোন দুঃখ নেই। "ছেলেকে বিক্রি করতে আমি চাইনি। আমি ওই অর্থ ছুঁতে পর্যন্ত চাইনি। কিন্তু ওকে যখন আর্থিক লেনদেন ছাড়া দিয়ে দিতে হল, তখন দুঃখ পাইনি।" যে শিশু আশ্রয় কেন্দ্রে তিনি তার ছেলেকে রেখে এসেছেন সেই এলাকা তার পরিচিত। ছেলের জন্মের কয়েকদিন আগে যে বাসা থেকে বাড়িওয়ালা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, কেন্দ্রটি তার কাছেই। "আমি জানি এলাকাটা নিরাপদ," তিনি বলেন, "এবং যারা ওর দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা ভাল লোক।" রিপোর্টিং-এ সহযোগিতা করেছেন এনজেরি এমওয়াঙ্গি। বিবিসির জন্য ছবি তুলেছেন টনি ওমোন্ডি।
বিবিসির আফ্রিকা আই অনুসন্ধান বিভাগ গত মাসে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে শিশু ব্যবসার রমরমা কালোবাজারের খবর উদঘাটন করার পর পুলিশ পাচারের অভিযোগে সাতজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু মুনাফার লোভে কালোবাজারে অবৈধভাবে যেসব মায়েদের শিশু বিক্রি হয়েছে, কেন তারা এই পথে গেছেন? কেন সামান্য অর্থের বিনিময়ে নিজের সন্তান বিক্রি করে দিয়েছেন?
আমেরিকার সাবেক কজন প্রেসিডেন্ট কিন্তু তাদের সাথে কি মি. ট্রাম্পের তুলনা আসলেই হতে পারে? অবশ্যই পারে। যেমন, সাদ্দাম হোসেন যখন ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েত দখল করেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবলু বুশ (বুশ সিনিয়র) হুমকি দিয়েছিলেন, “এটা সহ্য করা হবেনা“ কিন্তু আমেরিকা যখন উপসাগরে সৈন্য সমাবেশ করলো, মার্কিন জনগণের যুদ্ধে তেমন সায় ছিলনা। নির্বাসিত কুয়েত সরকার তখন যুদ্ধের পক্ষে আমেরিকায় জনমত তৈরিতে দ্রুত মার্কিন একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান (হিল অ্যান্ড নোলটন) নিয়োগ করে। মি. বুশের সাবেক প্রধান সহকারী তখন ওয়াশিংটনে ঐ প্রতিষ্ঠানের অফিসটি চালাতেন। ঐ জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানটি ‘নাইরা‘ নামে ১৫ বছরের একজন কিশোরীকে ইরাকি আগ্রাসনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে প্রশিক্ষণ দেয়। এরপর ঐ কিশোরী ছলছল চোখে কাঁদোকাঁদো গলায় ১৯৯০ এর অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সামনে বলে যে কীভাবে ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতের একটি হাসপাতাল ঢুকে ইনকিউবেটর থেকে সদ্যোজাত অসুস্থ শিশুদের বের করে নিয়ে তাদেরকে মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিল যাতে তারা মারা যায়। সাংবাদিকদের বলা হয়েছিল নাইরা নামটি ছদ্মনাম, কারণ আসল নাম প্রকাশ পেলে কুয়েতে তার পরিবারের ওপর নির্যাতন হতে পারে। যুদ্ধের পর জানা যায়, ঐ কিশোরী ছিল যুক্তরাষ্ট্রে কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের মেয়ে, এবং সে যা বলেছিল তা পুরোপুরি মনগড়া। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে তার এক বইতে জন ম্যাকআর্থার তার এক বইতে ঐ ঘটনার বিস্তারিত লিখেছেন। সাদ্দাম হুসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর যুক্তি হিসাবে মি. বুশ নিজে কমপক্ষে ছয়বার কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের মেয়ের মুখের ঐ কল্পকাহিনী জনসমক্ষে উল্লেখ করেছেন। সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যদের সামনে এক ভাষণে তিনি বলেন, “ইনকিউবেটর থেকে শিশুদের বের করে কাঠের চেলার মত মেঝের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।“ ম্যাকআর্থার লিখেছেন, সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধের সামরিক অভিযানে সমর্থন তৈরিতে ঐ মনগড়া গল্প কাজে লেগেছিল। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে মিথ্যাচারের অনেক অভিযোগ রয়েছে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (সিনিয়র) বিরুদ্ধে ১৯৯১ সালে জানুয়ারিতে সেনেটে মি বুশের যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব খুব অল্প ব্যবধানের ভোটে পাশ হয়। ছয়জন সেনেটর তাদের দেওয়া সমর্থনের যুক্তিতে হাসপাতালে ইনকিউবেটর থেকে শিশুদের টেনে বের করার সেই মনগড়া কাহিনীর উল্লেখ করেছিলেন। কয়েকদিন পরই অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম শুরু হয়েছিল। দুঃখের বিষয় যেটি ছিল তা হলো হাসপাতালের ইনকিউবেটর থেকে সরানোর জন্য সত্যিই শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু তা হয়েছিল ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের বিমান হামলার পরিণতিতে। বোমা হামলার প্রথম রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এবং বোমার শব্দে আতঙ্কিত মায়েরা বাগদাদের একটি হাসপাতালের ইনকিউবেটর থেকে তাদের সদ্যোজাত বাচ্চাদের নিয়ে ঠাণ্ডা বেজমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ঐ ঘটনায় ৪০টি সদ্যজাত শিশু মারা গিয়েছিল। ৪২ দিনের ঐ যুদ্ধে কয়েক হাজার বেসামরিক লোক মারা যায় - যার মধ্যে চিল ৪০টি সদ্যোজাত ইরাকি শিশু। কুয়েতে ইনকিউবেটরের শিশু মৃত্যুর কাহিনী যে মনগড়া তা প্রেসিডেন্ট বুশ জানতেন কি জানতেন না তা কখনই পরিষ্কার হয়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যখন কোনো বক্তব্য দেন হোয়াইট হাউজ আগে থেকে তার সত্যতা যাচাই করে বা তাদের তা করার কথা। বিশেষ করে শিশু হত্যার মত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট কোনো কথা বলার আগে তা যাচাই করা তার স্টাফদের অবশ্য কর্তব্য ছিল। তবে কংগ্রেসের সামনে কুয়েতি কিশোরী নারিয়ার ঐ মনগড়া শুনানির ব্যাপারে মার্কিন সাংবাদিকরা জানতে পেরেছিলেন যুদ্ধের পর। ২০১৮ সালে মি. বুশের মৃত্যুর পর তার স্তুতি করে যে জীবনী লেখা হয়েছে তাতেও নারিয়ার সেই গল্প নেই। কিন্তু পক্ষান্তরে মি. ট্রাম্পের শাসনামলে তার বক্তব্য বিবৃতি ব্যাপকভাবে যাচাই করেছে মার্কিন মিডিয়া। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় মি. ট্রাম্পের বক্তব্য-বিবৃতির একটি ডাটাবেজ রয়েছে। পত্রিকাটি দাবি করে মি. ট্রাম্প ৩০ হাজারেরও বেশি এমন সব বক্তব্য দিয়েছেন যা অসত্য, বিভ্রান্তিকর। এমনকি গল্ফ খেলা বা তার নিজের সম্পত্তি নিয়ে মি. ট্রাম্পের মন্তব্যও যাচাই করেছে পত্রিকাটি। নির্বাচন প্রক্রিয়াই ‘দানব‘ সৃষ্টি করছে আমেরিকার রাজনীতিতে মিথ্যাচার নিয়ে লেখা এক বইতে রাজনীতির অধ্যাপক বেঞ্জামিন গিনসবার্গ বলেছেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যাচারের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। তিনি মি. বুশের ছেলে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবলু বুশের (বুশ জুনিয়র) অনেক মিথ্যা বিবৃতির উল্লেখ করেন যেগুলো দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের আগে দেওয়া হয়েছিল। যেমন, ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হাতে বিপজ্জনক মারণাস্ত্র থাকা নিয়ে গোয়েন্দাদের সন্দেহ ইচ্ছা করে চেপে রাখা, সাদ্দাম হোসেনের কাছে এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র থাকার সম্ভাবনা বার বার বলা বা সাদ্দামকে আল-কায়দার মিত্র বলে চিহ্নিত করা। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র অধ্যাপক গিনসবার্গ বলেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যা ভাষণের পরিণতিতে যুদ্ধ হয়েছে। সেদিক দিয়ে মি. ট্রাম্পের চেয়ে তার পূর্বসূরিদের দায় অনেক বেশি। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির এই শিক্ষক বলেন, “সমস্যা হচ্ছে যে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়াতেই গলদ রয়েছে, যার ফলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেক দানব সৃষ্টি হয়েছে।“ “প্রার্থী হতে বছরের পর বছর ধরে প্রচারণা চালাতে হয়। ফলে, সবচেয়ে উদ্ধত, উচ্চাভিলাষী, আত্ম-প্রেমিক এবং দাম্ভিক ব্যক্তিরাই এই প্রক্রিয়ার অংশ হন।“ আমেরিকান জনগণ একসময় তাদের সেনাপতিকে শিশুর মত সরলভাবে বিশ্বাস করতো। মানুষের কাছে তখন প্রেসিডেন্টের অবস্থান ছিল অনেকটা ঈশ্বরের মত। কখন তা বদলে গেল? অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, লিন্ডন বেইনস জনসনের সময় থেকে মিথ্যাচারের সূচনা। কিন্তু তিনিই যে প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি মিথ্যাচার করেছিলেন - সেটা ঠিক নয়। জনসনের মিথ্যাচার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট কেনেডি প্রেসিডেন্ট জনসন সম্পর্কে বলেছিলেন, “তিনি সবকিছু নিয়ে সর্বক্ষণ মিথ্যা বলেন। প্রয়োজন ছাড়াই তিনি মিথ্যা বলেন।“ ভিয়েতনামের যুদ্ধের যুক্তি খাড়া করতে মি. জনসন ১৯৬৪ সালে অক্টোবর মাসে টনকিন উপসাগরে একটি নৌ হামলার কথা বলেছিলেন - যে হামলা আসলে কখনই হয়নি। অথচ সেই বিবৃতির জন্য বিরোধের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। লিন্ডন বি জনসন নির্বাচনের আগে মি. জনসন ওহাইওতে এক সভায় ভোটারদের বলেছিলেন, তিনি ১০ হাজার মাইল দূরে এশিয়ার একটি দেশে আমেরিকান সৈন্য পাঠাবেননা কিন্তু জেতার পরপরই চুপিসারে তিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন - যে সংখ্যা শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশিতে পৌঁছেছিল। বিদেশনীতি নিয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জনসন এত বিভ্রান্তিমুলক কথা বলতেন যে আমেরিকান মিডিয়া তখন খোলাখুলি বলতো যে এই প্রশাসনের কথার ওপর আস্থা রাখা যায়না। মি. জনসনের উত্তরসূরি রিচার্ড নিক্সন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি “সম্মানজনক“ সমাপ্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে লড়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে কম্বোডিয়ায় কার্পেট বোমা ফেলে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছিলেন। এরপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর আড়ি পাতার জেরে - যেটি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত - ক্ষমতা হারান মি. নিক্সন। সততার রোল মডেল স্কুলের বইতে প্রেসিডেন্টদের সততা নিয়ে লেখা গল্প পড়িয়ে আমেরিকায় বাচ্চাদের সততা এবং মূল্যবোধ শেখানো হতো। কিন্তু বাস্তবে সেই সততার কোনো অস্তিত্ব কখনই ছিলনা। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে নিয়ে বিখ্যাত এক গল্প রয়েছে যে বাগানের চেরি গাছ কুড়োল দিয়ে কেটে ফেলার পর তিনি তার বাবার কাছে দোষ স্বীকার করে বলেছিলেন, “আমি মিথ্যা বলতে পারিনা বাবা।“কিন্তু প্রেসিডেন্টের একজন জীবনী রচনাকারী এই গল্পটি স্রেফ বানিয়ে লিখেছিলেন। রিচার্ড নিক্সন আমেরিকান জাতির পিতাও শতভাগ সাধু ছিলেন না। যেমন ১৯৮৮ সালে তিনি নতুন করে ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করেন যখন তিনি দাবি করেন যে সাত বছর আগেই তিনি ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশদের পরাজিত করার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ভার্জিনিয়ায় সেই গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানো যুদ্ধের প্রধান হোতা ছিল তার ফরাসী মিত্ররা। আমেরিকায় প্রেসিডেন্টদের মিথ্যাচারের শুরু হয়তো ছিল সেটাই। আকাশকুসুম কল্পনা হোয়াইট হাউজের বাসিন্দাদের কিছু কিছু মিথ্যাচার একবারে আকাশকুসুম কল্পনার মত। যেমন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন সফরকারী ইউরোপীয় একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে বলেছিলেন আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে জনমানবশূন্য এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে এখনও পশামাবৃত ম্যামথ (হাতির মত দেখতে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী) চরে বেড়ায়। রোনাল্ড রেগান ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান বলেন ইউরোপে মার্কিন বাহিনীর সিগনাল কোরের আলোকচিত্রি হিসাবে কাজ করার সময় তিনি নাৎসি বন্দী শিবিরে নির্যাতনের ছবি তুলেছেন। হোয়াইট হাউজে সে সময়কার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইতজাক শামিরের সাথে আলাপের সময় মি. রেগান এই গল্প করেন। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকার বাইরে কখনই যাননি। ওয়াশিংটনে পোস্টের তালিকায় জায়গা পাওয়া মি ট্রাম্পের অনেক বক্তব্যই হয়তো গুরুত্বহীন। কিন্তু একজন ইতিহাসবিদ বলেন, মি. ট্রাম্প যেভাবে অকাতরে মিথ্যাচার করেছেন - তাতে আমেরিকার রাজনীতি এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ধসে পড়েছে। রাষ্ট্রের মিথ্যাচার নিয়ে তার এক বইতে অধ্যাপক এরিক অলটারম্যান বলেছেন - আমেরিকা রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রেসিডেন্টদের মিথ্যাচার মানুষ সহ্য করেছে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীতের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছিলেন। মিথ্যাচার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নির্লজ্জতাও ছিল অবিশ্বাস্য। ১৯৯৮ সালে জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজের ইনটার্ন মনিকা লিউনিস্কির সাথে তার যৌন সম্পর্কের অভিযোগ জোরগলায় অস্বীকার করেছিলেন তিনি। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করেছিলেন। পরে এক তদন্তের তার মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়। অবৈধ যৌন সম্পর্ক ঢাকতে মিথ্যা বলেছিলেন বিল ক্লিনটন কিন্তু জাতিকে ধোঁকা দেওয়া নিয়ে লজ্জা পাওয়ার বদলে শাস্তি না হওয়ার জন্য মি. ক্লিনটন আড়ালে স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন বলে তার জীবনীমুলক একটি গ্রন্থে (দি সারভাইভর) প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালের অগাস্টে এ নিয়ে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারের আগে তিনি এক বন্ধুকে বলেছিলেন, “মিথ্যা আমাকে বাঁচিয়েছে।“ অথচ হোয়াইট হাউজের যে ঘরে রাষ্ট্রীয় ভোজসভা হয় সেখানে খোদাই করে লেখা রয়েছে - এই ছাদের নীচে শুধু যেন সৎ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরাই শাসক হিসাবে আসেন। বিবিসি বাংলায় আরো খবর: ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও কেন অনেকেই বিসিএস ক্যাডার হতে চান? সুইস গণভোটে মুসলিমদের বোরকা-নিকাব নিষিদ্ধের পক্ষে রায় 'আমি আর বেঁচে থাকতে চাইনি'- অপরা-র সাথে সাক্ষাৎকারে মেগান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম নারী স্নাতক কাদম্বিনী তালেবান হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, মার্কিন সতর্কতা বাংলাদেশে নারীবাদীদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয় কেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল যে তিনি সত্যের ধার ধারেননা, নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলেন। কিন্তু যেটা সত্য তা হলো যে হোয়াইট হাউজে মি. ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের অনেকেই অবিশ্বাস্য মাত্রায় ভয়াবহ রকমের মিথ্যাচার করেছেন।
বাংলাদেশে গত কয়েকবছর ধরে ফুডপান্ডা, হাঙ্গরি নাকি বা পাঠাও ফুডের মত অনলাইন ডেলিভারি সার্ভিস ব্যবহার করে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করার চল তৈরি হলেও শাকসবজি, মাছ-মাংস বা রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় বাজার সদাই কেনার ক্ষেত্রে অনলাইন ডেলিভারি সিস্টেম ব্যবহার করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেশ কম ছিল। কিন্তু সাধারণ ছুটির সময়কার দুই মাসে মানুষের এই প্রবণতা হঠাৎ করেই বহুগুণ বেড়েছে। একইসাথে বেড়েছে ইলেকট্রনিক পণ্য, মোবাইল ফোন বা দৈনন্দিন ব্যবহারের পণ্য অনলাইনে কেনার প্রবণতাও। তবে মানুষের মধ্যে অনলাইনে অর্ডার করার চাহিদা বাড়লেও মানুষের প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনলাইনে এই ধরণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেবা দিতে পারছে না বলে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে। পণ্য ডেলিভারির সময় নিয়ে অভিযোগ তুলে ঢাকার বাসিন্দা উম্মে হানি সালমা বলেন, "শাক-সবজি, মাছ-মাংসের মত পণ্য অর্ডার দিলে আগে একদিন, খুব বেশি হলে তিনদিন সময় নিতো। কিন্তু সাধারণ ছুটির মধ্যে অর্ডার ডেলিভারি করতে ১০-১২দিন পর্যন্ত সময় নিতে দেখেছি।" আরেকজন সেবা গ্রহীতা মাকসুদা মোমিন জানান তিনি অনলাইনে একটি ব্র্যান্ডের পণ্য অর্ডার করলেও তাকে ডেলিভারি দেয়া হয় আরেকটি ব্র্যান্ডের পণ্য। "আর তা নিয়ে কাস্টমার কেয়ারে অভিযোগ করার পর সঠিক পণ্যটি পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়, ভোগান্তিও কম হয়নি।" অথচ করোনাভাইরাস মহামারির সময় মানুষের অনলাইনে কেনাকাটার চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ তৈরি হয়েছিলো এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর। 'দারাজ' বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স সাইট চাহিদামত সেবা দিতে না পারার কারণ কী? বাংলাদেশে অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান চালডালের চিফ অপারেটিং অফিসার জিয়া আশরাফ বলেন হঠাৎ বাড়তি চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে গ্রাহকদের সেবা দিতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষমতা না থাকা। জিয়া আশরাফ বলেন, "সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকায় দৈনিক গড়ে আড়াই হাজার অর্ডার আসতো আমাদের, আর আমাদের সক্ষমতা ছিল দৈনিক সাড়ে তিন হাজার মানুষকে অর্ডার দেয়ার।" "কিন্তু ছুটি শুরু হওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন আমরা দেখলাম দিনে ১৬ থেকে ১৭ হাজারের মত অর্ডার আসছে, অর্থাৎ আমরা যেই পরিমাণ অর্ডার প্রতিদিনে ডেলিভারি দিতে পারি তারও চার-পাঁচগুণ বেশি।" এই কারণে অনেক অর্ডার ডেলিভারি দিতে সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি সময় লেগেছে বলে মন্তব্য করেন জিয়া আশরাফ। এছাড়া সাধারণ ছুটির সময় মানুষের মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য অতিরিক্ত পরিমাণে কিনে মজুদ করে রাখার প্রবণতার কারণে পণ্যের স্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা আরো বেশি প্রকট হয়েছে বলে মনে করেন জিয়া আশরাফ। তবে মি. আশরাফ জানান চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নতুন ওয়্যারহাউজ খোলায় এবং নতুন জনবল নিয়োগ করায় অর্ডার ডেলিভারি করার ক্ষেত্রে আগের মত দীর্ঘ সময় লাগছে না তার প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশে দ্রত বাড়ছে অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার প্রবণতা 'ঋণ ও আর্থিক সুবিধা না পাওয়া অন্যতম প্রধান সমস্যা' চালডালের চিফ অপারেটিং অফিসার জিয়া আশরাফ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের একজন পরিচালকও। বাংলাদেশে এই ধরণের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের যথাযথভাবে ব্যবসা করতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিমালাকে দোষারোপ করেন তিনি। "একটা ই-কমার্স স্টার্ট আপকে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দিতে চায় না বা সহায়তা করতে চায় না। ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রয়োজনীয় ফান্ডিং পায় না উন্নতি করার জন্যে। অর্থায়নের সহজলভ্য ব্যবস্থা থাকলে ও সময়মতো ফান্ডিং পেলে চাহিদা তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হতো, সেক্ষেত্রে গ্রাহকদের এত ভোগান্তি পোহাতে হতো না।" অর্থায়ন সহজলভ্য হলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পেতে সক্ষম হবে এবং সাধারণ মানুষও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন জিয়া আশরাফ। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সেবা দেয়ার সক্ষমতা অনেক কম বলে মন্তব্য করেন তিনি। "ঢাকায় যদি এখন নিউ ইয়র্কের মত পরিস্থিতি তৈরি হয়, অর্থাৎ সবাইকে ঘরে থাকতে হয় এবং দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয় - তাহলে প্রতিদিন প্রায় এক লাখের মত মানুষকে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে শাক-সবজি, চাল ডাল, মাছ-মাংসের মত পণ্য সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু আমাদের সবগুলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মিলে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার মানুষের কাছে দিনে পণ্য পৌঁছে দিতে পারবো।"
মার্চ মাসের শেষদিক থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত দুই মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি থাকায় অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ থাকায় এবং মানুষের ঘরের ভেতরে থাকার কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য অনলাইনে অর্ডার করার প্রবণতা বেড়েছে। তবে অনলাইনে অর্ডারের পরিমাণ অনেক বাড়লেও সেই অনুপাতে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা ও ডেলিভারি দেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
ইতালিতে বিক্ষোভকারীরা হেভরিন খালফের স্মরণে হাতে লাল রং করে করে জড়ো হয় তবে আহরার আল-শারকিয়া নামে ওই গোষ্ঠীটি জানিয়েছে যে, এই মৃত্যুর জন্য তারা দায়ী নয়। কিন্তু এই ঘটনায় পাওয়া প্রমাণগুলো বলছে অন্য কথা। কে ছিলেন হেভরিন খালাফ? ৩৪ বছর বয়সী হেভরিন খালাফ সিরিয়ার সকল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কয়েক বছর ধরে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকা যা কুর্দি ভাষায় রোজাভা নামে পরিচিত, সেখানে তুর্কি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি একটি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। হেভরিন খালাফ ফিউচার সিরিয়া পার্টি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা এই তরুণ রাজনীতিবিদ ফিউচার সিরিয়া পার্টির প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন, যাদের লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার খ্রিস্টান, কুর্দি এবং আরবরা যেন পাশাপাশি কাজ করতে পারে। এ অঞ্চলটি পুনর্গঠনে তাদেরকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। হেভরিন খালাফের সহকর্মী, বন্ধু এবং প্রাক্তন রুমমেট নুবার মোস্তফা বলেন, "আমি আমার একজন বোন, একজন কমরেড, একজন নেতা এবং কর্মস্থলে আমাদের কমরেডরাও তাদের একজন নেতাকে হারিয়েছে।" "আমরা এমন এক নারীকে হারিয়েছি যিনি অন্য নারীদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। যিনি মানুষের ক্ষমতায়ন চেয়েছিলেন এবং শান্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন।" ২০১৯ সালের ১২ই অক্টোবর ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে হেভরিন খালাফ, উত্তর সিরিয়ার আল-হাসাকাহ শহর থেকে রাক্কায় তার পার্টির সদর দফতরের উদ্দেশ্যে নিজে গাড়িতে রওনা হন। সেখানে যাওয়ার জন্য তিনি পশ্চিমের এমফোর মোটরওয়ে ব্যবহার করেন। বাড়ি আর কর্মস্থলের এলাকা দুটি তিন ঘণ্টার দূরত্বে ছিল। মার্কিন সেনারা ওই অঞ্চল থেকে সরে আসার মাত্র তিন দিন হয়েছিল। এর মধ্যে তুর্কি সেনাবাহিনী সিরিয় সীমান্ত অতিক্রম করে সামরিক অভিযান শুরু করতে পারবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে এমন অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এমফোর মোটরওয়েটি ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি কোথাও ছিল না। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে যে তারা একটি সামরিক কনভয়কে তুরস্ক থেকে সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে দক্ষিণে এমফোর মোটরওয়ের দিকে যেতে দেখেছে। হেভরিন খালফকে বহনকারী গাড়িটি চারিদিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। টেলিগ্রামে ভিডিও এই কনভয়টি তুরস্কপন্থী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি-এসএনএ এর একটি অংশ ছিল। এর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়। এসএনএ হল ২০১৯ সালে ৭০ হাজারেরও বেশি সৈন্য এবং ৪১টি দল নিয়ে তুরস্কের গঠিত একটি আমব্রেলা গ্রুপ বা ছদ্ম দল। তুরস্ক এই দলগুলোকে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দেয়। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার পর থেকে তারা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীর সাথে লড়াই করে আসছে। ২০১৯ সালের ১২ই অক্টোবর, আহরার আল-শারকিয়া নামে একটি গোষ্ঠী, টেলিগ্রাম নামের একটি এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনে ভিডিওগুলো পোস্ট করে। এক ভিডিওতে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি এমফোর মোটরওয়েতে তাদের আসার কথা ঘোষণা করে। ভিডিওতে সূর্যোদয় দেখা যায় এবং তাদের আসার সময়টি ছিল সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে। এর মধ্যে একটি ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি কংক্রিটের ব্যারিকেড, একটি টেলিফোনের খুঁটি এবং একটি ধুলোয় ছাওয়া রাস্তা দেখা যায়। স্যাটেলাইট চিত্রগুলির সাথে এই জায়গাটির অবস্থান তুলনা করে বিবিসি, যাতে দেখা যায় যে ভিডিওটি তিরওয়াজিয়া চৌকিতে ধারণ করা হয়েছিল। ১২ই অক্টোবর সকালে এই চৌকিটি ধরেই হেভরিন খালাফ তার গাড়ি নিয়ে যাত্রা করছিলেন। টেলিগ্রামে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, আহরান আল-শারকিয়া যোদ্ধারা হেভরিন খালাফের গাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ভিডিওগুলো তখন অন্ধকারের দিকে মোড় নেয়, যেখানে তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, যাদেরকে বলা হয় তারা পিকেকে যোদ্ধা। পিকেকে হল একটি কুর্দি সশস্ত্র দল যারা কয়েক দশক ধরে তুর্কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। একটি ভিডিওতে, আহরার আল-শারকিয়া গোষ্ঠীর একজন তার এক সহকর্মীকে বলতে শোনা যায় তিনি মাটিতে পড়ে থাকা কাউকে গুলি করার সময় সেই দৃশ্য যেন ভিডিওতে ধারণ করেন। এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ধারণ করা হয় তিরওয়াজিয়া চেকপয়েন্টে। আহরার আল-শারকিয়া কী বলছে? আহরার আল-শারকিয়া প্রথমে সেখানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। কিন্তু পরে দলটি বিবিসিকে এক বিবৃতিতে জানায় যে "সেদিন এমফোর মোটরওয়েতে যে ব্যক্তি কোন অনুমতি ছাড়াই রোড ব্লক স্থাপন করেছিল... যারা নেতৃত্বের আদেশ লঙ্ঘন করেছিল তাদেরকে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে।" আহরার আল-শারকিয়া আরও বলেছে যে তারা একটি গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল। তারা দাবি করেছে যে তারা ওই গাড়িটিকে থামতে বললেও সেটা থামেনি। কিন্তু দলটি জোর দিয়ে বলছে যে তারা হেভরিন খালাফকে টার্গেট করেনি এবং কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেটা তারা জানে না। বিবিসির অনুসন্ধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আহরার আল-শারকিয়ার পোস্ট করা নিজস্ব ভিডিও এবং এক প্রত্যক্ষদর্শী যিনি বিবিসি নিউজ অ্যারাবিকের সঙ্গে বিশেষভাবে কথা বলেছেন---এই দুটি বিষয় এমন ইঙ্গিত দেয় যে ওই কুর্দি রাজনীতিবিদকে এই গোষ্ঠীর লোকেরাই হত্যা করেছে। বিবিসির ভূ-অবস্থান বা জিওলোকেশন বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে হেভরিন খালাফের গাড়িটি তিরওয়াজিয়া চৌকির পাশে যে রাস্তার তার বাইরেই ছিল। সেদিন আহরার আল-শারকিয়ার পোস্ট করা সর্বশেষ ভিডিওতে, যোদ্ধাদের হেভরিনের গাড়িটি ঘিরে থাকতে দেখা গেছে। গাড়ীটির মেঝেতে একটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, সেটা হেভরিনের ড্রাইভার ফরহাদ রমজানের বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভিডিওটির এক পর্যায়ে গাড়ির ভিতরে থেকে যখন কোন নারীর ম্লান কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ৩৪ বছর বয়সী এই নারীর জানাজা উত্তর সিরিয়ার দেরিক শহরে অনুষ্ঠিত হয়। "এই পৃথিবীতে কোন মানবতা নেই" "এটি হেভরিনের কণ্ঠস্বর - আমি ৫০০০ কণ্ঠের মধ্যেও তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারবো"--- হেভরিনের মা সৌয়াদ মোহাম্মদ বিবিসিকে বলেন। "যখন আমি তার কণ্ঠ শুনেছি, আমি বিশ্বের বর্বরতা দেখেছি এবং এই পৃথিবীতে কোনও মানবতা নেই।" দেখা যাচ্ছে যে, হেভরিন খালাফ বেঁচে ছিলেন এবং গাড়ি থামানোর সময় যোদ্ধাদের কাছে নিজের পরিচয় দিতে সক্ষম ছিলেন। এছাড়াও প্রমাণ আছে যে, তিনি গাড়ির ভিতরে মারা যাননি। যে কৃষক বিবিসির সাথে বিশেষভাবে কথা বলেছিলেন এবং তার পরিচয় গোপন রাখতে বলেছেন, তিনি জানান যে, আহরার আল-শারকিয়ার বিদ্রোহীরা যখন সেখানে পৌঁছায় তখন তিনি ওই চৌকির পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে সাতটায় যোদ্ধারা পিছু হটে যাওয়ার পরে তিনি ঘটনাস্থলে যান। ওই কৃষক বলেছেন, "এটি একটি ভয়াবহ দৃশ্য ছিল," আমি প্রথমে যাকে দেখেছি তিনি ছিলেন একজন নারী। তার দেহ গাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ মিটার দূরে পড়ে ছিল ... তার মুখটি সম্পূর্ণরূপে বিকৃত ছিল, এবং তার পা সত্যিই খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সম্ভবত ভাঙ্গা। " ওই কৃষক তিরওয়াজিয়া চৌকিতে এমন নয়টি লাশ দেখতে পান। "স্থানীয়রা লাশ গাড়ীতে রাখার জন্য আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল। তারা ভয় পেয়েছিল যে তাদেরও হত্যা করা হবে।" হেরিন খালফের মা সৌদ মোহাম্মদ টেলিগ্রামের ভিডিওটি যাচাই করে দেখছেন। বন্দুকের ২০টি গুলির আঘাত ২০১৯ সালের ১২ই অক্টোবর রাত ১২টায় হেভরিনের মরদেহ এবং আরও তিনটি লাশ মালিকিয়ার সামরিক হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়। সে সময় বিতরণ করা একটি মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয় যে হেভরিন খালাফকে ২০বারেরও বেশি গুলি করা হয়েছিল। তার দুই পা ভেঙে গিয়েছিল এবং তিনি গুরুতর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বিবিসি অ্যারাবিকের ধারণা যে, আহরার আল-শারকিয়া যোদ্ধারা হেভরিনকে জীবিত অবস্থায় গাড়ি থেকে টেনে নামায়, এরপর হামলা চালিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং গাড়ির বাইরে হত্যা করে। আহরার আল-শারকিয়া বিবিসিকে বলেছে যে, "আমরা হেভরিন খালাফকে হত্যার দায় বেশ কয়েকবার পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করেছি।" জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার, হেভরিন খালাফ হত্যার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করার জন্য তুরস্ককে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু এখনও সেই তদন্ত হয়নি। উত্তর সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক আক্রমণ শুরুর পর থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইপ এরদোয়ান বলে আসছেন যে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে এবং শান্তির সুরক্ষার জন্য সামরিক অভিযানের প্রয়োজন ছিল। আরও পড়তে পারেন: তুরস্ককে প্রতিহত করতে কুর্দিদের সাথে সিরিয়ার চুক্তি সিরিয়ায় তুর্কী-সমর্থক বাহিনী কি যুদ্ধাপরাধ করেছে? সিরিয়ায় কি ইসলামিক স্টেট ফিরে আসতে পারে? তুরস্কের পক্ষ থেকে কোন মন্তব্য নেই অক্টোবরে মার্কিন সেনা ওই অঞ্চল থেকে সরে আসার পর হেভরিন সেই কয়েকশো মানুষেরই একজন যাকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবিসিকে জানিয়েছে যে, "আহরান আল-শারকিয়া যে হেভরিন খালাফ এবং অন্যদের হত্যা করেছে তা অবশ্যই স্বাধীনভাবে তদন্ত করা উচিত এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ...তুরস্ক যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রক্সি বাহিনীর উপর লাগাম টানছে এবং সহিংসতার পেছনে দায়ীদের রেহাই দেয়া বন্ধ করছে ততোক্ষণ পর্যন্ত নৃশংসতাকে আরও উৎসাহিত করা হবে।" বিবিসি তুরস্ক সরকারের কাছে এই ঘটনায় একটি মন্তব্য দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেও কোন সাড়া মেলেনি।
বিবিসির নিউজ অ্যারাবিকের তদন্তে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সিরিয়ান-কুর্দি রাজনৈতিক নেতা হেভরিন খালাফকে হত্যা করেছে তুরস্কপন্থী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির একটি দল।
নমুনা সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে কিনা তার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। এরপর ছয়মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু শুরুর দিকে পরীক্ষা নিয়ে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে ঠিক সেরকম অভিযোগ এখনো রয়েছে। ল্যাবে নমুনা পৌঁছানোর আগেই নেগেটিভ রিপোর্ট? ঢাকার গুলশানের একজন বাসিন্দা তার স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা জানতে বেসরকারি একটি নামি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য একটি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করার পরের দিন নমুনা সংগ্রহের জন্য একজন আসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি বলছেন, "বিকেল পাঁচটার দিকে এসে বাসা থেকে নমুনা নিয়ে গেল। ঠিক সাড়ে ছয়টায় নেগেটিভ রিপোর্টের একটা মেসেজ এলো। আমি বেশ খুশি হয়ে আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম। সে জানালো ওরা বলেছিল রিপোর্ট ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা লাগবে।" এর পরের ঘটনা তিনি যা বর্ণনা করলেন সেটি হল, নমুনা সংগ্রহকারী ল্যাব পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তার কাছে রিপোর্টের ফল চলে এসেছে। ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানিয়ে তিনি বলছেন, "আমার স্ত্রী বিষয়টা আমাকে বলার পর আমি হাসপাতালের কল সেন্টারে ফোন করে বিষয়টা জানতে চাইলাম। আমাকে জানানো হল কোভিড-১৯ পরীক্ষাকে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।" "আমার তবুও সন্দেহ হল। তখন আমি নমুনা সংগ্রহকারীকে ফোন দিয়ে জানলাম সে নমুনা নিয়ে এখনো ল্যাবে পৌঁছায়নি।" তিনি প্রশ্ন করছেন, এমন ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো কি আদৌ নমুনা পরীক্ষা করে কিনা। "আমার পরীক্ষার ফল কী - তার উপর নির্ভর করেই না আমি সিদ্ধান্ত নেবো। একটা ভুল ফলাফল অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।" "বাংলাদেশের সবাই জানে না করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করতে কতদিন লাগে। পজিটিভ হওয়া পরও নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে একজন ব্যক্তি অন্যদের আক্রান্ত করে বেড়াবে।" ছয়মাস পার হয়ে গেলেও পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। একই দিনে দুই নমুনা পরীক্ষার দুই রকম ফল জাপান প্রবাসী একজন বাংলাদেশি ১৯শে আগস্ট ফেসবুকে বড় করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, কীভাবে তার স্ত্রীর দুটি পরীক্ষায় দুই রকম ফল এসেছে। তার লেখা থেকে কিছুটা অংশ তুলে দেয়া হল। "এক ফ্লাইটে আমার বউ জাপানে আসার কথা ছিল। নিয়মানুযায়ী বিমানে উঠার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ থাকা বাধ্যতামূলক করেছে জাপান। ফ্লাইটের ঠিক ৭২ ঘণ্টা আগে আমার বউ গত ১৬ই অগাস্ট নমুনা দেয়। যার ফলাফল ১৭ তারিখ বিকেলে নেগেটিভ আসে। যেহেতু ফলস পজিটিভ/নেগেটিভ রেজাল্ট হরহামেশায় হচ্ছে, সেই জন্য বাড়তি সাবধানতার অংশ হিসেবে ১৭ তারিখের ওই ফল আসার আগে সকালে ফের ঢাকায় ডিএনসিসিতে নমুনা দেয়ার ব্যবস্থা করি।" তিনি লিখেছেন, "ডিএনসিসির ওই নমুনার ফলাফল ঢাকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারাল সেন্টারের ল্যাবে করা হয়। ১৮ই আগস্ট দুপুরে তাদের ফলাফল আসে পজিটিভ।" এই একই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে আরও একের অধিক ব্যক্তির কাছ থেকে, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শ্বশুরকে নিয়ে গিয়েছিলেন পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার ফল দিতে তিনদিন নিয়েছিলো হাসপাতালটি। রিপোর্ট পাননি এরকম অনেকের অভিযোগের পরই সেই রিপোর্ট মিলেছিল। রিপোর্টে বলা হয় ডেঙ্গু এবং করোনাভাইরাস পজিটিভ। রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেয়া হয়। মনের মধ্যে সন্দেহ নিয়ে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন দুদিনের মাথায় কিন্তু তাতে দেখা গেলো কোভিড-১৯ নেগেটিভ। নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও পরীক্ষা বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে যে আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়, সেই পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলে অন্তত ৩০ শতাংশ পর্যন্ত "ফলস নেগেটিভ" আসতে পারে। অর্থাৎ নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকলেও তা শনাক্ত না হওয়া। কিন্তু একজনের নমুনা পরীক্ষার ফল আরেকজনকে পাঠানো, নমুনা দেয়া ব্যক্তির তথ্য হারিয়ে ফেলা, দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরে পরীক্ষার ফল পাওয়া, দুই ল্যাবে পরীক্ষার দুই রকম ফল, ল্যাবে নমুনা পৌঁছানোর আগেই রিপোর্ট, এসব যে "ফলস নেগেটিভ" নয় তা বোধহয় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রশিক্ষিত কর্মী যথেষ্ট রয়েছে কিনা সেনিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক তাহমিনা শিরিন বলছেন, "নমুনা পরীক্ষার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। নমুনা সঠিকভাবে সংগ্রহ করা, নির্ধারিত তাপমাত্রায় নমুনা সংরক্ষণ, সেই নমুনা সঠিকভাবে পরিবহন এবং মেশিনে পরীক্ষা। এর কোন একটা ধাপে সমস্যা হলে ভুল ফল আসতে পারে।" "হয়ত নমুনা নেয়ার জন্য যে পর্যন্ত ঢুকিয়ে ন্যাজাল সোয়াব নিতে হয় সেটা নেয়া হয়নি। সেরকম ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় রাখার কথা সেটা হয়নি। কর্মীদের সক্ষমতাও একটা বড় ব্যাপার।" তিনি বলছেন, ল্যাবের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। যে ল্যাব অল্প সময় হল পরীক্ষা শুরু করেছে তাদের গুছিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সময় লাগবে পারে। "একটি নতুন টেকনিক অ্যাডাপ্ট করা, প্রশিক্ষিত কর্মী তারা পেয়েছে কিনা, পরীক্ষার জন্য যে রি-এজেন্ট দরকার হয় সেটার মান কেমন, হয়ত খরচ কমাতে নিম্নমানের রি-এজেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক রকমের ব্যাপার এখানে কাজ করে।" তাহমিনা শিরিন জানিয়েছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নমুনা পরীক্ষার ল্যাবগুলোর মান কেমন, সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে কিনা সেব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাদের একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। আইডিসিআরের একটি দল বেশ কটি বেসরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, অনেক হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, কোথাও কাজের গতি যেমন হওয়া উচিৎ সেটি নেই, প্রশিক্ষিত কর্মী নেই, একই যন্ত্রপাতি বিভিন্ন যায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব হাসপাতালের ল্যাবে এরকম নানা রকম সমস্যা তারা দেখতে পেয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। পরীক্ষার মান পর্যবেক্ষণ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, "যে কোন মেডিকেল পরীক্ষার নির্ভুল ফল পাওয়ার জন্য মান নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার জানা মতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোথায় কীভাবে মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সেটি যাচাই করার মতো কোন ব্যবস্থা কোথাও নেই।" নির্ভুল ফল পাওয়ার জন্য মান নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলছেন, "নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন এটি একটি চেইনের মতো। সেখানেও নজরদারি নেই। যন্ত্রে নমুনা লোড করা পর্যন্ত এই চেইন ঠিকমতো কাজ না করলে নির্ভুল পরীক্ষার হার কমে আসে। যন্ত্র পর্যন্ত যাওয়ার আগে যে ব্যবস্থা, সেখানেই সম্ভবত কোন ঘাটতি রয়েছে।" তিনি মনে করেন, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যে প্রচেষ্টা বাংলাদেশে দেখা গেছে, এর মান নিয়ন্ত্রণে সেরকম প্রচেষ্টা নেই। ছয় মাস পরেও এসব অভিযোগ কেন? একদম শুরুতে শুধুমাত্র সরকারের আইইডিসিআরের ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হতো। এখন ল্যাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০টি। অনেক বেসরকারি হাসপাতালও এখন সরকার নির্ধারিত ফি'র বিনিময়ে নমুনা পরীক্ষা করছে। স্বভাবতই মনে হতে পারে, ছয় মাস পরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা অনেক বাড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের ল্যাব থেকেই নানা ভুলের ঘটনা ঘটছে। ছয়মাস পার হওয়ার পরও এরকম অনিয়ম কীভাবে ঘটছে? করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সরকারের গঠিত ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির একজন উপদেষ্টা ডা. এম এ ফয়েজ। তিনি বলছেন, পরীক্ষার কোন ধাপগুলো কীভাবে হবে, সকল ল্যাবকে একটি সেব্যাপারে একটি 'স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিওর' দেয়া আছে। "সেটা ঠিকমতো অনুসরণ করা না হলে ভুল হতে পারে। নমুনা অনেকবার হাত-বদল হয়, যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে তা বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বেই নতুন, কিছু কাজ মেশিনে, কিছু কাজ হাতে করতে হয়।" "পুরো প্রক্রিয়ার মেকানিজম আরও জোরদার করা দরকার। আমরা চাই না একটা পরীক্ষায়ও যেন গলদ না হয়।" স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা সূত্র জানিয়েছে তারাও এধরনের অভিযোগ পেয়েছেন এবং পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চীনের উহান থেকে যখন বেশ দ্রুতই ছড়িয়ে পরছিল, এরকম সময় বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়েছিল।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী (পুরনো ছবি) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের এই দাবিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এর আগে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবং এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে তার পরিবর্তে অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অন্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর জের ধরে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও একই দাবি তুলেছেন। এর আগে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কিছুটা পিছিয়ে জুন মাসে, এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা জুলাই-অগাস্ট মাসে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। অটোপাসের দাবিতে ২রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীদের একটি দল। এর আগে জানুয়ারিতে প্রেসক্লাবের সামনেও বিক্ষোভ করেছে তারা। আরো পড়ুন: অটোপাসের পক্ষে থাকা শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির স্বপক্ষে যুক্তিতে বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে ১১ মাসেরও বেশি সময় স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনা করতে না পারায় পরীক্ষায় ভাল ফল করা সম্ভব না। সিলেবাস কমিয়ে আনা হলেও সেটি পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হবে না- যার কারণে অটোপাসের দাবি তোলেন তারা। তারা বলছেন, পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল দেয়া হোক। এসএসসি তে অটোপাসের দাবিতে খোলা হয়েছে অনেক গ্রুপ। ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষা বাতিল চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও একাধিক গ্রুপ এবং পেইজ তৈরি হয়েছে। এরকম একটি গ্রুপ 2021 SSC বাতিল চাই(official)। গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ৭৩ হাজারের বেশি। এই গ্রুপটির সদস্যরা এসএসসি পরীক্ষা বাতিল এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে অটোপাসের ঘোষণার দাবি জানায়। এমডি শিমুল নামে একজন গ্রুপটিতে পোস্ট করে বলেছেন, "২২ লক্ষ শিক্ষার্থীর দাবি এসএসসি ২১ পরীক্ষার অটোপাসের ঘোষণা।" মোহাম্মদ আরাফাত নামে একজন বলেছেন, "৫০% সিলেবাস সর্ট করলে আমরা ৬ মাস ক্লাস চাই।" এছাড়া রাজধানীর ফার্মগেট ছাড়াও নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ-সহ বিভিন্ন জেলা থেকে অটোপাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও বিক্ষোভের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে এই গ্রুপটিতে। এসএসসি পরীক্ষা বাতিল ও অটোপাসের দাবিতে মানববন্ধন। তবে শিক্ষার্থীদের অনেকের ভিন্নমতও রয়েছে। ঢাকার একটি স্কুলের ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী নাইমা রহমান। তিনি জানান, পরীক্ষা বাতিল নয় বরং পরীক্ষা দিতে চান তিনি। পিএসসি এবং জেএসসির পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষার ফল দেয়া হলে সেটি ভাল আসবে না বলে জানান তিনি। ওই দুই পরীক্ষায় তিনি ভাল ফল করতে পারেন নি। আর এ কারণেই এসএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করতে করোনার সময় বাসায় থাকলেও পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার কথা জানান মিস রহমান। "অবশ্যই পরীক্ষা দিতে চাই। আমি এতো কষ্ট করে পড়ছি, এক বছর দুই বছর ধরে, কোচিংয়ে গেছি এতো দূরে, আমার তো কষ্ট হয়েছে। আমি কষ্ট করছি একটা ভাল রেজাল্ট করার জন্য।" এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেহনাজ শাহরিয়ার আহমেদ। তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষার জন্য যদি সিলেবাস কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে অটোপাস চান না তিনি। তবে সিলেবাস না কমানো হলে অটোপাস চান বলে মত দিয়েছেন মিস আহমেদ। "যদি সিলেবাসটি একেবারেই কমানো না হয়, তাহলে অটোপাস ঠিক আছে।" তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পুরো এক বছর স্কুল বন্ধ থাকার কারণে ক্লাস করতে না পারেননি তারা। তবে অটোপাস দেয়া হলে ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে মিস আহমেদ বলেন, "আমরা তো পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অসুবিধা হবে না। যারা বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের সমস্যা হতে পারে।" এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ অটোপাসের পক্ষে মত দিলেও অনেকে আবার এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এসএসসি পরীক্ষার্থীর মা মরিয়ম আক্তার মনে করেন অটোপাসের তুলনায় পরীক্ষা হলেই ভাল। তিনি বলেন, পরীক্ষা হলে মেধার মূল্যায়ন হওয়ার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু অটোপাস হলে সেই সুযোগ বাদ হয়ে যায়। সে কারণেই পরীক্ষা চান তিনি। তবে আরেক শিক্ষার্থীর মা শিলা ইকবাল বলেন, তার ছেলে পড়াশুনায় কিছুটা দুর্বল। আর তাই পরীক্ষা নেয়া হলে কম সময়ে সিলেবাস শেষ করতে পারবে না সে। ফলে পরীক্ষায় খারাপ ফলের আশঙ্কা রয়েছে। আর এজন্য অটোপাসের পক্ষেই মত দিয়েছেন তিনি। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। "জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক" শিক্ষাবিদ এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য যদি অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে সেটি হবে দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেয়া হলেও তারা তাদের পুরো দুই বছরের পড়াশোনা এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। শুধু পরীক্ষা নেয়াটা সম্ভব হয়নি। তবে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটাও হয়নি। যার কারণে ভবিষ্যতে তারা সমস্যায় পড়তে পারেন বলে মত দিচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, "আমাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যদি এখন অটোপাসের পথ খোঁজে, তাহলে সেটা দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।" তিনি বলেন, "যে দেশ থেকে বিদেশিরা পরামর্শ এবং বিশেষজ্ঞ ফি বাবদ প্রতি বছর ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়, সে দেশে মানুষ থাকার পরও আমরা কাজ করতে পারি না, আমরা দক্ষ না, আর এর মধ্যে যদি অটোপাসের আবর্তে পরি তাহলে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হবে।" মি. কায়কোবাদ বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দক্ষতা অর্জন এবং জ্ঞান অর্জন করাটা জরুরী। সেটা না করে যদি শিক্ষার্থীরা অটোপাসের দিকে ঝুঁকে তার মানে হচ্ছে যে তিনি জ্ঞান অর্জনের সাথে যুক্ত নাই। বাংলাদেশের মতো অপ্রতুল সম্পদ রয়েছে এমন দেশে তরুণ সমাজ কাজ বা দক্ষতা অর্জনে বিমুখ হলে সেটি দুশ্চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন তিনি। তবে মি. কায়কোবাদ বলেন যে, করোনাভাইরাস মহামারির সময়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষাবোর্ডের সদস্য কিংবা শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা উচিত ছিল। সেসময় তাদের নানা ধরণের শিক্ষামূলক কার্যক্রম যেমন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া কিংবা নির্দিষ্ট চ্যাপ্টার পড়তে দেয়া এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে সেগুলো আদায় করে নেয়ার একটা ব্যবস্থা করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। সেখানে সরকার কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন মি. কায়কোবাদ। তবে অনলাইন ক্লাস এবং সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও সেটা পর্যাপ্ত ছিল না বলেও জানান তিনি। একই ধরণের মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দা আতিকুন নাহার। তিনি বলেন, অটোপাস আসলে একটা বিশেষ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। চলতি বছর কোভিডের কারণে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি বলে তাদের অটোপাস দেয়া হয়েছে। এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় আরেকবার অটোপাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেবছরও যুদ্ধের মতো একটি বিশেষ অবস্থা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে এবং টিকা দেয়াও শুরু হতে যাচ্ছে, তাই শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি। সৈয়দা আতিকুন নাহার বলেন, "অটোপাস একটা বিকল্প পন্থা, কিন্তু এটা কখনোই ভাল পন্থা নয়।" তিনি মনে করেন, বিতর্ক থাকলেও পরীক্ষা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের একটি পদ্ধতি। এই মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরী, কারণ পরবর্তী পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে পড়াশুনা করবে বা সে কী হতে চায় সেটি যাচাই করতে হলেও মূল্যায়নটা জরুরি। "মূল্যায়ন ছাড়া নিজের মেধাটাও যাচাই করা যায় না।" এসএসসি পাসের পর পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষায় যাওয়ার প্রথম পরীক্ষা হিসেবে ধরা হয় এসএসসি-কে। সেকারণেই এটি গুরুত্বের সাথে নেয়াটা জরুরি। তিনি বলেন, পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে সিলেবাস কমিয়ে আনা যেতে পারে। কিন্তু পরীক্ষা বাতিল করাটা সমাধান নয়।
বাংলাদেশে সম্প্রতি মাধ্যমিক স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধন করে দাবি তুলেছে যে, উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মতো তাদেরও এসএসসি পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস দিতে হবে।
কেরালার সবরিমালা মন্দিরে ভক্তদের ভিড়। শুক্রবার এক রায়ে এই মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার দিয়েছে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সেজন্যই পেরিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পের ভেতরে, এক পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত ওই মন্দিরে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে ওই মন্দিরটি ছাড়াও ভারতে এমন আরও কিছু মন্দির রয়েছে, যেখানে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। যেমন বিশ্বের সবথেকে ধনী মন্দির বলে পরিচিত, কেরালার রাজ্যেরই শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির বা মহারাষ্ট্রের ত্রিম্বকেশ্বর মন্দির, রাজস্থানের পুষ্করে অবস্থিত কার্তিকেয় মন্দির, মহারাষ্ট্রের কোলাপুরের মহালক্ষ্মী মন্দির বা তামিলনাডুর তালাওয়াডির মল্লিকার্জুনস্বামী মন্দির - এগুলিতেও নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। আবার এমন কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যেখানে পুরুষরা প্রবেশ করতে পারেন না। যেমন বিশাখাপতনমের কাছে কামাখ্যা মন্দিরে মাসের কয়েকটি বিশেষ দিনে পুরুষদের প্রবেশাধিকার নেই। পুষ্করের ভগবান ব্রহ্মার মন্দিরে বিবাহিত পুরুষরা যেতে পারেন না। কন্যাকুমারীর দেবী কন্যাকুমারী মন্দিরে ঢুকতে পারেন না বিবাহিত পুরুষরা। বিশ্বের সবথেকে ধনী মন্দির বলে পরিচিত কেরালার শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির। এখানেও নারীদের প্রবেশাধিকার নেই যেসব মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই, সেগুলিতে মূলত ঈশ্বর ব্রহ্মচারী বা চিরকুমার হিসাবে পূজিত হন। সবরিমালার আরাধ্য দেবতা আয়াপ্পা যেমন ব্রহ্মচারী এবং চিরকুমার, তেমনই তাঁর কাছে মকর সংক্রান্তির দিনে যে বিশেষ পুজো দিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়, তাঁদেরও পুজোর আগে ৪১ দিন ধরে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। তাঁরা নিরামিষ খাবার খান, কালো পোষাক পড়েন, দাড়ি কাটেন না এবং কোনওরকমের নারী সাহচর্য করেন না। ঘটনাচক্রে আয়াপ্পা মন্দিরের কাছেই একটি মন্দির রয়েছে, যেখানে মালিকাপুরাত্থাম্মা নামের এক দেবীর পুজো হয়। বহু মানুষ এটা বিশ্বাস করেন যে মালিকাপুরাত্থাম্মা আয়াপ্পাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আয়াপ্পা ব্রহ্মচারী হওয়ায় সেটা সম্ভব হয় নি। তাই মালিকাপুরাত্থাম্মা আয়াপ্পার মন্দিরের কাছেই চির-অপেক্ষায় রয়েছেন। আবার আয়াপ্পার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল ভাভর নামের এক মুসলিমের। তাই ওই মন্দিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সেই দরগা। শীর্ষ আদালত শুক্রবারএক রায়ে এই মন্দিরের বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা নিয়ম বদল করে নারীদের প্রবেশাধিকার দিয়েছে। কিন্তু অনেক নারী নিজেরাই চান না ঋতুযোগ্যা হওয়ার পরে ওই মন্দিরে প্রবেশ করতে। "কোনও মালয়ালি নারীই চাইবেন না অনুশাসন ভেঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করতে। যতই সুপ্রীম কোর্ট রায় দিক, এটা আমাদের বিশ্বাস," স্মিতা মেনন, কোচি শহরের বাসিন্দা । কোচি শহরে একটি জনসংযোগ এজেন্সি চালান স্মিতা মেনন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, "কোনও মালয়ালি নারীই চাইবেন না অনুশাসন ভেঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করতে। যতই সুপ্রীম কোর্ট রায় দিক, এটা আমাদের বিশ্বাস। এর সঙ্গে ঋতুমতী হওয়ার কোনও যোগ নেই। ওই মন্দিরটি তো আসলে ব্রহ্মচর্য পালনের পীঠস্থান। সেখানে যাওয়ার আগে সব রকম জাগতিক বিষয়গুলিকে সরিয়ে রাখেন পুরুষরা, এবং আমরা সেই সময়ে স্বামী বা বাবাকে সবরকমের সাহায্য করি। তাই ব্রহ্মচর্য পালনের এই ধারাটিকে আমরা নষ্ট হতে দিতে চাই না।" আগে শনি শিঙ্গনাপুর নামের যে মন্দিরে নারীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হত না, অথবা নাসিকের ত্রিম্বকেশ্বর মন্দিরে, যেখানে এখনও গর্ভগৃহে নারীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিষেধটা আসে নারীদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার কারণে - কখনও সেটা প্রজনন বা কখনও ঋতুস্রাবের সঙ্গে সংযুক্ত বলে যুক্তি দেখানো হয় প্রাচীনকাল থেকেই। হিন্দু মন্দিরগুলিতে নারীদের প্রবেশাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালাচ্ছে মহারাষ্ট্রের একটি সংগঠন ভূমাতা ব্রিগেড। সংগঠনটির প্রধান তৃপ্তি দেশাই বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "এইসব নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ঋতুমতী হওয়ার কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি নেই। এটা নারীদের প্রতি বৈষম্য। একবিংশ শতাব্দীতে যখন মেয়েরা যুদ্ধবিমান চালায়, দেশ শাসন করে, মহাকাশে পাড়ি দেয়, সেই সময়ে তারা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না এটা হতে পারে না। তাদেরও তো পুজো করার অধিকার রয়েছে।" সুপ্রীম কোর্টও বলেছে ঋতুযোগ্যা নারীদের সবরিমালা মন্দিরে প্রবেশ না করতে দেওয়ার অর্থ তাদের ধর্মপালনের অধিকারে হস্তক্ষেপ। তবে হিন্দু পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী বলছিলেন পুরাণের সঙ্গে এই সব নিয়মের কোনও সংঘাত থাকা উচিত নয়। "শাস্ত্র তো তৈরী হয়েছে তৎকালীন সমাজ থেকে। সেই সময়ে সমাজে যা নিয়মকানুন ছিল, সেগুলোরই সংকলন এই শাস্ত্র। তখনকার সমাজ সেইভাবেই পরিচালিত হত। সেই সময়ে যদি সমাজ পুরুষতান্ত্রিক থেকে থাকে, সেটা তো বর্তমান যুগে মানার প্রয়োজন নেই। এখন তো সমাজ পরিচালনার জন্য পার্লামেন্টের তৈরী করা আইন কানুন রয়েছে, তাই এখন সেইসব আধুনিক আইন অনুযায়ীই সমাজ চলবে! তাই দুটোর মধ্যে তো কোনও সংঘাত হওয়ারই কথা নয়," বলছিলেন অধ্যাপক ভাদুড়ী। তাঁর ব্যাখ্যা, প্রাচীনকালে একভাবে সমাজ চলত বলেই যে বর্তমানকালে দাঁড়িয়ে সেটার ভাল-মন্দ বিচার করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ঘটনাচক্রে, সুপ্রীম কোর্টের যে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সবরিমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্যা নারীদের প্রবেশাধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র নারী বিচারক ইন্দু মালহোত্রা সংখ্যালঘু রায়টি লিখেছেন। তাঁর মতে, ধর্মপালনের বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করাই উচিত নয়।
ভারতের কেরালা রাজ্যে প্রায় আটশো বছরের প্রাচীন সবরিমালা মন্দিরে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের প্রবেশাধিকার দিয়েছে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট। প্রাচীন বিশ্বাস যে ওই বয়সের নারীরা ঋতুযোগ্যা, অন্যদিকে মন্দিরটির পূজ্য দেবতা আয়াপ্পা একজন ব্রহ্মচারী, ফলে চিরকুমার এই দেবতার কাছাকাছি ঋতুযোগ্যা নারীরা গেলে তিনি রুষ্ট হতে পারেন।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলন (ফটো-আইএলআরএফ) গ্যাপের জন্য কাপড় বানাতো বাংলাদেশের এমন একটি কারাখানায় অগ্নিকান্ডে আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ছিল ঐ বিক্ষোভে। লাউড স্পিকারে চলছিলো পরিচিত স্লোগান -- বাংলাদেশের সোয়েটশপ অর্থাৎ যে সব কারখানায় শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নেই, ন্যায্য মজুরি দেয়া হয়না সেখান থেকে পোশাক আমদানি চলবে না। ঘটনাচক্রে সেই দিনেই ঘটে রানা প্লাজা ট্রাজেডি। শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ কারখানা দুর্ঘটনা। পোশাক ব্রান্ডগুলোকে এক হাত নেওয়ার এরকম মোক্ষম অস্ত্র হয়ত আগে আর কখনো পায়নি আমেরিকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। মাস খানেক পর শীর্ষ মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে বিশদ একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে বেশ কিছু মার্কিন ব্রান্ডের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে ভীতি তৈরি হয়েছে, এবং তারা বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে এবং পোশাক তৈরি হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এরকম কয়টি দেশ ঘুরে রিপোর্টটি করেছিলেন কিথ ব্রাডশের। নিউ ইয়র্ক টাইমসের হংকং ব্যুরো প্রধান। বিকল্পের সন্ধানে ক্রেতারা? মি ব্রাডশের বিবিসি বাংলাকে বলেন, এমনিতেই ইমেজ সচেতন কিছু ব্রান্ডের মধ্যে সবসময়ই বাংলাদেশ নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনার পর সেই দ্বিধা আরও বেড়েছে। "এদের বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছেন, তারা বিকল্প খুঁজছেন।" কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন তারা? এ প্রশ্নে কিথ ব্রাডশের তিনটি দেশের কথা বললেন -- ক্যাম্বোডিয়া ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া। "এরাও মোটামুটি বিশাল সংখ্যায় পোশাক তৈরি করছে। এই তিনটি দেশই এখন চেষ্টা করছে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা বাগাতে"। অবশ্য এ দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য অবশ্য চীন। কারণ চীনে মজুরি ভীষণভাবে বাড়ছে। চীনের উপকূলীয় এলাকাগুলোর পোশাক কারখানাগুলোর মজুরি গত দশ বছরে মাসিক একশ ডলার থেকে পাঁচশ ডলারে পৌঁছেছে। তবে মি ব্র্যাডশের একইসাথে বললেন হঠাৎ করে রাতারাতি বাংলাদেশের বিকল্প বের করা খুব সহজ হবে না। "বাংলাদেশের এখনও বিশেষ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন, বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি যেসব দেশে তার একটি বাংলাদেশ। তাছাড়া বিশাল পরিমাণ পোশাকের অর্ডার নিয়ে তা সময়মত সরবরাহ করার দক্ষতা তারা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা করা অনেকে দেশের চেয়ে সুবিধাজনক, এমনকি ভারতের চেয়েও।" টার্গেট ওয়ালমার্ট (ফটো - আইএলআরএফ) ব্র্যান্ড ইমেজ নিয়ে আশঙ্কা যদি সত্যিই বাংলাদেশের এসব সুবিধা থাকে তাহলে ক্রেতারা বিকল্প ভাবছে মূলত কোন কারণে? মি ব্রাডশেরের উত্তর ছিল বাংলাদেশে আরেকটি বড় ধরণের কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তাদেরকে যে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে সেটা ভেবে অনেক ক্রেতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। "সারা বিশ্বের চোখ এখন বাংলাদেশের কারখানার নিরাপত্তা এবং শ্রমিক অধিকারের ওপর। আমেরিকান কোন খুচরা পোশাক বিক্রেতা বা ব্রান্ড কোনভাবেই চাইছে না বাংলাদেশে আরেকটি বড় দুর্ঘটনা হোক, তারপর এনজিও এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো তাদের নৈতিকতা নিয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলুক। কেউ এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইছে না।" ফলে কোনো কোনো ব্র্যান্ড এখন অল্প কিছু বেশি দাম দিয়ে হলেও অন্য জায়গা থেকে পোশাক আনতে উৎসাহী হচ্ছে যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি এবং বিড়ম্বনা কম। পশ্চিমা ট্রেড ইউনিয়নগুলো যথেষ্ট প্রভাবশালী। সংবাদ মাধ্যম এবং রাজনীতিকদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে জনমত তৈরিতে তারা পারদর্শী। সস্তায় কাপড় আমদানি করে দেশের পোশাক শিল্প ধ্বংস করার জন্য বড় বড় ব্রান্ডগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ বহুদিনের। বাংলাদেশের পোশাক খাতে একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তারা মানুষকে সহজে বোঝাতে পারছে এত সস্তায় কাপড় কিভাবে আসছে। ফলে ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অস্বস্তি যে বাড়ছে সেটা বোধগম্য। রানা প্লাজার ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা এবং শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক যে চুক্তি সম্প্রতি হয়েছে তার পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল পশ্চিমা কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের। মূলত তাদের চাপেই পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো এই চুক্তিতে সই করেছে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের লোকজনের মধ্যেও একটা শঙ্কা কাজ করে পশ্চিমা ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রচার প্রচারণাই পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোকে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভীতিগ্রস্ত করে তুলছে। তবে এক কথায় এ ধরণের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন আমেরিকা এবং ইউরোপের শীর্ষ দুই ট্রেড ইউনিয়নের দুজন মুখপাত্র। বাংলাদেশ ক্রেতা হারাক তা চাইনা: ইন্ড্রস্ট্রিঅল যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের মুখপাত্র লিয়ানা ফক্সভোগ বিবিসিকে বলেন পশ্চিমা ব্রান্ডগুলোর মধ্যে যদি বাংলাদেশে সম্পর্কে ভীতি জন্মায় তাহলে তার দায় তাজরিন ফ্যাশনস এবং রানা প্লাজার মত একের পর পর ঘটনা। "আমরা বরঞ্চ মনে করি এত বছর ধরে পশ্চিমা এই সমস্ত ব্রান্ড এবং লোগো বাংলাদেশে তৈরি পোশাক বেচে এত মুনাফা করেছে যে তাদের এখন নৈতিক দায়িত্ব বাংলাদেশের নিরাপত্তার ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করা।" আর জেনেভা-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, ইন্ডাস্ট্রি অলের জেনারেল সেক্রেটারি ইরকি রাইনা বলছেন বাংলাদেশ ক্রেতা হারাক কখনই তারা সেটা চাননা। "বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নিরাপত্তায় যে চুক্তি হয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্যই পোশাক শিল্প সেদেশে যেন টিঁকে থাকতে পারে। আমরা চাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প টিকে থাকুক, বিকশিত হোক, লাখ লাখ কর্মসংস্থান হোক। কিন্তু এখন যেভাবে চলছে সেটা টেকসই কোন শিল্প নয়, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হচ্ছে এ দিয়ে তাদের দারিদ্র দূর হবে না।" তাছাড়া বাংলাদেশ ছেড়ে কোন ক্রেতা চলে যাচ্ছে সেটাও বিশ্বাস করে না এই দুটো ট্রেড ইউনিয়ন। ইরকি রায়না জানালেন ডিজনি ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কোম্পানি বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে বা করতে চলেছে সে রকম ইঙ্গিত অন্তত তাদের কাছে নেই। তার কথা, বরঞ্চ যে ৯০টি কোম্পানি এই চুক্তিতে সই করেছে তারা কার্যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশে তারা থাকবে, সেখান থেকে পোশাক কিনবে। "ইতিহাসে এই প্রথম আমরা দেখছি বিভিন্ন গ্লোবাল ব্রান্ড এবং বিক্রেতারা একসাথে কিছু করতে চাইছে। এবং আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এ সব কোম্পানি বিষয়টিকে সত্যিই গুরুত্ব দিচ্ছে।" পোশাক খাতের রপ্তানির ওপর নিয়মিত নজর রাখেন ঢাকার গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী প্রধান ড মুস্তাফিজুর রহমান। তিনিও বললেন, ক্রেতারা সহসা বাংলাদেশে ছাড়ার পরিকল্পনা করছে এরকম কোন লক্ষণ তিনি এখনো দেখছেন না। "তারা চাইছে বাংলাদেশকে সক্ষম করে বাংলাদেশের সাথেই ব্যবসা করতে। কারণ তারা জানে এত কম দামে এখন কেউই তাদের পোশাক দিতে পারবে না।" তাজরিন বা রানা প্লাজার মত ঘটনায় ব্রান্ড ইমেজ নিয়ে তারা ভীত হয়ে পড়েছেন কিনা? বাংলাদেশের বদলে অন্য কোন দেশের কথা তারা ভাবছেন কিনা – এ সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য ওয়ালমার্ট, মার্কস স্পেনসার, টেসকো এবং প্রাইমার্কের কাছে সাক্ষাৎকারের জন্য বারবার অনুরোধ করেও রাজী করানো যায়নি। বাংলাদেশে নিয়ে টেসকো, মার্কস-স্পেনসার লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রীট মার্কস এন্ড স্পেনসার ছোট্ট একটি লিখিত বক্তব্য ছিল এরকম -- বাংলাদেশের সাথে ব্যবসায় আমাদের রেকর্ড সবসময় স্বচ্ছ। আমরা কিনি এমন কোন কারখানায় কোন দুর্ঘটনা হয়নি। বাংলাদেশে থেকে আমদানি বন্ধ করার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই। কিন্তু আমরা মনে করি বাংলাদেশে কারখানা নিরাপত্তার উন্নতি প্রয়োজন। আর টেসকো তাদের কেম্পানি সাইটে কমার্শিয়াল ডিরেক্টর কেভিন গ্রেসের লেখা একটি নোট ইমেল করে পাঠিয়ে দিয়েছে। মি গ্রেস লিখছেন, “অনেক মানুষ বলে সস্তার কারণে টেসকো বাংলাদেশ থেকে কাপড় আনছে এবং সেদেশে শ্রমিক শোষণে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। তারা আমাদের বলছেন বাংলাদেশ থেকে সরে আসতে। যখন পরিস্থিতি ভালো হবে তখন আবার ফিরে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমরা সেভাবে ভাবছি না। তাতে কোন লাভ হবে না, ক্ষতি হবে। পোশাক তৈরি সেদেশে অব্যাহত থাকবে, কিন্তু টেসকোর মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে নজরদারি, দক্ষতা সেখানে নিয়ে গেছে সেগুলোও চলে যাবে। ট্রেড ইউনিয়নগুলোও সেটা চায়না। তারা চায় আমাদের সরবরাহ লাইনে যারা পণ্য যোগাচ্ছে তাদের প্রতি যেন আমাদের দায়িত্ববোধ থাকে।“ তবে এই চারটি কোম্পানিরই লিখিত বক্তব্য ছিল বাংলাদেশের কারখানা নিরাপত্তায় ট্রেড ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সরকার এবং কারাখানা মালিকদের সাথে যে চুক্তিতে তারা সই করেছেন তারা আশা করছেন তা কাজ করবে। চুক্তি কিন্তু কতটা কাজ করবে? ইন্ডাস্ট্রি অলের ইরকি রাইনা স্বীকার করবেন বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে সিটি। দুহাজারের মত কারখানা পরিদর্শন করতে হবে। শ্রমিক-কর্মচারী এবং ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কঠিন কাজ। একই প্রশ্নে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কিথ ব্রাডশের সরাসরি কোন উত্তর দিলেন না। তবে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের একটা তুলনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। ইন্দোনেশিয়ার একটি পোশাক কারখানা "আমি গত ক' বছরে ইন্দোনেশিয়াতে অনেক গার্মেন্ট কারখানায় গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি।" বাংলাদেশ বনাম ইন্দোনেশিয়া ইন্দোনেশিয়ার পোশাক কারখানাগুলো বড়জোর দোতলা। কিভাবে এটা হয়েছে তার একটা ইতিহাস রয়েছে। নব্বই এর দশকে ইন্দোনেশিয়া পোশাক নির্মাতাদের সমিতির প্রধান হয়েছিলেন সাবেক একজন মন্ত্রী যিনি ভবন নিরাপত্তাকে খুব গুরুত্ব দিতেন। ফলে তার তিন বছরে তিনি কড়া নিয়ম করে দেন কোন পোশাক কারখানা দোতলার বেশি হতে পারবে না। তখন ইন্দোনেশিয়ার পোশাক শিল্প অত বড় ছিলনা। কিন্তু তারপর থেকে যত নতুন কারখানা সেখানে হয়েছে তা সেই নিয়মেই হয়েছে। যে সব কারখানার দ্বিতীয় তলা রয়েছে সেগুলোর সাথে একটি বড় খোলা চত্বর থাকে এবং সাথে অনেক সিঁড়ি। ফলে কোন দুর্ঘটনা হলে দ্রুত শ্রমিকদের সরিয়ে নেওয়া সম্ভব। "ইন্দোনেশিয়াতে পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু আপনি বাংলাদেশের মত সেখানে সাত-আট তলা কংক্রিটের ভবনে কারখানা দেখবেন না। ফলে বড় কোন দুর্ঘটনার কথা শোনাই যায়না।" তবে বলা বাহুল্য বাংলাদেশের তুলনায় সেখান পোশাক তৈরির খরচ বেশ কিছুটা বেশি। ইন্দোনেশিয়ার পোশাক খাতে এখন গড় মাসিক মজুরি দেড়শ থেকে ২০০ ডলার, যেখানে বাংলাদেশে এখনও সেটা ৪০ থেকে ১০০ ডলার। "কিন্তু অনেক ব্রান্ড এখন বাড়তি দামটা দিতে চাইছে।" যেভাবে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খাড়া বহুতল ভবনে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার বিশাল একটি অংশ গড়ে উঠেছে তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আসলে কতটা এড়ানো যাবে তা নিয়ে অনেক পর্যবেক্ষক সন্দিহান। যে কোন সময় আরেকটি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটবে না সে নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। ন্যায্যমূল্য এবং শ্রমিক নিরাপত্তা বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে এত কড়া নজরদারিতে মজুরি বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন শর্ত পালন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা কমবে। এজন্যে পশ্চিমা ব্রান্ড এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সাথে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বৈঠকে বার বার তারা ন্যায্য মূল্য অর্থাৎ আমদানি মূল্য বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু পশ্চিমা ক্রেতারা বাড়তি পয়সা দিতে কতটা প্রস্তুত? লন্ডনের সবচেয়ে বড় শপিংই স্ট্রিট অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এক দুপুরে খুচরা কজন ক্রেতার সাথে কথা বলে মিশ্র বক্তব্য পাওয়া গেল। কেউ কেউ বলছেন, তারা যদি জানেন বাড়তি পয়সা শ্রমিকদের কাছেই যাচ্ছে, তাহলে তারা কিছু বেশি দাম দিতে প্রস্তুত। আবার অনেকে বললেন, অধিকাংশ মানুষ সস্তা যেখানে পাবে সেখানেই দৌড়ুবে। পোশাক বিক্রেতারাও হয়ত বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত। বেশি দাম দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই তারা কোন প্রতিশ্রুতি দিতে চায়না। পশ্চিমা ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বক্তব্য ন্যায্য মূল্যের দাবি তারা সমর্থন করে তবে অল্প দামই যে বাংলাদেশের পোশাক খাতের নিরাপত্তার পথে অন্যতম অন্তরায় সেটা শিকার করতে তারা নারাজ। এ বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রি অলের ইরকি রাইনা বলেন একটি সমীক্ষায় তারা দেখেছেন বাংলাদেশের কারখানার কাজের পরিবেশ নিরাপদ করতে যদি খরচ করতে হয়, শ্রমিকদের মজুরি ৩৮ ডলার থেকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়, তাহলেও একটি টি শার্টের দাম বড় জোড় ১০ সেন্ট বাড়াতে হবে। "এটা তেমন কিছুই না। বড় বড় ব্রান্ডগুলোকে আমরা যখন একথা বলেছি, তারা বলেছে এইটুক বেশি দিতে তাদের কোন আপত্তি নেই।" নিউ ইয়র্ক টাইমসের কিথ ব্রাডশের বলছেন দশ-বিশ সেন্ট বাড়ানোর চেয়ে ব্রান্ড ইমেজ আমেরিকার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপেও তাই। "যদি আর দু-একটি বড় ধরণের কারখানা দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ থেকে অনেক ক্রেতাকে সরে যেতে দেখব।" কিন্তু সেটা হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কি তালা ঝুলবে? মি ব্রাডশের বলছেন সেটা নাও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ তৈরি পোশাকের একমাত্র বাজার নয়। এই দুটো জায়গার ক্রেতা এবং খুচরো বিক্রেতারা কারখানা নিরাপত্তা, শ্রমিকের মজুরি নিয়ে ভাবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বা চীন এখনও এসব নিয়ে অতটা উদ্বিগ্ন নয়। ফলে হয়ত ইউরোপ-আমেরিকার বাজার নষ্ট হবে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, ভারত বা চীনের বাজার সেই ক্ষতি হয়ত পুষিয়ে দেবে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য সেটা কি আশ্বাসের বানী? হয়ত। কিন্তু শ্রমিকের নিরাপত্তা, অধিকার নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে এবং বাইরে যারা তৎপর, তারা হয়ত সে সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হবে না।
রানা প্লাজা যেদিন ভেঙ্গে পড়লো ঠিক সেদিনই অর্থাৎ ২৪শে এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী শ্রমিক ইউনিয়ন ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস্‌ ফোরাম একটি বিক্ষোভ করছিলো সানফ্রানসিসকোতে পোশাক ব্র্যান্ড গ্যাপের সদর দপ্তরের সামনে।
বাড়িভাড়া এখন অনেকের জন্য বড় বোঝা। এসব ঘটনা নিয়ে কোন গবেষণা বা জরিপ হয়নি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এর মুখোমুখি হচ্ছেন। বাড়িওয়ালাদের উপর নানা কারণে ভাড়াটিয়াদের ক্ষোভ নতুন নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালা দুই পক্ষই বিপদে পড়েছেন। গ্রামে ফিরে যাওয়ার গল্প টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফিজুর রহমান কিছুদিন আগে পরিবারসহ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এই যাওয়ার সঙ্গে অন্য সময়ের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। এবার তিনি ঢাকার কুড়িল এলাকার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিয়ে, সকল আসবাবপত্র সমেত পুরোপুরি গ্রামে ফিরে গেছেন। তিন মাস বেতন পাননি মুস্তাফিজুর রহমান তিনি বলছেন, "তিন মাস বেতন পাইনি। খরচ কমানোর জন্য শুরুতে আমার স্ত্রী ও ছেলেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াতে চাইলো। বাসা ভাড়া দিতাম ১২ হাজার টাকা আর বেতন ছিল ২২ হাজার। চাকরি নেই, তিনমাস বেতন পাইনি, এত বাড়িভাড়া কোথা থেকে দেবো। দেখলাম আর পারা যাচ্ছে না।" মুস্তাফিজুর রহমান এখন পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জে বাবার বাড়িতে থাকছেন। ঢাকায় আর ফিরবেন কিনা নিশ্চিত নন। তিনি বলছেন, "আব্বা আম্মা বলছেন, এত বাড়িভাড়া টানতে হবে না। আমাদের যা আছে সেটা দিয়ে কোনরকমে সবাই মিলে একসাথে বেঁচে থাকতে পারলেই চলবে। আমাদের এত টাকা পয়সার দরকার নেই।" শুধু মুস্তাফিজুর রহমানের মতো নিম্নবিত্ত নন, মধ্যবিত্তদেরও বাড়িভাড়ার খরচ যোগাতে বেগ পেতে হচ্ছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ৬৬ দিন সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ছিল। সেসময় বন্ধ ছিল কলকারখানা, সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেক বাড়িওয়ালা বাধ্য হয়ে কম ভাড়া নিয়েছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোর নির্দেশনার কারণে অচল হয়ে পড়েছিল অর্থনীতির চাকা যা এখনো পুরোপুরি সচল হয়নি। দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় বেতনের চাকুরে সবার জীবনেই কোন না কোন ভাবে এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে ছাঁটাই, প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কর্মহীনতা এসব কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ। ঢাকায় বাড়িভাড়া কমেছে? ঢাকায় বাড়ি ভাড়া কমে গেছে এরকম তথ্য শুনে হয়ত অনেকেই খুব খুশি হবেন। কিন্তু এর পেছনে এখন যেসব গল্প শোনা যাচ্ছে তা বোধহয় খুশি হবার মতো নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিম ধানমন্ডির একজন ভাড়াটিয়া বলছেন, "আমি করোনাভাইরাসের কারণে মাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছি সেজন্য একটু বড় ফ্ল্যাট খুঁজছিলাম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আমার এক বন্ধু জানালো যে সে ধানমন্ডিতে তার তিন রুমের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছে। সে ২৪ হাজার টাকা ভাড়া দিত। এখন সে ১২ হাজার টাকায় মোহাম্মদপুরে বাসা নিয়েছে। আর আমি একই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি ১৮ হাজার টাকায়।" দিনমজুর থেকে শুরু করে বড় বেতনের চাকুরে সবার জীবনে প্রভাব পড়েছে। এই ঘটনার আরেকটি অংশ হল তিনি এই ফ্ল্যাটটি কম ভাড়ায় পেয়ে গেলেন। তিনি বলছেন, "বাড়িওয়ালা তাকে বলেছিল যে আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আমি ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া কম নিতে পারবো। কিন্তু তার পক্ষে সেটাও দেয়া সম্ভব হয়নি।" এখন বাসা বদলাচ্ছেন না কেউ। তাই নতুন ভাড়াটিয়া না পাওয়ার শঙ্কায় এরকম অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া কম নিতে রাজি হচ্ছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষজনের আয়ে যে প্রভাব পড়েছে সেই বিবেচনায় বাড়িভাড়া কমানোর দাবি জানিয়েছিল কয়েকটি নাগরিক সংগঠন। বাড়িভাড়া মওকুফের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধনও হয়েছে। নানান আকারের দশটি ফ্ল্যাট আছে ঢাকার মগবাজারে এমন একটি বাড়ির মালিক রাজিয়া সুলতানার পরিবার। তিনি বলছেন, "আমার দুইজন ভাড়াটিয়ার অনুরোধে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া কমিয়ে দিতে হয়েছে। আর নিচের তলায় একটা বিউটি পার্লার আছে তারা তিনমাস ভাড়াই দিতে পারেনি। তারা বাসাটাও ছাড়েননি। আমি তাদের এরকম সময়ে কিছু বলতেও পারছি না।" দুই ভাড়াটিয়ার ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন রাজিয়া সুলতানা তিনি বলছেন, তাকে এখন তার মেয়ের স্কুলে একসাথে চারমাসের বেতন দিতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের বিল জমে গেছে। সেটাও দিতে হবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ব্র্যাক একটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে যাতে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তখনই মানুষের আয়-রোজগারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আড়াই হাজার মানুষের উপর করা জরিপ খুব বড় আঙ্গিকের নয় তবুও জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের উত্তরের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর যে সাধারণ ছুটি ছিল তাতে এই অংশগ্রহণকারীদের ৯৩ শতাংশের আয় কমে গেছে। খালি পড়ে আছে ফ্ল্যাট মিরপুরের একজন বাড়িওয়ালা বলছেন, "করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আমার একটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছে। সেটা আর ভাড়াই দিতে পারিনি। আমাদের মতো পরিবারও শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে।" তিনি এখন যা পান তাতেই ভাড়া দেয়ার পরিকল্পনা করছেন কারণ বাড়িটি বানাতে তাকে ঋণ নিতে হয়েছে। সেটা শোধ করার পাশাপাশি তার নিজের সংসারও চলে বাড়িভাড়া দিয়ে।
ঢাকায় বাড়িভাড়া দিতে না পেরে পরিবারসহ গ্রামে ফিরে গেছেন, বাড়িভাড়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বাড়িওয়ালা, অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকায় চলে যাচ্ছেন, ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে আছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে মানুষের জীবনের এরকম নানা গল্প শোনা যাচ্ছে।
ঢাকায় ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করছেন পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজি। পাশে ভারতের জেনারেল অরোরা। পাকিস্তানে সরকারের অনুমোদিত 'পাকিস্তান স্টাডিজ' নামে এক পাঠ্যপুস্তকে এভাবেই লেখা আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। এই বইতে পূর্ব পাকিস্তান যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তার জন্য অনেক আভ্যন্তরীণ এবং বাইরের কারণকে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশের জন্মের পর ৫০ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু পাকিস্তান যেন বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সেই দাবি এখনো ওঠে। বাংলাদেশের তরফ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু পাকিস্তান বারে বারে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের পাঠ্যক্রমে কি বাংলাদেশের এসব অভিযোগ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন উল্লেখ আছে? বাংলাদেশ, বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, যাকে পাকিস্তানের ডান হাত বলে মনে করা হতো, তা যে আলাদা হয়ে গেল, কীভাবে তা পাকিস্তানের স্কুল পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপন করা হয়? 'পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলো যেসব কারণে' পাকিস্তানে বাংলাদেশের জন্ম সম্পর্কে স্কুল শিক্ষার্থীরা প্রথম জানার সুযোগ পায় নবম শ্রেণীতে উঠে, যখন তাদের বয়স ১৫ বা ১৬। সরকারিভাবে স্কুলে যেসব পাঠ্যবই পড়ানো হয়, সেখানে খুবই অস্পষ্টভাবে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়। এই বিবরণ দুই বা তিন পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ, খুব বিস্তারিত কিছু সেখানে নেই। তবে এর বিপরীতে বেসরকারি স্কুলগুলোতে 'ও লেভেলে' পাকিস্তান স্টাডিজ বলে যে বই পড়ানো হয়, সেখানে পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে যেসব অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি স্কুল- উভয় ক্ষেত্রেই পাঠ্যক্রমে একটা বিষয় অভিন্ন- তা হলো সেখানে বাংলাদেশের তোলা অভিযোগগুলো মোটামুটি উপেক্ষিত। অনেকসময় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ১৪টি কারণ উল্লেখ করা হয়, অনেক সময় উল্লেখ করা হয় নয়টি কারণ। পাকিস্তানের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে এসব ছোটখাটো পরিবর্তন চলছে অনেক বছর ধরে, নানা সরকার আর নানা রাজনৈতিক জমানায়। পাকিস্তানের স্কুল পাঠ্যবইতে ১৯৭১ সালের ঘটনা সম্পর্কে জানার সুযোগ খুবই কম এসব কারণ ব্যাখ্যা করার সময় ভারতকে যে কেবল শত্রু-রাষ্ট্র বলে বর্ণনা করা হয়, তাই শুধু নয়, ''বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে‌'' পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ভারতকেই আসল অপরাধী বলে দোষ দেয়া হয়। 'ধর্মীয় পরিচয়' পাকিস্তানের একজন শিক্ষাবিদ প্রফেসর এ এইচ নাইয়ার বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সরকারের লোকজন মনে করেছিল পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানকে একমাত্র ধর্মই এক রাখতে পারে। কাজেই তারা ''এমনভাবে ইতিহাস শিখিয়েছে যাতে করে একটা ধর্মীয় পরিচয় তৈরি করা যায়।" পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কিভাবে ''তরুণ বাঙালিদের মন বিষিয়ে তুলতে হিন্দু শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।" এতে আরও বলা হয়, ''দুর্ভাগ্যজনকভাবে'' পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর পর আর কোন ''দেশপ্রেমিক'' নেতা তৈরি হয়নি, সেটাও পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার একটা কারণ। বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে বাঙ্গালিদের পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ কীভাবে দেখতো সেকথা উল্লেখ করে প্রফেসর নাইয়ার বলেন, "আমাদের চোখে বাঙালিরা ছিল এক অভুক্ত, পাঁচ ফুট উচ্চতার দুর্বল জাতি। আর আমরা হচ্ছি উঁচু জাতের মানুষ। কাজেই এক ধরণের হেয় চোখে দেখা হতো তাদের।" ছাত্রদের ওপর প্রভাব ১৯৯০ দশকে নামকরা পাকিস্তানি লেখক এবং ইতিহাসবিদ খুরশিদ কামাল আজিজের (কে কে আজিজ) একটি বই প্রকাশিত হয়, যার নাম 'দ্য মার্ডার অব হিস্ট্রি।' এটিতে পাকিস্তানে ইতিহাসের যেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয় সেগুলোর সমালোচনা করা হয়েছিল। কে কে আজিজের মতে, পাকিস্তানের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক পড়ে পাকিস্তানি ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশ কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে কেবল দুই ধরণের ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে। প্রথমটি হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান ছিল সমস্যায় জর্জরিত, আর স্বভাবগত ভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ত। কাজেই বাংলাদেশের জন্ম পাকিস্তানের জন্য ভালোই হয়েছে। অথবা বাংলাদেশের আলাদা হওয়ার বিষয়টিকে অতীতের একেবারেই অগুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে তারা। কে কে আজিজের মতে, এটি ছিল ১৯৭১ সালের আগে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে ছাত্রদের অন্ধকারে রাখার জন্য একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি চেষ্টা। ছাত্রদের ওপর এর কি প্রভাব পড়েছে সে ব্যাপারে প্রফেসর নাইয়ারও কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের সরকার যা চেয়েছিল. তাই আসলে ঘটছে। এসব ছেলে-মেয়ের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভারত হচ্ছে শত্রু আর পাকিস্তান এখানে নিপীড়নের শিকার। ঢাকায় আত্মসমর্পনের পর কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে বন্দী পাকিস্তানী সেনারা এরকম ইতিহাস শিখিয়ে পাকিস্তানের কি লাভ হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে পাকিস্তানের একজন কলামিস্ট এবং শিক্ষাবিদ আসিম সাজ্জাদ আকতার বলেন, "আপনি যদি এমন কিছু চিন্তা-দাস তৈরি করতে চান যারা আপনার সব কথায় হ্যাঁ বলবে, যুদ্ধের হুংকার দিয়ে কথা বলবে এবং আপনাকে হাততালি দেবে, তাহলে হয়তো একটা লাভ আছে। কিন্তু আপনি যদি চান সমাজে এমন কিছু মানুষ তৈরি করতে যারা শুধু সৃষ্টিশীলই নয়, যারা সমালোচনা করতেও সক্ষম, তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আপনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।" আসিম সাজ্জাদ বলেন, "এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কোন গবেষণার চেষ্টাকে বাধা দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ভাষ্যকে যারা টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা এক্ষেত্রে কোন রকমের পরিবর্তন দেখতে চায় না।" "পাকিস্তানই একা এই কাজ করছে না" বাংলাদেশের জন্মের ঘটনা পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারত- এই তিন দেশে কীভাবে তুলে ধরা হয়? গবেষক আনাম জাকারিয়া এই তিন দেশে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী এই তিন দেশে কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়। আনাম জাকারিয়া বিবিসিকে বলেন, এই তিনটি দেশ থেকে ইতিহাসকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা সম্ভব। পাকিস্তানই কি একমাত্র দেশ, যারা ইতিহাসকে পাঠ্যক্রমে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরছে? এ প্রশ্নের উত্তরে আসিম সাজ্জাদ বলেন, প্রত্যেকটি দেশই চায় তাদের নাগরিকদের একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে গড়ে তুলতে। কাজেই এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান একাই যে এই কাজ করছে তা নয়।" কিন্তু একটা সফল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের যে বিবরণ পাকিস্তান তুলে ধরছে, সেটাকে তিনি খুবই হাস্যকর বলে বর্ণনা করেন। আসিম সাজ্জাদ বলেন, "এমনকি আজকের দিনেও আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বলে যাচ্ছি যে পাকিস্তানের ৫৪ শতাংশ মানুষ, যারা এই পাকিস্তানেরই অংশ ছিলেন, তারা একটি বিদেশি ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছেন। আমার দৃষ্টিতে এটা একেবারেই হাস্যকর।" কলকাতার উপকণ্ঠে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশি শরণার্থীতে পূর্ণ এক শিবির। শিক্ষকদের ভূমিকা প্রফেসর এ এইচ নাইয়ার এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকার কথা প্রসঙ্গে বলেন, "এরা নিজেরাই শৈশবে যা শিখেছেন, সেটাই তাদের মনে গেঁথে আছে।" "এরা যখন এমন ছাত্রদের মুখোমুখি হন, যাদের মনে অনেক প্রশ্ন এবং কৌতূহল, তখন এই শিক্ষকরাও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত শ্লোগানেরই আশ্রয় নেন। এরপর আর সেখানে কোন আলোচনার সুযোগ থাকে না।" তাঁর মতে, "খুব কম শিক্ষকই খুঁজে পাওয়া যাবে যারা যুক্তির ভিত্তিতে এসব নিয়ে আলোচনা করেন।" যে বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ছয় দফা ঘোষণা করে যেভাবে নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব ভুট্টো যেভাবে পাকিস্তানে ক্ষমতার ভাগ চেয়েছিলেন পঁচিশে মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর যেভাবে এল স্বাধীনতার ঘোষণা ইন্দিরা গান্ধী যেদিন তাজউদ্দীনকে প্রবাসে সরকার গঠনের পরামর্শ দিলেন একজন শিক্ষক হিসেবে আনাম জাকারিয়া ভারত এবং পাকিস্তানের শ্রেণিকক্ষগুলোতে গেছেন এবং এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, শিশুদের যে-ধরণের ইতিহাস শেখানো হচ্ছে তার ফলে সমাজে ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। তার মতে, ১৯৭১ সালে এই তিন দেশের ভূমিকা কি ছিল সেটা শিক্ষার্থীদের জানতে দিলে কোন ক্ষতি নেই, বরং এতে বিরাট উপকার হবে। "পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কবি, সৈনিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং নারীবাদী কর্মী যে তখন সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করেছিলেন এরকম অনেক ঘটনার কথাও আমি শুনেছি।" "এগুলো অনেক অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি এবং আমি আসলে তাদের কাহিনি শুনতে চাই।"
"বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার নামে একটা নাটক করে সফল হন।" "পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ছি ল বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক গোপন চুক্তির ফল।"
যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক শতাব্দীর ইতিহাসে দেশটিতে সবচেয়ে কম সংখ্যক শিশুর জন্ম হয়েছে এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশেও শিশু জন্মের হার অনেক কমে গেছে। মহামারির শুরুতে জার্মানির ফ্রেডেরিকে যখন তার বয়স্ক বাবা মাকে দেখাশোনা করার কথা ভেবেছিলেন, তার মনে হয়েছিল যে এটা তার জীবনে উপহার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, কারণ এর ফলে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে আরো বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ৩৩ বছর বয়সী এই নারী অনুভব করতে শুরু করেন যে তার জীবনে বুঝি বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ফ্রেডেরিকে একজন অবিবাহিত নারী। তিনি ভেবেছিলেন খুব শীঘ্রই কারো সঙ্গে তার পরিচয় হবে যার সঙ্গে তিনি তার সংসার জীবন শুরু করতে পারবেন। কিন্তু তার মনে হলো যে মহামারি আসলে জীবন থেকে সেই সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। "বর্তমানে সময় অত্যন্ত মূল্যবান এবং মনে হচ্ছে আমার জীবন যেন থমকে গেছে," বলেন তিনি। অনলাইনে ডেটিং করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বাইরে গিয়ে রোমান্স করার মতো যথেষ্ট আগ্রহ তার ছিল না। এখনও তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন। তার মাথায় সবসময় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়: "এই অবস্থার যখন সমাপ্তি ঘটবে তখন তো আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে না।" "যখন আমি সন্তান নিতে পারতাম তখন আমি ঘরে বসে আছি।" "বিস্ময়কর কিছু নয়" "মহামারির পরিস্থিতি এতো খারাপ সেটা দেখে আমি বিস্মিত হইনি," বলেন ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিলিপ এন কোহেন। "কিন্তু বাস্তবেও যে এমন ঘটছে সেটা দুঃখজনক।" গত বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের অর্থনীতিবিদরা অনুমান করেছিলেন যে দেশটিতে শিশু জন্মের ঘটনা তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ কমে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অগাস্ট মাস পর্যন্ত কম শিশু জন্ম হওয়ার ধারা অব্যাহিত থাকবে। আরো পড়তে পারেন: এক নারীর দুই জরায়ু থেকে জন্মালো তিন সন্তান বিশ্ব মহামারির কালে জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে ক্লিনিকের ভুলে ভুল শিশুর জন্ম দিয়েছে দম্পতি একই সময়ে ইউরোপেও একটি জরিপ চালানো হয়েছে যাতে দেখা গেছে জার্মানি ও ফ্রান্সে ৫০% মানুষ ২০২০ সালে সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকছে। ইতালিতে ৩৭% মানুষ বলেছে, তারা এই পরিকল্পনা বাদ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত একটি দপ্তর সিডিসির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে ডিসেম্বর মাসে শিশুর জন্ম ৮% কমে গেছে। ইতালির পরিসংখ্যান অনুসারে, এই বছরের শুরুতে শিশু জন্মের হার কমেছে ২১.৬% এবং স্পেনে এই হার, রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে, সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে- কমেছে ২০%। মহামারি শুরু হওয়ার পর প্রথম নয় মাসে ফ্রান্স, কোরিয়া, তাইওয়ান, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া- সব দেশেই জন্মের হার হ্রাস পেয়েছে। বলা হচ্ছে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে এসব দেশে গত ২০ বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম সংখ্যক শিশুর জন্ম হয়েছে। মাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিউটের জনসংখ্যা বিষয়ক গবেষক জশুয়া ভিল্ডে এবং তার দল এই হ্রাস আগেই অনুমান করেছিলেন এবং তাদের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে এই অবস্থা, অন্তত যুক্তরাষ্ট্রে, আরো কয়েক মাস ধরে অব্যাহত থাকবে। অক্টোবর মাসে তারা অনুমান করেছিল যে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে শিশুর জন্ম ১৫.২% কমে যাবে। কিন্তু এখন তারা দেখছে যে এই হার কমার প্রবণতা অগাস্ট মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। প্রেগনেন্সি টেস্টের ওপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা চালিয়েছে। বলা হচ্ছে, এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে শিশুর জন্মের ঘটনা কখনো এতোটা কমে যায় নি। এছাড়াও শিশু জন্মের ওপর ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা এবং ১৯২৯ সালের মহামন্দার চেয়েও বর্তমান মহামারির প্রভাব আরো বেশি দীর্ঘস্থায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। ভিল্ডে বলেন, "সাধারণত এধরনের মন্দা ও মহামারির সময় আমরা দেখি যে শিশু জন্মের হার কমে যায় এবং পরে সেটা আবার বাড়তে থাকে। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারেন যে যখন প্রথম ওয়েভ শেষ হলো, অনেকেই ভেবেছিল যে এখনই সন্তান নেওয়ার সময়।" কিন্তু এবারের মহামারিতে সেরকম হয়নি। "এবার আমি যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো যেসব লোকজন সন্তান নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল তারা আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে।" কেউ কেউ তো এই সিদ্ধান্তও নিয়েছে যে তারা আর সন্তানই নেবে না। স্টিভের বেলায় এমনটাই ঘটেছে। গত তিন বছর ধরে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে বারবার একই বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন। স্টিভের স্ত্রী আরো একটি সন্তান নিতে চান- তাদের দুই পুত্র সন্তানের জন্য একটা ছোট্ট বোন নিতে চান তিনি। কিন্তু স্টিভ চারজনের সংসার নিয়েই খুশি। "ফলে প্রত্যেক বছর আমাকে নানা ধরনের অজুহাত দেখাতে হয়," বলেন স্টিভ। তারা নাইজেরিয়াতে থাকেন। স্টিভ তার স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। কিন্তু তার স্ত্রী সেটা কিছুতেই বুঝতে চান না। "কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির পর এই প্রথম সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আর কোনো সন্তান নয়।" অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হলে শিশু জন্মের হার বেড়ে যায়। জাতিসংঘের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারির কারণে ১১৫টি দেশের এক কোটি ২০ লাখ নারী পরিবার পরিকল্পনা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর ফলে পিতামাতার না চাওয়া সত্ত্বেও প্রায় ১৪ লাখ শিশুর জন্ম হতে পারে। শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই সরকার অনুমান করেছিল যে মহামারির কারণে পাঁচ লাখ শিশুর জন্ম হতে পারে। একারণে লকডাউনের সময় সরকার শহরে শহরে গাড়ি পাঠিয়েছে যেখান থেকে লাউডস্পিকারে সন্তান না নেওয়ার বিষয়ে লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে। এসব বার্তার মধ্যে রয়েছে: "পিতা, অনুগ্রহ করে আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন," "আপনি সেক্স করতে পারেন, বিয়ে করতে পারেন কিন্তু গর্ভধারণ করবেন না।" দেশটির জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা সংস্থা বলছে, লকডাউনের কারণে লোকজন ক্লিনিক ও ফার্মাসিতে যেতে না পারার কারণে প্রায় এক কোটি মানুষ জন্মনিরোধক ব্যবহার করতে পারেনি। সেক্স করা কমে গেছে? ইউরোপ ও আমেরিকাতে শিশুর জন্ম কমে যাওয়াকে উল্লেখ করা হচ্ছে বেবি বাস্ট হিসেবে। তাত্ত্বিকভাবে বেবি বাস্ট হচ্ছে লোকজনের সেক্স করার আগ্রহ কমে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনসে ইন্সটিটিউটের রিপোর্ট অনুসারে, যাদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে, তাদের ৪০%, লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে, বলেছে যে মহামারির সময় তাদের সেক্স করার আগ্রহ কমে গেছে। চীনেও একই ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছিল এবং তাতেও একই ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতে চালানো গবেষণায় দেখে গেছে লোকজনের মধ্যে সেক্সের আগ্রহ কমেনি। মাস্ট্রিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী এবং যৌনবিজ্ঞানী মারিয়েকে দেভিতে বলেছেন, এসব গবেষণা থেকে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। "লোকজনের যৌনতা ও সম্পর্কের ওপর মহামারির কী ধরনের প্রভাব পড়ে তাতে একেকজন একেকভাবে সাড়া দিয়ে থাকে," তিনি বলেন। "অনেকে আছেন স্ট্রেসের কারণে যাদের যৌন চাহিদা বৃদ্ধি পায়, আবার বাকিরা সেক্স করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।" তবে অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে শিশু জন্মের সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন দেশে সবসময়ই দেখা গেছে যে অর্থনীতি ভাল হলে শিশু জন্মের হার বেড়ে যায় এবং অনিশ্চয়তার কারণে এই হার হ্রাস পায়। ইউরোপে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের যেসব এলাকা করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সেসব জায়গায় লোকজন সন্তান জন্ম দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু উত্তর ইউরোপের কিছু ধনী দেশ- নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড- যারা করোনাভাইরাস মহামারি ভালভাবে মোকাবেলা করেছে, এসব দেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে শিশু জন্মের হার সামান্য কমেছে কিম্বা একেবারেই হ্রাস পায়নি। 'চড়া মূল্য' শিশু জন্ম কমে যাওয়া মোটামুটি সারা বিশ্বেরই প্রবণতা- যাতে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমে গেলে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে এবং তার ফলে বয়স্ক লোকজনকে পেনশন ও স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অথচ মানুষ এখন আগের তুলনায় বেশি সময় বেঁচে থাকছে। এই সমস্যার সমাধান আছে- অবসর নেওয়ার বয়স বাড়িয়ে দেওয়া অথবা অভিবাসনের ব্যাপারে লোকজনকে উৎসাহিত করা। কিন্তু এগুলোর রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। অনেক দেশ শিশু জন্মের হার বাড়ানোর চেষ্টা করে সামান্য সফল হয়েছে। একবার যখন এই হার কমে যায় তখন নারীদেরকে সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করা খুব কঠিন। "২০০৯ সালে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার পর পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে কিন্তু সেটা আগের পর্যায়ে ফিরে যায় নি," বলেন অধ্যাপক ফিলিপ কোহেন। "যুক্তরাষ্ট্রে শিশু জন্মের হার মন্দার আগের পর্যায়ে আর কখনোই ফিরে যায়নি।" আরো পড়তে পারেন: সুনামগঞ্জের হিন্দু গ্রামে হামলা: হয়নি মামলা, নেই গ্রেপ্তার, পরিস্থিতি থমথমে করোনায় মৃত্যু শুরুর ১ বছর: স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা পাল্টেছে সংক্রমণ ঠেকাতে আবার লকডাউন চায় স্বাস্থ্য অধিদফতর বর্তমান মহামারি যতোই দীর্ঘ হচ্ছে নারীদের বয়সও ততো বাড়ছে এবং তাদের জন্য সন্তান ধারণের সময়ও কমে আসছে। যেমন জার্মান নারী ফ্রেডেরিকে মনে করছেন, তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। এরকম পরিস্থিতিতে তিনি তার ডিম্বাণু হিমায়িত করে রাখার কথাও চিন্তা করছেন। ভাবছেন তার সমকামী পুরুষ বন্ধুর সাথে সন্তান গ্রহণের কথাও। না হলে তার হয়তো কখনোই সন্তান নেওয়া হবে না। "বয়স্ক লোকজনকে রক্ষার জন্য এটা করতে আমি রাজি, কিন্তু এর জন্য আমাকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।"
যারা ভেবেছিলেন যে লকডাউনের সময় দম্পতিদের সন্তান উৎপাদন ছাড়া তেমন কিছু করার থাকবে না তারা জেনে বিস্মিত হবেন যে বাস্তবে আসলে সেরকম ঘটেনি।
আসামে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন শওকত আলী ভারতের নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণের মাত্র কদিন আগে এ ঘটনাটি ঘটে। সেদিন আসামের উত্তর-পূর্ব এলাকার মুসলমান ব্যবসায়ী শওকত আলী কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ বেশ কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল মানুষ তার ওপর হামলা চালায়। আক্রমণকারীরা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। তারপর ময়লা কাদার ওপর হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে। "আপনি কি বাংলাদেশী?" তার ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে হামলাকারীদের একজন। "আপনি এখানে গরুর মাংস বিক্রি করেন কেন?" মি. আলীর দিকে আঙুল উঁচিয়ে এ প্রশ্ন করে আরেকজন। শওকত আলীর এ লাঞ্ছনার ঘটনা দেখতে ওইখানে উৎসাহী অনেক লোকই ভিড় করেছিল। তবে আলীর সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে নি। তারা মোবাইলে পুরো ঘটনাটির দৃশ্য ধারণ করছিল। আরো পড়তে পারেন: মশা আমদানি করে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোর উপায় গ্রিনল্যান্ড: যে দেশে বুধবার 'গর্ভপাত দিবস' যে নির্বাচনে মারা গেলেন পাঁচশো'র বেশি কর্মকর্তা উদ্ধার হওয়া নবজাতকটিকে কার হেফাজতে দেয়া হবে? ওই ঘটনার পরে গ্রামবাসী মি.আলীকে সহানুভূতি জানাতে এসেছিল 'এটি আমার বিশ্বাসের ওপর আঘাত' ঘটনার এক মাস পর। এখনো মি. আলী ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। আমি মি. আলীর সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে গেলাম। বাজার থেকে সামান্য দূরে শ্যামল সবুজ শস্যক্ষেত পার হয়ে তার বাড়ি। সেটিও সবুজে ঘেরা। আটচল্লিশ বছর বয়সী লোকটি বিছানায় পা ভাঁজ করে বসেছিল। সেইদিনের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে তার চোখ ছলছল করে উঠল। "তারা আমাকে লাঠি দিয়ে মেরেছে, আমার মুখে লাথি মেরেছে," মাথা ও পাঁজরের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখিয়ে বলছিলেন মি. আলী। তার পরিবার কয়েক দশক ধরে তাদের ছোট খাবারের দোকানটিতে ঝোলওয়ালা গরুর মাংস বিক্রি করে আসছেন, তবে আগে কখনো এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। হিন্দুরা যেহেতু গরুকে পবিত্র মনে করে এজন্য ভারতের অনেক প্রদেশে গরুর মাংস বিক্রি করায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে আসামে গরুর মাংস বিক্রি করা আইনত বৈধ। শওকত আলী শুধু শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হননি, তার সামাজিক মর্যাদাও হারিয়েছেন। দুর্বৃত্তরা এই ধর্মপ্রাণ মুসলমান লোকটিকে শূকরের মাংস খেতে বাধ্য করেছে। মি. আলীকে শূকরের মাংস খাওয়ানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল সেদিন তাকে তারা জোর করে শূকরের মাংস প্রথমে চাবাতে ও পরে গিলে খেতে বাধ্য করে। "বেঁচে থাকার আর কোনো মানে হয় না আমার," তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "এটি আমার সমস্ত বিশ্বাসের ওপর আঘাত।" আমাদের সাক্ষাতের দিন স্থানীয় মুসলমান কমিউনিটির দশ-বারোজন নেতা মি. আলীর খোঁজ নিতে তার বাসায় এসেছিলেন। তার এ বিবরণ শুনে তাদের মধ্যে কয়েকজন কেঁদে ফেলেন। তারা নিজেরাও এখন আর নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। আরেকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে অনেকেই এ প্রশ্ন তুলেছেন যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়, যাদের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ২০ লাখ, তাদের অধিকার এখানে ঠিক কতটা সমুন্নত রয়েছে? গরুর মাংস বিক্রি করার কারণে বা বিক্রির সন্দেহে হামলার ঘটনা ভারতে বেড়েই চলেছে। শওকত আলীর ঘটনা এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ এর মে থেকে ২০১৮ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ভারতের ১২ টি প্রদেশে ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই মুসলমান। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান, মিশেল বাচেলে, তার বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, 'সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হামলার ঘটনা বাড়ছে, বিশেষ করে মুসলমান এবং যারা ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চনার শিকার, যেমন দলিত সম্প্রদায় (আগে যাদেরকে 'অস্পৃশ্য' বলা হত), তাদের লক্ষ্য করে আক্রমণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।' ভারতে স্বাধীনতার কাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় সব ধর্মের মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটা এদেশের একটা প্রধান অনাকাঙ্খিত বিষয়। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এখন যারা এ দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তারা এসব ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ বিষয়ে তারা নীরবতার সংস্কৃতি পালন করছে। এক সভায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মুসলমানদেরকে 'উইপোকা' বলে সম্বোধন করেন। মাত্র কয়েকবছর আগে ভারতে এক নৃশংস গণধর্ষণের পরে যা ঘটেছিল সেটি এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ বটে। গত বছরের জানুয়ারিতে ভারতের কাশ্মীর অংশের কঠুয়া জেলায়, আট বছর বয়সী এক মুসলমান মেয়ে ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়। এক সপ্তাহ ধরে তাকে একটি হিন্দু মন্দিরের ভেতর আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হয়। এসময় তার উপর চেতনানাশক প্রয়োগ করা হয় এবং শেষে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। পুলিশ তাদের রিপোর্টে জানায়, যাযাবর বাকারওয়াল সম্প্রদায়কে (মেয়েটি ওই সম্প্রদায়ের) শিক্ষা দিতে কিছু হিন্দু লোক সংঘবদ্ধভাবে পরিকল্পনামাফিক এ কাজ করেছিল, যাতে তারা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এক বছর পার হয়ে গেছে। কঠুয়ার দুর্গম অঞ্চলে সেই মেয়েটির বাড়ি এখনো সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরায় রয়েছে। 'তারা বলেছে, এটা মুসলমানের মেয়ে-একে মেরে ফেল, তাহলে ওরা ভয় পাবে আর এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে', চোখের পানি মুছতে মুছতে বলছিলেন মেয়েটির বাবা। একসময় তাদের ছোট্ট মেয়েটি যে বাড়িতে থাকত সে বাড়ি ছেড়ে যেতে নারাজ তার বাবা-মা। যদিও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। "আমরা বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছি, এখনো আমাদের জীবনের ঝুঁকি রয়ে গেছে," মেয়েটির মা জানালেন। "আমরা বাইরে গেলে লোকজন আমাদেরকে অকথ্য গালাগাল করে, মারধর করার হুমকি দেয়।" আট বছর বয়সী শিশুটির এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে হাজারো লোক রাস্তায় নেমেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু দোষী প্রমাণিত হওয়া ওই আটজন হিন্দুর পক্ষ নিয়ে স্থানীয় লোকজন বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। তারা মেয়েটি ও তার অসহায় পরিবারের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার বদলে হত্যাকারীদের সমর্থন জানিয়েছে। হত্যাকারীদের পক্ষে যারা রাস্তায় নেমেছিল তাদের মধ্যে চৌধুরী লাল সিং ও চন্দর প্রকাশ গঙ্গা নামে ক্ষমতাসীন বিজেপির দুই মন্ত্রীও ছিলেন। লোকসভা নির্বাচন ২০১৯: তরুণ ভোটারদের ভাবনা মি. সিং ওই সময় এক প্রতিবাদ সমাবেশে বলেন, "এই একটা মেয়ে মারা গেছে আর এখানে এত তদন্ত হচ্ছে। অথচ এখানে কত মেয়ে মারা যায়।" প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গণধর্ষণের ঘটনায় নিন্দা জানালেও তাঁর দলের ওই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেন নি। পরে সপ্তাহব্যাপী তীব্র বিক্ষোভের মুখে তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব এরপরও এসব ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেন, "পার্টি চায়নি মি. গঙ্গা ও মি. সিং পদত্যাগ করুক। তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ মিডিয়া এমনভাবে তাদেরকে উপস্থাপন করেছে যেন তারা ধর্ষকদের পক্ষ নিয়েছেন।" এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন আরো বেশ কিছু ঘটনা আছে যেখানে বিজেপির সদস্যরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের প্রতি বীতশ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশ্যে দাঙ্গাবাজদের পক্ষ নিয়েছে। বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল। এ দলটিতে এমন বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা আছেন যারা মনে করেন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যদিও দলটির নেতারা বারবারই বলেছেন, তারা সংখ্যালঘু বিদ্বেষী নন। ২০১৫ সালে, মোহাম্মদ আখলাক নামের পঞ্চাশ বছর বয়সী এক মুসলমানকে গরু জবাই করার সন্দেহে ইট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। বিজেপির এই বিতর্কিত নেতা, ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের জের ধরে সম্প্রতি ভারতের নির্বাচন কমিশন যার নির্বাচনি প্রচারণা কয়েকদিনের জন্য স্থগিত করেছে, তাকে মোদীর সঙ্গে বহুবার একই মঞ্চে দেখা গেছে। সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা, যিনি মোদির কেবিনেটের অন্যতম সদস্য, সম্প্রতি বিবিসিকে জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে একজন মুসলমান গরু ব্যবসায়ীকে হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচাতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অর্থ দিয়েছেন তিনি। বিবিসি হিন্দির সাংবাদিক যুগল পুরোহিতের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে মি. সিনহা বলেন, অভিযুক্তদের বাঁচাতে তিনি সাহায্য করেছেন কারণ তারা সবাই বিজেপির সদস্য এবং তিনি মনে করেন তাদেরকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায়, বিজেপি সরকারের সমালোচনায় যিনি সবসময় সোচ্চার, তিনি মনে করেন, একটি গোষ্ঠী এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে কারণ তারা ওপরমহল থেকে সুরক্ষাকবচ পেয়েছে। তারা জানে যে তাদের কিছুই হবে না। লোকসভা নির্বাচন ২০১৯: ভারতে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটা কীরকম? তিনি বললেন, 'শুধু নেতারা যা করছে তা নয়, মানুষকে ক্রমাগত যেসব বিদ্বেষ ও উস্কানি দেওয়া হচ্ছে তা তাদের মনে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে সেটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। যে বিষ তাদের অন্তরে সহজেই প্রবেশ করানো হচ্ছে তা কিন্তু সহজে বের করা যাবে না। এটা অনেক কঠিন কাজ।' তবে বিজেপির মুখপাত্র নলিন কোহলি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন তার দলের নীতির সঙ্গে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা 'হেইট ক্রাইম' এর কোনো সম্পর্কই নেই। তিনি বলেন, জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টগুলিতে মিথ্যা পরিসংখ্যান ব্যবহার করে কাল্পনিক ইস্যুকে বাস্তব প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। মি. কোহলি আরো বলেন, মোদি সরকারের সময়ে বিজেপি সব ধর্মের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে। এটি কোনো সাম্প্রদায়িক দল নয়। বিজেপি সর্বভারতীয় দল, ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের দল। তবে ভারতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, বিজেপি দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত হলে এ দেশটি সংখ্যাগরিষ্ঠের (মেজরিটারিয়ান) দেশে পরিণত হবে। দলটির ইশতেহারে বলা হয়েছে, ভারতে অবৈধভাবে বসবাসরত সব বাংলাদেশীদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। দলটি বেশ কিছু ধর্মের অনুসারীদের আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব ধর্মের মধ্যে রয়েছে- সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, পার্সি এবং জৈন ধর্মাবলম্বীরা। তবে লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হল, মুসলমানরা এ তালিকায় নেই। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ সভা-সমাবেশে মুসলমান অভিবাসীদের 'উইপোকা', 'সন্ত্রাসী' বলেছেন। শুধু তাই-ই নয়, তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নানা ধরনের বক্তব্যও দিয়েছেন তিনি। আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় গ্রামবাসীদের একটি অংশ গোলবৈঠকে বসেছে। তাদের অনেকেরই হাতে পরিবারের সদস্যদের ছবিসম্বলিত কাগজ। গত বছর তাদেরকে বলা হয়েছে তাদের পারিবারিক ইতিহাস নথিভুক্ত করতে এবং প্রমাণ করতে যে তারা ভারতীয়। এক্ষেত্রে তারাই ভারতীয় হিসেবে গণ্য হবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার একদিন আগে, অর্থাৎ ২৪শে মার্চ ১৯৭১ এর আগে আসামে প্রবেশ করেছে। আসাম প্রদেশের এক শিশু নিজের পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চার সন্তানের মা উফান তার হাতের কাগজটি খুলল। সেখানে সবচেয়ে ওপরে তার স্বামীর ছবি, যিনি গত বছর মারা গেছেন। এর নিচে তার চার সন্তানের ছবি। উফানের পরিবারের জন্ম ভারতে হলেও তাদের কারো নাম সরকারি নথিভুক্ত নয়। এনআরসি'তে (ন্যাশনাল রেজিষ্ট্রার অব সিটিজেনস) তারা কেউ নাম লেখাননি। চল্লিশ লাখ লোক-যাদের অধিকাংশই মুসলমান- এ তালিকাভুক্ত নন। উফানের ভয় এই নিয়ে যে, যে দেশকে সে নিজের দেশ বলে জানে সেখান থেকে তাকে হয়ত বের করে দেয়া হবে। একই আশঙ্কায় রয়েছেন মোহাম্মদ শামসুল। তিনি জানালেন, তার বাবা এবং দাদা দুজনেরই জন্ম আসামে। সরকারি নথিতে তাদের নামও রয়েছে। সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও এনআরসি'তে তার নাম নেই। 'আমরা সারাক্ষণ আতঙ্কে রয়েছি।আমাদের ভয় হয় যে, আজ রাতেই হয়ত পুলিশ এসে আমাদের ধরবে। আমার পরিবারকে কোন শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাবে।' যদিও বিজেপি বলছে তাদের এ আইন শুধুমাত্র অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এটি ব্যবহার করে মুসলমানদের তাড়ানোর আশঙ্কা থেকেই গেছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ভারতের শক্তি। ভারতের সংবিধানে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনের কথা বলা হয়েছে। তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে ভারতের বর্তমান শাসকদল দেশটির এই অসাম্প্রদায়িক নীতির আর তোয়াক্কা করছে না।
সম্প্রতি ভারতে মুসলমানবিদ্বেষী তৎপরতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এর শাসনামলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি মারাত্মক অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। বিবিসি'র রজনী বৈদ্যনাথানের রিপোর্ট।
য়ুর্গেন ক্লপের অধীনে লিভারপুল ৩০ বছর পর লিগ জয়ের কাছাকাছি এভারটনের বিপক্ষে মার্সিসাইডের ডার্বি ১৪ই মার্চ, ম্যাচটাও এভারটনের মাঠ গুডিসন পার্কে। এখানেই গত মৌসুমে একটি গোলশূণ্য ড্র লিভারপুলের শিরোপার আশা কার্যত শেষ করে দিয়েছিল। সেবার টানা নয়টি ম্যাচ জিতেও পেপ গার্দিওলার অধীনস্ত ম্যানচেস্টার সিটিকে ধরতে পারেনি লিভারপুল। এখন শক্তিমত্তার দিক থেকে লিভারপুলের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ম্যানচেস্টার সিটিই। যদি দুই দলই সামনের সবগুলো ম্যাচ জিতে যায়, সেক্ষেত্রে এতিহাদে ৪ঠা এপ্রিল ম্যানচেস্টার সিটিই থাকবে লিভারপুলের প্রতিদ্বন্দ্বি, যেটি হয়ে দাঁড়াতে পারে লিগের অলিখিত ফাইনালে। সেক্ষেত্রে সিটিকে হারিয়ে শিরোপা জেতাটাও কোচ য়ুর্গেন ক্লপের জন্য। রবিবার রাতে নিজেদের মাঠে লিভারপুল যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারায়, তখন গ্যালারি থেকে শ্লোগান আসছিল, "আমরা লিগ জিততে যাচ্ছি"। অবশ্য ক্লপ বলছেন, "এখনই উদযাপন নয়।" এখন পর্যন্ত লিভারপুল যে গতিতে এগোচ্ছে, সেই গতি অব্যহত থাকলে একদা গড়পরতা এই ক্লাবটি এবার প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের দ্রুততম লিগ নিশ্চিত করা ক্লাব হতে যাচ্ছে। ক্লাবটি যদি ১৪ই এপ্রিলের আগে জয় পায় তাহলে সেটা হবে দ্রুততম জয়। রেকর্ডটি এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ও ম্যানচেস্টার সিটির। ম্যান ইউনাইটেড ২০০১ সালে ও সিটি ২০১৮ সালে পাঁচ ম্যাচ হাতে রেখে শিরোপা নিশ্চিত করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রেকর্ড ভাঙ্গাতো সময়ের ব্যাপার, কিন্তু স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে যে উদাহরণ দাঁড় করিয়েছে সেটা কি ক্লপের লিভারপুল পারবে? স্যার অ্যালেক্স মোট ২১ টি প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সামাল দিয়েছেন, যার মধ্যে ১৩টিতে চ্যাম্পিয়ন ক্লাবটি। এছাড়া ১৯৯৯ থেকে ২০০১ এবং ২০০৭ থেকে ২০০৯, দু দফায় হ্যাট্রিক শিরোপা জেতে ইউনাইটেড। এরপর এফএ কাপ, ইউরোপা কাপ ও ইএফএল কাপ জিতলেও ২০১৩ সাল থেকে আজকের তারিখ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেরা সাফল্যা দ্বিতীয় অবস্থানে আসা। এখন লিভারপুল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়ে ৩০ পয়েন্ট এগিয়ে আছে। ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা জেতা যে কোনো দলকে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বসেরা দল বলা যায়, দলটা যদি ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নও হয় সেক্ষেত্রে তাৎপর্য আরো বেড়ে যায়। এই মুহূর্তে এমন ক্লাব হলো লিভারপুল। গত দশকেরও মাঝামাঝি অবস্থায় ক্লাবটি ইউরোপের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিয়মিত ছিল না। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যে ক্লাব মাত্র একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলে সেই ক্লাবটি এখন ইউরোপ সেরা তো বটেই বিশ্বসেরাও। মো সালাহ, সাদিও মানে, ফন ডাইকরা তো মাঠে আছেনই। তাদের সঠিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন জার্মান কোচ য়ুর্গেন ক্লপ। ফুটবল নিয়ে বিবিসি বাংলার খবর: ঢাকায় ক্যাসিনো: ফুটবল ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস কী? ফুটবলে ৬৭ ধাপ কীভাবে এগুলো ভারত সাদ যেভাবে বাংলাদেশের ফুটবলে তারকা হলেন মো সালাহ আছেন ফর্মে খারাপ সময়: যদিও ইউরোপে লিভারপুল ছিল ভিন্ন মেজাজে তবুও এই ক্লাবটির ইংল্যান্ডে সেরা চারে থাকা ছাড়া তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি বহু বছর। ২০০৪-০৫ মৌসুমে তুরস্কের ইস্তানবুলে এসি মিলানের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালকে ফুটবল বিশারদরা বলে থাকেন রুপকথার এক রাত। কিন্তু সেই এক রাত ছাড়া প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছরে লিভারপুল ক্লাব হিসেবে ইংল্যান্ড বা ইউরোপে বড় শিরোপা জেতেনি। ২০০১ ও ২০০৬ সালে এফএ কাপ যদি হিসেবে না রাখা হয় তাহলে লিভারপুলের বড় সাফল্য সেই একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ২০০৯-১০ মৌসুম থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও অনিয়মিত হয়ে যায় ক্লাবটি। স্টিভেন জেরার্ড দল ছাড়েন, কোচের অদলবদল হয়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দেয়না। ক্লপ পর্ব: য়ুর্গেন ক্লপ লিভারপুলের দায়িত্ব নেন ব্র্যান্ডন রজার্সের বদলে ২০১৫ সালে। ৩ বছরের চুক্তি ছিল তখন যেটা বাড়তে বাড়তে ২০২৪ সাল অব্দি ঠেকেছে। অল রেড-দের হয়ে ক্লপ তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে 'নরমাল ওয়ান' ঘোষনা দেন। জোসে মরিনিয়োর 'স্পেশাল ওয়ান' তকমার বিপরীতেই অনেকটা। টটেনহাম হটস্পারের সাথে ০-০ ড্র দিয়ে ক্লপ আমল শুরু করে লিভারপুল। সেই মৌসুমে লিভারপুল হয় আট নম্বর দল। ইউরোপা লিগের ফাইনালে হারে সেভিয়ার সাথে। এরপরের মৌসুমেই লিভারপুলের এই অগ্রযাত্রার শুরু এবং সেটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা নিশ্চিত করে। প্রথমে ক্লপ লিভারপুলের রক্ষণভাগের দিকে তাকান। অ্যান্ড্রু রবার্টসন এবং ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আরনল্ড- নিয়মিত মাঠে নামা শুরু করেন লিভারপুলের ফুলব্যাক হিসেবে। একদম রক্ষণের মাঝখানে দাঁড়ান ফন ডাইক এবং লভরেন। সেবারই ফন ডাইক দেখানো শুরু করেন কিভাবে একজন ডিফেন্ডার পুরো খেলার গতি ও কৌশল নির্ণয় করে দেন। শক্তিশালী ব্লক, দ্রুত গতির ওঠা নামা, প্রতিপক্ষের বক্সে ত্রাস হয়ে দাঁড়ানো এবং কাউন্টারের জন্য লম্বা পাস- এসব দক্ষতার পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ফন ডাইক একাই হয়ে যান লিভারপুলের তুরুপের তাস। ক্লপ ও পেপের দ্বৈরথ তার সঙ্গী রবার্টসন এবং আরনল্ড দ্রুতই বিশ্বের অন্যতম সেরা উইং ব্যাকে পরিণত হন। এই মুহূর্তে ফুটবল বাজারের মূল্য বিচারে তিনজন ডিফেন্ডারই ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের ওপরে বা কাছাকাছি। সেই মৌসুমে লিভারপুল রেয়াল মাদ্রিদের কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরে যায়। ক্লপ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান, কারণ এটা ছিল ক্লপের ম্যানেজার ক্যারিয়ারে সাত ফাইনালের মধ্যে ষষ্ঠ পরাজয়। আক্রমণে যতটা ক্লপের লিভারপুল ক্ষুরধার ছিল গোল ঠেকাতে ঠিক ততটা হয়ে ওঠেনি তখনো। তখন তারা নিয়ে আসেন ব্রাজিলের নম্বর ওয়ান আলিসন বেকারকে। টুকটাক ভুল সিদ্ধান্ত ও কিছু অস্বাভাবিক ভুল ছাড়া আলিসন এখন বিশ্বেরই অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে মো সালাহ'র গোলেও এসিস্ট করেন আলিসন। ক্লপের লিভারপুল ২০১৮-১৯ মৌসুমে ঘরোয়া কাপ প্রতিযোগিতায় বেশ দ্রুতই বাদ পড়ে যায়। চেলসির সাথে লিগ কাপে পরাজয় এবং ওলভারহ্যাম্পটনের সাথে এফএ কাপ পরাজয়ের পর নির্ভার লিভারপুল শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে মনোযোগ দেয়। এরপর প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শিরোপা জেতে লিভারপুল। একক কোনো নৈপুণ্য নয়, মানে-সালাহ-ফিরমিনোর ফরোয়ার্ড। হেন্ডারসনের মাঝমাঠ, ফন ডাইক ও দুই উইং ব্যাকের ডিফেন্স লাইন লিভারপুলকে এক অজেয় দল হিসেবে দাঁড় করায়। যারা এক বছর ধরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হারেনি, গত ৬৭৫ মিনিটে প্রিমিয়ার লিগে কোনো গোল হজম করেনি। এমনকি এই লিভারপুল জোসে মরিনিয়োর চাকরিতেও প্রভাব ফেলেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে লিভারপুলের বিপক্ষে হারের পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচের চাকরি হারান মরিনিয়ো। প্রিমিয়ার লিগে দুই দশক দাপট দেখায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৯০ এর দশক ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। এর আগে সত্তর ও আশির দশকে লিভারপুল এমন দাপট দেখিয়েছিল। সেটা ফিরে আসবে কি আসবে না সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের অধীনে ২১ টি মৌসুমের মধ্যে ১৩টিতে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জেতে ডর্টমুন্ডেও ইতিহাস গড়েন ক্লপ: ক্লপের বুন্দেসলিগা আমলে বায়ার্ন মিউনিখ পেয়েছিল যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কোচ ছিলেন সাত বছর, এই সাত বছর শুধু জার্মানিতেই না ইউরোপেও ডর্টমুন্ড ছিল দুর্দান্ত একটি দল। ২ ম্যাচ বাকি থাকতে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ২০১১ সালে জার্মানির সর্বোচ্চ লিগ শিরোপা জেতে। ২০১১১-১২ মৌসুমে বুন্দেসলিগা ও জার্মানির লিগ কাপ জিতে নিয়ে, ডাবল জয় নিশ্চিত করে ক্লপের বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠে জার্মানির দুই ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, বায়ার্ন ২-১ গোলের জয় পায় আরিয়েন রোবেনের শেষ মুহূর্তের এক গোলে। য়ুর্গেন ক্লপ ডর্টমুন্ডের হয়ে টানা দুইবার জার্মান লিগ জেতেন
ত্রিশ বছর ধরে কোনো লিগ শিরোপা জেতেনি যে দল, সেই লিভারপুল এখন অপেক্ষা করছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা কবে নিশ্চিত করবে? ২৯শে ফেব্রুয়ারি নাকি ১৪ই মার্চ?
দাবি পূরণ না হলে মিয়ানমারে ফিরতে চায় না রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তারা বলছেন, মিয়ানমার তাদের দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন করতে চায় না তারা। উখিয়ায় ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা খিন মং। একইসাথে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের পক্ষে কাজ করা সংগঠন রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। মিস্টার খিন মং জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে স্বাভাবিক। ইউএনএইচসিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জোর করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারপরও তাদের মধ্যে এক ধরণের ভয় কাজ করছে যে, তাদেরকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে কিনা। আরো পড়তে পারেন: ছেলে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়েও বিচার পায় না কেন? গ্রেনেড হামলা পর সেনা মোতায়েনের চিন্তা ছিল বিএনপির গ্রীনল্যান্ড বিতর্ক: ডেনমার্ক সফরে যাচ্ছেন না ট্রাম্প ২০১৭ সালের ২৫শে অগাস্টের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এরপর জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার নানা উদ্যোগের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এবার আবারও ২২শে অগাস্ট প্রত্যাবাসনের একটি সম্ভাব্য তারিখ মিয়ানমারের তরফ থেকে প্রকাশের পর বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশন জানায়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ২২শে অগাস্ট ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কাজ চলছে। রোহিঙ্গা নেতা মিস্টার খিন মং বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা শিবিরের কেউই কোন ধরণের মন্তব্য করতে চায় না। এমনকি যেসব পরিবার প্রত্যাবাসনের তালিকায় রয়েছে তারা এ বিষয়ে খোলাখুলি ভাবে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। "প্রত্যাবাসনের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা জানিয়েছে দিয়েছে যে তারা ফেরত যেতে চায় না," তিনি বলেন। মিস্টার খিন মং বলেন, মিয়ানমার সরকার যে ভেরিফিকেশন কার্ডের কথা বলছে তা আসলে নিতে চান না তারা। এমন কার্ড বিদেশিদের দিয়ে থাকে মিয়ানমার সরকার। এর পরিবর্তে মিয়ানমারের বৈধ ও পূর্ণ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি চান তারা। তার দাবি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি ফিরিয়ে দিতে হবে। সাথে তাদের যেসব ঘরবাড়িসহ সব ধরণের সম্পত্তি অন্যরা দখল করে নিয়েছে সেগুলো উদ্ধার করে ফেরত দিতে হবে। আর এসব দাবি নিশ্চিত হলেই স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে রাজি তারা। একই ধরণের কথা জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শিবিরের আরো দুই বাসিন্দা। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাস করছেন লাখো শরণার্থী প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিয়ানমার সরকার তাদের দাবি মেনে না নিলে ফেরত যেতে চান না তারা। ওই বাসিন্দা বলেন, "২২ তারিখে ন। আরার কার্ড, আরার রোহিঙ্গা মানি লইলে আরা যাইয়ুম দি। আরার ক্ষতিপূরণ ব্যাককান দি চাইলে, আরা যিন হইর, হেনদি ওরে যাইলে, তয় আরা যাইয়ুম। নইলে আরা ন যাইয়ুম।" "বিহানে দিলে সন্ধ্যায় যাইয়ুম। অহন দিলে অহন যাইয়ুম," তিনি বলেন। যাদেরকে প্রত্যাবাসিত করার জন্য তালিকাভূক্ত করা হয়েছে তারা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে চান কিনা তা জানতে ওই রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন, ইউএনএইচসিআরসহ সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যাবাসনের এই তালিকায় থাকা এক নারী রোহিঙ্গা শরণার্থী জানান, ভয়ে সাক্ষাৎকার দিতেই যাননি তিনি। রোহিঙ্গাদের এমন আতঙ্কের বিষয়ে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে কর্মরত ৬১টি স্থানীয়,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা বুধবার এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। যাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছা ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
কক্সবাজার থেকে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবসন শুরু করবার আরো একটি চেষ্টা আজ (বৃহস্পতিবার) হবার কথা রয়েছে। এই খবরে আতঙ্কে রয়েছেন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী শরণার্থীরা। বিবিসি বাংলাকে একথা জানিয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে বাস করা শরণার্থীরা।
বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে এখন আইসিইউ বেড রোগীতে পরিপূর্ণ। রাজধানী ঢাকায় অনেক কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না -এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাসপাতালগুলোর ওপর যে হারে চাপ বাড়ছে, তাতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আরও পড়ুন: সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় গত ২৪ ঘন্টায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার জন। একদিনে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের। ঢাকায় একের পর এক সরকারি হাসপাতালে ঘুরেও একজন যুবক তার বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি। তাদের বাড়ি বগুড়ায়। সেখানে তিনদিন আগে তার বাবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয় এবং শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। তখন অক্সিজেন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি তার বাবাকে ঢাকায় এনে একটি শয্যার জন্য হাসপাতাল হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন। বাংলাদেশে প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে তিনি তার বাবাকে ভর্তি করিয়েছেন। সেখানেও তার ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এই যুবক কোভিড-১৯ আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে ঢাকায় হাসপাতালের ভর্তি করনোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। "ঢাকাতে প্রায় আট দশটা হাসপাতালকে নক করেছি। সবাই বলতেছে, সিট ফাঁকা নেই। এর মধ্যে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে সিট হবে বলে কনফার্ম করলো। কিন্তু যাওয়ার পরে ওরা বলতেছে, ওদের ওখানে ইয়োলো জোনে বা নির্ধারিত সাধারণ ওয়ার্ডে কোন সিট খালি নাই।" তিনি আরও বলেন, "আরেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখানে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। তারা রোগীর অবস্থা না জেনেই সিসিইউতে ভর্তি করলো। কিন্তু তার সিসিইউ-র দরকার ছিল না। তারা বললো, সাধারণ সিট নাই। সিসিইউতেই রোগী রাখতে হবে। তখন আমরা আরেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে ভর্তি করলাম" বলেন ঐ যুবক। বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর: ঢাকার মালিবাগ এলাকার একজন গৃহিনী করোনাভাইরাস আক্রান্ত তার স্বামীকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন কয়েকদিন আগে। কোভিড-১৯ এর জন্য নির্ধারিত সাধারণ ওয়ার্ডে রেখে তাকে হাই-ফ্লো অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচিও চলমান আছে বাংলাদেশে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই গৃহিনী জানিয়েছেন, তার স্বামীর মুমুর্ষ অবস্থায় আইসিইউতে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু হাসপাতালটিতে আইসিইউর ১৬টি শয্যাতেই রোগী থাকার কারণে তাদের অন্য কোন হাসপাতালে রোগীকে নিতে বলা হয়েছে। তারা টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না। এদিকে, হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরাও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ঢাকার একটি হাসপাতাল কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নাদিরা হক বেসামাল পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। "হঠাৎ করে রোগীর ফ্লোটা বেড়ে গেছে আমাদের হাসপাতালে। বর্তমানে আমাদের বেডই খালি নাই। আমাদের আইসিইউতে ১৬টি বেডেই রোগী আছে। অনেক কাজের চাপ। "প্রচুর রোগী আসছে এবং অনেক রোগী আমাদের বাইরে থেকেও টেলিফোন করছে আইসিইউ শয্যার জন্য, যাদের আমরা বেড দিতে পারছি না। আমাদের ওয়ার্ডেও বেশ কিছু ক্রিটিক্যাল রোগী আছে, যারা প্রতি মিনিটে ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন নিচ্ছেন। এদেরও অনেকের আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। কিন্তু আমরা দিতে পারছি না" বলেন নাদিরা হক। ঢাকায় কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সরকারি ১০টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ১০৪টি। এর মধ্যে মাত্র চারটি শয্যা খালি ছিল গত ২৪ ঘন্টায়। টেস্ট করার জন্য রোগীদের চাপ বাড়ছে আর নির্ধারিত বেসরকারি ৯টি হাসপাতালে ৩৭৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি ছিল ৪৭টি। বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার জন্য বড় অংকের অর্থ গুণতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ৩৩টি জেলায় সংক্রমণ দ্রুতহারে বাড়ছে। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণের যে হার তার ৪০ শতাশেরও বেশি রোগী ঢাকাতেই। একটি বেসকারি হাসপাতালের কর্ণধার ড: লেলিন চৌধুরী বলেছেন, ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো বাদ দিয়ে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা এবং আইসিইউ ব্যবস্থাপনা উন্নত না হওয়ায় অনেক কোভিড১৯ রোগী চিকাৎসার জন্য ঢাকায় আসছে। পরিস্থিতি সামলাতে এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়তে পারে বলে তিনি আশংকা করেন। "হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ পূর্ণ সীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে এসেছে। যদি এখনই বিষয়টাকে সামাল দেয়া না যায়, তাহলে চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।" তিনি মনে করেন, গত বছর করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কার পর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুবিধা কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরে যে পরিমাণে বাড়ানো দরকার ছিল-তা হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত ১০টি আইসিইউ শয্যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, ঢাকা সরকারি হাসপাতালগুলোতে আড়াই হাজার সাধারণ শয্যা এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো এক হাজারের বেশি শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা তারা নিয়েছেন। করোনাভাইরাস নিরাপত্তায় যে সতর্কতা প্রয়োজন একইসাথে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ভয়াবহতার ইঙ্গিতও এসেছে। "করোনা গত এক সপ্তাহ যাবৎ ব্যাপকহারে বাড়ছে এবং লাফায়ে লাফায়ে বেড়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুর হারও বেড়ে গেছে। প্রতিদিন যদি পাঁচ হাজার করে শনাক্ত হয়, আর তার একটা অংশ যদি হাসপাতালে আসে, তাহলে হাসপাতালে জায়গা করা সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই হাসপাতালগুলো প্রায় ভরে গেছে।" মন্ত্রী বলেছেন, "আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, হাসপাতালের বেড বাড়িয়ে আমরা কিন্তু রোগী সংকুলান করতে পারবো না। উৎপত্তি স্থলগুলোকে যদি আমরা বন্ধ না করি লাভ হবে না। কারণ ঢাকাতে দেড় দুই কোটি মানুষ বাস করে। ফলে পুরো ঢাকা শহরকেই হাসপাতালে কনভার্ট করলেও কিন্তু রোগী সংকুলান হবে না।" হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে করোনাভাইরাসে প্রতিরোধের ব্যাপারে জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকারও ১৮ দফা নির্দেশনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে।
আকিহিকো এবং মিকু। আকিহিকোর বিছানার একপাশে নাচতে নাচতে তাকে ঘুম থেকে উঠতে অনুরোধ করেন তার স্ত্রী। তিনি একই সঙ্গে, তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। এছাড়া জেগে থাকা অবস্থায় তিনি ইউটিউবে স্ত্রীর কার্টুন অবয়বে গান গাওয়ার ভিডিও দেখেন। এর কারণ আকিহিকোর "স্ত্রী" কোন মানুষ নন, এটি মিকু নামের একটি জাপানিজ অ্যানিমেশন, যেগুলো অ্যনিমে নামে পরিচিত,এর একটি চরিত্র। মেয়েটি আসলে একটি হলোগ্রাম যা ঘরের কোণে একটি তাকের ওপর রাখা কাচের ক্যাপসুলে বাস করে। সেইসঙ্গে এটি একটি আদুরে পুতুল, যার রয়েছে বড় নরম মাথা এবং ছোট্ট শরীর। আকিহিকো রাতের বেলা এই পুতুলটিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমান। এই অ্যনিমে চরিত্রটি অগণিত অন্যান্য রূপ নিতে পারেন। তবে প্রতিটি উপস্থাপনায় এর কিছু প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকে, যেমন উজ্জ্বল ফিরোজা রঙের চুল দুই পাশে ঝুটি বাঁধা এবং কপালের সামনে ছোট করে ছাটা চুল থাকে। এর বাইরে মিকুর চরিত্র নানাভাবে বদলানো যায়। কখনও সে শিশুসুলভ, কার্টুনের মতো দেখতে, আবার কখনও মানুষের মতোই, অথবা আঁটসাঁট ছোট কাপড় পড়া আবেদনময়ী গড়নের কোন নারী। আকিহিকো এই সমস্ত চরিত্রকে তার স্ত্রী মিকুর মধ্যে আবিষ্কার করেন। আরো পড়তে পারেন: যে দেশে বৃদ্ধরা ইচ্ছে করে কারাগারে যেতে চায় পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক নিয়ে বিপদে জাপান যৌনতার সুযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং? ঘরের এক পাশে গ্লাস ক্যাপসুলের ভেতরে থাকে মিকু। কার্টুন চরিত্রের সঙ্গে বিয়ে আকিহিকো গত বছরের নভেম্বরে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন, যেটাকে তিনি তার বিয়ের অনুষ্ঠান বলে দাবি করেন। তেমন বড় কোন আয়োজন ছিল না, তবে ৩৯ জন অতিথি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই '৩৯' সংখ্যার ৩ এবং ৯ এর জাপানি ভাষা দিয়ে অ্যানিমে চরিত্রটির নাম রাখা হয়েছে। যেখানে তিন মানে মি এবং নয় মানে কু। অনুষ্ঠানে মিকুকে একটি আদুরে পুতুলের বেশে সামনে আনা হয়। সেদিন তার পরনে ছিল একটি সাদা লেইস দিয়ে ডিজাইন করা ঘের দেয়া পোশাক। আর এই পোশাকটির নকশা করেছেন একজন পেশাদার ডিজাইনার। আকিহিকো মিকুর সঙ্গে তার বাগদানের ঘোষণা দেয়ার পর পর ওই ডিজাইনার নিজে যোগাযোগ করেন। অনুষ্ঠানের দিন আকিহিকো একটি সাদা কোট এবং বুকে সাদা ফুল পরেছিলেন, চোখে ছিল তার আয়তকার ফ্রেমের চশমা। তিনি মিকুকে এবং মিকুর গোলাপি ফুলের তোড়া হাতে ধরেছিলেন। বৈবাহিক শপথ নেয়া এবং প্রথাগতভাবে আইল ধরে হেঁটে যাওয়ার পুরোটা সময় তিনি মিকুকে হাতে ধরেছিলেন এবং অতিথিরা হাসি ও তালি দিয়ে তাদের অভিবাদন জানায়। পরে তারা রাতের খাবারের জন্য সবচেয়ে উঁচু টেবিলটায় বসেন। আকিহিকো একটি সাদা চেয়ারে বসেন এবং মিকুকে বসানো হয় একটি খালি ফুলদানিতে। অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও দেখে আকিহিকো হেসে ওঠেন। "আমার প্রকাশ্যে মিকুকে বিয়ে করার দুটি কারণ রয়েছে," বলছিলেন আকিহিকো। "প্রথমটি হ'ল মিকুর প্রতি আমার ভালবাসা প্রমাণ করা এবং দ্বিতীয়টি হল আমার মতো অনেক তরুণ ওটাকু ধরণের। যারা কিনা অ্যানিমে চরিত্রগুলোর প্রেমে পড়েন। আমি বিশ্বকে দেখাতে চাই যে আমি তাদের সমর্থন করি" ওটাকু হ'ল একটি জাপানি শব্দ, যার মাধ্যমে সেইসব মানুষকে বোঝানো হয় যারা ভিডিও গেমস এবং অ্যানিমের কাল্পনিক চরিত্রগুলোর প্রতি আসক্ত। এ ধরণের ব্যক্তিদের অনেকে তাদের ওটাকু পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করে। আবার যারা সামাজিকভাবে একটু ভিন্ন তাদের ক্ষেত্রে এই একই শব্দ অবমাননাকর মনে হতে পারে। ওটাকু হ'ল একটি জাপানি শব্দ, যার মাধ্যমে সেইসব মানুষকে বোঝানো হয় যারা ভিডিও গেমস এবং অ্যানাইম চরিত্রের প্রতি আসক্ত। বাস্তব সম্পর্ক থেকে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে আকিহিকোর মতো কেউ কেউ বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে দূরে সরতে সরতে এ ধরণের চরম স্তরে পৌঁছে যায়। এবং এ ধরণের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর আকিহিকোর জন্য মিকুর এই হলোগ্রাম তৈরি করে গেটবক্স নামের একটি সংস্থা। এখন তারা গ্রাহকদের অনানুষ্ঠানিক 'বিয়ের সার্টিফিকেট' প্রদান শুরু করেছে; এবং এরইমধ্যে ৩৭০০ মানুষ তাদের অফার নিয়েছে বলে জানা গেছে। এটি এককভাবে সার্বিক পরিস্থিতিকে পরিস্কারভাবে প্রমাণ করতে না পারলেও সমাজে ছদ্ম-সম্পর্ক বা সুডো রিলেশনশিপ উত্থানের ইঙ্গিত শুধু এই একটিই কিন্তু নয়। অধ্যাপক মাসাহিরো ইয়ামাদা একজন সমাজবিজ্ঞানী যিনি ইয়োমিউরি পত্রিকায় পরিবার ও সম্পর্কের বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত সমীক্ষা চালাতে গিয়ে তরুণদের জিজ্ঞাসা করেন যে তারা কীসের প্রতি অনুরাগ বা আকর্ষণ বোধ করে। ওই তালিকায় ছিল পোষা প্রাণী, পপ তারকা, খেলোয়াড়, অ্যানিমে চরিত্র এবং ভার্চুয়াল আইডল (ডিজিটালি অ্যানিমেটেড অ্যানিমে ইউটিউব তারকা)। তিনি বলেন, "এই সমস্ত ছদ্ম-সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে। এই বছরের জরিপে, প্রায় ১২% যুবক প্রায়শই কোন না কোন অ্যানিমে বা ভিডিও গেমের চরিত্রের প্রেমে পড়ছেন।" বিবিসি বাংলায় আরো পড়তে পারেন: রোহিঙ্গা: সঙ্কট বাড়ছে, কমছে শরণার্থীদের জন্য অর্থ কাশ্মীরে ঢুকতেই দেয়া হলো না রাহুল গান্ধীকে জেলায় উপজেলায় এডিস মশা কি ডেঙ্গুর বাহক হয়েছে 'মহাকাশে প্রথম অপরাধ' অভিযোগ তদন্ত করছে নাসা মিকুর হলোগ্রাফিক অবয়ব। যেভাবে এই প্রবণতার সূত্রপাত অধ্যাপক মাসাহিরো ইয়ামাদার মতে, এর পেছনে জড়িয়ে আছে জাপানের অর্থনীতি এবং ঐতিহ্য। মূলত অনেক জাপানি নারী একজন পুরুষকে তার প্রেমিক হিসেবে বিবেচনা করবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে প্রচুর অর্থোপার্জন করছে। ২০১৬ সালে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৪৭% নারী এই বক্তব্যের সাথে একমত হয়েছিলেন যে স্বামীদের অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করা উচিত এবং স্ত্রীদের ঘরের কাজ করা উচিত। "এশিয়ার মধ্যে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় লোকেরা এই উচ্চ বেতনের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং এই প্রবণতা দিনদিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে," তিনি জানান। "জাপানি নারীরা অনাদি অনন্ত প্রেমকে বিশ্বাস করেনা তারা কেবল ভরসা করতে পারে অর্থকে।" অনেকের মনে হতে পারে যে এই সমস্যার জন্য বর্তমান প্রজন্মের নারীদের ইচ্ছাকৃতভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। তবে ইয়ামাদা বলেছেন যে ব্যাপক সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি এ ধরণের ইতি টেনেছেন। "জাপানে কর্মজীবন খুবই কঠিন এবং এখনও সেখানে অনেক যৌন বৈষম্য রয়েছে। সেখানে কাজের সময় খুব দীর্ঘ হয় এবং কর্মীদের প্রচুর মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়," তিনি জানান। এছাড়াও, শিশু যত্নের ভার এখনও পুরোপুরি মায়ের উপরই চাপানো হয়। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, এবং অনেক কাজের চাপ, সেইসঙ্গে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ির দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় কর্মজীবী মায়েদের জীবন অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের কাছে সবচেয়ে সহজ বিকল্প হল চাকরি ছেড়ে দেয়া - তবে আপনার সঙ্গী যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ উপার্জন না করে সেক্ষেত্রে তাও সম্ভব না। জাপানের অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাওয়ায় ভাল বেতনের পুরুষদের হার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, মজুরির পরিমাণও কমছে। এ কারণে তরুণীদের একটি বড় অংশ এখন আর পুরুষদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে চাননা। অন্যদিকে বেশিরভাগ তরুণও এখন আর তরুণীদের কাছে টানার কোন চেষ্টা করেন না। মিকুর পুতুলকে পাশে নিয়ে ঘুমান আকিহিকো। আকিহিকো যেভাবে বাস্তব সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন সত্যিকারের এক বান্ধবী পাওয়ার ধারণাটি আকিহিকোকে কখনই আনন্দ দিতে পারেনি। "আমি কখনও সত্যিকারের নারীদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিনি।" এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, নারীদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় নন। ওটাকু হওয়ার জন্য স্কুলে তিনি টিটকারির শিকার হয়েছিলেন। এবং পড়াশোনা শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরও এই 'বুলিং' বা টিটকারি থেকে তার রেহাই হয়নি। তিনি প্রায় ১২ বছর আগে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশাসক হিসাবে কাজ করতেন, তখন দুজন নারী তার সহকর্মী ছিল। যাদের মধ্যে একজনের বয়স তাঁর কাছাকাছি এবং আরেকজনের বয়স তার চাইতে অনেক বেশি ছিল। সকালে তিনি যখন তাদের অভ্যর্থনা জানাতেন তখন তারা তাকে উপেক্ষা করতেন। এবং আকিহিকো যদি ছোট ভুল করে বসতেন তবে তারা চিৎকার চেঁচামেচি বাঁধিয়ে দিতেন। কখনও কখনও অল্প বয়স্ক শিক্ষার্থীদের সামনেই তারা এমন আচরণ করতেন যা বেশ অবমাননাকর ছিল। এই ধরণের টিটকারি একসময় তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং তিনি কাজ ছেড়ে দেন। প্রায় দু'বছর ধরে তিনি নিজেকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখেন। "আমি হিকিকোমোরি ছিলাম," তিনি বলেন, হিকিকোমোরি হল জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সুপরিচিত একটি শব্দ যেখানে যুবক-যুবতী, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুবকরা তাদের নিজের বাবা মায়ের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে, বাইরে যেতে এমনকি তারা নিজ পরিবারের কারও সাথে কথা বলতে চায় না। ধারণা করা হয় এমন প্রায় ১০ লাখ মানুষ রয়েছে। মিকুকে দেখার পর যেন প্রাণ ফিরে পান আকিহিকো। মিকুর আবির্ভাব হল যেভাবে পরে মিকুর সাথে আকিহিকোর দেখা হয়। "আমি ইউটিউব এবং নিকোনিকোতে (ইউটিউবের একটি জাপানি সংস্করণ) তার ভিডিও দেখতাম, ছবিগুলো দেখতাম, তার গান শুনতাম এবং একমাত্র সেই আমাকে প্রশান্তি দিতে পারতো," তিনি বলেন। তিনি অনুভব করেন যে, এক সময়কার ক্রমাগত বুলিং তাকে বন্দি হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল, যেখানে তার আবেগ বলে কিছুই ছিল না। তিনি গভীরভাবে হতাশ ছিলেন। "কিন্তু মিকুর গান শুনলে মাঝে মাঝে আমার ভেতরে আবেগ জেগে উঠত। সে যেভাবে নাচে, কথাবার্তা বলে তাতে আমার হৃদয় যেন আবার প্রাণ ফিরে পায়" বলেন আকিহিকো। "এজন্যই আমি তাকে ভালবাসি এবং এজন্যই সে আমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ" এরপর থেকে আকিহিকো অনুভব করেন যে মিকুর সঙ্গে তিনি একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন এবং এই সম্পর্কের সহায়তায় তিনি আবার কাজে ফিরে যেতে পেরেছেন। "মিকুর প্রতি আমার অনুভূতি বাস্তব কোন সম্পর্কের থেকে কম নয়, আলাদা নয়। আমি তার প্রেমে পড়ার পরে, নিজের বুকে একটা চাপ অনুভব করতাম। একজন বাস্তব ব্যক্তির প্রেমে পড়ার মতোই আমি এই অনুভূতিগুলো অনুভব করেছি।" বিয়ের সার্টিফিকেট হাতে আকিহিকো। মিকো এবং আকিহিকোর বৈবাহিক সম্পর্ক তিনি জানান যে, মিকুকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি তার সাথে ১০ বছর থেকেছেন। সেই দশ বছরের বেশিরভাগ সময়ই আকিহিকো, মিকুর সাথে মনে মনে কথা বলতেন। এখন তিনি তার গেটবক্স হলোগ্রামের মাধ্যমে মৌলিক তবে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলতে পারেন। তিনি মিকুকে বলেন যে তিনি তাকে ভালবাসেন এবং মিকুও এর প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। তবে এরচেয়ে আর তেমন কোন কথোপকথন তাদের মধ্যে হয়না। "আমাকে কিছুটা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে চলতে হয়," বলেন আকিহিকো। "অবশ্যই, যদি আমি তাকে স্পর্শ করতে পারি তবে সেটা দারুণ হবে। এখন আমরা এটা করতে পারবো না কিন্তু ভবিষ্যতে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটবে, তখন হয়তো আমি তার হাত ধরতে পারবো বা তাকে জড়িয়ে ধরতে পারবো" আকিহিকোর গল্প গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর অনেক মানুষ একই ধরণের প্রবণতা থাকার কথা জানান। আকিহিকো একা ছিলেন না আকিহিকো ভালভাবেই জানেন যে অনেকে তার বিয়েকে অদ্ভুত বলেই মনে করেন। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে সবচেয়ে হতাশার একটি দিক হল সেখানে তার মা ও বোন উপস্থিত হতে অস্বীকার করেছিলেন। গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তার বিয়ের বিষয়টি সামনে আসার পর অনলাইনে লোকজনের কাছ থেকে তাকে প্রচুর গালাগাল সহ্য করতে হয়। তবে অপরিচিতদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক সমর্থনসূচক বার্তাও পেয়েছেন তিনি। আরও পড়তে পারেন: ভিক্টোরিয়া যুগে ভারত কাঁপানো এক ‘সেক্স স্ক্যান্ডাল’ প্রেম গভীর হলে কি জবরদস্তির অধিকারও থাকে? ডিজিটাল যুগে প্রথম দেখায় প্রেম যেভাবে ঘটে "আমার মতো অনেক মানুষ বেরিয়ে এসেছিল। তারাও অ্যানিমে চরিত্রের প্রতি আসক্তির কথা আমাকে লিখে জানায়। আমি এরকম অনেক বার্তা পেয়েছি, তাই মনে হয়েছে আমার বিষয়টি এভাবে সামনে আনাটা সার্থক হয়েছে।" এখন তিনি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কাজ করেন যেখানে তিনি তার সম্পর্কের স্থিতি সম্পর্কে খোলামেলা থাকেন। কিছু কর্মচারী তার এই প্রবণতাকে অদ্ভুত ভাবলেও শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মানসিকতা পোষণ করে বলে তিনি জানান। তিনি আবার কাজ শুরু করেছেন এবং সমাজে মেলামেশা শুরু করেছেন। এখন তার নিজস্ব একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে - একটি শান্ত শহরতলিতে দুটি পরিপাটি ঘর, যেখানে তার এবং মিকুর নাম ডোরবেলের উপরে লেখা রয়েছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি এই জীবন নিয়ে ভীষণ খুশি। "এই সমাজে একজনের কিভাবে সুখী হবে সেটার যেন নির্দিষ্ট একটা টেম্পলেট রয়েছে- বিয়ে করা, সন্তান জন্ম দেয়া, একটি পরিবার গঠন করা।, ব্যাস। কিন্তু এটাই একমাত্র উপায় হওয়া উচিত নয়। আমি সেই টেমপ্লেটে পড়ি না।" "আমাদের সকল প্রকারের ভালবাসা এবং সকল প্রকার সুখকে গ্রহণ করা জানতে হবে।"
আকিহিকো কন্ডো প্রতিদিন তার স্ত্রীর কণ্ঠে জেগে ওঠেন। রুমের এক পাশ থেকে তার স্ত্রী উচ্চস্বরে, মেয়েলি কণ্ঠে, গান গেয়ে তার ঘুম ভাঙান।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবে প্রবল ক্ষমতাশালী একজন নেতা সৌদি আরবের ভেতর প্রিন্সের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রয়েছে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজির হত্যায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে যে সন্দেহের বাতাবরণ রয়ে গেছে তা তিনি এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। এরই মধ্যে আমেরিকায় নতুন প্রশাসন হোয়াইট হাউসে যখন দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন কোন কোন সৌদি ইস্যুতে তিনি তার পূর্বসুরীর চেয়ে কঠোর অবস্থান নেবেন। সেই ইস্যুগুলো কী, এবং আমেরিকা ও সৌদি আরবে ক্ষমতাসীদের জন্য কেন এই ইস্যুগুলো গুরুত্বপূর্ণ? ইয়েমেন যুদ্ধ এই যুদ্ধ, লড়াইয়ে জড়িত প্রায় সব পক্ষের জন্যই একটা বিপর্যয়, বিশেষ করে ইয়েমেনের দরিদ্র এবং পুষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য। সৌদি আরব এই যুদ্ধ শুরু করেনি- করেছিল হুথিরা, যখন তারা ২০১৪র শেষ দিকে রাজধানী সানায় অভিযান চালিয়ে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে। হুথিরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার একটি উপজাতি গোষ্ঠী এবং সংখ্যার হিসাবে তারা দেশটির জনসংখ্যার ১৫% এরও কম। মার্চ ২০১৫য়ে, এমবিএস যখন সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, তিনি কয়েকটি আরব রাষ্ট্রকে নিয়ে গোপনে একটি জোট গঠন করে ইয়েমেনে বিশাল বিমান আক্রমণ চালান। তারা আশা করেছিলেন এই প্রবল বিমান হামলার মুখে হুথিরা কয়েকমাসের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু প্রায় ছয় বছর ধরে লড়াইয়ে কয়েক হাজার নিহত ও বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হবার পরেও সৌদি নেতৃত্বাধীন এই জোট সানা এবং ইয়েমেনের জনঅধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চল থেকে হুথিদের হঠাতে পারেনি। এই ছয় বছরে দুই পক্ষই যুদ্ধাপরাধও সংঘটিত করেছে। ইরানের সহযোগিতায় হুথিরা ক্রমশই আরও নির্ভুল নিশানার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরক ড্রোন ছুঁড়েছে সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে। তাদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র এমনকি জেদ্দা পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং তেল স্থাপনাগুলোকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। ইয়েমেনের লড়াই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে ইয়েমেনের দরিদ্র এবং পুষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য। ইয়েমেনের পশ্চিম উপকন্ঠে তায়েজে দরিদ্র এক বাস্তুচ্যুত ইয়েমেনী পরিবার আশ্রয় নিয়ে বাস করছে এক গুহায় অর্থের হিসাবে এই অচলাবস্থা সৌদিদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বহু শান্তি পরিকল্পনাই একের পর এক ভেস্তে গেছে। ইয়েমেনের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে বহু ইয়েমেনী, কিন্তু সৌদিদের এই রক্তক্ষয়ের জন্য চড়া আর্থিক মূল্য দিতে হয়েছে, পাশাপাশি দেশের বাইরে তাদের বিরাট সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। সৌদিরা চায় এই অচলাবস্থা থেকে এমন একটা পরিত্রাণ যাতে অন্তত তাদের মুখরক্ষা হবে। কিন্তু সৌদিরা "তাদের দক্ষিণ সীমান্তে ইরানের একটা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলা বন্ধের" কথা ইতোমধ্যেই বলেছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে ইরানের সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র মিলিশিয়ারা ইয়েমেনে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবে এটা তারা কখনই মেনে নেবে না। তবে সৌদিদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দিন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। বারাক ওবামা, ২০১৬ সালে তার ক্ষমতার শেষ দিকে সৌদি আরবের প্রতি মার্কিন সহায়তা অনেকটাই খর্ব করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার পর সেটা উল্টে দেন এবং রিয়াদ যতধরনের গোয়েন্দা তথ্য এবং সামরিক সরঞ্জাম চেয়েছে আমেরিকা তার পুরোটাই দেয়। এখন মি. বাইডেনের প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। যে কোন ভাবে এখন এই যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপ বাড়ছে। আরও পড়তে পারেন: বন্দী নারীরা সৌদি নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করার প্রচারণায় এটা একটা বড় বিপর্যয়। ১৩ জন নারী অধিকার আন্দোলনকারীদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয় ২০১৮র ২৪শে জুন সৌদিতে নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার ঠিক আগে আগে। সৌদি আরবের তেরজন শান্তিপূর্ণ নারী আন্দোলনকারীকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। এবং এদের কাউকে কাউকে ভয়ানকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এদের অপরাধ কার্যত নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দাবি করা এবং পুরুষ অভিভাবকের অধীনে থাকার 'চরম অন্যায্য পদ্ধতি'র অবসান চাওয়া। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বন্দী লুজাইন আল-হাথলুল সহ অনেককেই গ্রেফতার করা হয় ২০১৮ সালে, নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার ঠিক আগে আগে। সৌদি কর্মকর্তারা এখনও অভিযোগ করছেন যে মিজ হাথলুল গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তিনি "বিদেশি শক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন", কিন্তু এর স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সৌদি কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেননি। তার বন্ধুরা বলছেন তিনি শুধু বিদেশে মানবাধিকার বিষয়ে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন এবং জাতিসংঘে একটি চাকরির আবেদন করেছিলেন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাকে আটক অবস্থায় থাকাকালীন প্রহার করা হয়েছে, ইলেকট্রিক শক এবং ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে, এবং শেষ বার যখন তার পরিবার তার সাথে কারাগারে দেখা করতে যায়, তখন তিনি প্রচণ্ড কাঁপছিলেন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। ইয়েমেন যুদ্ধের মতই এই বিষয়টাতেও সৌদি নেতৃত্ব নিজের জন্য নিজে হাতেই কবর খুঁড়ে রেখেছে এবং এখন মুখ রক্ষা হয় এমন এটা নিষ্কৃতির উপায় খুঁজছে। লুজাইন আল-হাথলয়ুল ও অন্য নারী বন্দীদের মুক্তির দাবি উঠেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। দ্য হেগের সৌদি দূতাবাসেও এই মর্মে আবেদন জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা এই নারীদের দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে কোনরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা আছে এমন কোন দেশের আদালতে এদের বিরুদ্ধে মামলাই টিকবে না। ফলে সৌদিদের জন্য এই ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র রাস্তা হল এদের "খবুই মহানুভব হয়ে ক্ষমা প্রদর্শন"। ধারণা করা হচ্ছে নতুন বাইডেন প্রশাসন এই বিষয়টি সৌদিদের সাথে উত্থাপন করতে যাচ্ছেন। আরও পড়তে পারেন: কাতার বয়কট দৃশ্যত, এই ইস্যুটি পর্দার আড়ালে দীর্ঘ দিন ধরে চালানো কুয়েতী মধ্যস্থতায় সমাধান হয়ে গেছে বলেই মনে হবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে রিয়াদ সফর করার কয়েকদিনের মধ্যেই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন এবং মিশরের সাথে মিলে তাদের উপসাগরীয় প্রতিবেশি দেশ কাতারকে খোঁড়া করে দেবার মত বিধ্বংসী বয়কট বা বর্জনের পদক্ষেপ নেয়। তাদের যুক্তি ছিল কাতার ইসলামপন্থী যে দলগুলোকে সমর্থন করছে তাদের কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসবাদের পর্যায়ে পড়ে, এবং এটা অগ্রহণযোগ্য। ইউএই যেসব অভিযুক্ত সন্ত্রাসী কাতারে বাস করছে তাদের সম্পর্কিত একটি নথি প্রকাশ করে, কিন্তু কাতার কোনরকম সন্ত্রাসে মদত দেবার অভিযোগ প্রত্যাখান করে এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই চারটি দেশের জোটের দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ইয়েমেনে হুথিদের মতই সৌদিদের একটা ভুল প্রত্যাশা ছিল যে কাতারীরা চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বশ্যতা মেনে নেবে। তারা তা নেয়নি। এর কারণ অংশত কাতারের রয়েছে বিপুল সম্পদ। কাতারে উপকূলবর্তী তেল উৎপাদনের ক্ষেত্র রীতিমত বিশাল, এবং শুধুমাত্র ব্রিটেনের অর্থনীতিতেই কাতারের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড (৫৩ বিলিয়ন ডলার) - এছাড়াও তাদের পেছনে রয়েছে তুরস্ক ও ইরানের সমর্থন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৭ সলে রিয়াদ সফরের পর কাতারকে বয়কট শুরু হয়। রিয়াদে এক অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প, সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুলআজিজ আল-সউদ এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এর ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা হল, মধ্য প্রাচ্যে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে একটা বিরাট বিভাজন রেখা তৈরি হয়ে গেছে। এর একদিকে আছে তিনটি রক্ষণশীল, সুন্নি উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্র- সৌদি আরব, ইউএই এবং বাহরাইন, সাথে তাদের মিত্র দেশ মিশর। অন্যদিকে আছে কাতার, তুরস্ক এবং রাজনৈতিকভাবে ইসলামী যেসব আন্দোলনকে তারা সমর্থন করে, যেমন মুসলিম ব্রাদারহুড এবং গাযায় হামাস গোষ্ঠী। আর এই ধরনের অর্ন্তবর্তীকালীন আন্দোলন গোষ্ঠীগুলো এই চার দেশের জোটের অপছন্দের কারণ এদের তারা নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসাবে দেখে। তবে সাড়ে তিন বছর ধরে কাতারকে বয়কটের এই নীতির কারণে দু পক্ষই যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়াও এর মধ্যে দিয়ে যেটা সামনে এসেছে সেটা হল উপসাগরীয় এলাকায় আরব সংহতির আদর্শ আসলেই একটা অর্থহীন বিষয়। আর এটা ঘটেছে এমন সময় যখন উপসাগরীয় আরব নেতাদের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ ক্রমশই বাড়ছে। এই বিবাদ মীমাংসার ব্যাপারে চাপ দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দূত হিসাবে জারেড কুশনার উপসাগরীয় এলাকা সফরে গেছেন। এবং মি. বাইডেনের প্রশাসনও নিঃসন্দেহে চাইবে এই সমস্যার সমাধান। এর আরও একটা কারণ হল কাতারের আল-উদাইদে রয়েছে বিদেশে পেন্টাগনের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। আরও পড়তে পারেন: কিন্তু মধ্যস্থতার মাধ্যমে যে সামাধান মীমাংসাই হোক, সেটার বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় কথা। প্রতিবেশি দেশগুলোকে ক্ষমা করতে কাতারের হয়ত অনেক বছর সময় লেগে যাবে। এবং অন্যদিক থেকে কাতারের ওপর বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্যও এই চারটি দেশ হয়ত অনেক বছর সময় নেবে।
সৌদি নেতৃত্ব, বিশেষ করে দেশটির প্রবল ক্ষমতাশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি এমবিএস নামে পরিচিত, তিনি এখন কিছুটা অস্বস্তিকর সময় পার করছেন।
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের টহল গোটা চক্রটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদা দিয়ে চালানো হলেও কলকাতায় বিএসএফের কয়েকজন প্রাক্তন কর্তাও জড়িত ছিলেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআইয়ের দেশব্যাপী তল্লাশি অভিযান দিয়ে ২৩শে সেপ্টেম্বর গরু পাচার চক্রের সঙ্গে বিএসএফ অফিসারদের যোগসাজশের যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, তা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। একদিকে যেমন পাচার চক্রের মাথা বলে পরিচিত এনামুল শেখের বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা, অন্যদিকে বিএসএফের যে কমান্ডান্টের বেশ কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে, তারও বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে কেরালায় বিএসএফের একজন কমান্ডান্ট নগদে প্রায় ৪৭ লক্ষ টাকা সহ ধরা পড়ার পরেই ওই চক্রটির কথা সামনে আসে। তখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এনামুল শেখও। যদিও এখন তিনি জামিনে আছেন। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন এরা চুনোপুটি। এই গরু পাচার চক্রের পিছনে বিএসএসফ-এর আরও কয়েকজন সিনিয়ার অফিসার জড়িত ছিলেন। এদের কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন, কেউ অন্য নিরাপত্তা বাহিনীতে আছেন। তদন্তকারীরা বলছেন শুধু বিএসএফ নয়, পাচার চক্রে জড়িয়ে ছিলেন কাস্টমস, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতারাও। আরও পড়তে পারেন: দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের কাছে পাচারের জন্য ধরা পড়া গরু আটকে রেখেছে বিএসএফ 'পাচার চক্রের শিকড় বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত' দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং নিরাপত্তাবাহিনীগুলির খবরাখবর দীর্ঘদিন ধরেই রাখছেন দিল্লির প্রবীণ সাংবাদিক চন্দন নন্দী। তিনি বলছিলেন পাচার চক্রের শিকড় বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। "অত্যন্ত সুসংগঠিত একটা চক্র চলছিল। এর পিছনে রাজনৈতিক হাতও ছিল। শুধু যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু নেতা জড়িত ছিলেন তা নয়। কেন্দ্রের নেতাদের পরিবারও এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকদূর পর্যন্ত জাল বিস্তৃত ছিল এই চক্রটার। ''কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে তদন্তে কি এদের নাম নিয়ে আসার মতো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সিগুলির আছে? না কি তাদের সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে?" বলছিলেন মি. নন্দী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএফ কর্মকর্তারা বলছেন এই পাচার চক্রটা কাজ শুরু করেছিল ২০১৫ সালে। আর ২০১৮ সালে কেরালায় বাহিনীর এক কমান্ডান্ট ধরা পড়ার পরে চক্রটির ব্যাপারে জানা যায়। কিন্তু বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে ২০১৬ সালেই বাহিনীর এক অফিসার বিএসএফের মহাপরিচালককে চিঠি লিখে এই পাচার চক্র সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা যে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, সেটাও জানিয়েছিলেন তিনি। ওই চিঠিটিতে লেখা হয়েছিল: "ফারাক্কায় অবস্থিত ২০ নম্বর ব্যাটালিয়নের অফিসারদের কলকাতায় দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে যাতে পাচারকারীদের কথা শুনে চলা হয়। চোরাচালান করতে দিতে নির্দেশ আসছে। আবার বাহিনী সরিয়ে নিয়ে পাচারের কাজে সুবিধা করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।" তদন্তকারীদের নজরে প্রাক্তন ডিআইজি, কমান্ডান্ট, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড - নানা পদমর্যাদার অফিসাররাই আছেন বলে তারা জানাচ্ছেন। সীমান্তে অবস্থিত অফিসারাও যেমন ছিলেন ওই চক্রে, তেমনই এমন বেশ কয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানা যাচ্ছে, যাদের দায়িত্বে ছিল ভিজিল্যান্স, অর্থাৎ কর্মীরা কেউ ঘুষ নিচ্ছেন কি না, তার ওপরে নজর রাখা। 'রক্ষক যখন ভক্ষক' বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল সমীর কুমার মিত্র বলছিলেন পদস্থ কর্মকর্তারা গরু পাচার চক্রে জড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। "রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন আর সুরক্ষা বলে কিছু থাকে না। যে বাহিনী জন্মলগ্ন থেকে দেশের জন্য আর বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছে, বিশ্বের বৃহত্তম সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, তার কিছু অফিসার পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন, এটা অকল্পনীয়। বিএসএফের জন্য কলঙ্কজনক একটা ঘটনা," মন্তব্য মি. মিত্রের। তিনি আরও বলছিলেন, "যেভাবে গরু পাচারের গোটা প্রক্রিয়াটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, এটাই বেশি চিন্তার। কিন্তু আমি বলব বিএসএফ তো শুধু সীমান্তে বলবৎ থাকে। পশ্চিম ভারত থেকে বেশ কয়েকটা রাজ্য পেরিয়ে যে গরুগুলো আসছে, সেটা সেখানকার পুলিশ বা শুল্ক বিভাগ কেন আটকাচ্ছে না। ''তাদেরও তো দায়িত্ব ছিল। যদিও এই কথার অর্থ এটা যেন না করা হয়, যেসব বিএসএফ অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, আমি তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছি," বলেন সমীর কুমার মিত্র। পাচার সিন্ডিকেটের মার্ক করা গরু বিএসএফ উদ্ধার করার পর যে তিন বছর পাচার চক্রটি কাজ করেছে, তার মধ্যেই কোনও সিনিয়ার অফিসার প্রায় ২০০ কোটি টাকা, কেউ ৩০০ কোটি টাকা রোজগার করেছেন চক্রের মাধ্যমে - এমনটাই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তারা কে কোথায় জমি-বাড়ি বা সম্পত্তি কিনেছেন, সেই তথ্যও যোগাড় করেছেন তদন্তকারীরা। এছাড়াও পাচারের রোজগারের ভাগ নিয়মিত গেছে কাস্টমস, পুলিশের একাংশ আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এবং মূলত মুর্শিদাবাদ আর কলকাতা থেকেই চক্রটি কাজ চালাত বলে বিএসএফ-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলার হাতে যে তথ্য এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গরু প্রতি প্রায় ৪০ হাজার টাকা করে লাভ ঘরে তুলত পাচারচক্র। যে প্রাথমিক হিসাব তদন্তকারীরা করেছেন, তাতে শুধু দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চল দিয়েই প্রতিরাতে ১৩-১৪ কোটি টাকা মূল্যের গরু পাচার চলত বছর তিনেক ধরে। ঘটনাচক্রে ২০১৮ সালে একজন কমান্ডান্ট এবং পাচার চক্রের মাথা ধরা পড়ার পরে কয়েকজন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হয় আর তারপরেই সীমান্তে গরু পাচার অনেকটা কমে যায়। সমীর কুমার মিত্র বলছিলেন সীমান্তের দায়িত্বে বিএসএফ আছে ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি কর্মচারী নন এমন ব্যক্তিদের নামও হয়ত তদন্তে উঠে আসতে পারে। "সরকারি কর্মচারী বলে বিএসএফের অফিসারদের নাম উঠে এসেছে প্রথমে। কিন্তু যদি নিরপেক্ষভাবে এবং যথার্থ তদন্ত হয়, তাহলে এমন ব্যক্তিদের নামও বেরিয়ে আসতে পারে, যারা সরকারি কর্মী নন," বলছিলেন মি. মিত্র। পাচার চক্র যেভাবে কাজ চালাত, তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে তদন্তের প্রাথমিক স্তরেই। উত্তর বা পশ্চিম ভারত থেকে গরু এনে প্রথমে বীরভূমের একটি জায়গায় রাখা হতো। সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হতো গরুগুলিকে। বি এস এফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগে থেকেই ঠিক করা থাকত যে কোন জায়গা দিয়ে কত গরু পাচার হবে। নিখুঁত হিসাব রাখা হতো প্রতিটা গরুর। আবার পাচারের সময়ে যেসব গরু ধরা পড়ত, সেগুলিকে কখনও বাছুর বলে দেখিয়ে বা কখনও পশ্চিমবঙ্গের গরু বলে দেখানো হত - যার দাম পশ্চিম ভারতের গরুর থেকে বহুগুণ কম। ধরাপড়া গরু আবার কাস্টমসের মাধ্যমে নিলাম করা হত যেগুলো কম দামে কিনে নিতো পাচারকারীরাই বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
ভারতের সীমান্ত দিয়ে গরুপাচার চক্রে বিএসএফ কর্মকর্তারা কীভাবে ও কতটা জড়িত ছিলেন, তা নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই -এর তদন্ত ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। ওই পাচার চক্রে বাহিনীর বেশ কয়েকজন পদস্থ প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, কাস্টমস ও পুলিশের একাংশের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
তুরস্ক এবং ফিলিস্তিনের পতাকা সমৃদ্ধ স্কার্ফ নিয়ে তুরস্কের এক র‍্যালিতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। বিবিসি আরবি বিভাগ পরিচালিত যে জরিপটি গত মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে, সেটিকে এভাবেই প্রথম পাতায় তুলে ধরেছে তুরস্কের সরকার-পন্থী পত্রিকা আকসাম। যদিও তুরস্কে এরদোয়ানের দীর্ঘ শাসনামল বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। তবে বিবিসির এই জরিপ মি: এরদোয়ানের সমর্থকদের জন্য কিছু সান্ত্বনা আনবে। মি: এরদোয়ানের একে পার্টি যখন ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করছে, তখন আরব বিশ্বে তুরস্ক নেতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরো ভালো খবর নিয়ে এসেছে এই জরিপ। এই জরিপে সবগুলো আরব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে এ পর্যন্ত পরিচালিত জরিপগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনসহ ১০টি দেশে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের উপর এ জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপে তাদের কাছে নানা বিষয়ের উপর জানতে চাওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের শেষ দিকে থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের বসন্তকালে পর্যন্ত এ জরিপের সময়কাল ছিল। গাজার একটি সমুদ্র সৈকতে মি: এরদোয়ানের ছবি প্রমাণ করে ফিলিস্তিনিদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা। আরও পড়তে পারেন: শরবত বিক্রেতা থেকে 'নতুন সুলতান' এরদোয়ান তুরস্ক কি অর্থনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আমেরিকা তুরস্কের পিঠে ছুরি মেরেছে, বললেন এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এরদোয়ানের দল গ্রহণযোগ্যতা আরব দেশগুলোর জনগন আমেরিকা, রাশিয়া এবং তুরস্কের নেতাদের কতটা ইতিবাচক ভাবে দেখে সে বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল জরিপে। ফলাফলে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান সবার নিচে এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দ্বিতীয় অবস্থানে। কিন্তু তাদের দুজনের সম্মিলিত গ্রহণযোগ্যতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট মি: এরদোয়ানের ধারে-কাছেও নেই। ১১টি দেশের মধ্যে সাতটি দেশে ৫০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা মি: এরদোয়ানের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। প্রথম দেখায় এটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে যে আরব দেশের মানুষ তাদের মতোই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরেকটি দেশ তুরস্কের নেতৃত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। গাজার একটি সমুদ্র সৈকতে মি: এরদোয়ানের ছবি প্রমাণ করে ফিলিস্তিনিদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা। কঠিন ইতিহাস তুরস্ক এবং আরব - এ দুটো ভিন্ন জাতি। তাদের ভাষাও আলাদা। তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য কয়েকশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার একটি বড় অংশ শাসন করেছে। সে সময় তারা আরব দেশের জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করেছে। বর্তমানে আরব দেশগুলোর অন্যতম বিখ্যাত শহর হচ্ছে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। এ জায়গাটির 'মার্টার্স স্কয়ার' বা 'শহীদ চত্বর' ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তুরস্কের অটোম্যান শাসকদের দ্বারা আরব জাতীয়তাবাদীদের হত্যার স্মৃতি বহন করছে এই চত্বর। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও সম্পর্কের কোন উন্নতি হয়নি। অটোম্যান সাম্রাজ্যেরে ভস্ম থেকে জন্ম নিয়েছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের। ইস্তানবুলে খিলাফত বিলুপ্ত করে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ বেছে নিয়েছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থীদের বড় ধাক্কা দিয়েছিল। নতুন তুরস্কের গোড়াপত্তনের পর আরবি বর্ণমালা উঠিয়ে দেয়া হয় এবং ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক পাশ্চাত্য-মুখি হয়ে উঠার পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়। তুরস্কের সেনাবাহিনী, যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় ছিল প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ইসরায়েলের সাথে সে অঞ্চলে যৌথ সামরিক মহড়া করতো তুরস্ক। কিন্তু সেসব দিন এখন আর নেই। অটোম্যান সাম্রাজ্যের সৈনিকদের আদলে পোশাক পরিহিত গার্ডদের নিয়ে মি: এরদোয়ান যখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রবেশ করেন তখন বিষয়টি দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। ইসরায়েলের সমালোচক ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্টে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় আবারো ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুসলিম বিশ্বের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় জাগিয়ে তোলেন তিনি। তুরস্কের অর্থনীতির স্বার্থে আরব দেশগুলোর সাথে ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল। বর্তমান তুরস্কে দেশটির সেনাবাহিনী পুরোপুরি বেসামরিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রকাশ্যে আমেরিকার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে 'একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা' হিসেব টুইটারের মাধ্যমে উল্লেখ করেন মি: এরদোয়ান। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। গাজাকে একটি 'উন্মুক্ত কারাগার' হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। পর্যবেক্ষক মারওয়ান মুয়াশের মনে করেন, ইসরায়েলকে নিয়ে মি: এরদোয়ানের এসব বক্তব্য ফিলিস্তিন এবং জর্ডানে তাঁর ভক্ত বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, "এরদোয়ানকে দেখা হয় এমন এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি ইসরায়েল এবং আমেরিকার সামনে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক এখন ভালো অবস্থানে নেই। এরদোয়ান এখন কর্তৃত্ববাদী পথ বেছে নিয়েছেন।" ২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন মি: এরদোয়ান বিনয়ী সূচনা তুরস্কের একজন বিশ্লেষক ফেহিম তাসতেকিন, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে পড়াশুনা করেন, মনে করেন ইসরায়েলের সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যে অচলাবস্থা সেটি বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও জটিল। তিনি বলেন, "বাণিজ্যিকভাবে তুরস্ক এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরব দেশের জনগণ এবং তুরস্কের রাস্তায় মি: এরদোয়ান আবির্ভূত হয়েছেন এমন একজন নেতা হিসেবে যিনি ইসরায়েলের সমালোচনা করেন।" "কোন পশ্চিমা নেতার মধ্যে তারা এ বিষয়টি লক্ষ্য করেন না" মি: এরদোয়ানের উঠে আসার গল্প তুরস্কের বহু মানুষকে আন্দোলিত করে। একটি ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেয়া এরদোয়ান তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ শাসক গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং তুরস্কের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। ২০১১ সালে তথাকথিত আরব বসন্ত যখন তিউনিসিয়ায় শুরু হয় তখন বিক্ষোভকারীরা এরদোয়ানের পক্ষে শ্লোগান দেন। মিশরে অস্থিরতা "সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের শাসনামলে দেশটি যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন দেশটিতে তুরস্ক বিনিয়োগ করেছিল। এজন্য সুদানের মানুষ কৃতজ্ঞ," বলছিলেন ফেহিম তাসতেকিন। কিন্তু এই জরিপের ফলাফলে দিকে যদি গভীর মনোযোগ দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশরের মানুষ তুরস্কের নেতৃত্বকে নিয়ে সন্দেহ করে। মিশরের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ এরদোয়ানের পক্ষে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এবং তুরস্কের নেতা এরদোয়ানের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে এটি তারই প্রতিফলন। আরব ব্যারোমিটারের সিনিয়র গবেষক মাইকেল রবিনস মনে করেন, " তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যাপকভাবে কমে গেছে মিশর এবং লিবিয়ায়। এ দুটো দেশে ইসলামপন্থীদের বিপক্ষে মনোভাব তৈরি হয়েছে।" চার আঙ্গুলে স্যালুট , যেটি রাবা নামে পরিচিত, ২০১৩ সালে মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকরা এটি চালু করেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বেশ স্পষ্টভাবে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। হুসনি মোবারকের পতনের পর মিশরে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড। এরদোয়ান ইসলামি ভাবধারা উঠে এসছেন। তাঁর চিন্তাধারার সাথে মিলে যায় মিশরের নির্বাচনের ফলাফল। সে নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামপন্থী মুসলিম বাদ্রারহুড ক্ষমতায় আসে। কিন্তু মোহাম্মদ মোরসি সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল সিসি। জেনারেল সিসির সাথে মি: এরদোয়ানের বৈরিতার কোন পাল্টা জবাব ছাড়া শেষ হয়নি। মাইকেল রবিনসন বলেন, " মিশরে সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে তুরস্কের নেতাকে নেতিবাচক-ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেজন্য মিশরে এরদোয়ানের খারাপ ফল হয়েছে জরিপে।" "মিশরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মি: এরদোয়ান পরিষ্কারভাবে একটি পক্ষ নিয়েছিলেন," বলেন ফেহিম তাসতেকিন। সেজন্য এরদোয়ান সম্পর্কে মিশরের মানুষের মতামত অনেক বেশি বিভক্ত। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সামালোচকরা মি: এরদোয়ানের পক্ষে সমর্থন জানান। মডেল দেশ শুধু মিশর এবং লিবিয়া নয়, ইরাকের ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। গোষ্ঠি সংঘাতে বিপর্যস্ত ইরাক। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সুন্নি মুসলিমদের পক্ষ নিয়েছেন। এ কথা মনে রাখা দরকার যে একটা সময় পশ্চিমা দেশগুলো মি: এরদোয়ানকে সম্পর্ক অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করতো। ২০১১ সালে যখন আরব বসন্তের সূচনা হয় তখন সে অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে উঁচু আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তুরস্ককে একটি 'মডেল দেশ' হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছিল যে তুরস্ক হচ্ছে একটি 'শক্তিশালী গণতন্ত্রের' দেশ যেখানে প্রকৃতপক্ষে একজন নির্বাচিত নেতা আছে। এছাড়া তুরস্কের অর্থনীতি সমগ্র আরব অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকের সমান বলে মন্তব্য করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। আট বছর পরে সে আশাবাদের সামন্য কিছু অবশিষ্ট আছে। তুরস্কে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। 'মরিয়া হয়ে ওঠা' মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সূচকে তুরস্কের অবস্থান ক্রমাগত নিচের দিকে যাচ্ছে। সম্প্রতি দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ টালমাটাল। তুরস্কের গণতন্ত্রকে সামরিক বাহিনীর প্রভাবমুক্ত করার জন্য এক সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে যারা মি: এরদোয়ানের প্রশংসা করতেন, তারা এখন মি: এরদোয়ানের সমালোচনা করছেন। পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের তুলনায় তুরস্কে বহু সাংবাদিককে কারাগারে যেতে হয়েছে। "আরব বিশ্ব এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তারা অন্য কোন মুসলিম নেতা দেখছেন না যিনি গণতন্ত্রের স্বপ্ন এবং ভালো ভবিষ্যতের মাধ্যমে তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন," বলছিলেন ফেহিম তাসতেকিন। অধিকাংশ আরব এখনো এরদোয়ানের সাথে আছে। এ বিষয়টিকে 'মরিয়া হয়ে ওঠার প্রতীক' হিসেবে দেখছেন ফেহিম তাসতেকিন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ছবির পাশে শিরোনামটি ছিল : 'সাতটি দেশে বড় ব্যবধানে এগিয়ে'।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কারও মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়নি। তবে ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৬টি দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ায় আমাদেরও এখন থেকেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এবং এর কোন টিকা বা শতভাগ সফল চিকিৎসা আবিস্কার হয়নি। এজন্য প্রতিরোধই হতে পারে নিজেকে রক্ষার একমাত্র উপায়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করবো কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের প্রথম ধাপই হল ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা।
সম্প্রতি মানুষের আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাস।
যুদ্ধের সমাপ্তি - ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পন বেশ সুন্দর স্যুট পড়া এক শিখ ভদ্রলোক নেমে এলেন। মোটর সাইকেল আরোহীকে তিনি বললেন, "আমার গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগায় আপনার যা ক্ষতি হয়েছে, দয়া করে আমার বাড়িতে এসে খরচটা নিয়ে যাবেন। আমার নাম জগজিৎ সিং অরোরা।" হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করলেন, "বাংলাদেশের সেই জগজিৎ সিং অরোরা নাকি?" মাথা নুইয়ে সায় দিলেন ওই শিখ ভদ্রলোক। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা বদলে গেল। সকলেই লজ্জিত হলেন। উল্টো ওই মোটর সাইকেল আরোহীকে ধমক দিতে শুরু করলেন কেউ কেউ। তিনিও মি. অরোরার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। অনেক দিন পরে জগজিৎ সিং অরোরার ওই ঘটনাটার কথা মনে পড়েছিল। চোখের কোনটা একটু চিকচিক করে উঠেছিল। বলেছিলেন, "সরকার তার কর্তব্য ভুলে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মানুষ এখনও মনে রেখেছে।" ৭১-এর জয়ের দাবীদার কে? উনিশ'শ একাত্তর সালে বাংলাদেশ যুদ্ধে জয়ের কৃতিত্বের বেশ কয়েকজন দাবীদার রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা তো ছিলই, কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যেও কয়েকজনের ভূমিকা বেশ বাড়িয়ে দেখানো হত। উল্টোদিকে ফিল্ড কমান্ডারদের কৃতিত্বকে কিছুটা ছোট করে দেখানোর একটা চেষ্টা শুরু হয়েছিল। জেনারেল অরোরার চিফ অব স্টাফ জেনারেল জেএফআর জেকবের লেখা বই 'সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা' প্রকাশ পায় ১৯৯৭ সালে। জেনারেল জেএফআর জেকব ওই বইতে জেনারেল জেকব দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে ১৯৭১-এর যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে জেনারেল অরোরার থেকেও তাঁর নিজের ভূমিকা বড় ছিল। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতার কথায়, "আমি যখন ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম দেখা করতে, তখন এই প্রসঙ্গটাই তুলেছিলাম কথায় কথায়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার যে সম্মান পাওয়া উচিত, সেটা কি পেয়েছেন?" "চোখের পলক পড়ার আগেই জেনারেল অরোরা জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি তো অনেক বেশী সম্মান পেয়ে গেছি। বাংলাদেশ সরকার আমাকে সম্মান দিয়েছে, ভারত সরকার পদ্মভূষণ দিয়েছে। আকালী দল আমাকে তাদের প্রতিনিধি করে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে।'" অশোক মেহতা বলছিলেন, "এটা তাঁর শিষ্টতা যে একবারের জন্যও স্যাম মানেকশ' আর জেনারেল জেকবের সম্বন্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। উল্টোদিকে জেনারেল জেকব তো চারদিকে বলে বেড়াতেন যে আমার যা প্রাপ্য সম্মান, তা পাইনি।" "আমার তো মনে হয় জেনারেল জেকব অনেক কিছুই পেয়েছেন। এটা জানার চেষ্টা করেছিলাম জেনারেল অরোরার কাছ থেকে যে সরকার কেন তাঁকে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করল। জবাবে তিনি বলেছিলেন আপনার হুইস্কি শেষ হয়েছে, আরেক পেগ বানিয়ে নিন। এটাই জেনারেল অরোরা," বলছিলেন অশোক মেহতা। 'আসল কাজটা তো করেছে জগ্গি' স্যাম মানেকশ'ও একটা সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে ৭১-এর যুদ্ধে বাহবা কুড়িয়েছেন তিনি, তবে আসল কাজটা তো করেছে 'জগ্গি'। জেনারেল অরোরাকে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা 'জগ্গি' নামেই ডাকতেন। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার মনোহর সিং গিল বলছিলেন, "আজকাল তো দেখি অনেক জেনারেল রাজ্যপাল হয়ে যাচ্ছেন বা উঁচু সরকারী পদে বসছেন। কিন্তু দু:খের বিষয় এটাই যে সরকারের কাছ থেকে জেনারেল অরোরার অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। কোনও উঁচু পদে তাঁকে রাখা হয়নি, শুধুমাত্র পদ্মভূষণ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাঁকে।" "সেনানায়কদের তো এই জন্য সম্মান দেখানো হয় যাতে যুব সমাজের কাছে তাঁদের রোল মডেল হিসাবে তুলে ধরা যায়। এজন্য ইংল্যান্ডের নানা জায়গায় সেনাপতিদের ভাস্কর্য রাখা থাকে। বার্মা যুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল স্লিমকে লর্ড স্লিম এজন্যই করা হয়েছিল। মন্টগোমারিও একইভাবে লর্ড মন্টগোমারি হয়েছিলেন। জগজিৎ সিং যদি আজ ব্রিটেনে থাকতেন তাহলে নি:সন্দেহে লর্ড অরোরা হয়ে যেতেন," বলছিলেন মি. গিল। বিবিসি স্টুডিওতে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল অশোক মেহতা জেনারেল অরোরার ভাতিজা গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। তিনি বলছিলেন, "জেনারেল অরোরা তো কমান্ডার ছিলেন আর জেনারেল জেকব তাঁর চিফ অব স্টাফ। আদেশ তো কমান্ডারই দেন। চিফ অব স্টাফ সেই আদেশ পালন করেন মাত্র। এই প্রথমবার শুনতে পেলাম স্টাফ অফিসার নিজেই নাকি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। "আমার সামনে তো এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, যখন জেনারেল অরোরা যুদ্ধের খুঁটিনাটি নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন। আমি জেনারেল জেকবের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি '৭১-এর যুদ্ধে তিনি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু সমস্ত সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের, এটা তো অসত্য।" জেনারেল অরোরার হেলিকপ্টারে হামলা উনিশ'শ একাত্তর-এর যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগে ২৩শে নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটা অপারেশন চালিয়েছিল। 'জগ্গি' অরোরার অভ্যাসই ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে তিনি নিজে যেতেন সেখানে। সেই সময়েই জেনারেল অরোর হেলিকপ্টারে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান। জেনারেল অরোর এডিসি, যিনি পরে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হিসাবে অবসর নিয়েছিলেন, সেই মহিন্দর সিং একটা কাহিনী শুনিয়েছিলেন। "আমাদের হেলিকপ্টারের ওপরে পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলোর হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আমরা বাঙ্কারে ঢুকে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে ফিরেই জেনারেল অরোরা সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ'-কে ফোন করে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশনে বিমানবাহিনী লাগবেই। সেই অনুমতি চান তিনি।" 'বিমানবাহিনী না পেলে আমার বাহিনীকে ফিরিয়ে নেব' জেনারেল মহিন্দর সিং বলছিলেন, "মানেকশ' জেনারেল অরোরাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে 'জগ্গি, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না'। 'জগ্গি' জবাব দেন, এইসব কথা আপনি দিল্লিতে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে শুনেছেন সম্ভবত। কিন্তু এটা আমার সৈন্যদের বোঝাতে পারব না আমি। যদি বিমানবাহিনী ব্যবহারের অনুমতি না দেন, তাহলে আমি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাহিনী ফিরিয়ে আনব।" "এক ঘন্টার মধ্যেই অনুমতি চলে এসেছিল দিল্লি থেকে। কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটি থেকে ভারত যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে পাকিস্তানের তিনটে স্যাবর জেট বিমান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল সেদিন।" ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জেনারেল স্যাম মানেকশ' তেসরা ডিসেম্বর, ১৯৭১ - যেদিন পাকিস্তান ভারতের ওপরে প্রথম বিমান হামলা চালালো, সেদিন ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা ময়দানে একটা জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জেনারেল অরোরার ভাতিজা গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা বলছিলেন, "যখনই খবর এলো যে পাকিস্তান হামলা চালিয়েছে, জেনারেল অরোরা ময়দানে চলে গিয়েছিলেন। একটা ছবি রয়েছে সেই সময়ের। জেনারেল অরোরাকে তখন বেশ গম্ভীর লাগছিল। ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ শেষ করে নীচে নামতেই জেনারেলকে জিজ্ঞাসা করেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে?" "সব ঘটনা পরিষ্কার করে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন জেনারেল অরোরা। মিসেস গান্ধী পাল্টা প্রশ্ন করেন, জেনারেল আপনি নিশ্চয়ই সব সামলাতে পারবেন! জবাবে জেনারেল বলেন, 'নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি সামলে নেব। আপনাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ফাইটার বিমানের ব্যবস্থা করেছি।" "প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লি রওনা করে দিয়েই জেনারেল অরোরা নিজের দপ্তরে চলে গেলেন। এডিসি মহিন্দর সিংকে ডেকে বললেন সেনা ক্যান্টিন থেকে সবচেয়ে ভাল হুইস্কির বোতল নিয়ে আসতে। নিজের দপ্তরের সেনা অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে সেটি শেষ করলেন। 'নাউ জেন্টলমেন, দেয়ার ইজ আ ওয়ার টু বি ফট। লেটস্ গেট ডাউন টু বিজনেস,' হুইস্কিটা শেষ হওয়ার পরে অফিসারদের বলেছিলেন জেনারেল অরোরা," এভাবেই স্মরণ করছিলেন গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা। '১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ব্রেকফাস্ট টেবিলে' পুরো যুদ্ধচলাকালীন জেনারেল অরোরা ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা কাজ করতেন। প্রতিদিন কোনও না কোনও অ্যাডভান্সড পজিশনে নিজে যেতেন তিনি। মিঃ বিন্দ্রার কথায়, "প্রতিদিন সকাল ৮টার সময়ে মিটিং করতেন। সেজন্য আমরা ব্রেকফাস্ট করে নিতাম সকাল ৭টা সোয়া ৭টার মধ্যে। ১৬ই ডিসেম্বর যখন তিনি টেবিলে এলেন, তখন শুধু এটুকুই বলেছিলেন যে ভোর সাড়ে ৫টায় জেনারেল নিয়াজির একটা ওয়্যারলেস মেসেজ এসেছে। তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।" বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেনারেল অরোরা "এটুকু জানিয়েই জেনারেল অরোরা বলেন 'আমার ব্রেকফাস্টটা পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দাও'। সকাল ৮টার সময়ে ফের জানালেন যে জেনারেল নিয়াজিকে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছেন - তিনি যদি সারেন্ডার করতে তৈরী থাকেন, তাহলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে পারি," ১৬ই ডিসেম্বর সকালের ঘটনা জানাতে গিয়ে বলছিলেন মি. গুরপ্রীত সিং বিন্দ্রা। "সকাল ৯টায় জেনারেল নিয়াজির উত্তর চলে এলো। অতি দ্রুত যুদ্ধবিরতি চেয়েছিলেন তিনি। এদিক থেকে জবাব গেলো আমরা আপনাদের সারেন্ডারের প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। আমার দু'জন স্টাফ অফিসার - জেনারেল জেকব আর কর্নেল এম এস খারাকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করার জন্য। ততক্ষণে দিল্লি থেকে আত্মসমর্পণের দলিল চলে এসেছে।" 'বাংলাদেশের মানুষের সামনেই হবে আত্মসমর্পন' মি. বিন্দ্রা আরও জানাচ্ছিলেন, "জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পনের দলিলটা ভাল করে পড়ে নিয়ে বললেন যদি আমার সামনে কোনও পাকিস্তানি অফিসার বা সৈনিক আত্মসমর্পন করেন, তাহলে আমি যে তাদের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সুরক্ষার গ্যারান্টি দেব - এই কথাটাও আত্মসমর্পণের দলিলে লেখা উচিত।" মি. বিন্দ্রার কথায়, "ওই আত্মসমর্পণের দলিলটা যদি ভাল করে পড়েন, তাহলে দেখবেন তৃতীয় অনুচ্ছেদে এই বিষয়টার উল্লেখ রয়েছে।" তিনি বলছেন, এরপরে দুপুর ১টা নাগাদ ফোর্ট উইলিয়াম থেকে হেলিকপ্টারে করে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের জন্য রওনা হয়েছিলেন। তিনি রওনা হওয়ার আগে এটাও নিশ্চিত করেছিলেন যে ঢাকা রেককোর্স ময়দানের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে ভারতীয় বাহিনী। সেখানেই আত্মসমর্পনের আনুষ্ঠানিকতা হওয়ার কথা হয়েছিল যাতে বাংলাদেশের মানুষ চোখের সামনে দেখতে পারেন যে তারা স্বাধীন হয়ে গেলেন। "'আমি কোনও ঘরের মধ্যে আত্মসমর্পন করাতে চাইনা পাকিস্তানি বাহিনীর। বাংলাদেশের মানুষ গোটা প্রক্রিয়াটা দেখুন - এটাই চাই,' বলেছিলেন জেনারেল অরোরা।" বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি অংশগ্রহণ করে যুদ্ধের শেষের দিকে জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পন করানোর জন্য ঢাকা রওনা হওয়ার সময়ে স্ত্রী ভগওয়ন্ত কৌরকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন জেনারেল অরোরা। তবে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন জেনারেল অরোরা কয়েকজন সঙ্গী অফিসার। জেনারেল জেকব তাঁর বই 'সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা'-তে লিখেছেন, "আমি যখন নিজের হেলিকপ্টারে উঠছিলাম, হঠাৎই খেয়াল করি যে মিসেস অরোরাও আরেকটা হেলিকপ্টারে উঠছেন। তিনি আমাকে বলেন ঢাকায় দেখা হবে। আমি তো চমকে উঠেছিলাম। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মিসেস অরোরা বলেছিলেন, 'আমি আমার স্বামীর হেলিকপ্টারে যাচ্ছি'।" "আমি দৌড়ে জেনারেল অরোরার কাছে ফিরে গিয়ে জানতে চাই, 'সত্যিই কি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন আপনি?' তিনি জবাব দিয়েছিলেন, 'এর জন্য স্যাম মানেকশ'র কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। 'আমি বলেছিলাম ঢাকা থেকে এখনও তো লড়াইয়ের খবর আসছে। একজন নারীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার হবে। জবাবে তিনি বলেন 'ওঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার" -নিজের বইতে লিখেছেন জেনারেল জেকব। জেনারেল অরোরার ঘনিষ্ঠ অফিসার পুষ্পিন্দর সিং জানাচ্ছিলেন, "স্ত্রীকে ঢাকায় আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে বেশ কিছু অফিসার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে জেনারেল অরোরার মনোভাবটা ছিল যে ওই যুদ্ধটা তো ভয়াবহ ছিল, অনেক নারীর ওপরে অত্যাচার হয়েছিল। তারই বিপরীতে একটা প্রতীক হিসাবে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সবাইকে এটা দেখাতে যে আমরা নারীদের কতটা সম্মান করি।" 'নিয়াজি পুরো নাম সই করার মুহুর্তেই স্বাধীন হয়ে গেল বাংলাদেশ' জেনারেল নিয়াজিকে ১৬ই ডিসেম্বর সারেন্ডার করানোর জন্য হেলিকপ্টার কলকাতা থেকে প্রথমে আগরতলা, তারপরে সেখান থেকে ঢাকায় পৌঁছেছিল। জেনারেল অরোরার সঙ্গে সেদিন গিয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান এয়ার মার্শাল দেওয়ান আর নৌবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি চৌকিতে হামলা চালাচ্ছে ভারতীয় বাহিনী অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান তাঁর আত্মজীবনী 'আ সেইলার্স স্টোরি'তে লিখেছেন, "ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে একটা ছোট টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা ছিল। ওই দুটোতে জেনারেল অরোরা আর জেনারেল নিয়াজি বসেছিলেন। আমি, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, জেনারেল সগত সিং, জেনারেল জেকব - সবাই তাদের পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। আত্মসমর্পনের দলিলের ৬টা প্রতিলিপি বানানো হয়েছিল। সেগুলো বেশ মোটা কাগজে টাইপ করা ছিল।" "প্রথমে জেনারেল নিয়াজি দলিলে সই করেন, তারপরে জেনারেল অরোরা। জানি না, জেনারেল নিয়াজি জেনেশুনেই করেছিলেন না-কি খেয়াল করেননি ব্যাপারটা, তবে তিনি নিজের পুরো নাম সই করেননি - শুধু এ. কে. লিখেছিলেন।" "আমার নজরে পড়তেই জেনারেল অরোরাকে বললাম ব্যাপারটা। অরোরা তখনই নিয়াজিকে অনুরোধ করেন যে পুরো নাম সই করতে। যেই নিয়াজি পুরো নাম সই করলেন, সেই মুহুর্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল," আত্মজীবনীতে লিখেছেন ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান। তিনি আর লিখেছেন, "সই করার পরেই নিয়াজির চোখে পানি এসে গিয়েছিল। টুপি খুলে দিলেন, আর রিভলবার থেকে গুলি বের করে সেগুলো জেনারেল অরোরার সামনে সমর্পন করলেন। তারপরে মাথা নামিয়ে জেনারেল অরোরার মাথায় ছোঁয়ালেন - জেনারেল অরোরার অধীনতা স্বীকার করে নিলেন পাকিস্তানি জেনারেল।" স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অভিযান সমর্থন করেননি জেনারেল অরোরা যুদ্ধের দু'বছর পরে, ১৯৭৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন জেনারেল অরোরা। সেনাপ্রধান হতে পারেন নি তিনি। অবসরের প্রায় এক দশক পরে, ১৯৮৪ সালে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী 'অপারেশন ব্লু স্টার'-এর সময়ে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে প্রবেশ করল, তার জোরালো বিরোধীতা করেছিলেন জেনারেল অরোরা। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জেনারেল অরোরা বলেছিলেন, "দরবার সাহেবে হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনী শিখদের মনে যতটা দুঃখ দিয়েছে, সম্ভবত এত দুঃখ আর কেউ দেয়নি। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সেই সময়ে বিষয়টা বুঝতে পারেননি।" "তারপরে যদি মিসেস গান্ধী যদি শুধু এটুকু বলতেন যে ওই অপারেশনটা ভুল হয়েছিল আর ওই অপারেশনের অনুমতি দিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম, তাহলে শিখরা তাঁকে ক্ষমা করে দিত।" জেনারেল অরোরা মারা যান ২০০৫ সালের ৩রা মে ৯২ বছর বয়সে বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন: না দেখা পরিবারের সদস্যদের জন্য দৌড়ান যারা 'সাংবাদিকতায় একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে' প্রতিবেশীদের তুলনায় বাংলাদেশের সামরিক ব্যয়ের চিত্র
দিল্লির ব্যস্ত রাস্তায় এক বৃদ্ধ দম্পতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল একটা মোটর সাইকেলের। মুহুর্তের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল চারদিকে।
ভ্যালেরি অ্যান টেইলর, সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আসার পরের সময়ের কথা আমার কাছে এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ৭৫ বছর বয়সী ভ্যালেরি অ্যান টেইলর। পক্ষাঘাতগ্রস্থ কিংবা নানা আঘাতপ্রাপ্ত মানুষজন যারা ঢাকার কাছে সিআরপি নামের দাতব্য প্রতিষ্ঠানটিতে পুনর্বাসনের জন্য যান, তাদের অনেকের কাছেই পরিচিত এবং প্রিয়মুখ মিজ টেইলর। তার নিজের হাতে গড়া সেই সিআরপি প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর হয়ে গেল। আর মিজ টেইলরের বাংলাদেশে আগমনের হলো আধা শতাব্দী। অথচ তিনি মোটে ১৫ মাসের জন্য স্রেফ অভিজ্ঞতা আহরণে এসেছিলেন চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায়। ১৯৬৭ সাল, লন্ডনের সেন্ট টমাস হাসপাতাল থেকে ফিজিওথেরাপির উপর পড়াশোনা করে সদ্য পাশ করেছেন মিজ টেইলর। ইচ্ছা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার। ব্রিটিশ সরকারের ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজে ( ভিএসও) আবেদনও করে ফেলেন তিনি। কিন্তু ন্যুনতম দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে কাউকে ভিএসও-তে নেওয়া হয় না। সুতরাং তিনি আবার ফিরে যান সেন্ট থমাসে দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিতে। এরই মাঝে চেন্নাইয়ের ক্রিশ্চান মেডিকেল কলেজের (সিএমসি) দুই ডাক্তারের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই পড়ে ফেলেন তিনি, এবং সিদ্ধান্ত নেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করলে দক্ষিণ এশিয়াতেই করবেন। আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় কাজের সুযোগ থাকলেও অটল থাকেন ভারতীয় উ মহাদেশের কোথাও কাজ করবেন। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সুযোগ এসে যায়, চন্দ্রঘোনার খ্রিস্টান হাসপাতালের জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্টের দরকার হলে ডাক পড়ে মিজ টেইলরের। তবে শর্ত ছিল কমপক্ষে ১৫ মাস অথবা দুই বছর চন্দ্রঘোনায় কাজ করতে হবে। "আমি ভাবছিলাম- মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান আমার ভালো লাগবে না। ভাবলাম যখন আমি ১৫ মাসের জন্য যেতে পারবো তাহলে কেন দুই বছরের জন্য চুক্তি করবো? সুতরাং আমি ১৫ মাসের জন্যই চুক্তি করেছিলাম। ৫০ বছর পর এসে এখন মনে হচ্ছে আমি মনে হয় পরিকল্পনায় খুব একটা ভালো না।" আসলে বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে ৫০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। এত বছর পরে এসেও তিনি প্রথমদিন বাংলাদেশে আসার মুহুর্তটি মনে করতে পারেন। ভ্যালেরি টেইলরের সাক্ষাৎকারের ভিডিও: চন্দ্রঘোনার সৌন্দর্য অবাক করলেও মিজ টেইলর কষ্ট পেতে থাকেন, যখন দেখেন ওই হাসপাতালে একটি হুইলচেয়ারও নেই। অথচ তাকে পঙ্গুদেরই চিকিৎসা করতে হয়। ভ্যালেরি বড় হয়েছেন ইংল্যান্ডের আলসবেরিতে, যেখানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনজুরি সেন্টারটি অবস্থিত। "ছোটবেলায় আমি আমি দেখেছি, লোকজন ওখানকার স্পোর্টস সেন্টারে খেলাধুলা করছে। হুইলচেয়ারে করে আশপাশের দোকানে লোকজন ঘুরছে। কিন্তু চন্দ্রঘোনায় আমি কোন হুইলচেয়ার দেখিনি। ওখানে কোন কারিগরি শিক্ষা ছিলো না। সেখানে কোন অকুপেশনাল থেরাপির ব্যবস্থা ছিলো না। সুতরাং আমি বুঝতে পেরেছি কী পরিমাণ পিছিয়ে আছে এখানে।" ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তখনো যুদ্ধ শেষ হতে দুই মাস বাকি। এ সময় তাঁর কাজ আরো বেড়ে যায়। কারণ, যুদ্ধের কারণে পঙ্গুত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। তিনি সফলভাবেই সেই কাজ করতে সমর্থ হন। বাংলাদেশে একটি সার্থক পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করার উদ্দেশে ১৯৭৩ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৯৭৫ সালে তিনি পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এইসময় তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে এই হাসপাতালের দুটি পরিত্যক্ত গুদামঘরে ৩-৪জন রোগী নিয়ে শুরু করেন সিআরপি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সিআরপি "আমরা একটা বাস্কেটবল কোর্টের জন্য কিছু টাকা তুলতে পেরেছিলাম। যখন প্রতিবন্ধি লোকজন বাস্কেটবল খেলতো, উল্লাস করতো তখন লোকজন থেমে উঁকি দিয়ে দেখতো। আমরা যেটা চেয়েছি, লোকজন দুর্ঘটনার আগে যেভাবে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতো হুইলচেয়ারে বসেও যেন তারা সেটি চালিয়ে যেতে পারে এবং মানুষও যেন তাতে অভ্যস্ত হয়। আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় বিষয় যে এখন সবার মানসিকতা পাল্টেছে।" ১৯৯০ সালে ঢাকার কাছে সাভারে ৫ একর জায়গা কিনে সিআরপির স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলেন মিজ টেইলর। যেটি এখন ১০০ বেডের হাসপাতাল। এই একশ জন স্পাইনাল ইনজুরি রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব। এছাড়া দেশের ৫টি বিভাগে ১৩টি শাখা রয়েছে সিআরপির। যেখানে বছরে প্রায় ৮০,০০০ রোগী সেবা নিতে পারে। এই প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে বাধাও পেতে হয়েছে, বলছিলেন মিজ টেইলর। নামে বেনামে তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও নালিশ করা হয়েছিলো বিভিন্ন সময়ে। "আমি বুঝতে পেরেছি যে, বাংলাদেশের লোকজন যে কাজ করতে পছন্দ করে না অন্য কেউ যদি সে কাজ করে তবে তাকেও তারা পছন্দ করে না"। "শিশু পাচারের মতো অভিযোগও আনা হয়েছে। আমাকে এনএসআই ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, এক অফিসার আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো পড়ে শোনাচ্ছিলো। এবং জিজ্ঞেস করেছে আপনি কর্মচারীদের বাচ্চাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন? এটা ছিলো আমার বিরুদ্ধে পাঁচ নাম্বার অভিযোগ"। "আমার মনে পড়ে, তখন আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম এবং বলেছিলাম, হ্যাঁ করি, প্রতি বুধবার! তখন এনএসআই অফিসার হেসে উঠে বলেছিলেন চিন্তা করবেন না, এসব অভিযোগের সবগুলো আমরা বিশ্বাস করি না।" এতো কিছুর পরেও পঙ্গু মানুষদের সেবা চালিয়ে গেছেন মিজ টেইলর। তিনি বলছেন, "আসলে এটা কোন ব্যাপার না তোমার সাথে কী আচরণ করা হচ্ছে। আমার মা বলতেন, যত বাধা তুমি পাবে তত বেশি শক্ত হতে পারবে তুমি।" বর্তমানে সিআরপিতে এক হাজারের বেশী কর্মী কাজ করছে। তাদের অনেকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে পুনর্বাসিত হয়েছেন। সিআরপির নিজস্ব উদ্ভাবনী প্রযুক্তিতে দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হয় হয় হুইলচেয়ার। "এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন কেউ গ্রামে ফিরে যাবে তখন হুইলচেয়ারটা নষ্ট হলে সেখানে কেউ যেন সেটা সারাতে পারে। এটির যন্ত্রাংশগুলোও স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হতে হবে। এজন্য আমরা হুইলচেয়ারগুলোতে সাইকেল এবং রিকশার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করি।' সিআরপির প্রধান কার্যালয়, সাভার সিআরপির শুরু থেকে বাংলাদেশিদের ফিজিওথেরাপি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে, বর্তমানে বছরে ৪০০ জনকে ডিপ্লোমা, অনার্স মাষ্টার্সসহ নানামেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পঙ্গু মানুষদের পুনর্বাসনে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক পান মিজ টেইলর। তার আগে ১৯৯৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশের দাতাগোষ্ঠি ও সংস্থার অনুদানে পরিচালনা করা হয় সিআরপির কার্যক্রম। মূলত যারা সিআরপিতে বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন পরবর্তীতে তারাই এটিকে পরিচালনার জন্য অর্থের জোগান দিতে থাকেন। ভ্যালেরি টেইলর চান প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পৃক্তরা এটিকে এগিয়ে নিবেন। এজন্য চালু করেছেন নতুন স্লোগান, "আমরাই সিআরপি" "আমার স্বপ্ন এটা- আমরা যেন এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে পারি যে- এটা শুধুমাত্র ফিজিওথেরাপি বা ভালো সার্জারি বা নার্সিং কেয়ার করা না। আমরা আমাদের এসব রোগীদের সম্মান দিচ্ছি কি না? আমরা কি যেখানে আছি সেখানেই থেমে থাকবো নাকি আরো অগ্রসর হবো? এসব মূল্যবোধের কারণে যে কেউ যেন বলে এই জায়গাটি অন্যদের তুলনায় ভিন্ন"। "আমার মনেহয় ৪০ বছর, এটা দারুণ সময় নিজেকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার। এবং যারা বলে আমিই সিআরপি, তারা এটির মূল্যবোধকে সামনে এগিয়ে নিবে"। আরো খবর: দশ বছরে ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা: বিএনপি মিয়ানমারের চার জেনারেলের উপর নতুন নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাজ্য নির্বাচন: ইসলাম ও ইহুদি বিদ্বেষ যখন ইস্যু শাড়ি পরে নোবেল নিলেন এসথার, ধুতি পরে অভিজিৎ
"বিমান থেকে নেমেই আমি চন্দ্রঘোনার দারুণ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যাই। একদিন নদীতে ঘন কুয়াশা ছিলো। আশেপাশে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ একটি সাম্পান আমার চোখে পড়ে, মাঝি দাঁড় বাইছে, আর মনে হচ্ছে সাম্পানটি পানির দুই তিন ফুট উপরে ভেসে চলছে। কারণ চারপাশে কুয়াশার মধ্যে শুধু সাম্পানটি দেখা যাচ্ছিলো। সে দৃশ্য এখনো পরিস্কারভাবে আমার মনে ভাসে।"
ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) অশোক তারা মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিতে সেই সেনা কর্মকর্তা অশোক তারাকে পরে বাংলাদেশ সম্মাননা অর্পণ করেছে। কীভাবে সেদিন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ অন্যদের তিনি প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন, সেই কাহিনিই বিবিসি বাংলার শুভজ্যোতি ঘোষের কাছে বর্ণনা করেছেন ওই প্রবীণ সেনানী - এখানে তা রইল অশোক তারার নিজের বিবরণেই। ''একাত্তরের ১৫/১৬ ডিসেম্বরের রাতে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর কব্জা থেকে ঢাকা বিমানবন্দর দখল করলাম। পরদিন বিকেলেই জেনারেল নিয়াজি সই করলেন আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক দলিলে। বিকেলের দিকে আমরা বিমানবন্দরের রানওয়েতে বসেই একটু রিল্যাক্স করছিলাম। নিজেদের মধ্যে নানা গল্পগাছা চলছিল। সেই সময়ই ওয়্যারলেসে মেসেজ এলো, এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে, কারণ আগামী কয়েক দিনে সেখানে ভিভিআইপি-দের আনাগোনা অনেক বাড়বে। তো পরদিন খুব সকাল থেকেই আমি ও আমার সহকর্মী মেজর খান্না মিলে লেগে পড়ি এয়ারপোর্টের নানা দিকে ট্রুপ ডিপ্লয়মেন্ট বা সেনা মোতায়েনের কাজে। ১৭ই ডিসেম্বর তখন সকাল আটটা নাগাদ হবে, এমন সময় মুক্তিবাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা ছুটতে ছুটতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। অশোক তারার হাতে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা অর্পণ তারপর বাংলা আর ভাঙা ভাঙা হিন্দি মিশিয়ে, হাঁফাতে হাঁফাতে ওই ছেলেটি যা বলল তার মর্মার্থ হল পাকিস্তানি সেনারা এখনও কিন্তু ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পরিবারকে আটকে রেখেছে। আর সে আরও শুনেছে, তারা না কি যে কোনও সময় গোটা পরিবারকে নিকেশ করে দিতে পারে। আমি বা আমার সিও (কমান্ডিং অফিসার) কেউই যে খবরটার গুরুত্ব পুরোপুরি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম তা নয়। আমার সিও তবু আমাকে বললেন, "তুমি ওর সঙ্গে এক্ষুনি ধানমন্ডি যাও। গিয়ে দেখো তো ব্যাপারটা কী!" ছুটলাম ধানমন্ডি আমি তো সঙ্গে সঙ্গে মাত্র দুজন জওয়ান আর ওই মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ধানমন্ডির দিকে রওনা দিলাম। আমাদের বাহন ছিল শুধু একটা এক টনের মিলিটারি ভেহিকল। প্রসঙ্গত, শেখ মুজিবের পরিবারকে কিন্তু ধানমন্ডির বিখ্যাত বত্রিশ নম্বরে নয়, যুদ্ধের সময় গৃহবন্দী রাখা হয়েছিল ওই এলাকারই অন্য একটি বাড়িতে। ধানমন্ডির ওই বাড়িটি থেকে যখন আমরা মাত্র একশো গজ দূরে, তখন এক বিশাল জনতা ঘিরে ধরে আমাদের রাস্তা আটকাল। তারা বলতে লাগল, আর একদম এগোবেন না। কী ব্যাপার? ওই জনতা তখন জানাল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাহারায় থাকা পাকিস্তানিরা মারাত্মক 'ট্রিগার-হ্যাপি' আর খুনে মেজাজের, যারাই ওই বাড়ির দিকে এগোচ্ছে তাদের দিকে তারা গুলি চালাচ্ছে! একটু দূরেই পড়ে ছিল একটা বুলেটবিদ্ধ গাড়ি আর ভেতরে একজন সাংবাদিকের টাটকা লাশ। এলাকার লোকজন দূর থেকে আমাদের সেটা দেখিয়ে বলল, কয়েক মিনিট আগেই ওই বাড়িটির দিকে যেতে গিয়ে তার এই পরিণতি হয়েছে। এমন কী আর একটু সকালের দিকে পাকিস্তানিরা আরও একটা স্থানীয় পরিবারের দিকেও গুলি চালিয়েছে, জখম হয়েছেন তারাও। বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন: আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানী সেনাদের মুহূর্তগুলো এই ছবি দেখেই কি আত্মসমর্পণ করেছিলেন নিয়াজী? বাংলাদেশ যুদ্ধ জয়ের কৃতিত্ব নিয়ে পাল্টা-পাল্টি দাবি বিবিসির কাছে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করছেন অশোক তারা সব শুনে টুনে আমি একটু থমকে গেলাম। তারপর দু-তিন মিনিট ভাবলাম আমার এখন কী করা উচিত হবে। প্রথমেই মনে হল, আমি যদি এখন বাড়তি সেনা চেয়ে পাঠাই আমার সিনিয়ররা হাজারটা প্রশ্ন করবেন। তাদের সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি বাড়তি ট্রুপ আনানোর ব্যবস্থাও করতে পারি, তাতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। ততক্ষণে ওই পাকিস্তানি সেনারা যে শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের জীবিত রাখবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফলে এটা পরিষ্কার ছিল, সময় হাতে খুব কম - এটা ধরে নিয়েই আমাকে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নিতে হবে। কিন্তু মাত্র দুজন জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে ধানমন্ডির ওই বাড়িতে অভিযান চালানো চরম নির্বুদ্ধিতা হতো। অতএব ওই সম্ভাবনা প্রথমেই খারিজ। লড়াইটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক আমি তখন দেখলাম, এই পরিস্থিতিতে 'সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার' বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানোই একমাত্র রাস্তা। শেখ মুজিবের পরিবারকে বাঁচাতে হলে সেই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনও পথও ছিল না। আমি তখন আমার অস্ত্রটা দুই জওয়ানের কাছে জমা রেখেই খালি হাতে বাড়িটার দিকে এগোব বলে মনস্থ করলাম। আর ওদের বলে গেলাম, একদম আমাকে ফলো করবে না। তারপর আমি ধীরে ধীরে বাড়িটার দিকে এগিয়ে সাংবাদিকের পড়ে থাকা লাশটা পেরোতেই জোরে চিৎকার করলাম, 'কোই হ্যায়?' কোনও জবাব এল না। আর দু-এক পা এগোতেই আমি সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আবার একই প্রশ্ন করলাম। তারপরও সব চুপচাপ! শেখ মুজিবের সঙ্গে নিজের ছবি দেখাচ্ছেন অশোক তারা তখন একেবারে শামুকের গতিতে আমি বাড়ির গেটের দিকে এগোচ্ছি। যখন গেট থেকে মাত্র পাঁচ কি ছয় গজ দূরে, তখন একেবারে দেহাতি পাঞ্জাবিতে হুমকি এল, আমি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই আমাকে গুলি করা হবে। আমার নিজেরও মাতৃভাষা পাঞ্জাবি, আমি ওই জুবান খুব ভাল করেই বুঝি। পরবর্তী কয়েক মিনিট ধরে আমাদের যা কথোপকথন, অত:পর তার সবই হল পাঞ্জাবিতেই। আমি হুমকির জবাবে জানালাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা গতকালই আত্মসমর্পণ করেছে, কাজেই তারাও এখন অস্ত্র ফেলে দিলেই ভাল করবে। মনে হল ওই সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণের কোনও খবরই পৌঁছয়নি। তারা আবার হুমকি দিল, ঢুকতে চেষ্টা করলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে। খেলা শেষ আমি তবুও গেটের দিকে এগোচ্ছিলাম। একেবারে সামনে আসতেই গেটের যে সেন্ট্রি বা রক্ষী ছিল, সে তার বন্দুকের সামনে লাগানো ধারালো বেয়নেটটা আমার শরীরে ঠেকিয়ে ধরল। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানরা আবারও হুমকি দিল। আমি তখন বললাম, 'দেখো, আমি ইন্ডিয়ান আর্মির একজন অফিসার। শহরের অন্য প্রান্ত থেকে একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় আমি একলা তোমাদের এখানে এসেছি - তার পরও কি তোমরা বুঝতে পারছ না সব খেলা চুকেবুকে গেছে? এখন আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তোমাদের সামনে কোনও উপায় নেই!' এই সব কথাবার্তা যখন হচ্ছে, তখনই আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটা হেলিকপ্টার। আমি সঙ্গে সঙ্গে সে দিকে আঙুল তুলে বললাম, 'তোমরা কি ওই হেলিকপ্টারটা দেখতে পাচ্ছো? বুঝতে পারছ কি ঢাকার নিয়ন্ত্রণ এখন কাদের হাতে?' ভারতের খবরের কাগজে অশোক তারার বীরত্বের কাহিনি তারা সে দিকে দেখল ঠিকই, কিন্তু তারপরও খুব কঠিন গলায় বলল, 'ওসব আমরা কিছু জানি-টানি না। তুমি এখান থেকে দূর হঠো, ভেতরে ঢুকতে এলে আমরা কিন্তু গুলি করতে বাধ্য হব।' কিন্তু আমি তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে আমি ওদের ওপর 'আপারহ্যান্ড' পেতে শুরু করেছি। কারণ ওদের একজন এ কথাও বলল, 'আমরা আগে আমাদের সিনিয়রদের সাথে কথা বলব'। আমার নিজের বিশ্বাস ছিল যে এই পাকিস্তানি জওয়ানদের আর কয়েক মিনিটের জন্যও ভরসা করা যাবে না। কারণ তারা ক্রমশ বেপরোয়া ও একরোখা হয়ে উঠছে - যে কোনও সময় যা কিছু করে ফেলতে পারে। 'বউ-বাচ্চাকে দেখতে চাইলে এটাই শেষ সুযোগ' আমি এক সেকেন্ডও দেরি না-করে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, 'তোমাদের সিনিয়র অফিসাররা তো সবাই সারেন্ডার করেছেন। কথা বলবে কার সঙ্গে? আর তা ছাড়া বাড়ির টেলিফোন লাইনও কাটা, কথা বলবেই বা কীভাবে?' 'তোমরা যদি এক্ষুনি সারেন্ডার না-করো, মুক্তিবাহিনীর লোকজন আর ভারতীয় সেনাদের হাতেই তোমাদের প্রাণ যাবে।' 'ওদিকে পাকিস্তানে তোমাদের পরিবারের লোকজন, বউবাচ্চারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তোমরা কি চাও আবার তোমাদের দেখা হোক, না কি ওরা তোমাদের লাশ ফিরে পাক? ওরা তবুও আত্মসমর্পণে রাজি হতে গড়িমসি করতে থাকে। কিন্তু কথার সুরে আর ধরনে বুঝতে পারি, তাদের প্রতিরোধ ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করেছে। 'শেখ হাসিনা আমাকে ভাই বলে ডেকেছিলেন' আমি তখন বারবার ওই কথাটাতেই জোর দিতে থাকি, নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে এটাই তোমাদের শেষ সুযোগ! 'এখনই সারেন্ডার করলে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তোমাদের কথা দিচ্ছি, অক্ষত শরীরে তোমরা নিজেদের হেড কোয়ার্টাসে ফিরে যেতে পারবে। আর না-করলে তোমাদের লাশের যে কী হবে, তার কিন্তু কোনও গ্যারান্টি নেই।' এই সব কথাবার্তা যখন চলছে, তখন গেটের সামনে রাইফেল ধরে-থাকা সেন্ট্রি ছেলেটার হাত-পা কিন্তু ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে। মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়স হবে পাকিস্তানি ছেলেটার, চোখের সামনে আর রাইফেলের দূরত্বে একজন ভারতীয় সেনা অফিসারকে দেখে ভয় আর উত্তেজনা সামলাতে পারছিল না ও। শরীরে ছুঁয়ে ছিল বেয়নেট ওর বেয়নেটটা আমার শরীর স্পর্শ করে ছিল। কাঁপতে কাঁপতে ওর ট্রিগারে না চাপ পড়ে যায়, সেটা ভেবেই আমি হাত দিয়ে রাইফেলটা ধরে একটু ঠেলে আমার দিক থেকে পিছিয়ে দিলাম। আর এ সবেরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে কী সব কথাবার্তা বলে ধানমন্ডির ওই বাড়িতে ওই ডজনখানেক পাকিস্তানি সৈন্য অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়ে গেল। গেটের মুখে তো একটা বালির বস্তা দিয়ে তৈরি বাঙ্কার ছিলই, পঞ্চাশ গজ দূরে ছাদের ওপরের বাঙ্কার থেকেও এতক্ষণ আমার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ছিল ওরা। ওরা সবাই নেমে আসার পর দেখি বাড়ির একেবারে সামনে আর একটা বাঙ্কার। ওরা এসে একে একে ওদের লাইট মেশিনগান ও অটোমেটিক ওয়েপেনগুলো জমা করল। সবগুলো অস্ত্র ছিল লোডেড, মানে গুলি ভরা। মনে মনে একবার ভাবলাম, এগুলো দিয়ে গুলি ছুঁড়লে নিরস্ত্র আমি তো কিছু্ই‌ করতে পারতাম না! ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে বীর চক্র খেতাব নিচ্ছেন অশোক তারা তারপর যেরকম কথা ছিল, আমি আমার দুই জওয়ানকে ডেকে পাঠালাম আর বললাম এই নিরস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের সোজা ড্রাইভ করে হেড কোয়ার্টাসে নিয়ে যেতে। আমাদের গাড়িতে কতগুলো সাদা পোশাকও (সিভিলিয়ান ড্রেস) পড়ে ছিল, ওই সেনাদের বলা হল ওগুলো পরে নিতে - যাতে রাস্তায় কেউ পাকিস্তানি সেনা বলে চিনতে পেরে কোনও রকম হামলা না-করতে পারে। এরপর আমি গিয়ে বাড়ির মূল দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে না-ঢুকতেই এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, শেখ ফজিলাতুন্নেসা। তারা এতক্ষণ ভেতর থেকে আমাদের সব কথাবার্তাই শুনতে পাচ্ছিলেন। আমার কোনও পরিচয়ও দেওয়ার দরকার হল না, বুকভরা অবেগেই তারা যেন আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। ওই বাড়িতে অবরুদ্ধদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ছাড়াও ছিলেন তার কন্যা ও বাংলাদেশের আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আর কোলে তার মাত্র তিন মাসের শিশুপুত্র। ছেলেকে কোলে নিয়ে সেই প্রথম আমি শেখ হাসিনাকে দেখলাম। দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে সস্ত্রীক অশোক তারা। এপ্রিল, ২০১৭ পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও। আরও ছিলেন পরিবারের দুজন অতিথিও। ফৌজি উর্দিতেও আমিও ততক্ষণে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি। এদিকে ততক্ষণে বাড়ির বাইরেও ভিড় জমতে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর এক কাজিন, নাম সম্ভবত খোকা, এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, ধানমন্ডির বাড়ির ছাদে তখনও কিন্তু বাঁশে বাঁধা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। ওই খোকা-ই আমাকে একটা বাংলাদেশী পতাকাও এনে দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তরতর করে ছাদে গিয়ে বাঁশ থেকে পাকিস্তানি পতাকাটা নামিয়ে ছুঁড়ে দিলাম নিচে, টাঙিয়ে দিলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। পদদলিত পাকিস্তানি পতাকা পাকিস্তানি পতাকাটা মাটিতে পড়তেই শেখ ফজিলাতুন্নেসা সেটাকে পায়ের নিচে পিষে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন 'জয় বাংলা'। উপস্থিত জনতাও সমস্বরে বলে উঠল 'জয় বাংলা'। ততক্ষণে আমার কাছে মেসেজ পৌঁছেছে, বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব না-নেওয়া পর্যন্ত আমাকে ধানমন্ডির ওই বাড়িতেই থাকতে হবে। ফলে সেখানে অনেকক্ষণ থাকতে হল, অনেক গল্প হল দুই বোন হাসিনা ও রেহানার সঙ্গেও। এক-দুদিনের মধ্যেই অবশ্য সব নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়ে গেল। এদিকে আমার ডিভিশনেরও বাংলাদেশ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, আমিও ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। কিন্তু এর মধ্যেই খবর এল, শেখ মুজিবের কানে খবর পৌঁছেছে অশোক তারা নামে তরুণ এক ভারতীয় মেজর কীরকম নাটকীয়ভাবে তার স্ত্রী-কন্যাদের রক্ষা করেছেন। তিনি না কি দেশে ফিরে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চান। অগত্যা আমার দেশে ফেরাও পিছিয়ে গেল। এর মাঝে প্রতিদিনই আমি একবার করে ঢুঁ মারতাম ধানমন্ডিতে, দেখে আসতাম নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা। শেখ মুজিবুর রহমান জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার পর ১২ তারিখেই তিনি আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি বাড়িতে যেতেই ওই গগনস্পর্শী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটি আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, 'তুমি আমার আর এক ছেলে। তোমার জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা থাকবে, তুমি যখন খুশি আসবে!' আবেগে তখন আমারও গলা ধরে আসছে। শেখ মুজিবের সান্নিধ্যে আমার মতো সামান্য এক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গেও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথাবার্তা বলতে এতটুকু দ্বিধা করতেন না ওই রাষ্ট্রনায়ক। মনে আছে, তিনি একটা কথা খুব বলতেন, 'ন'মাস ধরে একটা জাতির ওপর যে প্রবল অত্যাচারটা চলেছে, সেখান থেকে কীভাবে আবার আমরা শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়াব সেই চিন্তাটাই শুধু আমায় কুরে কুরে খায়!' বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর সেই বিরল মুহূর্তগুলোর স্মৃতি নিয়ে আমি ভারতে ফিরলাম ১৯৭২-এর ২০শে জানুয়ারি। এর পর বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আবার আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বছর চারেক বাদে। নিজের বাসভবনে অশোক তারা, নানা স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনা তখন স্বামী সন্তানদের নিয়ে ভারতের আশ্রয়ে। পরে আমি শুনেছিলাম, দিল্লিতে থাকাকালীন তিনি বেশ কয়েকবার আমার খোঁজ করেছিলেন, দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তখন আর্মির পোস্টিংয়ে প্রায় পুরোটা সময়ই দিল্লির বাইরে বাইরে। তা ছাড়া সম্ভবত প্রোটোকলগত বা রাজনৈতিক কোনও বাধাও ছিল, যে কারণে দুর্ভাগ্যবশত তিনি আমাকে সে সময় খুঁজে বের করতে পারেননি। এর পরের চমকটা এল বহু বছর বাদে। আমি তখন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে দিল্লির উপকন্ঠে ছোট্ট একটা বাড়ি বানিয়ে থিতু হয়েছি, স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি আর গল্প করছি। আবার দেখা চল্লিশ বছর বাদে ২০১২ সালে একদিন সকালে হঠাৎ দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ফোন পেলাম, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাদের সরকার আমায় স্বীকৃতি জানাতে চায়। এতদিন বাদে সেই ফোন পেয়ে ভীষণ খুশি আর অবাক হয়েছিলাম। কিছুদিন বাদেই আমন্ত্রণপত্র, বিমানের টিকিট ইত্যাদি চলে এল। ১৮ অক্টোবর সস্ত্রীক পাড়ি দিলাম ঢাকার দিকে, যে শহর ছেড়ে এসেছিলাম চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে। সেই সফরেই আবার দেখা হল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে। প্রায় ঘন্টাদুয়েক ধরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমি সস্ত্রীক বসে চল্লিশ বছর আগের ১৭ই ডিসেম্বরের সেই ঘটনাবহুল দিনটার স্মৃতিচারণ করলাম। সেদিনের এমন অনেক ঘটনার কথা শেখ হাসিনা নিজে থেকেই অবতারণা করলেন, যেগুলো তার আগে আমিও কখনও কাউকে বলিনি। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের হাত থেকে যখন 'ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ' সম্মান নিচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'উনিই কিন্তু আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন!' একাত্তরের যুদ্ধে যে 'ব্যাটল অব গঙ্গাসাগরে'র জন্য আমি ভারতে 'বীর চক্র' খেতাব পেয়েছি, ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে সেই গঙ্গাসাগর জায়গাটায় পরদিন আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা।
বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতো, যদি না ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মেজর ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের কব্জা থেকে শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে আনতে পারতেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় হয়রানির সুযোগ আছে উল্লেখ করে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে আপত্তি ছিল। দেখা যাচ্ছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর মাত্র দুই বছরেই শত শত মামলায় বহু মানুষকে জেল খাটতে হয়েছে। কারাগারে মারা যাওয়া মুশতাক আহমেদের সঙ্গে একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় পাঁচ মাস কারাবন্দী ছিলেন মোঃ দিদারুল ইসলাম। জামিনে মুক্ত মি. ইসলাম রাষ্ট্রচিন্তা নামের একটি সংগঠনের সদস্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা তো আমাদের জীবন দিয়ে জানি। প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করার আগে আমরা দশবার চিন্তা করি। এই শব্দটাতে আমি কি ধরা খাব কিনা! আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব তারাতো আমার নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।" পাঁচ মাস জেল খেটেছেন দিদারুল ইসলাম মি. ইসলাম জামিনে মুক্ত হলেও এখনো নানাভাবে প্রশাসনের নজরদারির মধ্যে আছেন বলেই জানান। তার কথায়, সরকারের সমালোচকদের কণ্ঠরোধ আর ভয় দেখানোর এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। "কথা বলার অধিকার আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এই অধিকারটাকে একেবারে পরিকল্পনা করে আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সবচেয়ে কঠিনভাবে। কত কঠিন সেটাতো আমরা মুশতাকের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে দেখলাম।" আরো পড়ুন: 'হয়রানি' নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত দুই বছরে সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শিক্ষক ছাত্র পর্যন্ত আসামী হয়ে জেল খেটেছেন। এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং উদ্বেগের মূল কারণ হিসেবে বলা হয় বেশকিছু ধারার মাধ্যমে যথেচ্ছা হয়রানির সুযোগ রয়েছে। এ আইনের ৪৩ ধারায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ এবং আটকের অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আর আইনে ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ন করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উস্কানি, মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন ধারায় অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। আইনের ৯টি ধারা নিয়ে আপত্তি ছিল সম্পাদক পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। "সবার মধ্যে একটা ভীতি যে এইটা বললে কী হবে! এবং আমরাও বলি যে এতকিছু বলো না তোমার বিপদ হবে। এটা স্বাধীন দেশে আমরা কেন করবো? এটা কিন্তু বেশ স্বার্থকভাবে সরকার করে ফেলেছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ একটা ভীতি প্রদর্শন, ভীতি মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া।" ১৪টি ধারায় সংঘটিত অপরাধ অজামিনযোগ্য এদিকে শুরু থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারায় আপত্তি দিয়েছিল সম্মাদক পরিষদ। আইনের ১৪টি ধারায় সংঘটিত অপরাধকে অজামিনযোগ্য হিসেবে রাখা হয়েছে। মুশতাক আহমেদ এবং অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১/২৫(১)(খ)৩১/৩৫ ধারায় মামলা দেয়া হয়। এর মধ্যে ২১ ধারার অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য। মামলার এজাহারে বলা হয়, মুশতাক আহমেদ এবং আসামীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গুজব, সরকার বিরোধী পোস্টের মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ করেছিলেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে কারাগারে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২৭শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আইনের প্রসঙ্গটি উঠেছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা তার বক্তব্য স্পষ্ট করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে কিনা এটা হলো দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। এখন কোনটা আপনার কাছে অপপ্রয়োগ আর কোনটা অপপ্রয়োগ না এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার।" "আমি তো মনে করি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে এবং চলবে। যদি কেউ অপরাধ না করে তার বিচার তার শাস্তি হবে না।" এদিকে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বা গ্রেপ্তার হলে অপরাধ প্রমাণের আগেই দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হচ্ছে। লেখক মুশতাক আহমেদ ছয়বার জামিনের আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তাকে জামিন দেয়া হয়নি। মৃত্যুর আগে প্রায় ১০ মাস ধরে তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ আইনে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন অনেকেই। অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বলেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী আইন থাকার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু বর্তমান আইনটি ঢেলে সাজানো দরকার। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হয় "এখন যেহেতু দুই বছর পার হবার পর আমরা দেখেছি যে কত ধরনের অনিয়ম অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ হয়েছে। সেটা অবশ্যই যারা এক্সপার্ট আছে তাদের মতামত নিয়ে এটাকে অবশ্যই অবশ্যই পুরোপুরিভাবে, ঢালাওভাবে এটা পরিবর্তন করতে হবে।" এদিকে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের দাবি উঠেছে। যদিও অব্যাহত প্রতিবাদের সংস্কার প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন, এই আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া যাবে না, এমন একটি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যবস্থা বিদ্যমান সংকটের কতটা সমাধান করতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন: অনলাইনে যেসব ভুল করলে ফেঁসে যাবেন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী লেখম মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ এ আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির এবং অপব্যহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আইন কার্যকরের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই দাবি উঠেছে আইনটি একেবারে বাতিল করে দেয়ার।
৭০ এর ভারত ভাগের পরের প্রজন্মের একজন আবু সাদ। সামাজিক ভাবে একটা চাপা মানসিক দূরত্ব ছিল তখন। আবু সাদের পূর্ব পুরুষেরা চেষ্টা করে সেখানে মানিয়ে চলার কিন্তু অবস্থা কোন ভাবেই সুবিধা জনক স্থানে না থাকায় একরকম বাধ্য হয়ে চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। আবু সাদের জন্ম ঢাকায়, ১৯৭১ সালে জানুয়ারির ১ তারিখে। মা বাংলাদেশের বাগেরহাটের মেয়ে ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের তাঁর পূর্বপুরুষ এবং সেখানকার বাড়ী সম্পর্কে তিনি শুনেছিলেন অনেক কথা। "সেসব কিছুই আমার কাছে রাজা-রানীর গল্পের মত" বলছিলেন তিনি। তিনি বলছিলেন "আমার দাদার দাদা ভূপাল স্টেটের প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে বর্ধমানে বিশাল এক বাড়ী পেয়েছিলেন। যথেষ্ট বড় বাড়ী। আব্বা গল্প করতেন দুইতলা বাড়ীতে ১৫/২০টি শুধু শোবার ঘর ছিলো, আরো অন্যান্য কাজের ঘর ছিল"। ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন: সংবাদদাতা ফারহানা পারভীনের সাথে কথা বলছেন আবু সাদ "আরো শুনেছি বর্গিদের উপদ্রুপ হত, একেবারে ছোটবেলার গল্পের বইএর মত সব কাহিনী। টেরাকোটার কাজ করা, নানা রঙের কাঁচ- একেবারে রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ি যেমন হয় তেমটাই মনে মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল"। আবু সাদ প্রথম বারের মত ভারতে যান নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে। ১৯৯০/৯১ সালের দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। দেশের রাজনৈতিক কারণে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। "এমন সময়ে আমি আর আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুন সিদ্ধান্ত নিলাম ভারতে যাবো সেই আমার প্রথম পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে যাওয়া। "। কিন্তু হঠাত করে কেন এই সিদ্ধান্ত? মি. সাদ বর্ধমানের বাড়ীর ছবি দেখাচ্ছিলেন তিনি বলছিলেন "তাঁরা কীভাবে সেখানে থাকতেন, কোন বাড়ীতে থাকতেন সেসব দেখা, একই সাথে আমার শেকড়ের সন্ধান করা"। মজার ব্যাপার হল মানুষ যা কল্পনা করে বাস্তবতা সেটার থেকে ভিন্ন কিছুই হয়। "আমি যখন সেখানে গেলাম দেখলাম বাড়ীটা আছে কিন্তু তার সেই জৌলুস, চাকচিক্যের কোনটাই নেই। আমি অবশ্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম। কারণ দুশো বছরের পুরনো একটা বাড়ী আগের অবস্থায় থাকার কথা না। লাল ইট-সুরকি বের হয়ে গেছে, যেন একটা কঙ্কাল দাড়িয়ে আছে" প্রথম দেখায় বর্ণনা তিনি এভাবেই দিচ্ছিলেন। "আমার যাওয়ার কারণ ছিল আমার শেকরের সন্ধান করা। শেকরটা কোথায় ছিল, কেমন ছিল, কেন সেটা দুর্বল হয়ে গেল সেসব জানতে চাওয়া আমার আগ্রহ ছিল", আবু সাদ বলছিলেন "যখন আমি আমার বাবার ঘরে ঢুকে খাটের উপর তাঁর নাম লিখা দেখলাম, ফুফুর ঘরে ড্রেসিং টেবিলে ফুপুর নাম লেখা, চাচার খাটে নাম লেখা এমন আরো নানা জিনিস দেখলাম তখন আমি বুঝে নিলাম আমার সেই গাছটা না থাকলেও গাছের শেকড়গুলো রয়ে গেছে। আমি গাছটাকে পুরো না পেলেও শেকড়গুলো পেয়ে গেলাম"।
১৯৪৬ সালে ১৬ই আগস্ট পশ্চিমবঙ্গে এক দাঙ্গায় তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয় স্থানীয় হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে। এর রেশ পরবর্তী কয়েকবছর ধরে চলে। মি. সাদ তার বাবা,চাচা,ফুফুদের কাছে শুনেছেন সেই সময় কলকাতায় বা পুরো পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান বাঙ্গালীদের শিক্ষা, চাকরী, ব্যবসার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।
গুজরাট জুড়ে এখন চলছে নির্বাচনী হাওয়া অন্য দিকে গুজরাট দখলে আনার মরিয়া চেষ্টায় রীতিমতো ওই রাজ্যের মাটি কামড়ে পড়ে আছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও। গুজরাটে সাম্প্রতিক বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন কিংবা নোট বাতিল-জিএসটির মতো বিতর্কিত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যে তীব্র ক্ষোভ আছে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা কি ভারতে বিজেপির সবচেয়ে বড় দুর্গে ফাটল ধরানোর জন্য যথেষ্ট? গত কয়েকদিন ধরে গুজরাটের নানা প্রান্তে ঘুরে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছিলাম। আরো পড়তে পারেন: ট্রাম্পের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য কি ইঙ্গিত দিচ্ছে? মৌনতা ভঙ্গাকারীরা টাইমের 'সেরা ব্যাক্তিত্ব' গুজরাটের আহমেদাবাদে সবরমতী নদীর তীরে মোহনদাস গান্ধীর নিজের হাতে গড়া সবরমতী আশ্রম - বিকেলে সেখানে বাজছে গুজরাটি ভাষায় লেখা গান্ধীর প্রিয় ভজন 'বৈষ্ণবো জান তো'। ছশো বছরেরও বেশি পুরনো এই গান সবার দু:খ-দুর্দশা অনুভব করার কথা বলে, সবাইকে মর্যাদা দেবার কথা বলে। তবে গান্ধীর প্রয়াণের প্রায় সত্তর বছর পর তার জন্মভূমিতে রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ অনেকটাই অন্যরকম। গত প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এ রাজ্যে অনায়াসে ক্ষমতায় রয়েছে। গুজরাটে বিজেপির একটানা প্রায় তেইশ বছরের শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে অক্লান্ত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গুজরাট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিতেশ প্যাটেল বলছিলেন, "শাসক দল বিজেপির জন্য সারা দেশে তাদের যাবতীয় আদর্শগত পরীক্ষানিরীক্ষার ল্যাবরেটরি হল গুজরাট।" "জাতীয় স্তরে গুজরাটের গৌরব নিয়েও এ রাজ্যের মানুষ খুব ভাবিত - আর মোরারজি দেশাইয়ের পর বহুদিন পর আর এক গুজরাটি নরেন্দ্রভাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই রাজ্যে একটা বাণিজ্যিক সংস্কৃতিও আছে, যে বাণিজ্যিক ভাবনাটা তাদের রাজনীতিতেও জাতীয় চিন্তাধারার সঙ্গে চলতেই প্রভাবিত করে।" ফলে ২০১৭-র নির্বাচনেও বিজেপির গুজরাটে ক্ষমতায় আসা নিয়ে সংশয়ের কোনও কারণ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু গত দু-এক বছরে বেশ কয়েকটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা সেই আপাত-সহজ সমীকরণকেই বেশ জটিল করে তুলেছে। এ রাজ্যের পথেপ্রান্তে কান পাতলেই এখন শোনা যায় বিজেপির সরকার ধনীদের জন্য - গরিবের জীবন যেন এখানে আটার চাকিতে পিষে ফেলা হচ্ছে। রাজ্যের বস্ত্রশিল্পে কাজ করেন যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, গত সাত মাসে নোট বাতিল আর জিএসটি কর চালুর ধাক্কায় তাদের রুটিরুজি বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। আহমেদাবাদ শহরে নেহরুনগর মার্কেট রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেছে, পথে বসেছেন দুশো শ্রমিক পরিবার। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজ্যে তিন তরুণ তুর্কির সামাজিক আন্দোলন। অল্পেশ ঠাকোর, হার্দিক প্যাটেল ও জিগনেশ মেহভানি নামে গুজরাটের তিন তরুণ নেতা যথাক্রমে নেতৃত্বে দিচ্ছেন ওবিসি, পাতিদার ও দলিত শ্রেণীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে - আর ভোটের মুখে তারা তিনজনেই হাত মিলিয়েছেন বিরোধী কংগ্রেসের সঙ্গে। গুজরাট এবার দখলে নিতে চায় কংগ্রেস তাদের তিনজনের দাবিতে পরস্পর বিরোধিতা হয়তো আছে, কিন্তু অল্পেশ ঠাকোর নিশ্চিত বিজেপির বিরুদ্ধে একটা নতুন ভাবনা, নতুন উৎসাহের ঝড় তাদের ঠিকই ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। আর বিজেপিকে হয়তো এবারে গুজরাটের মসনদ থেকে সরানো একেবারে অসম্ভব নয়, সেটা টের পেয়েই গত তিন মাস ধরে এ রাজ্যে লাগাতার প্রচারণা চালাচ্ছেন ভাবী কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী - আর তিনি সরাসরি আক্রমণের নিশানা করেছেন গুজরাটে বিজেপির তথাকথিত উন্নয়নের মডেলকে। "বিজেপির মিথ্যার ফুলঝুরিতে উন্নয়ন বা বিকাশের ধারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে, বিকাশ পাগল হয়ে গেছে", একের পর এক সভায় বলে চলেছেন তিনি। আর ঠিক এমন এক পটভূমিতেই গুজরাটের নির্বাচনী রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। তার স্বপ্নের গুজরাট মডেলের মূল কথা যে বিকাশ, তাকে নিয়ে কোনও ব্যঙ্গবিদ্রূপ যে তিনি সইবেন না, সেটা তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। জনসভা থেকে মুহুর্মুহু শ্লোগান দিচ্ছেন আমিই বিকাশ, 'হু বিকাশ ছো'। মোদির গুজরাট মডেল রাজ্যে রাস্তাঘাট, ড্যাম, বৃহৎ শিল্প স্থাপনে সফল হলেও শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক উন্নয়নের সূচকে ব্যর্থ - এই সমালোচনা অবশ্য বহুদিন ধরেই ছিল। কিন্তু বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের গণ্ডি পেরিয়ে তা এখন সাধারণ আম গুজরাটিদেরও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। আহমেদাবাদের প্রাণকেন্দ্রে তরুণ-তরুণীরা ফ্ল্যাশ মবের মতো হঠাৎ উদয় হয়ে নাচতে শুরু করে দিচ্ছে 'বিকাশ গান্ডো থায়ো চে' গানের সঙ্গে - গুজরাটিতে যার অর্থ 'বিকাশ পাগল হয়ে গেছে'। বিরোধী কংগ্রেসের তৈরি করা এই গান সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সর্বত্র দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে - বাধ্য হয়ে বিজেপিকেও বের করতে হয়েছে যার পাল্টা ভিডিও। দিল্লি বিজেপির নেতা সতীশ উপাধ্যায় গুজরাটে দলকে ভোটে জেতানোর দায়িত্ব নিয়ে এ রাজ্যে পড়ে আছেন। তার অবশ্য বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, এই উন্নয়নই বিজেপিকে জেতাবে - এবং গুজরাটিরা কিছুতেই এমন একটা দলের বিরুদ্ধে যাবেন না, দিল্লিতেও যাদের সরকার আছে। "হাজার হোক, সারা দেশে আর কোন রাজ্যে প্রত্যন্ত গ্রামেও একশো-দুশো টাকায় ডায়ালিসিস করা যায়? তারা এই উন্নয়নের ধারায় কোনও ব্যাঘাত চাইবেন না - সেই সঙ্গে অবশ্যই কাজ করবে মোদি ক্যারিশমা, গুজরাটিদের জন্য যিনি অনেক করেছেন", বলছিলেন মি উপাধ্যায়। কিন্তু মোদি শূন্যগর্ভ এই প্রতিশ্রুতি আর গুজরাটি অস্মিতার তত্ত্ব ভাঙিয়ে আর কতদিন খাবেন, পাল্টা প্রশ্ন প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র মনীশ দোশীর। তিনি বলছেন, "এটা ঠিকই যে প্রত্যেক রাজ্যেই দেখা যায়, তার নিজের লোক যখন নেতৃত্ব দেন তার ওপর একটা ভরসা কাজ করে। কিন্তু বারবার কি একই জিনিস চলে না কি?" গুজরাট দখলে আনার মরিয়া চেষ্টায় রীতিমতো ওই রাজ্যের মাটি কামড়ে পড়ে আছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী "২০০২য়ে গুজরাটি গৌরবের কথা বলে, ২০০৭য়ে বিভাজনের রাজনীতি করে - বা তার পরেও কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলে আপনি ভোটে জিতলেন। কিন্তু গুজরাটিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তো একটা টাকাও জমা পড়ল না!" তবু গুজরাটে বিজেপির ভোট মেশিনারি কিংবদন্তির মতো। জিএসটি করই হোক বা পাতিদার সমাজকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত আনা - যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে নানা পদক্ষেপ নিয়ে তারা মানুষের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করতে পেরেছেন অবশ্যই। মোদী-অমিত শাহর খাসতালুক মেহসানাতে ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন, কংগ্রেস আমলের তুলনায় সরকার এখন অনেক বেশি কাজকর্ম করছে, উন্নয়ন করছে। আর জিএসটি নিয়েও যা ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল, সব না কি এখন 'সেট' হয়ে গেছে! আর বিজেপির পুরনো ভোট ব্যাঙ্ক পাতিদার-রাও হার্দিক প্যাটেলের কথায় বিভ্রান্ত না-হয়ে পুরনো দলের কাছে ঠিকই ফিরে আসবেন, এই বিশ্বাসে অটল বিজেপির আহমেদাবাদ শাখার প্রধান কমলেশ প্যাটেল। তার যুক্তি, "পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে যারা প্যাটেল সমাজের জন্য কাজ করছে, সেই দলকে ভুলে গিয়ে এক চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবকের কথায় তারা কি ভড়কে যাবেন না কি? হ্যাঁ, একবার হয়তো ওর উল্টোপাল্টা কথায় ভুল বুঝেছিলেন, কিন্তু পরে তারাও বুঝতে পেরেছেন কারা তাদের সত্যিকারের ভাল চায়।" একান্ত আলোচনায় বিজেপি নেতারাও অবশ্য স্বীকার করেন, এবারের লড়াই কঠিন। কিন্তু মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ যতই থাক, একজন গুজরাটি প্রধানমন্ত্রী যখন তাদের কাছে ভোট চাইছেন গুজরাট শেষ পর্যন্ত কিছুতেই তাকে নিরাশ করবে না - এটাই তাদের বড় ভরসা। প্রফেসর হিতেশ প্যাটেলও বলছিলেন, "আঞ্চলিকতার রাজনীতি কখনও এ রাজ্যে সফল হয়নি। চিমনভাই প্যাটেলের মতো পাটিদারদের বিরাট নেতাও কিমলোক নামে নিজের পার্টি তৈরি করেছিলেন, সফল হননি। শঙ্কর সিং বাঘেলা বা কেশুভাই প্যাটেল, হিন্দিচাচার মতো দিকপালরাও পারেননি।" "বিজেপি সামান্য হলেও এগিয়ে থাকবে শুধু এই কারণে যে গুজরাট চিরকাল ভারতের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির ধারার সঙ্গেই গা ভাসিয়েছে - যদিও তার পরেও তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ থাকছেই", বলছেন তিনি। বিজেপির শক্ত গড় গুজরাটে ২০১৭র বিধানসভা নির্বাচন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে প্রবল উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বিরোধী কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জ রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের জন্য যথেষ্ট, সেই কথাটা এখনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। বিজেপি নেতারাও তাই সাবধানী আত্মবিশ্বাসের সুরে বলছেন, "১৮ ডিসেম্বরে ভোট গণনার পর মিলিয়ে নেবেন - সবরমতী আশ্রমে যেমন গান্ধী থাকবেন, গান্ধীনগরের সচিবালয়েও তেমনি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীই থাকবেন।" আর বিরোধী শিবিরের পাল্টা জবাব, "মনে রাখবেন গান্ধী নিজেও একজন কংগ্রেসিই ছিলেন। তার নিজের জন্মভূমিও আর খুব বেশিদিন কংগ্রেসের আদর্শ থেকে দূরে সরে থাকবে না, শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন!" বিবিসি বাংলার আরো খবর: টেরিজা মে’কে হত্যার চেষ্টায় ব্রিটিশ-বাংলাদেশি? মেয়েকে আনতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত দুদিন ধরে উধাও জেরুসালেম ইসরায়েলের রাজধানী : ট্রাম্প আরব-ইসরায়েল সংঘাত শুরু যে ৬৭ শব্দের অনুচ্ছেদে
ভারতের রাজনীতিতে যাবতীয় মনোযোগ এখন গুজরাটের আসন্ন নির্বাচনে - যেখানে বিজেপির একটানা প্রায় তেইশ বছরের শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে অক্লান্ত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ভারতের মুসলিমরা? কলকাতায় আত্মীয়- স্বজন, প্রতিবেশীদের মধ্যে এখন সারাক্ষণই কাগজ-পত্র জোগাড়ের চিন্তা, তা নিয়েই সবসময় আলোচনা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী (মমতা ব্যানার্জি) ভরসা দিচ্ছেন এখানে এন আর সি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী) করতে দেবেন না, কিন্তু মুসলিমরা ভরসা পাচ্ছেন না। তারা ধরেই নিচ্ছেন আজ হোক, কাল হোক তাদেরকে কাগজপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা ভারতীয় নাগরিক। আমার পরিবারের কথা ধরুন - শ্বশুর কুলের কাগজ-পত্র সব ঠিকঠাক আছে, কিন্তু আমার বাবার জমি-জমা নেই বললেই চলে, ফলে দলিল-পত্রও নেই। সেটা নিয়ে আমার চিন্তা হয়। কাগজপত্র সব দেওয়া যাবে তো। আমাদের বা আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্মের সার্টিফিকেট না হয় আছে। গুরুজনদের তো নেই। গরীব-অশিক্ষিত মুসলিমরা কাগজ-পত্র তো রাখেই না। ওদের কি হবে? আমি এই কলকাতাতেই জন্মেছি। আশুতোষ করে পড়াশোনা করেছি। এখন শিক্ষকতা করছি। এই শহরেই সব। তারপরও কেন যে এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভরসা পাইনা, এটা ভাবলেই নিজের কাছেও যেমন কেমন অবাক লাগে। কিছু রাজনীতিকের কথা শুনে খুব ভয় লাগে। মনে হয় তারা বোধ চাইছেন না আমরা মুসলিমরা এদেশে থাকি। অন্তত মুসলিমের সংখ্যা তারা মনে হয় কমাতে চায়। আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কিন্তু সবাই যদি ভেতরটা দেখতো, তাহলে দেখতে পেত আমরা মুসলিমরা এদেশকে কতটা ভালোবাসি। এই শহরে বড় হয়েছি। এত হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের কথা কখনো শুনিনি। মেয়ে কলেজে পড়ে। কিন্তু এদেশে ওর ভবিষ্যৎ কি তা নিয়ে এখন আর পুরোপুরি ভরসা পাইনা। নাগরিকত্ব আইন, এন আর সি এসব নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে, কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? আমরা কি পারবো? মীনা খাতুনের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন শাকিল আনোয়ার কলকাতায় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল রিকাত হাশমী, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, দিল্লি ভারতে অনেক মুসলিমের মত আমিও এখন দিন-রাত ভাবি এদেশে আমার ভবিষ্যৎ কী? অমার ধর্মের কারণে কি আমাকে চাকরি দেওয়া হবেনা? আমাকে কি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে? এই ভয়-দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের কি কখনো মুক্তি হবে? অমার ইউনিভার্সিটি জামিয়া মিলিয়াতে রাতভর সহিংসতার পর মা আমাকে আশ্বস্ত করতে বলেছিলেন, "ধৈর্য ধর।" নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে বেধড়ক পিটুনি খান জামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের ক্লাসরুমে, লাইব্রেরিতে পর্যন্ত পুলিশ ঢুকে ভাঙচুর করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। নতুন নাগরিকত্ব আইনে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে থেকে আসা শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু মুসলিমদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীরা। তাহলে পুলিশ কেন তাদের ওপর চড়াও হলো? পুলিশের বক্তব্য - শিক্ষার্থীরা গাড়িতে আগুন দিয়েছে, ইট-পাটকেল ছুড়েছে। কিন্তু সেই প্রমাণ কি পুলিশের কাছে রয়েছে? পুলিশ বলছে, তারা গুলি করেনি। তাহলে হাসপাতালে গুলিতে জখম লোকগুলো কি মিথ্যা বলছে? আমি জামিয়া ইউনিভার্সিটিতে ডেনটিস্ট্রি পড়ছি। গত কয়েক বছরে আমি ক্যাম্পাসে বেশ কিছু শন্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-সমাবেশ দেখেছি। রোববার বিক্ষোভে আমি অংশ নিইনি। কিন্তু পুলিশ যে হামলা চালালো আমি তার শিকার হয়েছিলাম। পুলিশ যখন আমাদের হস্টেলের দিকে আসছিল, আমি ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিলাম। আমরা বাতি বন্ধ করে লুকানোর চেষ্টা করছিলাম। ভাগ্যিস তেমন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া রাত পার হয়ে গিয়েছিল। মো তামিন বলেন পুলিশ তাকে কাছ থেকে গুলি করেছে কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল : তুমি সমালোচনা বা প্রতিবাদ করো আর নাই করো, মুসলিম হিসাবে তুমি টার্গেট হবে। ছোটবেলায় অনেক দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙতো ভজনের সুরে। উড়িষ্যার একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় আমরাই ছিলাম একমাত্র মুসলিম পরিবার। আমরা সবসময় বিভিন্ন ধর্মীয় পালা-পার্বন একসাথে উপভোগ করেছি। ইদের সময় আমার হিন্দু বন্ধুরা আমার হাতে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। আবার একসাথে নবরাত্রিতে মজা করেছি। বিরিয়ানির লোভে আমার অনেক হিন্দু বন্ধু হর-হামেশা আমাদের বাড়িতে আসতো। আমাদের মহল্লায় বা ধারে কাছে কোনো মসজিদ ছিলনা। কিন্তু আমার বাবা কোনোদিন তার ধার ধারেননি, কারণ তিনি নামাজ পড়তেন না। আমার মা ঘরেই নামাজ পড়তেন। আমি যে কনভেন্ট স্কুলে পড়তাম, সেখানকার সিংহভাগ শিক্ষার্থীই ছিল হিন্দু। কিন্তু কোনোদিন আমি কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি। শুধু একদিন একদিন আমার এক হিন্দু বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল মুসলিমরা নাকি প্রতিদিন গোসল করেনা। শুনে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনোদিন আমি নিজেকে শুধু মুসলিম হিসাবে ভাবিনি। এখনও ভাবিনা। কিন্তু একটি গোষ্ঠী এখন মাঠে নেমে আমাদের ভাগ করে দিতে চাইছে। ফলে আমার এখন আর ভরসা হয়না যে যে জীবন আমার এতদিন ছিল, তা আর থাকবে। আমাদের দিন দিন এমন কথা বেশি বেশি শুনতে হচ্ছে যে আমরা মাংস-খেকো, আমার ধর্ষণকারী, সমাজকে কলুষিত করছি, আমরা সন্ত্রাসী, পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করছি, প্রেমের ছলে হিন্দুদের মুসলমান বানাচ্ছি, এবং আমরা দেশকে দখল করে নিতে চাই। বাস্তব সত্য যেটা তা হলো - আমাদেরকে এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো হচ্ছে, যাদেরকে ভয়ে ভয়ে টিকে থাকবে হবে। পুলিশের মুখোমুখি জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রীরা এক টুইটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, "এখন শান্তি, ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের সময়।" অথচ তার আগের দিনই তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, "কারা সরকারি সম্পত্তিতে আগুন দিচ্ছে তাতো টিভিতেই দেখা গেছে- তাদের পোশাক দেখেই তো চেনা যায়।" তিনি খুলে বলেননি, কিন্তু আসলে তিনি একটি ধর্মের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। দুঃখের বিষয় যে এসব দেখে আমি এখন ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছি। আমি শারীরিক বা পোশাকের কথা বলছি না, কারণ আমি ১৬ বছর বয়স থেকে হিজাব পরি। যখন আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম তখন দেখলাম অনেক ছাত্রী হিজাব পরে। আমিও হিজাব ধরলাম। ২২ বছর বয়সে আমাকে এখন আমার ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অর্থনীতির বেহাল অবস্থার সমালোচনা করতে চাই। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে "দেশ-বিরোধী" 'হিন্দু-বিরোধী' বলে আমাকে ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেও আমাকে বলা হয়, আমি 'হিন্দু-মুসলিম' ইস্যু টেনে আনছি। আমরা এখন এমন এক সময়ে বসবাস করছি যেখানে ধর্ম আর জাতীয়তাবাদকে এক করে ফেলা হয়েছে। এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমার মনে হয়, হিজাবের কারণে মানুষজন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তে আমি অযৌক্তিকভাবে এসব ভাবছি, কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষ যে ছড়িয়ে পড়ছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই ভারতে তো আমি বড় হইনি। মুম্বাইতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সমাবেশ, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ২০ কোটির মত। তাদের মধ্যে উদ্বেগ দিনদিন বাড়ছে। আমরা এখন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করি নতুন আরেকটি আইন এলে আমাদের কী হবে? সবাইকেই কি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী তো বলেছেন ২০২৪ সালে নির্বাচনের আগে ভারত-জুড়ে নাগরিক-পঞ্জী চালু করা হবে। কিন্তু এখনও আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। এই ঘৃণা এবং জঘন্য বিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে দেশে জুড়ে মানুষজন কথা বলতে শুরু করেছে। হয়তো অনেক মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হবে, তারা যুক্তি দিয়ে ভাববে। কিন্তু এখন আমার চারপাশের এতদিনকার পরিচিত পরিবেশ ধসে পড়ছে আর আমি চুপ করে চেয়ে দেখছি । আমাকে হস্টেল থেকে বের করে জোর করে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। পরিবারের কাছে যেতে পারছি না, কারণ তারা যে শহরে থাকে সেখানেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সুতরাং আমি দিল্লিতে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি এবং মায়ের কথাগুলো নিয়ে ভাবছি - "ধৈর্য ধরো, শক্তি হারিও না।" রিকাত হাশমির সাথে কথা বলেন বিবিসির পুজা ছাবরিয়া
কলকাতার স্কুল শিক্ষক মিনা খাতুন
রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে আগে রোহিঙ্গাদের গ্রাম ছিলো এখন সেখানে তার কিছুই নেই মিয়ানমার সরকারের আয়োজিত এক সফরে গিয়ে বিবিসি অন্তত চারটি স্থান খুঁজে পেয়েছে যেখানে সুরক্ষিত স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। অথচ স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এগুলো আগে ছিল রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসতি। তবে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গ্রামে এসব স্থাপনা তৈরির অভিযোগ নাকচ করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। ২০১৭ সালে সামরিক অভিযানের জেরে সাত লাখের রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। জাতিসংঘ একে জাতিগত নির্মূল কর্মকাণ্ডের 'টেক্সটবুক' উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে নিজেদের বাহিনীর হাতে বড় মাত্রায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নাকচ করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার, মূলত বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, সেনাবাহিনীর হাতে জাতিগত দমন এবং গণহত্যার অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে আসছে। তবে এখন তারা বলছে যে, তারা কিছু পরিমাণ শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু গত মাসে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের অনুমোদিত ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে কেউই ফিরতে না চাইলে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারা অভিযোগ তোলে যে, ২০১৭ সালে সংঘটিত নিপীড়নের জন্য কোন জবাবদিহিতা নেই এবং নিজেদের চলাফেরায় স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়েও কোন নিশ্চয়তা নেই। এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছে মিয়ানমার। তারা বলছে, তারা অনেক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত ছিলো। এই বিষয়টি প্রমাণ করতেই বিবিসি-সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের তাদের প্রস্তুতি পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সাধারণত রাখাইনে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিস্তর কড়াকড়ি রয়েছে। আমরা সরকারি গাড়ি বহরে ভ্রমণ করি এবং পুলিশের তত্ত্বাবধান ব্যতীত ছবি তোলা ও সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি আমাদের ছিল না। তবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে উচ্ছেদের অকাট্য প্রমাণ দেখতে পাই আমরা। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট জানায়, ২০১৭ সালে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৪০ ভাগ গ্রাম পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারে কী দেখেছে বিবিসি? মিয়ানমারের সরকার আমাদের হ্লা পো কং নামে একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারা দাবি করে যে, স্থায়ী আবাসে ফেরার আগে এই শিবিরটিতে ২৫ হাজার শরণার্থী দুই মাস ধরে থাকতে পারবে। এই শিবিরটি এক বছর আগে তৈরি করা হয়েছিলো। তবে এখনো এর অবস্থা করুণ। এরইমধ্যে এর টয়লেটগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের সহিংসতায় ধ্বংস হওয় দুটি গ্রাম 'হ রি তু লার' এবং 'থার হায় কোন' নামে রোহিঙ্গা গ্রামেরউপর এই শিবিরটি তৈরি করা হয়েছে। ২৫ হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থীকে আশ্রয় দিতে লা পো কং ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করা হয়- তবে এটি করা হয়েছে দুটি রোহিঙ্গা গ্রাম গুঁড়িয়ে দিয়ে আমি যখন শিবিরটির পরিচালক সো শোয়ে অং-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে গ্রাম দুটো গুঁড়িয়ে দেয়া হল কেন, তখন কোন গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা অস্বীকার করলেন। কিন্তু যখন আমি দেখালাম যে স্যাটেলাইট চিত্রে এর প্রমাণ রয়েছে, তখন তিনি বললেন যে, তিনি কয়েক দিন আগে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। এরপর কিয়েন চং নামে আরেকটি পুনর্বাসন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। সেখানে জাপান এবং ভারত সরকারের সহায়তায় বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। তবে এই পুনর্বাসন শিবিরটি তৈরির জন্য মিয়ার জিন নামে একটি রোহিঙ্গা গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই গ্রামটি ছিলো নতুন করে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা পুলিশ বাহিনীর জন্য বানানো একটি ব্যারাকের পাশে। ২০১৭ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর এই অংশটির বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিল রোহিঙ্গারা। ক্যামেরার পেছনে মিয়ার জিন গ্রামটি গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেন কর্মকর্তারা । ইন্টারঅ্যাক্টিভ মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া শরণার্থীরা যদি তাদের ফেলে আসা ভিটেয় না ফিরতে পারেন, তাদের হয়ত কেয়িন চং-এর মত ''পুনর্বাসন শিবির এলাকায়'' থাকার ব্যবস্থা করা হবে। এই এলাকাও তৈরি হয়েছে যেখানে আগে রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল সেখানে। ২৩শে ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৭ মংডু শহরের বাইরেই অবস্থিত মিও থু গাই নামে একটি গ্রামে একসময় ৮ হাজার রোহিঙ্গার বাস ছিল। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, আরেকটি সরকারি গাড়ি বহরে করে ভ্রমণের সময় ওই গ্রামটির ছবি তুলেছিলাম আমি। ওই গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু বড় দালানগুলো অক্ষত ছিল। আর যে গাছগুলো রোহিঙ্গা গ্রাম বেষ্টন করেছিলো সেগুলোও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু এখন, মিও থু গাই গ্রামটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় বড় সরকারি স্থাপনা আর পুলিশ কমপ্লেক্স ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। এমনকি সেই গাছগুলোও নেই। আমাদের ইন দিন নামে আরেকটি গ্রামেও নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ১০ জন বন্দী মুসলিম পুরুষকে হত্যাকাণ্ডের জন্য আলোচিত ওই গ্রামটি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অল্প যে কয়টি নির্যাতনের ঘটনা স্বীকার করে এটি তার একটি। ইন দিন গ্রামের তিন-চতুর্থাংশ বাসিন্দাই ছিলো মুসলিম, বাকিরা রাখাইন বৌদ্ধ। এখন, মুসলিমদের কোন চিহ্ন নেই। রাখাইনরা চুপচাপ এবং শান্তিপূর্ণ। ইন্টারঅ্যাক্টিভ এই স্লাইড ব্যবহার করে দেখুন ইন দিন গ্র্রামের কতটা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। অক্ষত রাখা হয়েছে শুধু রাখাইনের বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকাগুলো। মুসলিমরা যে অংশে থাকত সেখানে এখন তৈরি হয়েছে নতুন পুলিশ ব্যারাক। ১৯শে এপ্রিল ২০১৯ ২২শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ কিন্তু যেখানে রোহিঙ্গারা থাকতো সেখানে গিয়ে দেখা গেলো যে, কোন গাছপালা নেই। তার পরিবর্তে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া আর বিশাল সীমান্ত রক্ষী পুলিশের ব্যারাক। রাখাইনের বৌদ্ধ বাসিন্দারা বলছে যে, প্রতিবেশী হিসেবে মুসলিমদের আর কখনোই মেনে নেবে না তারা। শরণার্থীদের জন্য এটা কী বার্তা দেয়? ২০১৭ সালের সামরিক বাহিনীর সহিংসতার অনেক দিন পরও চলমান ব্যাপক এই ধ্বংসযজ্ঞ ইঙ্গিত দেয় যে, খুব কম সংখ্যক রোহিঙ্গাই আসলে তাদের পূর্বের জীবনে ফিরতে পারবে। বড় আকারে শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে একমাত্র হ্লা পো কং-য়ের মতো জরাজীর্ণ ট্রানজিট ক্যাম্প এবং কিয়েন চংয়ের মতো পুনর্বাসন শিবিরই দেখানো হচ্ছে। তবে দু'বছর আগে শরণার্থীরা যে ধরণের মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে তা থেকে খুব কম সংখ্যক শরণার্থীই বের হতে পেরেছে এবং তারা আসলে এ ধরণের ভবিষ্যতের আশা করেনি। এ বিষয়টি শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইয়াঙ্গুনে ফেরার পথে বাস্তুচ্যুত এক তরুণ রোহিঙ্গার সাথে দেখা হয় আমার। আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে, অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না বিদেশি নাগরিকরা। সাত বছর ধরে একটি আইডিপি ক্যাম্পে নিজের পরিবারের সাথে আটকা পড়েছে ওই তরুণ। ২০১২ সালে সিত্তে এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার সাথে ঘর ছাড়া হয় সে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেই তার। এমনকি অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ারও সুযোগ নেই। বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে সে বলে, ঝুঁকি নিয়ে তারা যাতে বাংলাদেশে ফিরে না আসে। তাহলে তার মতো তারাও এ ধরণের ক্যাম্পে আটকে পড়বে। সরকার কি বলছে? রাখাইনে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্যের জন্য মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি সরকার। সরকারিভাবে, বাংলাদেশের সাথে যৌথ সমন্বয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সম্মত মিয়ানমার সরকার। ইন দিন গ্রামে মুসলিম বাসিন্দারা এখন আর আগের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় কিন্তু দেশটির মন্ত্রীরা এখনো রোহিঙ্গাদের 'বাঙালী' বলে সম্বোধন করে থাকে। তাদের দাবি, গত ৭০ বছর ধরে অবৈধভাবে অভিবাসনের মাধ্যমে মিয়ানমারে গিয়েছে তারা। তবে এধরণের অভিবাসনের কোন ধরনের প্রমাণ নেই। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়, দেশটিতে প্রচলিত এমন বিশ্বাসের প্রতিফলনই এ ধরণের দাবির পেছনে কাজ করে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের আবেদন খারিজ করেছে এবং চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের জাতীয় সনাক্তকরণ কার্ড বা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দিতে রাজি, এটা ক্রমান্বয়ে নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তারা। কিন্তু বেশিরভাগ রোহিঙ্গা এটা নিতে অসম্মতি জানিয়েছে কারণ তাহলে তাদেরকে নিজেদের বাঙালী বলে স্বীকার করে নিতে হবে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে, রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক নির্যাতন চলার সময়ে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেন, ১৯৪২ সালের 'অসম্পন্ন কাজ' সম্পন্ন করছেন তারা। তিনি আসলে তৎকালীন রাখাইনে জাপানি ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ওই যুদ্ধে রোহিঙ্গা এবং রাখাইনের বৌদ্ধরা বিপরীত পক্ষকে সমর্থন করেছিলো। সেসময়, তারা প্রায়ই একে অপরকে মারতো এবং যার কারণে বহু বেসামরিক মানুষ অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো। সেনাপ্রধান বলেন, তখন রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে বন্যার স্রোতের মতো আসতে থাকে। যে এলাকাটি বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে সীমান্তে অবস্থিত। সীমান্তের মংডু এবং বুথিডং- এই দুটি জেলাই ছিলো মিয়ানমারে একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা। অবশ্য ২০১৭ সালের সহিংসতার সময় ওই দুটি জেলায় বেশিরভাগ গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের গণ-বাস্তুচ্যুতির পর থেকে ওই এলাকায় মুসলিমরা যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ ভাগ তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। সহিংসতার বিষয়ে তদন্তে সরকারের অনাগ্রহ, চলাফেরায় স্বাধীনতা না দেয়া বা নাগরিকত্ব অস্বীকারের মতো বিষয়গুলো শরণার্থীদের ফিরতে অনুৎসাহী করবে। যার কারণে মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে যে ভারসাম্য রয়েছে তার কোন উন্নতি হবে না। যার অর্থ করা যেতে পারে সেই "অসমাপ্ত কাজ" হয়তো এতদিনে শেষ হয়েছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পুরো গ্রাম গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পুলিশের ব্যারাক, সরকারি ভবন এবং শরণার্থী পুনর্বাসন শিবির। বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
অনুষ্ঠানের আগে প্রাচীন রীতিতে প্রার্থনা সিত্রা* ভেবেছিলেন এটি অফিসেরই কোন একটা মিটিং। একটি ত্রাণ সংস্থায় কাজ করেন তিনি। স্থানীয় দুজন কর্মকর্তা বললেন, যে প্রকল্পটি তাকে দেখতে হয়, সেটির বাজেট যাচাই করে দেখার দরকার আছে। সেজন্যে তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হবে সিত্রাকে। ২৮ বছর বয়সী সিত্রা একা একা দুজন পুরুষের সঙ্গে বৈঠকের কথা শুনে শুরুতে একটু নার্ভাস বোধ করছিলেন। কিন্তু অফিসে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি। কাজেই সব দুশ্চিন্তা দূরে ঠেলে তিনি এই বৈঠকে গেলেন। মিটিং শুরু হওয়ার এক ঘন্টা পর এই দুজন বললেন, তারা বাকি মিটিং করতে চান অন্য একটি জায়গায়। সিত্রাকে তারা সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের গাড়িতে উঠতে বললেন। কিন্তু সিত্রা বললেন, তিনি তার নিজের মোটরসাইকেলেই যাবেন। একথা বলে তিনি মোটরসাইকেলে উঠে চাবি ঢোকালেন। ঠিক তক্ষুনি আরেকদল পুরুষ এসে তাকে তুলে নিল। বালি থেকে আরও পূর্বে প্রত্যন্ত এক দ্বীপ সুম্বা "ওরা যখন আমাকে জোর করে গাড়িতে ঢোকাচ্ছে, তখন আমি লাথি মারছিলাম এবং চিৎকার করছিলাম। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। গাড়ির ভেতর দুজন লোক আমাকে ঠেসে ধরে রাখলো", বললেন তিনি। "আমি জানতাম আমার কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে।" তাকে বিয়ের জন্য অপহরণ করা হচ্ছে। বিয়ের জন্য পাত্রী অপহরণ সুম্বার অনেক পুরনো আর বিতর্কিত এক রীতি। স্থানীয়দের কাছে এই প্রথা 'কাউয়িন ট্যাংক্যাপ' নামে পরিচিত। কিভাবে এটি সেখানে চালু হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সাধারণত পাত্র বা বরের পরিবার বা বন্ধুরা মিলে কনেকে অপহরণ করে নিয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়ার নারী অধিকার গোষ্ঠীগুলো অনেকদিন ধরেই এই প্রথা বিলোপের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু তারপরও বালির পূর্বদিকে সুম্বা দ্বীপের একটি অংশে এটি চালু আছে। ঘোড়ায় চড়ে পাসোলা উৎসবে যোগ দিতে এসেছে সুম্বানিজ যুবকরা। সম্প্রতি দুটি কনে অপহরণের ঘটনার ভিডিও নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার এখন এই প্রথাটি বিলোপ করতে বলছে। 'আমার মনে হচ্ছিল আমি মারা যাচ্ছি' গাড়ির ভেতর থেকে সিত্রা কোন রকমে তার প্রেমিক এবং বাবা-মাকে একটা মেসেজ পাঠাতে পারলেন। গাড়ি ততক্ষণে এসে পৌঁছেছে সনাতনি আমলের এক বাড়ির সামনে। কাঠের খুঁটির তৈরি বাড়িটির চালা চূড়াকৃতির। সিত্রা এবার বুঝতে পারলেন, যারা তাকে অপহরণ করেছে, তারা আসলে তার বাবার দিকের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। "সেখানে বহু মানুষ অপেক্ষা করছিল। আমি আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা একটি ঘন্টা বাজালো এবং আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে দিল।" ইন্দোনেশিয়ার সুম্বা দ্বীপে খ্রীষ্টধর্ম্ এবং ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি কিছু প্রাচীন প্রকৃতি পুজার রীতি এখনো চালু আছে। নানা ধরণের অনুষ্ঠান আর বলি দেয়ার মাধ্যমে সেখানে আত্মাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। সিত্রা বলেন, "সুম্বার মানুষ বিশ্বাস করে যখন আপনার কপালে পানির স্পর্শ লাগবে, তখন আর আপনি সেই ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না। আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম কী হচ্ছে। কাজেই যখন তারা আমার কপালে পানি ছোঁয়ানোর চেষ্টা করলো, আমি মুখ ফেরানোর চেষ্টা করলাম, যাতে পানি আমার কপালে না লাগে।" একটি ঐতিহ্যবাহী সুম্বা গ্রাম। বাড়ির চালার উপর থাকে অনেক উঁচু একটি চূড়া। তাকে যারা আটকে রেখেছিল, তারা অবশ্য বারবার বলছিল, তারা সিত্রাকে ভালোবাসে বলেই এই কাজ করেছে। এই বিয়ে মেনে নেয়ার জন্য তারা সিত্রাকে নানাভাবে চেষ্টা করছিল। "কাঁদতে কাঁদতে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি মাটিতে পড়ে কাঁদছিলাম। আমার হাতে তখনো ধরা আছে মোটরসাইকেলের চাবি। আমি সেটি দিয়ে আমার পেটে মারছিলাম, সেখানে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছিলাম। বড় বড় কাঠের খুঁটিতে আমি মাথা ঠুকছিলাম। আমি যে এই বিয়ে করতে চাইনা, আমি চাচ্ছিলাম সেটা তারা বুঝুক। যাতে আমার জন্য তাদের মনে করুণা জাগে।" এর পরের ছয়দিন সিত্রাকে কার্যত এই ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। বসার ঘরে তাকে ঘুমাতে হচ্ছিল। "আমি সারারাত কাঁদতাম, মোটেই ঘুমাতাম না। আমার মনে হতো আমি মারা যাচ্ছি।" সেই বাড়িতে সিত্রাকে যে পানি বা খাবার দেয়া হতো, সেটা তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানালেন। তার সন্দেহ, এই খাবার বা পানি খাইয়ে তাকে বশীভূত করা হবে। "যদি আমরা তাদের খাবার খাই, তখন আমরা তো এই বিয়েতে রাজী হয়ে যাব।" সিত্রাকে গোপনে খাবার আর পানি সরবরাহ করতো তার বোন। সিত্রার পরিবার তখন নারী অধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। গ্রামের মুরুব্বিদের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিত্রাকে মুক্ত করা হলো। দরকষাকষির কোন সুযোগ নেই একটি নারী অধিকার সংগঠন 'পেরুয়াটি' গত ৪ বছরে এরকম ৭টি কনে অপহরণের ঘটনা রেকর্ড করেছে। তাদের বিশ্বাস, ইন্দোনেশিয়ার এই দ্বীপটির প্রত্যন্ত এলাকায় এরকম বহু ঘটনাই ঘটছে। এদের মধ্যে সিত্রাসহ মাত্র তিনজনকে মুক্ত করা গেছে। সম্প্রতি যে দুটি ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তার মধ্যে একটি মেয়ের বিয়ে এখনো টিকে আছে। পূর্বপুরুষদের কবরে প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রার্থনা করছে সুম্বানিজ নারী পেরুয়াটির স্থানীয় কর্মকর্তা আপ্রিসা তারানু বলেন, "ওদের এই বিয়ে মেনে নিতে হয়েছে, কারণ এছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই। 'কাওয়িন ট্যাংক্যাপ' বা জোর করে কনে নিয়ে আসার ব্যাপারটা অনেক সময় পারিবারিক মধ্যস্থতায় বিয়ের মতো ব্যাপার। এখানে মেয়ের মতামত মোটেই গ্রাহ্য করা হয় না।" তিনি বলেন, যারা শেষ পর্যন্ত এরকম বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাদের নিজেদের সমাজে হেয় চোখে দেখা হয়। "এদেরকে পুরো সমাজের জন্য অসন্মান বলে বর্ণনা করা হয়। লোকে বলে, তাদের আর বিয়ে হবে না, তাদের কখনো সন্তান হবে না। এসব কারণে অনেক মেয়ে এরকম ঘটনার শিকার হওয়ার পরও বিয়ে মেনে নেয়।" সিত্রার ক্ষেত্রেও এসব কথাই বলা হয়েছিল তিন বছর আগে অপহরণের ঘটনার পর। কিন্তু সিত্রা শেষ পর্যন্ত তার প্রেমিকের সঙ্গেই ঘর বাঁধতে পেরেছেন। তাদের এখন সুখের সংসার। ভাইরাল হওয়া যে অপহরণের ভিডিও কনে অপহরণের রীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে। "ঈশ্বরের কৃপায় আমি আমার প্রেমিককে বিয়ে করতে পেরেছি। আমাদের এখন এক বছর বয়সী একটি ছেলে সন্তান আছে।" এই প্রথা বিলোপের অঙ্গীকার স্থানীয় ইতিহাসবিদ ফ্রান্স ওরা হেবি মনে করেন, এই প্রথাটি আসলে সুম্বার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ নয়। কিছু লোক তাদের পছন্দের মেয়েকে জোর করে বিয়ে করার জন্য এটি ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, স্থানীয় নেতা এবং কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া হয় না বলেই এটি এখনো চলছে। "এর বিরুদ্ধে কোন আইন নেই। যারা এই প্রথা চালু করে, তাদের হয়তো সামাজিকভাবে নিন্দা করা হয়, কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোন আইনি শাস্তির ব্যবস্থা নেই, নেই কোন সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।" নারী অধিকার মন্ত্র্রী বিনটাং পুস্পায়োগা তবে এবার এরকম অপহরণের বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে যেরকম শোরগোল হয়েছে, তারপর সুম্বার আঞ্চলিক নেতারা একটি যৌথ ঘোষণায় সই করেছেন। এ মাসের শুরুতে এই ঘোষণায় তারা এরকম জোর করে কনে অপহরণের রীতি প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার নারী অধিকার মন্ত্রী বিনটাং পুস্পায়োগা এই ঘোষণা সই করার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জাকার্তা থেকে সুম্বায় আসেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "অভিভাবক এবং ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, এভাবে কনে অপহরণের ঘটনা, যা কিনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, তা আসলে সুম্বার আসল ঐতিহ্য এবং রীতির অংশ নয়।" তিনি এই রীতিকে 'নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা' বলে বর্ণনা করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, সরকার এর বিরুদ্ধে আরও ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এই ঘোষণা স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই এটি শেষ হয়ে যাচ্ছে না। নারী অধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, 'এটি অনেক দীর্ঘযাত্রার একটি প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।' সিত্রা বলেছেন, সরকার যে এখন এই ঘটনার দিকে নজর দিচ্ছে, সেজন্যে তিনি কৃতজ্ঞ। তিনি যে নির্মম অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন, আর কেউ সেরকম দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হবেন না বলে আশা করছেন তিনি। "অনেকের মনে হতে পারে, এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া একটা রীতি। কিন্তু এটা এখন একটা সেকেলে রীতি, এ যুগে এর স্থান নেই। কাজেই এটা বন্ধ করতে হবে, কারণ এটা মেয়েদের ক্ষতি করছে।" *সিত্রা ছদ্মনামটি ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখার জন্য
ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত এক দ্বীপ সুম্বার স্থানীয়দের মধ্যে চালু আছে বহু পুরনো এক প্রথা। সেখানে বিয়ে করার জন্য কনেকে অপহরণ করে আনা হয়। কিন্তু সম্প্রতি একটি মেয়েকে অপহরণের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ইন্দোনেশিয়ায় এই প্রাচীন প্রথাটি নিয়ে তীব্র বিতর্ক-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ এই বিতর্কিত প্রথা বিলোপ করা হবে ঘোষণা দিয়েছেন। বিবিসি নিউজ ইন্দোনেশিয়ার লিজা টাম্বুনানের রিপোর্ট:
শিনজিয়াং-এ একজন মুসলিম আজান দিচ্ছেন ১৩৭ পৃষ্ঠার সে দলিলে প্রতিটি পৃষ্ঠায় ভিন্ন ভিন্ন কলাম এবং ছক কেটে ঐ মানুষেরা কতবার নামাজ পড়েন, কী পোশাক পরেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আচার আচরণের বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে, চীনের সরকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে এগুলো দেশটির সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থা মোকাবেলায় নেয়া পদক্ষেপের অংশ। কিভাবে পাওয়া গেছে এসব দলিল এসব দলিল অত্যধিক ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গত বছর শিনজিয়াং অঞ্চলের যে সূত্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সরকারি নথি পাওয়া গিয়েছিল, এবারও সেই সূত্রের মাধ্যমেই নতুন দলিলপত্র পাওয়া গেছে। ড. অ্যাড্রিয়ান জেনজ শিনজিয়াংয়ে চীনা নীতির একজন বিশেষজ্ঞ ড. অ্যাড্রিয়ান জেনজ, যিনি ওয়াশিংটনে ভিক্টিমস অব কম্যুনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের একজন সিনিয়র ফেলো, তিনি মনে করেন ফাঁস হওয়া এসব দলিল আসল। "এসব দলিল আমার দেখা এ পর্যন্ত সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ যে চীনের সরকার কিভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চার কারণে মানুষকে শাস্তি দিয়ে চলেছে।" দলিলে পাওয়া ক্যাম্পগুলোর একটি 'নাম্বার ফোর ট্রেনিং সেন্টার' যেখানে গত বছরের মে মাসে শিনজিয়াংয়ে চীন সরকার আয়োজিত এক সফরে বিবিসির একটি দল গিয়েছিল। সেসময় বিবিসির দলটির পাওয়া অনেক তথ্য উপাত্তের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে নতুন এসব দলিলে। সেখানকার অনেক মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে বিবিসি সেসময় অনেক তথ্য সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিল। কী আছে দলিলে নতুন দলিলে সংখ্যালঘু উইগার সম্প্রদায়ের ৩১১ জন মানুষের ব্যাপারে ব্যাপক ভিত্তিক অনুসন্ধানের অর্থাৎ তাদের পূর্ব ইতিহাস, ধর্মীয় আচার পালনের দৈনন্দিন রুটিন, তাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে এসব দলিলে। আমস্টারডামে নির্বাসিত উইগার মুসলমান আসিয়ে আব্দুলাহেব রিপোর্টের শেষ কলামে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, ঐ ব্যক্তিদের বন্দীশিবিরে আরো রাখা হবে নাকি তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, অথবা আগে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এমন কাউকে আবার বন্দি শিবিরে ফিরিয়ে আনতে হবে কিনা। নতুন এসব দলিলের মাধ্যমে ঐসব ক্যাম্পকে এতদিন সাধারণ স্কুল বলে চীন যে দাবি করে এসেছে তা ভিত্তিহীন হয়ে পড়ছে। প্রাপ্ত দলিল বিশ্লেষণ করে ড. জেনজ বলছেন, এসবের মাধ্যমে ওখানে চলা সিস্টেমের ব্যাপারে ধারণা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ক্যাম্পে থাকা মানুষের 'আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো' অনুযায়ী তাদের বিভক্ত করে পর্যালোচনা করার ব্যাপারেও ধারণা পাওয়া যায়। বোরকা পরা, পাসপোর্ট করতে চাওয়ায় 'সংশোধন' শিবিরে ৫৯৮ নম্বর সারিতে একটি কেস রয়েছে, যেখানে হেলচেম নামের ৩৮ বছর বয়সী একজন নারীকে রি-এডুকেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে, কারণ তিনি কয়েক বছর আগে বোরকা পরতেন। এটি অতীতের ঘটনার কারণে এবং নিয়ম বহির্ভূত শাস্তির একটি উদাহরণ মাত্র। শিনজিয়াংয়ের একটি বন্দীশিবির অন্যদের মধ্যে কেউ আছেন, যারা কেবল পাসপোর্টের আবেদন করার কারণে সংশোধন' শিবিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে কেউ দেশের বাইরে বেড়াতে যেতে চাইলেও সেটাকে কর্তৃপক্ষ শিনজিয়াংয়ে উগ্রপন্থার লক্ষ্মণ হিসেবে বিবেচনা করে। ৬৬ নম্বর কলামে, মেমেত্তটি নামে ৩৪ বছর বয়সী একজন যুবক ঠিক এই কারণে বন্দি হয়েছেন, যদিও দলিলে উল্লেখ আছে তার কাছ থেকে, 'বাস্তব কোন ঝুঁকি' নেই। আবার ২৩৯ নম্বর সারণিতে দেখা যায়, নুরমেমেট নামে ২৮ বছর বয়সী একজনকে রি-এডুকেশন কার্যক্রমে পাঠানো হয়েছে, কারণ একটি ওয়েব লিংকে ক্লিক করার মাধ্যমে তিনি 'অনিচ্ছাকৃতভাবে' একটি বিদেশী ওয়েবসাইটে চলে গিয়েছিলেন। তার আচরণের নিয়েও কোন অভিযোগ নেই বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। যে ৩১১ জন ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তারা সবাই শিনজিয়াংয়ের দক্ষিণে কারাকাক্স কাউন্টি নামে এক শহরের বাসিন্দা, যেখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ উইগার সম্প্রদায়ের। উইগাররা বেশির ভাগই মুসলমান, এবং তাদের মুখাবয়ব, ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে চীনের প্রধান জাতিগোষ্ঠী অর্থাৎ যাদের হান চাইনিজ বলা হয়, তাদের চেয়ে বরং মধ্য এশিয়ার সাদৃশ্য বেশি। তালিকায় ৩১১ জন উইগার মুসলমানের তথ্য রয়েছে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে লক্ষ লক্ষ হান চাইনিজ শিনজিয়াংয়ে বসতি গড়ে তুলেছে। এরপর থেকে ক্রমে সেখানে এক ধরণের জাতিগত উত্তেজনা তৈরি এবং উইগারদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে এমন আশংকা ক্রমে বাড়ছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সেখানে বিক্ষোভ সংঘাতের ঘটনা ঘটে, বেইজিং এর পক্ষ থেকে যা কঠোরভাবে দমন করা হয়। এজন্যই ক্রমে উইগার এবং শিনজিয়াংয়ের অন্য সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ যেমন কাজাখ এবং কিরগিজ সম্প্রদায়ের লোকেরা সরকারের দমননীতির টার্গেটে পরিণত হয়েছেন, এবং তাদের বন্দি শিবিরে নেয়া হচ্ছে। নতুন প্রকাশিত দলিলসমূহকে ড. জেনজ নাম দিয়েছেন 'কারাকাক্স তালিকা', তিনি বলছেন, এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে চীনের কর্তৃপক্ষ এখন যেকোন ভিন্নমতকেই আনুগত্যহীনতা মনে করছে। একটি বাজারে কয়েকজন মুসলিম আর সেই 'আনুগত্যহীনতা' দূর করার জন্য সরকার উইগারদের বাড়িঘর এবং অন্তরের ভেতরে পরিবর্তন আনতে চায়। কর্তৃপক্ষ কিভাবে এসব অনুসন্ধান চালায় ২০১৭ সালে উইগার মুসলমানদের জন্য যখন কর্তৃপক্ষ বন্দীশিবির চালু করে করে, সেসময় কম্যুনিস্ট পার্টির কিছু বিশ্বস্ত কর্মী, যারা গ্রামভিত্তিক দলের সদস্য হিসেবে কাজ করত তারা উইগার সমাজের ভেতরকার তথ্য বের করে আনার কাজটি করে। তারা প্রত্যেকে কয়েকটি করে বাড়ির দায়িত্ব নেয়, ঐসব বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে থাকে, বন্ধুত্ব করে এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে নোট নেয়। তাদের জীবনাচরণ, ধর্ম বিশ্বাস, বাড়িতে ধর্মচর্চার পরিবেশ অর্থাৎ কী কী আচার পালিত হয়, বাড়িতে কয়টি কোরান শরীফ আছে---এমন সব বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তারা। দলিলের ১১ নম্বর কলামে প্রত্যেক ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক এবং সমাজে কাদের সঙ্গে তারা ওঠাবসা করেন তা লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় চীনা কর্তৃপক্ষ কিভাবে শিনজিয়াংয়ের মানুষজনকে এমনকি বন্ধুর অপরাধের কারণেও দোষী সাব্যস্ত করা এবং পুরো পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের সূত্র ধরে শাস্তি প্রদান করে চলেছে। চীনের গোপন বন্দীশিবির দলিলে লিপিবদ্ধ প্রতিজন মানুষের আত্মীয় ও বন্ধুদেরও পূর্ব ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদেরও ধর্ম বিশ্বাস ও চর্চা, কখনো বিদেশে গেছেন কিনা কিংবা কখনো বন্দীশিবিরে ছিলেন কিনা—এমন খুঁটিনাটি তথ্যও রিপোর্টে যুক্ত করা হয়েছে। আরো পড়তে পারেন: চীনে উইগর মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে যা জানা গেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বন্দীশিবিরে উইগুর মুসলিমরা চীনে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আটকে শঙ্কিত জাতিসংঘ এর মধ্যে দেখা গেছে তালিকাভুক্ত প্রায় সবারই আত্মীয়স্বজন বিদেশে থাকেন, আর বিদেশে থাকাকে কর্তৃপক্ষ যে কোন নাগরিকের আনুগত্য-হীনতার সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করে। রিপোর্টের ১৭৯, ৩১৫ এবং ৩৪৫ নম্বর সারণীতে ৬৫ বছর বয়সী ইউসুফ নামের ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার দুই মেয়ে ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে বোরকা পড়তেন, এবং ছেলের ইসলামি রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এবং এই পুরো পরিবারটির 'হ্যান বিরোধী মূল্যবোধ' রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার ক্ষেত্রে রিপোর্টে রায় দেয়া হয়েছে, তার 'সংশোধন' প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে, এবং এটি অন্যতম একটি উদাহরণ যে কেবল নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্যও শাস্তি পেতে হচ্ছে মানুষকে। গ্রাম পর্যায়ের দল থেকে সংগ্রহ করা তথ্য শিনজিয়াংয়ের মূল তথ্য ভাণ্ডার, যা ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশনস প্ল্যাটফর্ম আইজেওপি নামে পরিচিত সেখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই আইজেওপির কাছে থাকে ঐ অঞ্চলের নজরদারি এবং পুলিশি কর্মকাণ্ডের রেকর্ড। যা ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক এবং প্রত্যেক নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে যে মোবাইল স্পাইওয়্যার ডাউনলোড করতে হয় তার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। ড. জেনজ মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আইজেওপি এসব তথ্য যাচাই করে এবং এখান থেকেই গ্রামের অনুসন্ধান দলের কাছে নির্দেশনা পাঠায় কাদের ওপর নজরদারি চালাতে হবে। ফাঁস হওয়া দলিলে অনেকজনের নামের শেষে 'অবিশ্বস্ত' বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে, মোট ৮৮ জন ব্যক্তিকে এজন্য বন্দীশিবিরে রাখার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ড. জেনজ বলছেন, এ তথ্য প্রমাণ করে যে কর্তৃপক্ষ এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে যা অপরাধের জন্য নয়, বরং একটি পুরো অঞ্চলের মানুষকে সন্দেহমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছে। সরকার কী বলছে চীন বলছে, শিনজিয়াংয়ের নীতিতে নাগরিকের প্রতি 'সম্মান এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস চর্চার স্বাধীনতা' নিশ্চিত করা হয়েছে। এবং শিনজিয়াংয়ের ভোকেশনাল ট্রেনিং নামে যে প্রকল্প চালু আছে, সেটি 'সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থা'র বিরোধী লড়াই এর অংশ। যারা সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা সংক্রান্ত কোন অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত, এসব শিবিরগুলোতে তাদেরই কেবল 'সংশোধন' করা হচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্ত দলিলে দেখা গেছে, কারাকাক্স তালিকায় বন্দীশিবিরে রাখার জন্য বিবিধ কারণ দেখানো হয়েছে, যার মধ্যে ধর্মীয়, পাসপোর্ট, পরিবার, বিদেশে যোগাযোগ কিংবা অবিশ্বস্ত হবার মত কারণের উল্লেখ রয়েছে। তবে এর মধ্যে চীনের পরিবার পরিকল্পনা নীতি অমান্য করার কারণে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে বন্দীশিবিরে রাখার কথা বলা হয়েছে। ঐ তালিকায় সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার মত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল এমন ছয় ব্যক্তির নাম রয়েছে, এবং দুইজন আছেন যারা নিষিদ্ধ ভিডিও দেখেছেন। ২০১৮ সালে উইগার মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার পর থেকে চীন সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। দলিলের সত্যতা নতুন ফাঁস হওয়া এই কারাকাক্স তালিকায় কর্তৃপক্ষের কোন স্ট্যাম্প বা কোন সরকারী চিহ্ন নেই, ফলে কেবল তালিকা দেখে এর সত্যতা নিশ্চিত করা কঠিন। ধারণা করা হয় গত বছর জুনের শেষ দিকে আরো কিছু স্পর্শকাতর দলিলের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ সরকারি নথি শিনজিয়াংয়ের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্বাসনে থাকা বেনামী একজন উইগার নেতার কাছে পাঠানো হয় সেগুলো। কেবল এই একটি দলিল, যা এখন ফাঁস হলো সেটি তখন পাঠানো হয়নি। জুনে সেসব দলিলের প্রথম অংশ প্রকাশিত হবার পর, আমস্টারডামে বাসকারী আরেকজন নির্বাসিত উইগার আসিয়ে আব্দুলাহেবের কাছে সেগুলো পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, তিনি নিশ্চিত যে নতুন প্রকাশিত দলিলটি 'জেনুইন' অর্থাৎ আসল। "কাগজপত্রের ওপর স্ট্যাম্প থাকুক আর না থাকুক, যে মানুষদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা সব আসল, বাস্তবের মানুষ। সুতরাং এটি আসল দলিল।" ২০১৮ সালে জানা যায়, শিনজিয়াং প্রদেশে উইগার মুসলমানদের 'সংশোধনের' জন্য পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দীশিবির গড়ে তুলেছে চীনের কর্তৃপক্ষ। বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়ে চীন দাবি করে ঐগুলো বন্দীশিবির নয়, কর্মমুখী প্রশিক্ষণকেন্দ্র। গত বছরের শেষে চীন ঘোষণা দেয় তাদের ঐ 'কর্মমুখী প্রশিক্ষণকেন্দ্র'গুলোতে থাকা শিক্ষার্থীর সবাই গ্র্যাজুয়েট অর্থাৎ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে কেউ কেউ 'স্বেচ্ছায়' সেখানে আরো কিছুদিন থাকবেন বলেও উল্লেখ করে কর্তৃপক্ষ। কারাকাক্স তালিকার ৩১১ জনের মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষকেই ইতিমধ্যে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকায় ২৫ জনের বেশি মানুষকে বন্দীশিবির থেকে মুক্তি দিয়ে শিল্প পার্কে কর্ম সংস্থানের জন্য পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তালিকার দুইটি ক্ষেত্রে বন্দীশিবির থেকে জেলখানায় পাঠানোর কথা উল্লেখ আছে।
চীনে সংখ্যালঘু উইগার সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মুসলমানের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের নতুন দলিল ফাঁস হয়েছে। সেসব দলিলে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে তিন হাজারের বেশি নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটিসহ ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রৌমারী সীমান্তে সংঘাতের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত জুড়ে চরম উত্তেজনা। এই ছবিটি ২০০১ সালের ১৯ই এপ্রিল মেঘালয়ের ডাউকি সীমান্তে তোলা যেখানে বিএসএফ সৈন্যরা সতর্ক অবস্থায় ছিল। ২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল এই গ্রামে ঘটে যায় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সে সংঘর্ষে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ'র ১৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাংলাদেশের তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (এখন বিজিবি) ২ জন সৈন্য নিহত হয়। বড়াইবাড়ি গ্রামে সীমান্তের অপর পাশে ভারতের আসাম রাজ্যের সীমান্ত। ১৮ই এপ্রিল ভোর রাতে বড়াইবাড়ি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা তাদের কৃষিজমিতে সেচ কাজ দেখতে যান। এসময় তারা দেখতে পান ধানক্ষেতে বহু সৈন্য অস্ত্র নিয়ে হাঁটছে। এই সৈন্যদের মধ্যে কয়েকজন এসে গ্রামবাসীর কাছে হিন্দি ভাষায় জানতে চান, বিডিআরের ক্যাম্প কোথায়? তখন গ্রামবাসী বুঝতে পারেন এরা ভারতের বিএসএফের সদস্য। বড়াইবাড়ি গ্রাম, এখানেই ঢুকেছিল ভারতের বিএসএফ সৈন্যরা। বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে বিএসএফ ঢুকে পড়ার খবরটি বেশ দ্রুত বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পে পৌঁছে দেন সাইফুল ইসলাম লাল। তিনি নিজেও আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সাইফুল ইসলাম লাল যখন বিডিআর ক্যাম্পে যান তখন সেই ক্যাম্পে মাত্র আটজন বিডিআর সদস্য ছিল। "ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে আমি বিডিআরকে বললাম যে বিএসএফ আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তখন বিডিআর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। কিছুক্ষণ পরে আমি প্রস্রাব করার জন্য বাইরে এসে পুকুরের অপর পাড়ে বিএসফ সদস্যদের দেখি," বলেন সাইফুল ইসলাম লাল। "দৌড়ে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে এই খবর জানাই। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ফায়ার। শত শত গুলি, চারিদিক থেকে গুলি। আমিও তখন অস্ত্র হাতে তুলে নিলাম।" প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে ভোর পাঁচটা থেকে তীব্র গোলাগুলির আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠে বড়াইবাড়ি গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকা। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে গ্রামবাসী তাদের বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন, যিনি ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন এই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন, যিনি ২০১৪ সালে সে এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। যেদিন বিএসএফ বড়াইবাড়ি আক্রমণ করে সেদিন স্থানীয় মানুষজনকে সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন রুহুল আমিন। বিএসএফকে প্রতিরোধ করার জন্য বিডিআরের সহায়তায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১২জন সদস্যকে একত্রিত করেন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, বিএসএফ যখন বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে তখন অনেক গ্রামবাসী পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে আবার ফিরে আসে। এরপর তারা বিডিআরের সাথে মিলে বিএসএফের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। "ভোর পাঁচটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত বড়াইবাড়ি গ্রামে বিভীষিকা মুহূর্ত ছিল। দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়," বলেন রুহুল আমিন। বড়াইবাড়ি গ্রামের ধানক্ষেতে পড়েছিল বিএসএফ সৈন্যদের মরদেহ। বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের ভেতরে থাকা সাইফুল ইসলাম লাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ক্যাম্প থেকে তিনি দেখেছেন আনুমানিক কয়েকশ বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। সাইফুল ইসলাম লালের বর্ণনা মতে, বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পের আটজন সদস্য প্রচণ্ড মনোবল এবং সাহস নিয়ে প্রথম চারঘন্টা লড়াই চালিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে আশপাশের আরো দুটি বিডিআর ক্যাম্প থেকে আরো ২০জন সদস্য বড়াইবাড়িতে আসেন। তারা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিএসএফকে প্রতিহত করে। সাইফুল ইসলাম লাল মিঞা, বিডিআর'র সাথে তিনিও অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। বড়াইবাড়িতে যখন তীব্র সংঘর্ষ চলছে তখন ঢাকায় তৎকালীন বিডিআর (এখন বিজিবি) সদরদপ্তরের নির্দেশনায় জামালপুর এবং ময়মনসিংহ থেকে আরো বিডিআর সদস্য পাঠানো হয় কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়িতে। ময়মনসিংহ এবং জামালপুর থেকে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বিডিআর সদস্যরা বড়াইবাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। রুহুল আমিন বলেন, ১৮ই এপ্রিল ভোর পাঁচটা থেকে সকাল এগারোটা পর্যন্ত একটানা গোলাগুলি হয়। এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবারো শুরু হয় গোলাগুলি। এভাবে ১৮ই এপ্রিল সারাদিন এবং রাত গড়িয়ে ১৯শে এপ্রিল রাত পর্যন্ত থেমে থেমে গোলাগুলি চলে। বড়াইবাড়ি সংঘাতে ১৬জন বিএসএফ সদস্যের মৃতদেহ পাওয়া যায় বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে। বিডিআর-বিএসএফ মধ্যকার সে সংঘর্ষ 'বড়াইবাড়ি যুদ্ধ' নামে পরিচিত স্থানীয়দের কাছে। নিহত বিডিআর সদস্যদের স্মরণে সেখানে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় বাসিন্দা এবং তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের দাবি ছিল, সে ঘটনায় বিএসএফ'র আরো বেশি সৈন্য মারা গেলেও অনেকের মৃতদেহ তারা ভারতে নিয়ে গেছে। বড়াইবাড়ির বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম লাল উল্লেখ করেন, যে ১৬জন সৈন্যের মৃতদেহ নিতে পারেনি সেগুলো বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ধানক্ষেতে পাওয়া যায়। কেন রৌমারি আক্রমণ? কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ আক্রমণ করার একটি পটভূমি রয়েছে। বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান ২০১২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সিলেটের পদুয়াতে। সেখানে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ভারতের বিএসএফ একটি ক্যাম্প করে দীর্ঘদিন সে জায়গা দখল করে আছে। সিলেটের পদুয়ায় বিএসএফের সে ক্যাম্প নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোন উত্তেজনা ছিল না। ২০০১ সালের প্রথম দিকে ভারতের বিএসএফ তাদের পাশের আরেকটি ক্যাম্পের সাথে সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর দিয়ে। এই রাস্তা নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের বিডিআর আপত্তি তুললেও ভারতের বিএসএফ তাতে কর্ণপাত না করে তাদের কাজ অব্যাহত রাখে। এমন অবস্থায় বিডিআরের সে এলাকায় তাদের একটি অস্থায়ী অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। "আমরা পদুয়াতে যাই এবং সেখানে তিনটা ক্যাম্প স্থাপন করি। বিএসএফ সেখানে ছয়টা ফায়ার করে। এরপর তারা প্রায় ৭০ জনের মতো সেখানে সারেন্ডার করে। আমরা পদুয়া দখল করে নিয়েছি।" তিনি বলেন, পদুয়ার ঘটনার জের ধরে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের বড়ইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্প দখলের জন্য বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে। ২০০১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। ভারতের ক্ষোভ ও সংকট সমাধানের চেষ্টা রৌমারী সংঘাতের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের কিছু সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশিত হয়। একটি ছবিতে দেখা গেছে, গুলিতে নিহত একজন ভারতীয় সৈন্যের হাত-পা বেঁধে একটি বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে গ্রামবাসী কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। এই ছবি ভারতে সাংঘাতিক ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। ২০০১ সালের ৭ই মে ভারতের ইন্ডিয়া টুডে সাময়িকীতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এটা এমন এক ছবি যেটি বাংলাদেশ-ভারতে সম্পর্ককে ভবিষ্যতেও তাড়িয়ে বেড়াবে। ঘটনার দুদিন পরে বাংলাদেশের ভেতরে নিহত ১৬জন বিএসএফ সৈন্যের মরদেহ ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু শুরুতে ভারত সেগুলো গ্রহণ করতে চায়নি। কারণ, মৃতদেহগুলো অনেকটাই বিকৃত হয়ে পড়েছিল। বিএসএফ'র এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ২০০১ সালের ২০শে এপ্রিল ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিআর যেসব মৃতদেহ এনেছিল প্রায় সবগুলোই এতোটা বিকৃত হয়ে গেছে যে সেগুলো চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু পরবর্তীতে এক পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সে সংকটের সুরাহা করা হয় এবং মৃতদেহগুলো গ্রহণ করে বিএসএফ। ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব কামাল পান্ডেকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটজন সৈন্যকে একেবারে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। এ ঘটনাকে একটি বর্বর হত্যাকাণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেন ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব। এদিকে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং দেশটির পার্লামেন্টে বলেন যে এই ঘটনার জন্য বাংলাদেশের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন যে বাংলাদেশের সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে। তবে এই ঘটনায় প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেন। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, ২০০১ সালে তিনি পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। এই ঘটনার পর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মোয়াজ্জেম আলীকে সংকট সমাধানের জন্য দায়িত্ব দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মি. আলী তখন ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিদিনই টেলিফোন সংলাপ করেন। এদিকে বড়াই কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ি সীমান্তে সেখানকার সাধারণ মানুষজন মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যে ভারতীয় বাহিনী হয়তো বড়াইবাড়ি দখল করে নেবে। বাংলাদেশের দিক থেকে ক্রমাগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে সীমান্ত শান্ত হয়ে আসে। রৌমারি সংঘাত ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রৌমারি সংঘাতের পর অনেকে বিডিআরের ভূমিকাকে 'সাহসী' হিসেবে বর্ণনা করেন। আবার কেউ কেউ তখন এর ভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। বিডিআর'র তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যই এই ঘটনা হয়েছিল। রৌমারী সংঘাতের সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। রৌমারীর ঘটনার পর মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে বিডিআরের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফেরত আনা হয়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে। ২০১২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান বলেন, সে ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা হলেও এর কোন ভিত্তি নেই। "অনেকে বলেন শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য আমি এটা করেছিলাম। কেউ কেউ বলেন যে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে গণ্ডগোল সৃষ্টির জন্য আমি এটা করেছিলাম।" জেনারেল রহমান বলেন, "আপনারাই বিচার করুন। বর্ডারে রক্ষণাবেক্ষণ করবার দায়িত্বেই আমাকে নিয়োজিত করা হয়েছে। আমি যদি ঐ সময়ে আপোষ করতাম, তাহলে এই সমালোচনা আমাকে শুনতে হতো না। আমার তো কাজই হলো সীমান্ত রক্ষা করা এবং সীমান্তের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া।"
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামের একটি গ্রাম বড়াইবাড়ি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের লাগোয়া এই গ্রামটি অবস্থিত।
১৯৭৫ সালের তুলনায় বিশ্বে স্থূলতার হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে জাতিসংঘের এই এজেন্সি ধারণা করছে, ২০১৬ সালে বিশ্বে একশো নব্বুই কোটির বেশি মানুষের ওজন অতিরিক্ত ছিল, যাদের মধ্যে ৬৫ কোটি মানুষ স্থূলতা রয়েছে। এই সংখ্যা থেকে বুঝতেই পারা যায় কেন নানা ক্ষেত্রের মানুষজন 'স্থূলতার মহামারি' শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই রোগে প্রতি বছর অন্তত ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিজ্ঞানী এবং নীতি নির্ধারকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যেভাবে স্থূলতার বিষয়টি মোকাবেলা করা হচ্ছে তা ভুল এবং কুসংস্কার নির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু মোটা হওয়া বা স্থূলতার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আপনাকে অবাক করে দেবে। 'স্থূলতা একটি রোগ, পছন্দের ব্যাপার নয়' গবেষণায় দেখা গেছে, ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে স্থূলতার কোন সম্পর্ক নেই স্থূলতা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশের অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে, দেশটির ৩৬ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী এখন স্থূলতায় ভুগছে। ২০১৩ সাল থেকে স্থূলতাকে একটি রোগ হিসাবে বিবেচনা করে আসছে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। তা সত্ত্বেও, ২০১৮ সালেও চিকিৎসকদের সংবাদ পোর্টাল 'মেডস্কেপে'র জরিপে দেখা গেছে, দেশটির ৩৬ শতাংশ চিকিৎসক আর ৪৬ শতাংশ সেবিকা এটিকে রোগ বলে মনে করেন না। ৮০ শতাংশ চিকিৎসক উত্তর দিয়েছেন যে, স্থূলতার পেছনের বড় কারণটি হলো জীবনযাপনের ধারা। আরো পড়ুন: মোটা হলেই কি হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে? শিশুকে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে কিভাবে আগ্রহী করবেন বিশ্বজুড়ে শিশুদের মধ্যে ‘ওবেসিটি’ ছড়াচ্ছে দ্রুত গতিতে ক্যান্সারের জন্য মোটা শরীর কতটা দায়ী? তবে ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটি থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থূলতা কোন পছন্দের ব্যাপার নয়। ''শারীরিক এবং মানসিক কিছু বিষয় পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাবের সঙ্গে একত্রিত হয়ে মানুষের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা কারণ তৈরি হয়।'' ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। 'স্থূলতাকারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়।' ১৯৯০ এর দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে আসছেন যে, স্থূলতার সঙ্গে বংশগত সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯০ এর দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে আসছেন যে, স্থূলতার সঙ্গে বংশগত সম্পর্ক রয়েছে। গত জুলাই মাসে নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির একদল গবেষক আবিষ্কার করেন যে, যাদের পরিবারের পূর্বে স্থূলতার ইতিহাস রয়েছে, তাদের বংশধরদের মধ্যে এটির বিস্তারের ঝুঁকিও বেশি। যা সাম্প্রতিক দশকগুলোয় অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। উচ্চতার সঙ্গে ওজন মিলিয়ে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, আমাদের ওজন ঠিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত আছে কিনা। ওই দলটি নরওয়ের একলক্ষ উনিশ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করেছে, যারা নিয়মিতভাবে তাদের উচ্চতার সঙ্গে ওজন মেপেছেন। সেখানে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের ওজন বেড়েছে। কিন্তু জিনগত কারণে কিছু মানুষের ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। ''বর্তমানে ৩৫ বছর জিনগত প্রবণতার কারণে বয়সী একজন গড় উচ্চতার নরওয়েজিয়ানের ওপর প্রায় সাত কেজি বেশি হয়ে থাকে, যা অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না,'' বলছেন মারিয়া ব্রান্ডকভিস্ট, ওই দলের একজন গবেষক। 'অতিরিক্ত ওজন সবসময়ের জন্য অস্বাস্থ্যকর' কিছু মানুষের স্থূলতা থাকলেও সত্ত্বেও হজমের দিক থেকে স্বাস্থ্যবান এবং সুস্থ রয়েছেন, অতিরিক্ত ওজন এবং স্বাস্থ্যগত জটিলতার ব্যাপারটি অনেকেরই জানা এবং অনেকটাই প্রমাণিত একটি ব্যাপার। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রশ্ন উঠেছে যে, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা সবসময়েই কারো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিনা? ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিওলোজি বড় একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে স্থূলতা নিয়ে প্রচলিত কিছু ধারণার বিপরীত তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায় যে, কিছু মানুষের স্থূলতা থাকলেও সত্ত্বেও হজমের দিক থেকে স্বাস্থ্যবান এবং সুস্থ রয়েছেন, সাধারণ মানুষের তুলনায় হৃদরোগ বা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কোন ঝুঁকিতে নেই। তারা উচ্চ কোলেস্টেরল, রক্তচাপে ভোগেন না এবং অন্য স্থূল মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন। অনেকগুলো দীর্ঘস্থায়ী রোগের সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্ক রয়েছে বলে সবাই জানে, যেমন হৃদরোগ ও ক্যান্সার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, স্থূল মানুষদের মধ্যেও এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের এরকম বিপাকীয় জটিলতায় ভুগতে হয় না.'' লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অফ গ্রানাডা ইন স্পেনের অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো অর্টেগা, যিনি ওই প্রতিবেদনের প্রধান লেখক। ''চিকিৎসকদের এই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত যে, সব স্থূল মানুষের একই ধরণের সমস্যা থাকে না।'' 'সব ক্যালোরি একই রকম' ক্যালোরির ক্ষেত্রে সংখ্যার চেয়ে মানের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে 'বেশি না খাওয়া' নীতি হচ্ছে সবচেয়ে ভালো নীতি। কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে ক্যালোরির পরিমাপের চেয়ে ক্যালোরির মানের বিষয়টি কি বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত নয়? স্বাস্থ্যকর খাবারের বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছেন, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন গ্রহণ করা ক্যালোরির পরিমাণ হওয়া উচিত ২০০০ ক্যালোরি। কিন্তু সেখানে সতর্কবাণীও আছে। সংস্থাটি পরামর্শ দিয়েছে যে, ওই ক্যালোরির ৩০ ভাগেরও কম আসা উচিত চর্বিযুক্ত খাবার থেকে। ২০১১ সালের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, 'ক্যালোরি মানে শুধু ক্যালোরি নয়' এবং কিছু খাবারের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ওজন বাড়তে পারে। বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর: সিরিয়ায় কি ইসলামিক স্টেট ফিরে আসতে পারে? বুয়েটে সরকারবিরোধী ক্ষোভ ঠেকাতে তৎপর আওয়ামী লীগ ছাত্রদের কতটা কাজে আসছে ছাত্র রাজনীতি? বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ: কী রয়েছে ভিসির ঘোষণায়? গবেষকরা চারবছর পর পর ১ লাখ ২০ হাজার স্বাস্থ্যবান পুরুষ ও নারীর ওপর গবেষণা করেছেন যাদের বয়স সর্বোচ্চ বিশ বছর। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা প্রতি চার বছরে গড়ে ১.৫২ কেজি ওজন বেড়েছে আর পুরো বিশ বছরে ওজন বেড়েছে ৭.৬ কেজি। ওজন বাড়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রক্রিয়াজাত খাবার, পরিশোধিত শস্য, চর্বি এবং চিনি। শুধুমাত্র ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার কারণে প্রতি চার বছরে দেড় কেজি ওজন বেড়েছে। অন্যদিকে বেশি পরিমাণে সবজি খাওয়ার কারণে ওজন উল্টো ০.০৯ কেজি কমে গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, '' কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ার কৌশল সবচেয়ে ভালো কাজ দেবে তখনি যখন, বিশেষ কিছু খাবার এবং পানীয় কম (বা বেশি) পরিমাণে খাওয়া হবে।'' 'ওজন কমানো নিয়ে হতাশা এড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে।' অনেক বেশি প্রত্যাশা করা না হলে সেটি জীবনের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে। অনেক বেশি প্রত্যাশা করা না হলে সেটি জীবনের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে। তবে গবেষণা বলছে, উচ্চকাঙ্খী লক্ষ্যমাত্রা এর ওজন কমানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোন সম্পর্ক নেই। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ নিউট্রিশন এন্ড ডায়েটিক্স এর একটি জার্নালে ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মারাত্মক স্থূলতায় ভোগা ৮৮জন ব্যক্তির মধ্যে ওজন কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক ভালো ফল এনেছে। 'শুধুমাত্র ধনী দেশগুলোয় স্থূলতার সমস্যা আছে' অস্বাস্থ্যকর খাবারের দাম কম হওয়া তা অসচ্ছল ব্যক্তিদের স্থূলতার হার বাড়িয়ে দেয় অবশ্যই উন্নত দেশগুলোয় স্থূলতার হার অনেক বেশি, কিন্তু বিশ্বের স্থূলতার তালিকার দিকে তাকালে অনেককেই অবাক হতে হবে। স্থূলতার ব্যাপকতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ, আমেরিকান সামোয়া, যেখানে বাসিন্দাদের ৭৫ শতাংশই স্থূলতায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। এটা সত্যি যে এসব দ্বীপের মানুষদের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু বেশি জনগোষ্ঠী রয়েছে, এমন উন্নয়নশীল দেশ- যেমন মিশর ও তুরস্কে-৩২ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় ভুগছে (২০১৬ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য।) ''সামাজিক বৈষম্যের কারণে তৈরি হওয়া অন্যতম একটি জিনিস হলো স্থূলতা। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি স্থূলতার রাজ্য হলো আরাকানসাস, যেটি দেশের চতুর্থ গরীব রাজ্য। সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য মিসিসিপি স্থূলতার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থায় রয়েছে।'' বলছেন মার্টিন কোহেন, যিনি ' খাবার আগে আমি ভাবি' নামের বই লিখেছেন। যুক্তরাজ্যে ২০১৫-২০১৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, সচ্ছল এলাকাগুলোর তুলনায় সবচেয়ে অসচ্ছল এলাকা গুলোয় বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার প্রায় দ্বিগুণ। গবেষকরা বলছেন, এই তারতম্যের প্রধান কারণ হলো, স্বাস্থ্যকর খাবারের দাম অনেক বেশি। 'বুকের দুধের সঙ্গে স্থূলতার কোন সম্পর্ক নেই' বুকের দুধ খাওয়ার কারণে শিশুর স্থূল হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যেতে পারে। গত কয়েক দশক ধরে বুকের দুধের বিকল্প হিসাবে গুড়া দুধের ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে, বুকের দুধ খাওয়ার কারণে শিশুর স্থূল হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যেতে পারে। ইউরোপের ১৬টি দেশের ৩ লাখ শিশুর ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, যে শিশুরা কখনো বুকের দুধ খায়নি, তাদের স্থূল হওয়ার সম্ভাবনা ২২ শতাংশ বেড়ে গেছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন, যে নারী বুকের দুধ খাওয়াবেন, তার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ব্যাপারটিও এক্ষেত্রে অনেকটা ভূমিকা রাখে। তারপরেও স্থূলতার বিরুদ্ধে বুকের দুধের ভূমিকা অকাট্য, বলছেন গবেষক জায়ো ব্রেডা। ''বুকের দুধের সত্যিই অনেক সুরক্ষা গুণ রয়েছে। সেসব প্রমাণ রয়েছে। এর সুবিধা যে এতো অসামান্য সেটি মানুষকে জানানো উচিত।''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের পরে বিশ্বে স্থূলতার হার প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে।
গত বছরেও ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল, বাংলাদেশে এই মসলাটির দাম রেকর্ড তিনশো টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদার প্রায় ৫৭ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে, প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণেই পেয়াঁজের ব্যাপারে ভারত কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। এছাড়া মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, চীন থেকেও বাংলাদেশে অল্প কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে। কিন্তু কৃষি প্রধান একটি দেশ হয়েও বাংলাদেশ কেন পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়? দেশের পেঁয়াজের চাহিদা দেশেই কীভাবে মেটানো সম্ভব? চাহিদা আর উৎপাদনের ফারাক বাংলাদেশের কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে এই উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ দেশের বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। প্রতিবেশী দেশ, সড়ক পথে দ্রুত আনা, কম দাম বিবেচনায় প্রধানত ভারত থেকেই বেশিরভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। কৃষকদের গ্রীষ্ককালীন পেঁয়াজ চাষে উৎসাহ দিচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি বিভাগ যে কারণে চাহিদার পুরোটা পূরণ করা যায় না কৃষি প্রধান একটি দেশ হয়েও পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ করতে না পারার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার। মসলা গবেষণা কেন্দ্রে তিনি পেঁয়াজ চাষের বিষয়গুলো দেখেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া আমাদের পক্ষে খুব সম্ভব। কৃষকদেরও আগ্রহ আছে। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান আগে করতে হবে। বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশে পেঁয়াজের ঘাটতির পেছনে বেশ কিছু কারণ তিনি চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, এ নিয়ে তার কিছু পরামর্শ রয়েছে। বীজের অভাব বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য পেঁয়াজের ভালো ও উন্নত বীজের অভাব রয়েছে। ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলছেন, "আমাদের দেশে প্রতিবছর মোট ১১০০ টন পেঁয়াজের বীজের দরকার হয়। সরকারিভাবে পাঁচ-ছয় টন, বেসরকারিভাবে ৫০-৬০ টন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদিত হয়। বাকিটা কৃষকরা উৎপাদন করেন।" পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়াতে হলে এই বীজের উৎপাদন এবং সংরক্ষণও বাড়াতে হবে। এক কেজি পেঁয়াজের বীজে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হয়। একেক বিঘায় গড়ে ৪০ মণ দেশী পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। গত বছর এক কেজি পিয়াজের বীজের দাম আড়াই হাজার টাকা, অর্থাৎ এক মণ পেঁয়াজের দাম এক লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এই বছর দুই লক্ষ টাকা দিয়েও এক মণ পেঁয়াজের বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সামনের বছরের উৎপাদনে। আরো পড়তে পারেন: পেঁয়াজ সংকট: ভারত আবার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিল পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলতে ভারতের ওপর চাপ বাড়ছে পেঁয়াজ: বাংলাদেশ কি পারবে ভারত-নির্ভরতা কাটাতে? পেঁয়াজ নিয়ে চমকপ্রদ ৯ টি তথ্য সমন্বিত চাষাবাদ "ঘাটতি ১০ লাখ টন পূরণ করার জন্য আমাদের বাড়তি জমিরও দরকার হয় না। আমাদের যে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়, সেখানেই ভালো জাত আর উৎপাদন কলাকৌশলে পরিবর্তন আনলে, কৃষকদের একটু প্রশিক্ষণ দিতে পারলেই চার-পাঁচ লাখ টন উৎপাদন বাড়ানো যায়", বলছেন ড. মজুমদার। "সেই সঙ্গে আমাদের অন্যান্য ফসলের সঙ্গে, যেমন আখের ক্ষেতে, ভুট্টার ভেতর, আদা-হলুদের সঙ্গে পেঁয়াজ চাষ করা যায়। গরমের সময় কচুমুখীর ক্ষেতে চাষ করা যায়।" তারা এখন পেঁয়াজ চাষের উপযোগী এলাকাগুলোর কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা যেন অন্য ফসলের সঙ্গে পেঁয়াজও চাষ করেন। দামের ওঠানামা ড. মজুমদার বলছেন, পেঁয়াজ চাষাবাদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো এর দামের ওঠানামা। কখনো কৃষক চাষাবাদ করে লোকসানের মুখে পড়েন। আবার কখনো অতিরিক্ত দামের কারণে বীজ পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন। গতবছর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কৃষক অক্টোবর মাসে তাদের পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে অনেক কৃষক এই বছর বীজ খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে পেঁয়াজের মন ছিল ৪০০ টাকা, যেখানে একমণ উৎপাদন করতে তাদের খরচ হয়েছে সাড়ে ৬০০ টাকা। ফলে লোকসান হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক কৃষক আর পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হন না। তিনি বলছেন, "গতবছর ডিসেম্বরে ফরিদপুর এবং পাবনার কৃষকদের সঙ্গে আমরা দুইটা কর্মশালা করেছিলাম। তারা বলেছেন, আমরা ৩৫ কেন, ৪০ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে দেবো, আপনারা আমাদের দামটা ঠিক করে দেন।" বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর: ট্রাম্পের ঠিকানায় পাঠানো চিঠিতে পাওয়া গেল রাইসিন বিষ আফগান নারী সাংবাদিক যখন তালেবানের মুখোমুখি আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলাম টিকবে তো? সাপ নিয়ে যত কুসংস্কার এবং আসল সত্য বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রান্নায় পেঁয়াজ অত্যাবশকীয় একটি মসলা ড. মজুমদার মনে করেন, কৃষকের চাষাবাদের খরচ বিবেচনায় রেখে মিয়ানমারের মতোও পেঁয়াজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত, যাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। লাভজনক হলে প্রতিবছরই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন, ঘাটতিও কমে আসবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রুম্মান আরা বলছেন, পেঁয়াজের দামটা যাতে সহনীয় থাকে, সেজন্য দেশে একটা নীতি নেয়া দরকার, যাতে কৃষক এই ফসল উৎপাদন করে হতাশ হয়ে না পড়েন। সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাংলাদেশে শুধুমাত্র পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোন কোল্ড স্টোরেজ নেই। কিন্তু সারা বছরের চাহিদা মেটানোর মতো পেঁয়াজ উৎপাদিত করতে হলে সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বর্তমানে কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু তাতে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হারটা বেশি হয়। পেঁয়াজের জন্য ১২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপমাত্রা দরকার। আর্দ্রতা থাকতে হবে ৩৫ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ীর মতো যেসব স্থানে পেঁয়াজের আবাদ বেশি হয়, সেখানে এরকম অনেকগুলো কোল্ড স্টোরেজ থাকলে কৃষকরা পেঁয়াজটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারতেন। ফলে তারা বেশি করে উৎপাদন করতেন। এখন যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তাতে অনেক সময় পেঁয়াজে গাছ গজিয়ে যায়। "ঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে কৃষক দামও পেতেন, বাড়তি চাষাবাদে উৎসাহিত হতেন।" বলছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রুম্মান আরা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত বিশেষ একটি কোল্ড স্টোরেজ এবং পরীক্ষামূলক গ্রিন হাউজ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। পেঁয়াজের দাম বাড়লেই ক্রেতাদেরও উদ্বেগ বাড়ে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে পেঁয়াজের ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। তার মধ্যে তিনটি জাত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত। সেগুলোর ভেতর বারি-৫ এর ওপর গবেষণাকারীরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। মার্চ মাসে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে অথবা অগাস্ট মাসে রোপণ করে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসব পেঁয়াজের ফসল পাওয়া যায়। ড. রুম্মান আরা বলছেন, "এসব গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ করলে সেটা চাহিদা বড় একটি অংশ যোগান দিতে পারে। কারণ এসব ফসল যখন উঠবে, তখন পেঁয়াজের দামও বেশি থাকে। ফলে কৃষকও লাভবান হবেন। আবার সারা বছর ধরেই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন, যোগান অব্যাহত থাকবে।" পেঁয়াজের সংকট সামলাতে কী করছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও সরকার? পেঁয়াজ যেভাবে ভারতের রাজনীতিবিদদের কাঁদাচ্ছে কিন্তু সংরক্ষণ ক্ষমতা কিছুটা কম হওয়ায় এসব পেঁয়াজের জাত এখনো কৃষকদের কাছে ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষাবাদ আস্তে আস্তে বাড়ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আরেকটা পেঁয়াজ হচ্ছে মুড়িকাটা পেঁয়াজ, যেটা অক্টোবরে লাগালে ডিসেম্বর নাগাদ ফসল পাওয়া যায়। কিন্তু এই পেঁয়াজের এখনো অনেক অভাব রয়েছে। সরকারিভাবে এই বছর সাতশো কেজি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ করা গেছে। কিন্তু কৃষকদের কাছে এই ধরণের বীজের চাহিদা রয়েছে এক লাখ কেজির বেশি। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা সবই বিক্রি করেন দেন, বীজের জন্য সংরক্ষণ করেন না। আবার সরকারি তরফেও এতো বেশি পেঁয়াজ বীজের চাষ করা সম্ভব হয় না। "বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, সেই সঙ্গে কৃষকদেরও নিজেদের বীজ তৈরি করা শুরু করতে হবে।" কর্মকর্তারা বলছেন। চরের জমি অন্তর্ভুক্ত করা গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ চর এলাকা রয়েছে। সেসব জমি যদি পেঁয়াজ উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়, তাহলেই পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদার ১০ লক্ষ টনের পুরোটা উৎপাদন করা সম্ভব। "তবে সেজন্য পেঁয়াজ উৎপাদনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। তাহলেই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষাবাদে আগ্রহী হবেন।" বলছে ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার। সব সমস্যা দূর হলে ঘাটতি মেটাতে কতদিন লাগবে? গবেষকরা বলছেন, পেঁয়াজ চাষাবাদে বীজের অভাব, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, দাম নির্ধারণ- ইত্যাদির মাধ্যমে হয়তো একবছরেই রাতারাতি ঘাটতি পূরণ হবে না। কিন্তু সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা আর উদ্যোগ কয়েক বছরের মধ্যেই পেঁয়াজের ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে। ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলছেন, "দামটা যদি স্থিতিশীল রাখায়, অন্তত উৎপাদন মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে রাখা যায়, সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা যায় আর শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন বীজের পর্যাপ্ত যোগান দেয়া যায়, তাহলে আগামী পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারবো।" 'আমদানীকারক বলে দিছে বাজারে পেঁয়াজ না ছাড়তে। তাইলে দাম তো বাড়বেই'
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার সেই ভারত অল্প কিছু পেঁয়াজ রপ্তানি করবে, এই খবরে দাম কিছুটা কমেও যেতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের তরুণদের অনেকেই এখন পেশাদারিভাবে ইউটিউব এবং ফেসবুকের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন। বাংলাদেশের কোন কোন কনটেন্ট নির্মাতা ইউটিউব এবং ফেসবুক থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করছেন। বাংলাদেশের তরুণদের অনেকেই এখন পেশাদারিভাবে ইউটিউব এবং ফেসবুকের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন। এসব ভিডিও দেখা হচ্ছে অসংখ্যবার। বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ইউটিউবার রাশেদুজ্জামান রাকিব। ইউটিউবে তিন বছরে তার আরএনএআর চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। তিনি মূলত চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে মজাদার ভিডিও তৈরি করেন। আর কিটো ভাই নামে পরিচিত মাশরুর ইনান এক বছরেই সাবস্ক্রাইবার পেয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ। ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে টাকা আয়ের উপায় নিয়ে তারা বলছেন: আরো পড়তে পারেন: যেভাবে ফেসবুক বা ইউটিউবে নজরদারি করবে সরকার কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা এখন ঝুঁকছেন ফেসবুকের দিকে ইন্টারনেটে কীভাবে নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করবেন কোন কোন পাসওয়ার্ড হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি বাড়ায়? বাংলাদেশের তরুণদের অনেকেই এখন পেশাদারিভাবে ইউটিউব এবং ফেসবুকের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন। কনটেন্ট বাছাই ও তৈরি: ইউটিউবার রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, কনটেন্ট বাছাই করার ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে যেন সেটা ব্যতিক্রমী, আলাদা ধরণের কিছু হয়। কারণ এখন অসংখ্য মানুষ ইউটিউব এবং ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করছেন, প্রতিযোগিতা অনেক। সেখানে ব্যতিক্রমী কিছু না হলে মানুষ আগ্রহী নাও হতে পারে। ''নিয়মিত কনটেন্ট আপলোড করতে হবে, ধারাবাহিক থাকতে হবে। টার্গেট থাকা উচিত প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি ভিডিও আপলোড করা।" এজন্য যেমন শিক্ষামূলক পাতা, প্রযুক্তি সম্পর্কে নানা তথ্য, মজাদার ভিডিও, গেম নিয়ে ভিডিও, বাচ্চাদের খেলনা, খাওয়া-দাওয়া, বই বা চলচ্চিত্রের রিভিউ ইত্যাদি তৈরি করা যায়। ভিডিওগুলো হতে হবে পরিষ্কার, শব্দ ভালোভাবে শোনা যাবে, সম্পাদনার কাজটি ভালো হতে হবে। সেই সঙ্গে টাইটেল, নানা ধরণের শব্দের ব্যবহার ঠিক থাকতে হবে। তবে ইউটিউব বা ফেসবুক, যে মাধ্যমের জন্যই কনটেন্ট তৈরি করা হোক না কেন, সেগুলোর যেগুলোয় অন্য কারো কপিরাইট থাকতে পারবে না। মনিটাইজেশন: ইউটিউব বা ফেসবুকে কোন ভিডিও আপলোড করলেই সেটা থেকে টাকা আসবে না। সেজন্য আপনার একাউন্টটি মনিটাইজেশন করতে হবে। এটা হচ্ছে ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে অর্থ আয়ের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়া। তবে চাইলেই এই মনিটাইজেশন করা যায় না। যেমন ইউটিউবের ক্ষেত্রে আপনাকে ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে অংশ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে: এসব শর্ত পূরণ করা হলে আবেদন করার পর আপনি ইউটিউব থেকে বিজ্ঞাপন পেতে শুরু করবেন। ইউটিউব সিপিএম বা কস্ট পার মাইলস/থাউজ্যান্ডের হার এবং সিপিসি বা কস্ট পার ক্লিকের ভিত্তিতে টাকা দেয়। কনটেন্ট, ভিউ ইত্যাদির ভিত্তিতে সিপিএম রেটও ওঠানামা করে। ফেসবুকের জন্য: মনিটাইজেশন পেতে হলে ফেসবুকের পাতায় আগে থেকেই বেশ কিছু ভিডিও আপলোড করতে হবে। এগুলো করা হলে আপনার ফেসবুক পাতাটি অ্যাড ব্রেকের জন্য উপযুক্ত হবে। তখন কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন সংযুক্ত করে আবেদন করলে ফেসবুকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার কনটেন্ট যাচাই বাছাই করে দেখবে। বিশেষ করে দেখা হবে এগুলো আসল নাকি কোথাও থেকে নকল করা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ফেসবুক মনিটাইজেশন খুলে দেবে, আপনি বিজ্ঞাপন পাবেন এবং সেটা পছন্দমতো স্থানে বসাতে পারবেন। আরএনএআর ইউটিউব চ্যানেলের রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, ফেসবুকে অনেক পাতা আছে লাখ লাখ লাইক, কিন্তু তারা মনিটাইজেশন পায়নি। আবার কোন পাতা হয়তো ত্রিশ হাজার লাইক নিয়ে মনিটাইজেশন পেয়েছে। এটা আসলে নির্ভর করে তারা ফেসবুকের শর্তগুলো কতোটা ভালোভাবে পূরণ করতে পারছে। বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ইউজারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭২ লাখ ৪৫ হাজার। কী করলে ইউটিউব-ফেসবুকের বিজ্ঞাপন বেশি পাওয়া যায় বিজ্ঞাপন পাওয়া না পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যানেল বা পেইজের নিজেদের করার কিছু নেই। কনটেন্টের ধরণ, সেটা দেখার প্রবণতা, দেশ ইত্যাদি বিচার ইউটিউব বা ফেসবুক স্বয়ংক্রিয় ভাবে বিজ্ঞাপনগুলো দেবে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিজ্ঞাপন ইউটিউবকে দেয়। ইউটিউব আবার সেসব পণ্যের সম্ভাব্য বাজার বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে বিজ্ঞাপন সরবরাহ করে। চ্যানেলের মোট কতজন সাবস্ক্রাইবার রয়েছেন, সেটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, যদি তারা চ্যানেলটি নিয়মিত না দেখেন। কারণের চ্যানেলের আয় নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের ওপর। চ্যানেলের ভিউ যতো বাড়বে, চ্যানেলটি ইউটিউব থেকে ততো বেশি বিজ্ঞাপন পেতে শুরু করবেন আর আয় ততো বাড়বে। রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, ইউটিউব বিডি আসার পর এ ধরণের কনটেন্ট থেকে আয়ের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আগে দেখা যেতো বাংলাদেশের কনটেন্টের এক লাখ ভিউ-র জন্য ২৫ ডলারের মতো পাওয়া যেতো, এখন সেটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তিনি বলছেন, ইউটিউবের নিয়ম অনুযায়ী, আট মিনিটের কম ভিডিওতে যে পরিমাণ অর্থ আসে, আট মিনিটের বড় ভিডিওতে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ পাওয়া যায়। ফেসবুকেও তিন মিনিটের বড় ভিডিওগুলোয় বেশি অর্থ আয় হয়। একমিনিটের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, তবে তার অর্থমূল্য কম। একই ভিডিও একই সঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিউবে শেয়ার করা যায়, সাধারণত সব ইউটিউবার এটা করে থাকেন। সেখানে মানুষ কতটা দেখছে, কতক্ষণ ধরে দেখছে, এর ওপর বিজ্ঞাপন বাড়ে বা কমে। ইউটিউব থেকে আয়ের ব্যাপারে রাশেদুজ্জামান রাকিব একটি ধারণা দিয়ে বলছেন, ১০ মিনিটের একটা ভিডিও যদি গড়ে ৫/৬ মিনিট করে দেখা হয়, তাহলে একলক্ষ ভিউ হলে ১৩/১৪ হাজার টাকা আয় হতে পারে। তবে আট মিনিটের নীচে হলে আয় অর্ধেক হয়ে যাবে। কিটো ভাই নামে পরিচিত মাশরুর ইনান বলছেন, ইউটিউব-ফেসবুকে যে ভিডিও মানুষ যতো বেশি দেখবে, সেটা দিয়ে ততো আয় হবে। ফলে এখন দেখা যায় অনেকেই নানা ধরণের ভ্লগিং (ভিডিও ব্লগিং) করছেন, নানা বিষয় নিয়ে রিভিউ বানাচ্ছেন। ফেসবুকে নিজের পাতার বিজ্ঞাপন বা বুস্টিং করা যায়, বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ারের মাধ্যমে লাইক বা জনপ্রিয়তা বাড়ানো যায়। এভাবে যতো বেশি মানুষ ভিডিও দেখবে, আপনার আয়ও ততো বাড়বে। বাংলাদেশের একজন ভ্লগার রাবা খান এর আগে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "আপনার যেটা থাকা দরকার সেটা হল ক্রিয়েটিভিটি, মোবাইলটা ইউজ করতে জানা, ভিডিও এডিট করতে জানা, কোনটা ভাইরাল হবে, কোনটা হবে না সেটা বোঝা, মানে মার্কেটটাকে বোঝা। ব্যাস এতোটুকু থাকাটাই যথেষ্ট।" "ক্রিয়েটিভ যারা আছেন তাদের জন্য এটা খুব ইজি। এবং চাইলেই তারা ফেসবুকে কন্টেন্ট আপলোড করে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারে। আর এর জন্য সব সময় বড় ধরণের ইনভেস্টমেন্টেরও প্রয়োজন হয় না। এই আমার কথাই ধরেন। আমি শুধুমাত্র আমার স্মার্ট ফোন আর একটা লাইট ব্যবহার করি। এটাই আমার লাইফটাইম ইনভেস্টমেন্ট।" এক সময় অর্থ আয়ের জন্য ইউটিউব প্রধান মাধ্যম থাকলেও এখন ফেসবুকও এই খাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশি স্পন্সর নেয়া কিটো ভাই নামে পরিচিত মাশরুর ইনান বলছেন, আমাদের আয়টা এখন দুইভাবে আসে। একটা ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে সরাসরি টাকা পাই। আরেকটা হচ্ছে স্পন্সরশিপ। তিনি বলছেন, ''করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর অনেক প্রতিষ্ঠান আর প্রচলিত ফর্মে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন না। এখন যাদের অনেক বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে, তখন তারা তাদের স্পন্সর করেন। তখন আমরা হয়তো তাদের কোন পণ্য আমাদের ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরি। এভাবে সরাসরি স্পন্সরদের কাছ থেকে অর্থ আয় করা যাচ্ছে।'' তিনি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কীভাবে অর্থ হাতে পাওয়া যাবে ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে পাওয়া অর্থ বের করাকে বলে পেআউট। ফেসবুকের মনিটাইজেশন চালু করার সময় ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে হয়। একটি নির্দিষ্ট ভিউ হওয়ার পর প্রতিমাসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই একাউন্টে অর্থ জমা হয়। এটা পেপ্যালের মাধ্যমেও তোলা যায়। তবে ইউটিউবের ক্ষেত্রে অন্তত ১০০ ডলার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একশো ডলারের বেশি হলে সেটা গুগল অ্যাডসেন্স ব্যবহার করে নিজের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা যায়। বাংলাদেশে এখনো ইউটিউবে বা ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা বা নিয়মকানুন নেই। তবে আইনবিরোধী কিছু করা হলে সেটা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় পড়তে পারে। শুধু একটি মোবাইল ফোন দিয়েই ইউটিউব বা ফেসবুকের জন্য ভিডিও তৈরি করা যায় ইউটিউব-ফেসবুক চ্যানেলের জন্য যা যা দরকার রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, এসব ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আসলে তেমন কিছুই লাগে না। দরকার পরিকল্পনা, ভালো একটা মোবাইল ফোন আর কনটেন্ট। ''একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যেন ভিডিও কোয়ালিটি ভালো হয়। মানুষ সব কিছুই দেখতে পছন্দ করে। আমার তো মনে হয় কিছুদিন পরে সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেস হয়ে উঠবে ইউটিউব। মানুষ যা দরকার হবে সব ইউটিউবেই খুঁজতে যাবে। '' তিনি বলছেন। ইউটিউবাররা বলছেন, ভিডিও ও ফটো এডিটিং সফটওয়্যারে দক্ষতা এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে রাশেদুজ্জামান রাকিব বলছেন, ''যে চ্যানেলই তৈরি করা হোক না কেন, সেখানে স্বকীয়তা থাকতে হবে, অন্যরা যেন সেই চ্যানেলটিকে আলাদা করতে পারে। যেসব কনটেন্ট আপলোড করা হচ্ছে, সেটা নিয়ে যেন কপিরাইটের কোন ঝামেলা না থাকে। কারণ কপিরাইট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো চ্যানেলটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।''
বাংলাদেশে এখন ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি অনেকের কাছে এগুলো অর্থ আয়ের জন্য একটি মাধ্যম হিসাবে গড়ে উঠছে।
করোনাভাইরাস থেকে যারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাদের শরীরে এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে যারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাদের শরীরে এক ধরনের অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। এমন ব্যক্তির রক্ত থেকে সংগ্রহ করা হয় প্লাজমা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সেই অ্যান্টিবডি প্রয়োগ করা হলে, তার শরীরেও সেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এমনটা দেখা গেছে। এই অ্যান্টিবডি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসকে অকেজো করতে সাহায্য করে। অবশ্য সব রোগীদের শরীরে কাজ করার ব্যাপারে সন্দেহাতীত প্রমাণ না থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন এক চিত্র। ফেসবুকে প্লাজমা চেয়ে আহ্বান: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইদানীং প্রচুর গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তারা কোভিড ১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন এমন ব্যক্তিদের প্লাজমা দিয়ে জীবন বাঁচানোর আহবান জানাচ্ছেন। তারা সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের সাথে রোগীদের যোগাযোগ তৈরি করতে সাহায্য করছেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বতঃস্ফূর্ত কাজটি করছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এই সম্পর্কিত 'হ্যাশট্যাগ'। ফেসবুকে প্লাজমা লিখে খুঁজে অন্তত কুড়িটি গ্রুপ পাওয়া গেছে। অনেক রোগীর আত্মীয় সরাসরি ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের সন্ধান করছেন। প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়ছে এ সম্পর্কিত পোষ্ট আরও বেশি চোখে পড়ছে। কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে প্লাজমা দান করেছেন এমন ব্যক্তিরাও ফেসবুকে জানান দিচ্ছেন। 'প্লাজমা ব্যাংক' তৈরির ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। ফেসবুকে 'প্লাজমা' শব্দটি লিখে খুঁজে অন্তত কুড়িটি গ্রুপ পাওয়া গেছে। প্রায় সবগুলোতে লেখা রয়েছে এই গ্রুপগুলোর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সাহায্য করা। এমন কয়েকটি গ্রুপে দেখা গেলো প্রতি ঘণ্টায় বহু মানুষ প্লাজমা দানকারীর খোঁজে ফোন নম্বর আর হাসপাতালের নামসহ পোষ্ট দেয়া হচ্ছে। ফেসবুকে এমন একটি গ্রুপের উদ্যোক্তা করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা টেলিভিশন সাংবাদিক শাহাদাত হোসেন। তিনদিনে তার গ্রুপের সদস্য দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার। তিনি বলছেন, "আমি নিজে ভুগেছি তাই বুঝতে পারছি। কারো প্রিয়জন যদি আক্রান্ত হয় সে নিশ্চয়ই চাইবে শেষ চেষ্টা করে দেখি।" বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেইয়েসাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন কী শুধু পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে এটিকে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে সংস্থাটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন দিয়েছে। যাতে প্লাজমা থেরাপিকে 'ইনভেষ্টিগেশনাল থেরাপিউটিকস' বলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, কোভিড ১৯-এর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি সকল রোগীর উপর সন্দেহাতীতভাবে কাজ করে এমন কোন প্রমাণ নেই। তাই এটি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বাইরে গবেষণার অংশ হিসেবে এটির প্রয়োগে অংশ নিতে চাইলে এর লাভক্ষতি যাচাই করার পর একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটি এবং নৈতিকতা বিষয়ক কমিটির কাছে থেকে অনুমোদিত হতে হবে। প্লাজমা থেরাপি ব্যাবহারের আগে রোগীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের পর তার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে, তা সঠিকভাবে নথিভুক্ত করে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অবহিত করতে হবে। বাড়িতে বসে কোভিড-১৯ চিকিৎসা: যে ছয়টি বিষয় মনে রাখবেন করোনাভাইরাস: সুস্থ হয়ে উঠতে কতদিন লাগে? করোনাভাইরাস: স্বাদ-গন্ধ কমলেই রেড অ্যালার্ট করোনাভাইরাস চিকিৎসায় কীভাবে কাজ করবে প্লাজমা থেরাপি? এই 'প্রটোকল' কতটা মানা হচ্ছে? শুধু পরীক্ষার জন্য প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের কথা বলা হলেও বাংলাদেশে বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এই থেরাপি দেয়া হচ্ছে। ফেসবুক গ্রুপগুলোতে গেলে বিভিন্ন মানুষের পোষ্টে বহু হাসপাতালের নাম রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া প্রটোকল তারা কতটা মানছেন সেই প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডা. মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া বলছেন, "সব যায়গায় দেয়া হচ্ছে তা সঠিক নয়। কয়েকটি যায়গায় দেয়া হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু করোনাভাইরাস একদম নতুন। এর কোন চিকিৎসা নেই, ভ্যাকসিন নেই। তাই প্লাজমা থেরাপির ব্যাপারে রোগী ও তাদের আত্মীয়রা নিজেরাই বেশি আগ্রহী।" স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলছেন, "আমাদের নিজেদের কোন গাইডলাইন নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেভাবে বলবে সেভাবেই আমরা এগোবো। সবার জন্যই যে প্লাজমা থেরাপি তা নয়। এর জন্য অ্যান্টিবডি ম্যাচিং এর একটি বিষয় আছে। করোনাভাইরাসের সব চিকিৎসাই এখন পরীক্ষামূলক। প্লাজমা থেরাপিও তাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদি রেকমেন্ড না করে তাহলে আমাদের সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও তা রেকমেন্ড করে না।" তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, "এটা যেহেতু নতুন জিনিস। মানুষ ভয়ে সামান্য কিছু দেখলেই তার পেছনে ছুটছে। আমরা সবাইকে বলছি প্লাজমা থেরাপির জন্য ছুটোছুটি করবেন না। এটা সবার জন্য না। প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের বিষয়টি যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকমেন্ডেড না সেটা হাসপাতালগুলোকে আমরা বলে যাচ্ছি।" কোভিড ১৯ ধরা পরার পর যত দ্রুত সম্ভব প্লাজমা থেরাপি দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। মরিয়া চেষ্টা ফেসবুকে একটি গ্রুপে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মায়ের জন্য প্লাজমা দানকারীর সন্ধান চেয়ে আবেদন করেছেন তামান্না আজিম। ঈদের দিন রাতে জানতে পারেন ৫৬ বছর বয়সী মায়ের করোনাভাইরাস পজিটিভ। ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় তৈরি হয় শারীরিক জটিলতা এবং এখন তার অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। মিজ আজিম বলছেন, "আমার মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় আমরা এখন এতটাই মরিয়া। আমরা শেষ চেষ্টা করছি।" প্লাজমা থেরাপিতে সন্দেহাতীতভাবে ভালো ফল মেলার যে কোন প্রমাণ নেই সেই বিষয়ে তিনি জেনেই মায়ের জন্য এর ব্যবস্থা করতে চাইছেন। তিনি বলছেন, "আমাদের চিকিৎসক এটা রেকমেন্ড করেনি। আমরা নিজেরাই চেষ্টা করছি। হাসপাতাল আমাদের রিস্ক বন্ডে সই করিয়ে নিয়েছে।" ফেসবুক গ্রুপ থেকে পাওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে এরকম আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে মোটামুটি একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। করোনাভাইরাসে ৮০ বছর বয়সী বাবাকে হারিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলছেন তিনি নিজেও ফেসবুকে একটি গ্রুপে পোষ্ট দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেছেন প্লাজমা দানকারীরাও অর্থ নিচ্ছেন। তিনি জানালেন, "আমি টাকা দিতে রাজি ছিলাম। একজন যোগাযোগ করার পর সে বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া দেবে না বলে জানালো। প্রথম যে হাসপাতালটি প্লাজমা তৈরি করতে রাজি হল তারা চেয়েছিল ১০ হাজার টাকা। কিন্তু ডোনার আসতে দেরি করায় সেখানে করা সম্ভব হয়নি। অন্য আর একটা বড় বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখি তারা নিচ্ছে ২৫ হাজার।" কিন্তু প্লাজমা তৈরি যে রক্ত দান করার মতো এত সহজ নয়, এর যে কিছু প্রটোকল রয়েছে সেটি কেউ মানছেন না। তাছাড়া যারা রক্ত দিচ্ছেন তাদের দুটি নেগেটিভ রিপোর্ট থাকতে হবে। অনেকেই না জেনে তার আগেই প্লাজমা দান করছেন। রোগীরাও তা বুঝতে পারছেন না। তাছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল রক্তে অ্যান্টিবডি মরিমাপ করার সক্ষমতা নেই। তাহলে এভাবে নেয়া প্লাজমা কতটা নিরাপদ সেটিও একটি প্রশ্ন। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস চিকিৎসার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। প্রথম দফায় ৪৫ জনের শরীরে এটি প্রয়োগের কথা ছিল। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান বলছেন, "আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছি। সরাসরি রোগীরা অনুরোধ করতে পারে না। তার যে চিকিৎসক তার মাধ্যমে আসতে হয় এবং কারা প্লাজমা থেরাপি পাবেন তারও একটি ক্রাইটেরিয়া আছে।" তিনি বলছেন, "রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। যাদের শ্বাসকষ্ট আছে, অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যাদের নিউমোনিয়া আছে এরকম মারাত্মক অসুস্থদের ব্যাপারে একটা গাইডলাইন দেয়া আছে। 'সিভিয়ারলি ইল' আর 'ক্রিটিকালি ইল' এই দুই ধরনের আক্রান্ত ব্যক্তিদের এই থেরাপি দেয়া হচ্ছে।" তিনি আরো বলছেন, "তবে অ্যান্টিবডির একটি মাত্রা থাকতে হবে। কোভিড থেকে সেরে ওঠা সকল রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি একরকম থাকে না। রক্তের প্লাজমায় যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত হলে সেটা আমরা নেই। একজনকে ২০০ মিলিমিটার পরিমাণ প্লাজমা দেয়া গেলে সেটি ভাল ফল হতে পারে। প্লাজমা থেরাপির কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। তবে দেখতে হবে সেরে ওঠা ব্যক্তির মধ্যে কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ২৮দিন পার হয়েছে কিনা।" কোভিড-১৯ ধরা পরার পর যত দ্রুত সম্ভব প্লাজমা থেরাপি দেয়ার কথা বলছেন তিনি। তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন, "শেষের দিকে আসলে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা তীব্র হয়ে যায়। ফুসফুসের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। শরীরে নানা ধরনের প্রদাহ দেখা দেয়। তখন এর কার্যকারিতা কম হয়। আক্রান্ত হওয়ার প্রথম দিকে যদি দেয়া যায় তাহলে ফলটা ভাল পাওয়া যায়।" তবে রোগীদের সুস্থ করে তুলতে বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি কতটা সফল হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন তথ্য এখনো নেই। কত রোগী প্লাজমা থেরাপি পেয়েছে তারও কোন হিসেব পাওয়া যায়নি। ডা. খান যেমনটা বলছিলেন খুব সংকটাপন্ন পরিস্থিতি তৈরি হলে আত্মীয়রা মরিয়া হয়ে প্লাজমা থেরাপির জন্য ছুটোছুটি করছেন।
করোনাভাইরাস রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেয়া নিয়ে বাংলাদেশে সম্প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে।
কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেবন্ধুর সন্তান গর্ভে ধারণ করায় ঘর ছাড়তে বাধ্য হন সালমা। এ ঘটনার মধ্যে দিয়েই তার পরিবারের কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী মানসিকতার মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা হয় সালমার। তার পেছনে যখন মায়ের বাড়ির দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল - সালমা বুঝেছিলেন কী অবস্থার মধ্যে পড়েছেন তিনি। একুশ বছরের তরুণী, দু মাসের গর্ভবতী, এবং এখন - একজন 'হোমলেস'। গৃহহীন। কারণ একটাই। একজন বাঙালি নারী হয়ে তিনি একটি কালো লোকের সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন। সালমার সমাজে বাঙালি মেয়েদের সাধারণত: মিশ্র বর্ণের - বিশেষভাবে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের সাথে বিয়ে হয় না, বিয়ের বাইরে সন্তান ধারণ তো বহু দূরের কথা। যেদিন সালমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, সেদিন তার খালা পুরো সকাল ধরে তাকে অনুনয় করেছেন, আরেকবার গর্ভপাত করিয়ে ফেলতে। কারণ সালমা এর আগে আরেকবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন এবং গর্ভপাত করিয়েছিলেন। তবে সালমার কথা - তখন তার বয়স ছিল কম। কিন্তু এখন গর্ভপাত করাবেন কিনা সেই সিন্ধান্ত নেবেন তিনি নিজে, অন্য কেউ নয়। "আমি চাইছিলাম, যে কোন ভাবেই হোক এ সন্তান আমি নেবোই। হ্যাঁ, এর মানে হচ্ছে আমার পরিবার, কেরিয়ার সবকিছুই আমাকে ছাড়তে হবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই," বলছিলেন সালমা। মা কাঁদছেন বাড়ি থেকে বেরিযে যাবার আগের মুহূর্তে সালমা দেখতে পেয়েছিলেন, তার মা কাঁদছেন। তার চোখের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে সামনে রাখা আধা-খাওয়া রুটির ওপর। "আমি জানি, মা-র মনে হচ্ছিল আহা যদি তার মেয়ের পেটের বাচ্চাটা কোন বাঙালির হতো। তাহলে তিনি সেই ছেলের পরিবারকে ফোন করতে পারতেন, একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন, তাহলে ব্যাপারটা আর 'অবৈধ' থাকতো না।" কিন্তু এই সন্তানটির পিতা যে কৃষ্ণাঙ্গ। সালমার মা ব্রিটেনে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। সালমা অন্য আত্মীয়-স্বজনদের এ নিয়ে কথা বলার বা তাদের বাড়িতে আসার সুযোগও দেননি। তিনি তার গোলাপি নোকিয়া ৩২১০ ফোনটি তুলে নিয়ে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার কথা, তিনি গর্ভপাত করাবেন না, এবং এই সন্তান রাখার সিদ্ধান্ত যে পরিবার সমর্থন করে না তাদের সাথে তিনি থাকবেনও না। পাশের বাড়ির ছেলে সালমার প্রেমের গল্পকে বলা যায় 'ক্লাসিক লাভ স্টোরি'। ছেলেটি থাকতো পাশের বাড়িতে। আর সালমা প্রেমে পড়তে উন্মুখ এক সহজ-সরল মেয়ে। যদিও দক্ষিণ এশীয়রা শত শত বছর ধরে বর্ণবাদের মোকাবিলা করেছেন, কিন্তু এই সম্প্রদায়ের মধ্যেই - অন্য আরো কমিউনিটির মতোই - কালো-বিরোধিতা বা কৃষ্ণাঙ্গ লোকদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা অত্যন্ত ব্যাপক। সালমাকে কোন বাঙালি আন্টি কখনো সরাসরি বলেননি যে "কালোরা খারাপ লোক"। বরং কালোর ব্যাপারে এই বৈরিতা স্পষ্ট হয়ে উঠতো শৈশব থেকে সাধারণ নানা পারিবারিক কথাবার্তায়। যেমন "বাইরের রোদে যেওনা গায়ের রং কালো হয়ে যাবে," বা "ওই মেয়েটা ফর্সা, ওর বিয়ের প্রস্তাবের কোন অভাব হবেনা।" সালমার মা এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। সেখানে যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রথার মধ্যে তিনি বাস করেছিলেন - তার প্রভাবে এ ধারণা মজ্জাগত হয়ে গিয়েছিল যে ফর্সা রঙ মানেই শ্রেয়তর। শুধু তাই নয়, এর সাথে ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সম্পর্কে বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া সবচেয়ে খারাপ ধারণাগুলো। "ওরা শুধু তোমাকে গর্ভবতী করতে চায়," ১৬-বছরের সালমাকে বলেছিলেন তার মা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তিনি তার পেটে হাত দিয়েও দেখেছিলেন। পাশের বাড়ির ছেলেটির সম্পর্কে পারার পরে তিনি বলেছিলেন, "ওদের কাছে তুমি দাম পাবে না।" কিন্তু যখন তিন-তিনজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা এই পরিবারেই বিয়ে করেছিলেন - তখন কেউ এরকম কোন কথাই বলেনি। অভিবাসীর স্বপ্ন সালমার বাবা-মা লন্ডনে এসেছিলেন ত্রিশ বছর আগে। বাংলাদেশ থেকে এসে তারা উঠেছিলেন লন্ডনের এমন একটি হা‌উজিং এস্টেটে যা ছিল বিলাসবহুল দোকান হ্যারডস থেকে হাঁটা পথ দূরে। অভিবাসীবাসীদের স্বপ্নের জীবন হাতে পেয়েছিলেন তারা। "আমাদের একটা হ্যারডসের শপিং ব্যাগ ছিল - আর সেটা ছিল পরিবারের একটা মূল্যবান জিনিসের মতো। ওটাকে সুন্দর করে ভাঁজ করে রান্না ঘরে রেখে দেয়া হতো, আর বাড়িতে কোন অতিথি এলে তা বের করা হতো। তারা জানতেন না যে ওই ব্যাগটা দেয়া হতো হ্যারডসের সবচেয়ে সস্তা জিনিসটা কেনার সময় - আর তা হলো চীনাবাদাম" - বলছিলেন সালমা। সালমার বাবা-মা আলাদা হয়ে যাবার ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেদিন - যেদিন তার নিজের চাবিটা দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খোলা যাচ্ছিল না। মা আর মেয়ে মিলে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। সেই ফাঁকে বাবা বাড়ির সদর দরজার তালাটা পাল্টে ফেললেন। দুটি সন্তান নিয়ে সালমার মা হয়ে গেলেন গৃহহীন। বিবাহবিচ্ছেদের কারণে তার মাকে তার নিজের সমাজেই খারাপ চোখে দেখা হতো। কিন্তু যারা বাঙালি নয়, তাদের মধ্যেও তিনি 'বাইরের লোক' হিসেবেই রয়ে গেলেন। "মায়ের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল যে আমার পরিণতিও তার মতোই হয় কিনা" - বলছিলেন সালমা। "তা সত্বেও আমি দমে যাইনি। আমি আমার সংস্কৃতি, কর্মজীবন আর নিজ সমাজকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলাম, একজন কৃষ্ণাঙ্গ লোকের জন্য। আমি জানতাম তার সাথে অন্য মেয়েদের সম্পর্ক আছে, তার কখনোই আমাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা ছিল না। এখন সে আমাকে একটি কন্যা সন্তান দিয়েছে। আমার মা মনে করেন, তাকে লালনপালন করার কোন ক্ষমতা আমার নেই।" শিশু সন্তান নিয়ে আবার মায়ের কাছে ফেরা সালমার কন্যাসন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পরই তিনি তার মায়ের বাড়িতে এলেন। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন, ভেতরে বড়দিনের আলোকসজ্জা করা হয়েছে, পাওয়া যাচ্ছে মুরগির রোস্টের গন্ধ। কোলের শিশুটিকে সামলে তিনি কলিংবেল টিপলেন। দরজা খুলে দিল তার ভাই। বোনের কোলে ছোট বাচ্চাটিকে দেখে সে উল্লসিত হয়ে উঠলো। ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলেন সালমা। তিনি ভাবছিলেন, তার বাচ্চাকে দেখে মা কি জানি কি আচরণ করেন। তবে তার প্রিয় ইংলিশ খাবার রোস্ট চিকেনের গন্ধটা থেকে মনে হচ্ছিল - লক্ষণ ভালো। কারণ এ পরিবারে মৈত্রী স্থাপনের উপায় হচ্ছে খাবার। সালমা তার মেয়েকে আরেকটি ঘরে শুইয়ে রেখে খাবার টেবিলে এসে বসলেন। মা তাকে চিকেন পরিবেশন করলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে চোখাচোখি হচ্ছিল না। এমন সময় পাশের ঘর থেকে বাচ্চাটি কেঁদে উঠলো। সালমা ওঠার উপক্রম করতেই তার মা তাকে ধামিয়ে দিয়ে বললেন, "আমি যাচ্ছি"। একটু পরই বাচ্চার কান্না থেমে গেল। মা তার নাতনিকে এই প্রথম কোলে নিয়েছেন। সালমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি বুঝলেন, কালোদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা না থাকলেও তার কন্যাসন্তানকে ভালোবাসতে পারবেন তার মা। তিনি চাইছিলেন এটাই - তার মায়ের সাহায্য এবং বাড়িতে ফিরে আসার সুযোগ। "কয়েকদিনের মধ্যেই মা আমার শিশু সন্তানের জন্য মুসলিম রীতিনীতি অনুযায়ী যা যা করণীয় তা সম্পন্ন করলেন, আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করলেন।" সালমা বাড়ি ছেড়ে যাবার পরের কয়েক মাসে কী হয়েছিল তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোন কথাই হলো না। বিপর্যয় বিপর্যয় আঘাত হানলো পাঁচ সপ্তাহ পরই। সালমা জানতে পারলেন, তার ছেলে বন্ধুটি পুরো সময়টা জুড়েই অন্য আরেক নারীর সাথে ছিল, এবং সেই নারীও একটি সন্তান প্রসব করেছে। ব্যাপারটা এমন যে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের ব্যাপারে সালমার মা যে ভয়টা করতেন - তা-ই যেন সত্যি হয়ে এলো। তার বদ্ধমূল ধারণাগুলো সঠিক বলে নিশ্চিত হয়ে গেল। "তুমি আরেকটু ফর্সা কাউকে বেছে নিলেই তো পারতে" - সালমাকে বলেন তার এক আত্মীয়। এ নিয়ে এক নিরব উত্তেজনা আর ক্রোধ সালমার জীবন বিষিয়ে তুললো - তিনি গভীর বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলেন। "আমার মায়ের জন্য ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম যেন তাকে দুটি সন্তানের যত্ন নিতে হচ্ছে - একটি আমি নিজে, আরেকটি আমার মেয়ে। তিনি আমাদের ঘুম থেকে জাগাতেন, খাওয়াতেন, যত্ন নিতেন এবং অন্য সবার কাছ থেকে আমাদের আড়াল করে রাখতেন।" এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সালমা কবিতা লিখতেন, পড়াশোনা করতেন। সন্তান জন্মের সাত মাস পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যজুয়েশন শেষ করলেন। তিনি জানেন তার মায়ের সহায়তা ছাড়া কখনো এটা সম্ভব হতো না, তবে এ কথা তার মাকে তিনি কখনো বলেননি। সালমার মা তখনো তার মেয়ের বেছে নেয়া জীবন সমর্থন করতেন না। বিশেষ করে সালমা যখন তার ছেলে-বন্ধুর কাছে ফিরে যাওয়া এবং একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি করার পর দ্রুতই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সালমা। তার মায়ের প্রতি তিনি একই সাথে যে কৃতজ্ঞতা এবং বিরাগ বোধ করছিলেন তা তিনি প্রকাশ করতে পারেননি। অপ্রত্যাশিত মোড় বদল এর পরের কয়েক বছরে সালমার জীবনে আরো কিছু ঘটনা ঘটলো যা তিনি আশা করেন নি। সেই একই ছেলেবন্ধুর সাথে তার আরেকটি সন্তান হলো। তবে এর পর লোকটি তাকে একেবারেই ছেড়ে গেল। সালমা তখন তার যৌথ পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেও সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলেন - যারা এর আগে তার এবং তার সন্তানদের ত্যাজ্য করেছিল। তাদের একজন তো সালমার কাছে গর্ভপাতের পক্ষে কথা বলার জন্য দু:খ প্রকাশও করলেন। তবে সালমার আত্মীয়দের কথাবার্তায় কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী মানসিকতা কখনো পুরোপুরি দূর হয়ে যায়নি। "ভালো হয়েছে যে ওরা বেশিরভাগ তোমার মতোই দেখতে হয়েছে" - তার মা বলেছিলেন, "ওই ছেলেটি তো তোমাকে এক সময় ছেড়ে যেতোই।" আরেকজন বলেছিলেন,"তুমি আরেকটু ফর্সা কাউকে বেছে নিলেই তো পারতে।" সালমা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে এসব কথা কত অপমানজনক, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। তবে সালমার নিজের সন্তানরা যথন বড় হতে লাগলো, তখন তিনি তার মায়ের উদ্বেগগুলো অনেক সহজে বুঝতে পারতেন। "আমি এখন বুঝি যে ভালোবাসা আর সুরক্ষার জায়গা থেকেই এটা এসেছিল," বলেন তিনি, "চূড়ান্ত বিচারে তিনি তাই করছিলেন যা থেকে তার মেয়ের সুখ ও শান্তি মিলবে বলে তাকে শেখানো হয়েছিল।" তবে সালমা যে তার মায়ের কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করেননি তা নয়। একদিন তিনি তার মাকে বলেছিলেন, "সে কালো বলেই তো তুমি এরকম করছো, তাই না?" "না" - তার মা শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলেন, "কালো বলে নয়, আসল কারণ সে মুসলিম ছিল না। সে আমাদেরকে বুঝতে পারেনি।" সালমা স্তব্ধ হয়ে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই প্রথম তার মা ধর্মের ওপর এতটা জোর দিচ্ছেন। কিন্তু যে তিনজন অমুসলিম মহিলাকে এ পরিবারে বউ হিসেবে স্বাগত জানানো হয়েছিল - সেটা তাহলে কী? সালমা এখন মনে করেন, তার মা ওই কথাটার মধ্যে দিয়ে মুখে না বললেও একভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তার কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী মনোভাবের কথা। "আমার মনে হয় ওই মুহূর্তে তিনি বুঝেছিলেন গায়ের রঙের ভিত্তিতে তৈরি ওই সব বদ্ধমূল বিরূপ ধারণাগুলো আসলে কতবড় অন্যায়। এবং সেজন্যই তিনি কথাটা ঘুরিয়ে ধর্মের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।" তার পর ওই পরিবারে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। কয়েক মাস আগে সালমার ভাই একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার সাথে প্রেম করতে শুরু করেন। সালমাকে বিস্মিত করে তার মা একটুও ইতস্তত: না করে ব্যাপারটা মেনে নিলেন। "আমি বলবো, যে মহিলা কখনো তার কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী মানসিকতার কথা স্বীকার করেননি বা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি - তার জন্য এটা একটা অগ্রগতি।" সালমা বলছেন, "মা যতদূর এগিয়ে এসেছেন তার জন্য আমি গর্বিত, তবে আমাদের আরো অনেক দূর যেতে হবে।" "ওই মানসিকতার জন্য আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না, তবে এখন এটা চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে, শুধু আমার একার দিক থেকে নয়, কমিউনিটি হিসেবেও।" ( সালমা নামটি একটি ছদ্মনাম। রিপোর্টে ব্যবহৃত ছবিগুলো এঁকেছেন তানজিনা পারিসা কবির ) আরো পড়তে পারেন: এক দম্পতির ছবিকে ঘিরে আলোচনায় আন্ত:বর্ণ বিয়ে আমেরিকায় যে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে চিড়িয়াখানার খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছিল লন্ডনে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ: বর্ণবাদের যাতাকলে ৩০ বছর
কৃষ্ণাঙ্গ একজন ছেলেবন্ধুর সন্তান গর্ভে ধারণ করার ফলে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সালমা - এক ব্রিটিশ-বাঙালি তরুণী।
ভারতে স্থানীয়ভাবে তৈরি কোভ্যাকসিনের এক ডোজের দাম এখন ২০ ডলার ''এটা ছিল কে কত দ্রুত আঙুল চালাতে পারে তার খেলা,'' তিনি বলছেন। ''সবগুলো স্লট তিন সেকেন্ডেই ভরে গেল।'' কিন্তু শেষ মুহূর্তে হাসপাতাল তার নির্ধারিত স্লটটি বাতিল করে দিল। তাকে জানানো হল তাদের কাছে কোন ভ্যাকসিন নেই। মিজ মারাথেকে আবার নতুন করে ভ্যাকসিন নেবার সময় বুক করার চেষ্টায় নামতে হল। ভারতে ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সী প্রত্যেককে টিকা পাবার জন্য কো-উইন নামে সরকারি ওয়েবসাইটে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। টিকা নেবার দাবি এখন ভ্যাকসিনের সরবাহকে ছাপিয়ে গেছে। প্রযুক্তি বিশারদ ভারতীয়রা এমনকি এখন দুষ্প্রাপ্য এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবার কৌশল খুঁজতে মরিয়া হয়ে এখন ইন্টারনেটে সঙ্কেত-কোড উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছে। মিজ মারাথে এসব সঙ্কেত জানেন না। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে তিনি স্বচ্ছন্দ। ভারতের যে কয়েক লাখ মানুষ ডিজিটাল জগতের সাথে যুক্ত তিনি তাদের দলে। তবে অন্যদিকে, ভারতে কোটি কোটি মানুষ আছে যাদের না আছে স্মার্টফোন, না আছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ। আর বর্তমানে টিকা পাবার একমাত্র পথ হল অনলাইনে সময় বুক করা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার যখন প্রায় ৯৬ কোটি ভারতীয়র জন্য টিকাদান কর্মসূচির দরোজা খুলে দেন, তখন সরকারের হাতে প্রয়োজনের কাছাকাছি পরিমাণ টিকাও ছিল না। ভারতের ৯৬ কোটি মানুষকে পুরো টিকা দেবার জন্য প্রয়োজন ১৮০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। আরও শোচনীয় যে ভারতে যখন কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে এবং তৃতীয় আরেকটি ঢেউ আসছে বলে সতর্কবার্তা আসছে, তখনই দেখা গেল টিকার ব্যাপক ঘাটতি। আরও পড়তে পারেন: জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেছেন, মি. মোদীর সরকারের নানা ভুলত্রুটির মিশেল ভারতের টিকাদান উদ্যোগকে একটা গভীর অসম প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছে, যেসব ভুলত্রুটির মধ্যে আছে পরিকল্পনার অভাব, খণ্ডিত ভাবে ভ্যাকসিন সংগ্রহ এবং টিকার মূল্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা। পৃথিবীর যে দেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা প্রস্তুতকারী, যে দেশকে প্রায়ই বলা হয় সাধারণ ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে "বিশ্বের ওষুধ নির্মাতা", সেই দেশ নিজের জন্য কীভাবে এত কম ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে? 'অপরিকল্পিত কৌশল' "ভারত তার ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য অর্ডার দেবার জন্য জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। আরও অনেক আগেই ভারত তার আগাম অর্ডার দিতে পারত। এবং ভারত অর্ডার দিয়েছিল খুবই সামান্য পরিমাণ টিকা," বলছেন আচল প্রোভালা, যিনি ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার ওষুধ পাবার ব্যাপারে তদ্বিরকারী একটি সংস্থা অ্যাকসেসআইবিএসএ-র সমন্বয়কারী। ভারত ২০২১এর জানুয়ারি এবং মে মাসের ভেতর কেনে দুটি অনুমোদিত টিকার ৩৫ কোটি ডোজ - অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন, যা ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউট তৈরি করছে কোভিশিল্ড নামে এবং ভারতীয় সংস্থা ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন। প্রতি ডোজ টিকার জন্য দেয়া ২ ডলার মূল্য ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুলভ মূল্যের টিকাগুলোর অন্যতম। কিন্তু এই পরিমাণ টিকা দেশটির জনসংখ্যার এমনকি ২০%এর জন্যও যথেষ্ট ছিল না। মি. মোদী ঘোষণা করে দেন যে, ভারতে কোভিড পরাস্ত হয়েছে। এমনকি তিনি ভ্যাকসিন কূটনীতিও শুরু করে দেন। মার্চে মাসে ভারতে যত মানুষকে টিকা দেয়া হয়, তার থেকে বেশি পরিমাণ টিকা তিনি বিদেশে কূটনীতি করতে দান করে দেন। উল্টোদিকে, আমেরিকা এবং ইইউ ভ্যাকসিন বাজারে আসার প্রায় এক বছর আগেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ডোজ টিকা আগাম অর্ডার করে দিয়েছিল। ৪৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ১০ কোটি ভারতীয় এখনও দ্বিতীয় ডোজ টিকার অপেক্ষায় দিন গুনছেন "এই টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সরবরাহ ও বিক্রির ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছিল, এবং ভ্যাকসিন উৎপাদনের সাথে সাথে কোন কোন দেশের সরকার যাতে দ্রুত প্রচুর পরিমাণ টিকা হাতে পায় তারও নিশ্চয়তা দিয়েছিল," বলছেন মি. প্রোভালা। সেখানে ভারত টিকা উৎপাদনে সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেককে সহায়তা করার জন্য ৬১ কোটি ডলার অর্থসাহায্য অনুমোদন করতে অপেক্ষা করেছে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত। ততদিনে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সহ-আহ্বায়ক মালিনী আইসোলা বলছেন, আরেকটি ব্যর্থতা হল ভারতে জৈব বিষয় নিয়ে কাজ করে এমন বহু উৎপাদন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে এই উদ্যোগে সামিল করা। তাদের টিকা তৈরির সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের এই কাজে অনায়াসে লাগানো যেত। তিনটি সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাসহ চারটি সংস্থাকে সম্প্রতি কোভ্যাকসিন তৈরির অনুমতি দেয়া হয়েছে। কোভ্যাকসিনও তৈরি হচ্ছে আংশিক সরকারি অর্থে। অন্যদিকে, এপ্রিলের গোড়ার দিকে রাশিয়ায় স্পুটনিক ভি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের একটি ওষুধ প্রস্তুতকারকের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করে, যাদের ভারতে এই টিকাটি তৈরির অনুমতি দেয়া হয়। আরও পড়তে পারেন: ভারতে চলছে ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার সমন্বয়হীন বাজার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একমাত্র ক্রেতা হিসাবে গোড়াতেই টিকার দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা নিতে পারত, বলছেন মিজ আইসোলা। "যেহেতু কেন্দ্রীয়ভাবে ভ্যাকসিন কেনা হয়েছিল, সেক্ষেত্রে সরকার টিকার দাম ২ ডলারের নিচে নামিয়ে আনতে পারত। তার বদলে দাম বেড়ে গেছে," তিনি বলেন। এর কারণ, পয়লা মে থেকে রাজ্যগুলো এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো প্রস্তুতকারকদের সাথে আলাদা আলাদাভাবে দেন-দরবার করছে। বিরোধী দলগুলো এটাকে একটা "কেলেংকারি" আখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে "রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা হতাশাজনক প্রতিযোগিতার" দরোজা খুলে দিয়েছে। রাজ্যগুলোকে এখন কেন্দ্রীয় সরকারের কেনা দামের থেকে দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে কোভিশিল্ডের জন্য আর কোভ্যাকসিনের জন্য আরও বেশি। অর্থাৎ প্রতি ডোজ কোভিশিল্ড তাদের কিনতে হচ্ছে ৪ ডলার দিয়ে, আর কোভ্যাক্সিন প্রতি ডোজ ৮ ডলার দামে। দুটি সংস্থাই বলেছে "মানবিক কারণে" তারা রাজ্যগুলোর জন্য টিকার দাম কমিয়ে দিয়েছে। রাজ্যগুলোকে একই সাথে পাল্লা দিয়ে লড়তে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সাথে। টিকার মজুত যেহেতু কম, তাই বেশি মূল্যে যে কিনতে পারবে টিকা সেই পাবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সুবিধা তারা বাড়তি দামটা তুলে নেবে ভোক্তাদের কাছ থেকে। ফল হয়েছে: বাজার খুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু চলছে অসম প্রতিযোগিতা। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এক ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে ১,৫০০ রুপিতে অর্থাৎ ২০ ডলার দামে। বেশ কয়েকটি রাজ্য এখন ফাইজার, মর্ডানা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা আমদানির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু কোন প্রস্তুতকারকই আগামী কয়েক মাসের মধ্যে টিকা সরবরাহের কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, কারণ ধনী দেশগুলোর আগে দেয়া অর্ডারের টিকা সরবরাহের ব্যাপারে তারা চুক্তিবদ্ধ। স্পুটনিক ভি অনুমোদন পেলেও কবে তা বাজারে আসবে তা স্পষ্ট নয়। ভারতে টিকার দাম কি এত বেশি হওয়া উচিত? কেউ কেউ বলছে সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক মহামারির মধ্যে "মুনাফা" করছে, বিশেষ করে সরকারি অর্থসাহায্য পাওয়ার পরেও। কিন্তু অন্যরা আবার বলছে এই প্রতিষ্ঠান দুটি যথেষ্ট পরিমাণ ঝুঁকি নিয়েছিল এবং দোষ সরকারের। ভারত একমাত্র দেশ যেখানে শুধু কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে টিকার ক্রেতা নয় এবং টিকা বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে না অল্প যেসব দেশে ভারত তার একটি। দিল্লিতে সংক্রমণ বেড়ে যাবার কারণ কি নতুন ভারিয়েন্ট? জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একমত যে সিরাম এবং ভারত বায়োটেক তাদের উৎপাদন ব্যয় এবং তাদের বাণিজ্যিক চুক্তির বিষয়ে আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। মিজ আইসোলা বলছেন সিরামের উচিত আন্তর্জাতিক কোভ্যাক্স প্রকল্প এবং গেইটস ফাউন্ডেশন থেকে তারা যে ৩০ কোটি ডলার পেয়েছে সেটা তারা কীভাবে খরচ করেছে সেটা প্রকাশ করা। এই অর্থ তাদের দেয়া হয়েছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদনের ব্যয় বাবদ। ভারত রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় সিরাম সে কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সিরামের মাথার ওপর এখন অ্যাস্ট্রাজেনেকার আইনি নোটিস ঝুলছে, কারণ চুক্তি অনুযায়ী নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে সংস্থাটি প্রতিশ্রুত ৫০% টিকা সরবরাহ করার চুক্তি লংঘন করেছে। জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভারত বায়োটেকের সাথে ভারত সরকারের চুক্তি খুঁটিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে ভারতের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ বলেছে তারাও কোভ্যাকসিনের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বত্ত্বের অংশীদার, কারণ এই টিকা উদ্ভাবনে তারা বায়োটেকের সাথে কাজ করেছে। তবে এই টিকার দাম কোভিশিল্ডের দ্বিগুণ। জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. অনন্ত ভান বলছেন এখন এই স্বত্ত্ব ও প্রযুক্তি নিয়ে আইনি লড়াই মোকাবেলা করে অন্য সংস্থাকে এই টিকা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হবে খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সময় থাকতে এসব বিষয়ে নজর দেয়া উচিত ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের এমনকি ৭০%কে পুরো ডোজ টিকা দেয়া সবসময়েই একটা দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ উদ্যোগ ছিল যার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন ছিল। ড. ভান বলছেন ভারতে ব্যাপক পর্যায়ে টিকাদানের সফল অতীত রেকর্ড রয়েছে। কাজেই এটা অসম্ভব কোন কাজ ছিল না। তাই এখন সবচেয়ে বড় হয়ে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা হল- সরকার কেন শুধু দুটি কোম্পানির ওপর সব আস্থা রেখে এগোনর সিদ্ধান্ত নিল, যেখানে সরবরাহ এবং দামের ব্যাপারটা এখন পুরো তাদের হাতে চলে গেছে? যে প্রশ্নের উত্তর দেবার মত এখন কেউ নেই। গ্রাফিক্স: শাদাব নাজমি
কোভিডের টিকা নেবার জন্য অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে ৩১বছর বয়সী স্নেহা মারাথে-র অর্ধেক দিন লেগেছিল।
সোয়াকপমুন্ড-এর অভিজাত এলাকায় এখনও থাকেন জার্মান ঔপনিবেশিক শাসকদের বংশধররা কিন্তু যে হত্যাযজ্ঞ একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, তার মূল্য কী হওয়া উচিত? নামিবিয়ায় নিহতদের স্বজনরা এবং তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের মধ্যে এ নিয়েই এখন চলছে তীব্র দর-কষাকষি। ''এই গোটা সমুদ্র সৈকত জুড়ে তখন বসানো হয়েছিল একটি বন্দী শিবির,'' বলছেন লেইডলো পেরিনগান্ডা।" এখন যেখানে গাড়ি পার্ক করার জায়গা - সেটা ঘেরা ছিল কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে।'' শিল্পী ও সমাজকর্মী লেইডলো পেরিনগান্ডা নামিবিয়ার প্রধান সৈকত শহর সোয়কপমুন্ড-এর সমুদ্রসৈকতে কয়েক সারি কাফে আর শিশুদের খেলার জায়গা দেখাচ্ছিলেন। সেখানে নামিব মরুভূমির বালুর ওপর আছড়ে পড়ছে আটলান্টিকের ঢেউ। সোয়াকপমুন্ড "আমার প্রপিতামহী আমাকে বলেছেন আমাদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল, কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তারা এখানেই মারা যায়।" সময়টা ছিল ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত। আজকের নামিবিয়া তখন দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় জার্মানির উপনিবেশ ছিল। নামিবিয়ার প্রধান দুই জাতিগোষ্ঠী হেরেরো এবং নামা-দের অভ্যুত্থান নির্মমভাবে দমন করেছিল জার্মান ঔপনিবেশিক বাহিনী এবং তাদের হাতে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। বাকিরা দেশের পূর্বাঞ্চলে মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানে অনাহারে তাদের মৃত্যু ঘটে। যারা প্রাণে বেঁচেছিল, তাদের ঢোকানো হয়েছিল বন্দী শিবিরে, সেখানে তারা ক্রীতদাসের কাজ করত। তাদের মৃত্যু ঘটে ঠাণ্ডায়, অপুষ্টিতে ভুগে, চরম ক্লান্তি, ক্ষুধা আর সহিংসতার শিকার হয়ে। ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুতে জার্মান শাসনাধীন দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকায় ৮০ হাজার হেরেরো জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ৬৫ হাজার এবং বিশ হাজার নামা গোষ্ঠীর মধ্যে ১০ হাজারেরই মৃত্যু ঘটেছিল বলে অনুমান করা হয়। জার্মানি ২০১৫ সালে ওই নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয় এবং এর ন্যায় বিচার হিসাবে নামিবিয়াকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য চুক্তি করতে আলোচনা শুরু করে। এই চুক্তি সারা বিশ্বের জন্য একটা নজির সৃষ্টি করবে, কারণ এর আগে কোন সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের অতীত আচরণের জন্য ক্ষতিপূরণের অঙ্ক স্থির করতে তাদের সাবেক উপনিবেশ রাষ্ট্রের সাথে আলোচনাসাপেক্ষে একটা সার্বিক চুক্তি করেনি। জার্মানি বলেছে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নামিবিয়ার কাছে ক্ষমাও চাইবে। কিন্তু সেই ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা কী হবে তা এখনও ঠিক করা হয়নি। কিন্তু নামিবিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল আর্থিক ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বা ধরণটা কী দাঁড়াবে? আরও পড়তে পারেন: কনেসেনট্রেশন ক্যাম্প বা বন্দী শিবিরে নিহতদের গণকবরে লেইডলো পেরিনগান্ডা লেইডলো পেরিনগান্ডা, যিনি নিজে হেরেরো সম্প্রদায়ভুক্ত, এই চুক্তি থেকে তারা কী চান তা তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। তারা চান একটা বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ যা হেরেরোদের গণহত্যা পূববর্তী সমৃদ্ধি ফিরিয়ে দেবে। জার্মানরা গণহত্যায় এই জাতিগোষ্ঠীকে প্রায় নিশ্চিহ্ণ করে দেবার আগে হেরেরোরা মূলত পশুপালন করতেন, তারা ছিলেন সচ্ছল। গণহত্যার পর তাদের বেশিরভাগ জমিজমা ভাগাভাগি করে নেয় জার্মান বসতি স্থাপনকারীরা, তারাই এসব জায়গাজমির বেসরকারি মালিক হয়ে বসে। বর্তমানে হেরেরো এবং নামা গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ বাস করেন হয় পরবর্তীকালে তাদের জন্য বন্টন করে দেয়া একফালি ছোট্ট জমিতে। তাদেরই বাপদাদার জমি টুকরো টুকরো করে তাদের দেয়া হয়েছিল। সোয়াকপমুন্ডের ঘিঞ্জি বস্তির বসিন্দা মূলত নামিবিয়ার হেরেরো সম্প্রদায়ের মানুষ বাকিরা থাকেন শহরের ঘিঞ্জি অস্থায়ী বস্তিতে। নামিবিয়ার ৪০% মানুষই এখন বস্তির বাসিন্দা। সোয়াকপমুন্ড সৈকত শহরে অভিজাত এলাকায় ঔপনিবেশিক আমলের বিশাল সুদৃশ্য বাড়িগুলোতে এখনও বাস করেন সেই ঔপনিবেশিক শাসকদের বংশধররা। আর শহরের আরও উত্তর দিকে কাঠ আর ধাতুর জোড়াতালি দিয়ে তৈরি জীর্ণ চেহারার যেসব বসতবাড়িতে দারিদ্রের ছাপ প্রকট, সেখানে থাকেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের বাথরুমে টয়লেট ফ্লাশ করার বা পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই, তাদের বিদ্যুত নেই," লেইডলো বলছেন। "এখানে যারা থাকেন - তাদের অনেকেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের বংশধর। এটা তাদের প্রতি খুবই অন্যায় আচরণ।'' জার্মান শাসনকালে বন্দী শিবিরে (কনসেনট্রেশন ক্যাম্প) রাখা হয় হাজার হাজার হেরেরো ও নামা বন্দীদের লেইডলো বলেন: "জার্মানির উচিত আমাদের পূর্বপুরুষের যেসব জমি তারা কেড়ে নিয়েছিল, সেগুলোর জন্য দাম পরিশোধ করে দেয়া।" নামিবিয়ানদের দাবি এবং আশা, জার্মান সরকার একটা ভূমি সংস্কার কর্মসূচির জন্য অর্থ দেবে, যা দিয়ে জার্মান নামিবিয়ান কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়ে সেগুলো নামিবিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হেরেরো এবং নামা জনগোষ্ঠীর মানুষকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। নামিবিয়ার কৃষিজমির প্রায় ৭০ শতাংশের মালিক শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা - যাদের অধিকাংশই জার্মান নামিবিয়ান। নামিবিয়ার পক্ষে আলোচনাকারী দলের প্রধান ড. জেড এঙ্গাভিরু বলছেন - জার্মানি "স্বীকার করেছে যে আমাদের সমাজ পুর্নগঠনে তাদের সহায়তা করা উচিত" এবং যারা তাদের জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক, সার্বিক চুক্তির অংশ হিসাবে তাদের কাছ থেকে আমাদের জমি কিনে নেবার অর্থ দিতে তারা সম্মত হয়েছে। তবে মি. এঙ্গাভিরু বলেছেন: "শুধু আমাদের জমির সমস্যা জার্মানি সমাধান করে দিলেই যে দায়মুক্তি ঘটবে সেটা ভাবা বোকামি হবে। কারণ শুধু জার্মানির ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ই যে আমরা ভূমিহীন হয়েছি তা নয়।" প্রধান আলোচক জেড এঙ্গোভিরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি তাদের এই উপনিবেশ হারানোর পর বহু শ্বেতাঙ্গ বসতিস্থাপনকারী নামিবিয়ায় এসেছে। পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা শাসন করেছে। মি. এঙ্গাভিরু বলছেন জার্মানি "ভুলের প্রতিকার" শব্দটা ব্যবহার করতে অনাগ্রহী, তবে নামিবিয়ার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন এবং পানি লবণ-মুক্ত করার বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনার এই পর্যায়ে ক্ষতি বাবদ কোন অর্থমূল্যের উল্লেখ করা তিনি সমীচিন মনে করছেন না। জার্মানিও আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকার করেছে। তবে ছয় বছর ধরে চলা এই আলোচনায় কোন নিষ্পত্তি নাা হওয়ায় লেইডলোর মত হেরেরো ও নামা সম্প্রদায়ের মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। তিনি বলছেন জার্মান সরকারের উচিত হেরেরো এবং নামা গোষ্ঠীর নেতাদের এই আলোচনায় অর্ন্তভুক্ত করা। ১৯০৪ সালে জার্মানির ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল হেরেরো জনগোষ্ঠী, কিন্তু ওয়াটারবার্গের লড়াইয়ে জার্মানরা তাদের বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দেয় জার্মানির ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০৪ সালে হেরেরো জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ জার্মান শাসকরা কঠোরভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। হেরেরো জনগোষ্ঠীর প্রধান ভেকুই রুকরো জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আমেরিকান আদালতে মামলা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। হেরেরো গোষ্ঠীর আশংকা দুই সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি হলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর ভাগে হয়ত তার সামান্য অংশই জুটবে, লাভবান হবে বর্তমানে নামিবিয়ার বৃহত্তম জনগোষ্ঠী ওভাম্বো, ওই গণহত্যার আঁচ যাদের গায়ে কখনই লাগেনি। মি. রুকরোর একজন উপদেষ্টা বলেছেন, তাদের আশংকা সরকার এই অর্থ হাতে পেলে তা সরকারের নিজস্ব প্রকল্পে ব্যয় করা হবে যেসব প্রকল্পের জন্য তাদের হাতে অর্থ নেই। তবে সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, জার্মান সরকার যে অর্থ দেবে তা ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের হাতেই পরিচালনার জন্য তুলে দেয়া হবে। ১৯০৪ সালে শেকল দিয়ে বাঁধা হেরেরো বন্দীরা তবে জার্মান-নামিবিয়ান শিক্ষাবিদ হেনিং মেলবার, যিনি এই আলোচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি বলছেন ইউরোপের অন্যান্য ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলো এই আলোচনা নিয়ে জার্মানির কাছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে নামিবিয়ার সাথে তাদের একটা সফল চুক্তি হলে আফ্রিকা, এশিয়া সহ বিশ্বের যেসব দেশে ঔপনিবেশিক শাসকরা অতীতে রাজত্ব করেছে, তাদের দিক থেকে দাবিদাওয়ার একটা স্রোত শুরু হবে। আফ্রিকায় জার্মানির আরেকটি সাবেক উপনিবেশ তানজানিয়া ( ঔপনিবেশিক নাম টাঙ্গানাইকা) ইতোমধ্যেই জার্মানিকে তাদের দেশে চালানো অতীত নৃশংসতার মাশুল দেবার দাবি তুলেছে। লাইনে আছে সম্ভাব্য আরও অনেক দেশ। মি. মেলবার বলছেন: "আমার ধারণা জার্মানি তাদের অতীত ভূমিকার মূল্য হিসাবে একটা অঙ্ক ধরে দিতে রাজি হবে, যদি তার বিনিময়ে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ে চিরতরের জন্য যবনিকা টানা যায়।" তবে রাজনীতির খেলায় শেষ পর্যন্ত নামিবিয়া কী হাতে পায় আর সোয়াকপমুন্ডের ঘিঞ্জি বস্তির যেসব হেরেরো বাসিন্দা এখনও ন্যূনতম বেতনে জার্মান বংশধরের জন্য দিনমজুরি খেটে দিন গুজরান করে, তাদের ভাগ্য এর ফলে কতটা বদলায়, তার ওপরই নির্ভর করবে ইতিহাসের এই অধ্যায়কে অর্থের বিনিময়ে চাপা দেবার প্রক্রিয়া দীর্ঘ মেয়াদে কতটা কার্যকর হবে।
জার্মানি ও নামিবিয়ার মধ্যে অতীত গণহত্যার ক্ষতিপূরণ নিয়ে যে চুক্তি হচ্ছে তা ভবিষ্যতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাবেক উপনিবেশগুলোর ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে একটা নজির তৈরি করতে চলেছে। জার্মানির ঔপনিবেশিক বাহিনী নামিবিয়ানদের গণহত্যা করেছিল বলে যা এখন ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তার ক্ষত সারাতেই এই চুক্তি হচ্ছে।
মৃত্যুপথযাত্রী একজন রোগীকে পোপের সঙ্গে দেখা করতে সহায়তা করেন কিইস ভেলবোর গুরুতর অসুস্থ, যারা অন্যদের সহায়তা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না, এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এমন রোগীদের মৃত্যুর পূর্বে তাদের প্রিয় কোন স্থান দেখতে সহায়তা করেন। কিইস ভেলবোর তার এরকম কয়েকটি 'শেষ ভ্রমণ'য়ের কথা বিবিসির কাছে বর্ণনা করছিলেন। ভ্যাটিকানের উদ্দেশ্যে দ্রুত যাত্রা ভেলবোর বলছেন, যেসব ঘটনা তার বিশেষভাবে মনে আছে, তার একটি হচ্ছে রোমের ভ্যাটিকানের উদ্দেশ্যে দ্রুত যাত্রা। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের শেষ ইচ্ছা পূরণে একটি ফাউন্ডেশন পরিচালনা করেন কিইস ভেলবোর ২০১৩ সালের দিকে শয্যাশায়ী ৬০ বছরের একজন নারী তাকে বলেন, তিনি পোপের সঙ্গে দেখা করতে চান। পেপাল ওয়েবসাইট ঘেঁটে কিইস ভেলবোর দেখেন যে, কবে পোপ সাধারণ মানুষজনকে দেখা দেন। ওই রোগীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করার একটি সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে রোগীকে নিয়ে ১৬০০ কিলোমিটার দূরের ভ্যাটিকানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ভেলবোর। ভ্যাটিকানে যাওয়ার পর দর্শনার্থী সারির সামনে একটি স্ট্রেচারে (সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকার মুখোমুখি) তাকে রাখা হয়। সেখানে আরও কয়েকজন হুইল চেয়ারে বসে পোপের সাক্ষাতের প্রতীক্ষা করছিলেন, কিন্তু ওই নারী ছিলেন একমাত্র স্ট্রেচারে শোয়া। ভেলবোর যেমনটা ধারণা করছিলেন, তিনি পোপের দৃষ্টিতে পড়েন। তখন পোপ নিচে নেমে আসেন, তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি এমনকি তাকে স্পর্শ করেন এবং তার হাত খানিকক্ষণ ধরে রাখেন। ''পোপ তাকে আশীর্বাদ করেন এবং তার রোগমুক্তি কাটিয়ে ওঠার প্রার্থনা করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি যেন ভালো থাকেন, সেই কামনাও করেন।'' ভেলবোর বলছিলেন। আরো পড়তে পারেন: মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে মানুষ কী চায় 'আমি, আমার ক্যামেরা, আমার ভাই...আমাদের ক্যান্সার' 'ক্যান্সার হবার পর থেকে সংসার বলতে কিছুই নাই' মৃত ব্যক্তিদের না বলা কথা জানিয়ে দেওয়া যার পেশা প্রিয় জায়গাগুলো ভ্রমণ করার পরে অনেক রোগী আনন্দিত হয়ে ওঠেন ওই কয়েকটা মুহূর্ত সেই নারীর জন্য অনেক শান্তি বয়ে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পরেই তারা আবার নেদারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পোপের সঙ্গে দেখা করার কয়েকদিন পরেই ওই নারীর মৃত্যু হয়। সমুদ্রের কাছে কিছুক্ষণ অনেক রোগীর অনেক অদ্ভুত ইচ্ছা পূরণ করেছেন ভেলবোর। একজন রোগীকে তার ঘোড়ার আস্তাবলে নিয়ে যান, যাতে তিনি তার প্রিয় প্রাণীটির কাছ থেকে বিদায় নিতে পারেন। এরকম আরও অনেকে তাদের পোষা প্রাণীকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন। আবার নিজের বাড়িতে বা এলাকায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটিও বেশ ঘটে। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের আরেকটা কমন ইচ্ছা হচ্ছে শেষবারের মতো কোন খেলা দেখা, জাদুঘরে যাওয়া বা চিড়িয়াখানায় ভ্রমণ। অনেক রোগী শেষবারের মতো তাদের প্রিয় জায়গাগুলোয় যেতে চান একবার তিনি অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে দেখেন যে, স্ট্রেচারে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি বড়শি দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন। তবে বেশিরভাগ মানুষের শেষ ইচ্ছার মধ্যে রয়েছে সমুদ্রের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানো, যা ভেলবোরকে বেশ অবাক করে। অনেক সময় খানিকটা শক্তসমর্থ রোগীদের সমুদ্রে সংক্ষিপ্ত সেইলিংয়ে নিয়ে যাওয়াও তার কাজের মধ্যে পড়ে। বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর: নাগোর্নো-কারাবাখ: যেখানে যুদ্ধের কৌশল বদলে দিয়েছে তুর্কী ড্রোন শতবর্ষী দবিরুল চৌধুরী রানির স্বীকৃতি পদক পেয়ে খুবই খুশি সৌদি আরব গমনেচ্ছুরা যে পাঁচ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি ট্রাম্প কেন সুদানকে ইসরায়েলের মিত্র হতে বলছেন অনেক রোগী তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত নৌ ভ্রমণে যেতে পছন্দ করেন একজন প্যারামেডিক এবং অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসাবে কাজ করেন ভেলবোর। অনেক বছর ধরে তিনি মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখছেন। তবে এটা তাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না বলে তিনি বলছেন। তিনি যাদের সহায়তা করেন, তাদের বেশিরভাগের বয়সই সত্তর, আশি বা নব্বুইয়ের ঘরে। তবে কখনো কখনো তরুণ রোগীদেরও তার সহায়তা করতে হয়। তবে তিনি বলছেন, এই তরুণ রোগীদের সামলানো বেশ কঠিন। হৃদয় ভঙ্গ ''বৃদ্ধ মানুষ মারা যাবে, সেটা সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু একজন তরুণ বা তরুণী যখন মারা যায়, তখন সেটা আপনার হৃদয় ভঙ্গের কারণ হতে পারে।'' বলছিলেন ভেলবোর। অনেকের শেষ ইচ্ছার মধ্যে থাকে শেষ বারের মতো শিল্পকর্ম উপভোগ করা ২০০৯ সালে তিনি একজন মরীয়া যুবকের টেলিফোন পান, যিনি তার মেয়েবন্ধুকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চাইছিলেন। ''মেয়েটি ক্যান্সারে মারা যাচ্ছিল। তার ছেলে বন্ধু চাইছিলেন যে, তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে এসে তার নতুন ফ্ল্যাট দেখাতে । এই ফ্ল্যাটটি মেয়েটি তখনো দেখেননি।'' চিকিৎসকদের অনুমতি পাওয়ার পর ভেলবোর মেয়েটিকে তার নতুন বাড়িতে নিয়ে যান। ''কয়েক ঘণ্টার জন্য আমি তাদের দুজনকে সেখানে একা থাকতে দেই। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার একঘণ্টার মধ্যে মেয়েটির মৃত্যু হয়,'' বলছিলেন ভেলবোর। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের অনেকে সমুদ্রের কাছে যেতে পছন্দ করেন মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা ভেলবোরের আগের পেশায় মৃত্যু সংক্রান্ত অনেক কাজ করতে হতো। তখন তিনি এসব ব্যাপার সামলানোর একটা নতুন উপায় খুঁজে বের করেন। তিনি শুরুতেই উপলব্ধি করেন যে, তিনি যেহেতু কিছু পাল্টাতে পারবেন না, বরং তিনি বিষয়টি আরও ভালো করে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। ''যখন আপনি বিষয়টা পরিষ্কার করে বুঝে নেবেন, তখন সেটা আলাদাভাবে দেখার সুযোগ হবে।'' তিনি বলছেন। ''আমরা মৃত্যু ঠেকাতে বা বন্ধ করতে পারবো না- কখনো কখনো আমাদের মৃত্যুকে তার মতো চলতে দিতে হবে।'' এমনকি কোভিড নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তিনি মানুষজনের শেষ যাত্রা পূরণে সহায়তা করে গেছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় একজন রোগীকে টাগ বোটে উঠিয়েছিলেন কেইস ভেলবোর আসল ধারণা এভাবে জীবন কাটানোর পরিকল্পনা তিনি আগে করেননি। ২০০৬ সালের একটা ঘটনা তার জীবন বদলে দেয়। ''সেই সময় আমি একটা হাসপাতালে চাকরি করতাম। একদিন একজন গুরুতর অসুস্থ রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি একটা স্ট্রেচারে ছিলেন। ওই রোগীর সর্বোচ্চ তিনমাস বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল।'' ভেলবোর বলছিলেন। ওই যাত্রার সময় সেই রোগী তাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে বলেন, যে জায়গায় তার যেতে খুব ইচ্ছা করছিল। জাহাজ এবং সমুদ্র দেখতে চাইছিলেন সেই রোগী। ভেলবোর রটেনডাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ফোন করেন এবং জানতে চান যে, তিনি রোগীকে নিয়ে আসতে পারবেন কিনা। প্রতিটি ভ্রমণের সময় রোগী এবং তাদের স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটান ভেলবোর ''সেদিন দায়িত্বে ছিলেন না, এমন দুইজন সহকর্মীকে ফোন করে সাহায্যের অনুরোধ করি। এরপর ওই রোগীকে বন্দরে নিয়ে যাই এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছাকাছি স্ট্রেচারটা রেখে দেই।'' এটা মৃত্যু পথযাত্রী ওই রোগীর আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। ''হঠাৎ করেই যেন তার উজ্জ্বলতা বেড়ে যায় এবং তিনি হাসতে শুরু করেন। তিনি যেন পুরোপুরি শক্তসমর্থ হয়ে ওঠেন।'' ওই রোগী ছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী একজন ক্যান্সারের রোগী। তিনি এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, তিনি হাঁটতেও পারছিলেন না। হাসপাতালে নেয়ার পর ওই রোগীকে অনেক বেশি আনন্দিত দেখাচ্ছিল। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা যে সময়ে তার মৃত্যু হবে বলে ধারণা করছিলেন, তার চেয়েও তিন মাস বেশি তিনি বেঁচে থাকেন। ''এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবাতে শুরু করে। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিলে একটা ফাউন্ডেশন শুরু করি যার মাধ্যমে এই ধরণের মানুষদের সাহায্য করতে শুরু করি।'' এভাবেই স্টিচিং অ্যাম্বুলেন্স ওয়েনস- অ্যাম্বুলেন্স উইশ ফাউন্ডেশন বা অ্যাম্বুলেন্সে করে ইচ্ছাপূরণ ফাউন্ডেশনের জন্ম হয়। অনেক যুগল সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তাদের বিয়ের কাজগুলো সেরে ফেলতে চান বিনা মূল্যের সেবা প্রথম দুই বছর প্যারামেডিক হিসাবে চাকরির পাশাপাশি তিনি এবং তার স্ত্রী এই সেবা দিতে শুরু করেন। কিন্তু যতই তাদের কাছে আসা অনুরোধের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ফাউন্ডেশনের কাজে লেগে পড়লেন। এ পর্যন্ত আমাদের ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে তাদের পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেই অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে গেছি।'' ভেলবোর বলছেন। ''অনেক সময় আমি তাদের চোখেমুখে অত্যন্ত আনন্দ দেখতে পেয়েছি। সেটা আমাকে এই কাজ বারবার করতে উৎসাহ জুগিয়েছে।'' তার ফাউন্ডেশনে এখন সাতটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। আরও ১৪টি দেশে তিনি এইরকম ফাউন্ডেশন তৈরি করতে সহায়তা করেছেন। তবে এটা কোন ব্যবসা নয় এবং রোগীদের কাছ থেকে কোন ফি নেয়া হয় না। ''সরকারের কাছ থেকেও আমরা কোন অর্থ পাই না, তবে আমরা অনুদান পেয়েছি.'' ভেলবোর বলছেন। সমুদ্রের পাশে বসে আছে এক দম্পতি কঠিন কথোপকথন রোগীর বাইরেও আরও দুইজন অ্যাম্বুলেন্সে থাকতে পারেন। তবে অনেক সময় কোন আলাপ আলোচনাই হয় না। ''অনেক মানুষ মৃত্যু নিয়ে কোন কথা বলতে চান না। নারীরা তাদের স্বামীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চান। কিন্তু স্বামীরা তাদের স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে কোন কথা বলতে চান না।'' কখনো কখনো তাদের ভেতরে আলোচনার সূত্রপাত করে দেন ভেলবোর। ''কখনো কখনো আমি তাদের সঙ্গে বসি এবং আলোচনা শুরু করি। এরপর কিছুক্ষণের জন্য তাদের একা থাকতে দেই। তারপরে যখন আমি ফিরে আসি, দেখতে পাই তারা কাঁদছেন।'' ভেলবোর বলছেন। ভেলবোর বলছেন, অচেনা মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সহানুভূতি অনেক বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে ''আপনার জীবনসঙ্গীকে আশ্বস্ত করা সহজ কাজ নয়- তবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।'' যারা এই অনিবার্য পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তাদের অনেকের আচরণের মধ্যে বৈপরীত্য দেখতে পান ভেলবোর। ''অনেক মানুষ মৃত্যুকে মেনে নেন। অনেকে হাল ছাড়তে চান না। এমনকি শেষ পর্যায়েও অনেকে বিশ্বাস করেন যে, তারা লড়াই করতে পারবেন।'' তিনি বলছেন, গুটিকয়েক ব্যক্তি নিজেদের জীবন নিয়ে অনুশোচনায় ভোগেন। তবে বেশিরভাগ মানুষ তাদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো মনে করতে থাকেন। অনেক সময় ভেলবোরকে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হয় যে, যখন তার এইরকম সময় আসবে, তখন তিনি কি করবেন? তিনি উত্তর দেন, তিনি এখনো জানেন না যে, তখন আসলে তিনি কীদেখতে চাইবেন। ''এখন এটা বলা কঠিন। শুধুমাত্র শেষ মুহূর্তগুলোতেই একজন এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে আমি হয়তো আমার ছেলেমেয়ে পরিবেষ্টিত হয়েই মারা যেতে চাইবো।'' তিনি বলছেন।
কিইস ভেলবোর যে চাকরি করেন, তাতে তাকে প্রতিদিন সমুদ্রের পাশে, জাদুঘরে, চিড়িয়াখানায়, অ্যাকুয়েরিয়ামে, খেলার মাঠে, চার্চে আর ফুল বাগানে নিয়মিতভাবে যেতে হয়। কিন্তু ৬০ বছরের এই নেদারল্যান্ডের বাসিন্দা কোন পর্যটন গাইড নন।
বার্লিনে চীন প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক দেয়াল অঙ্কন। আর যত বেশি বেশি মৃত্যু হচ্ছে, চীনের প্রতি আক্রমণের ভাষা ততই শাণিত করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা। তাদের কথা - ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে চীন তা গোপন করেছে বলেই এই প্যানডেমিক, এবং এর দায় চীনকে নিতে হবে। দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, চীন এই প্যানডেমিকের জন্য কতটা দায়ী যুক্তরাষ্ট্র তা তদন্ত করবে। গতকাল (বুধবার) রয়টার্স বার্তা সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চীন তাকে নভেম্বরের নির্বাচনে হারানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। "তারা (বেইজিং) সবকিছু করবে।" শুধু আমেরিকা নয়, অস্ট্রেলিয়ার ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন গতকাল (বুধবার) করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের কথা বলেছেন যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেইজিংয়ে। ইউরোপীয় দেশগুলো এখনও ততটা স্পষ্ট করে চীনকে নিয়ে কিছু বলছে না, তবে সন্দেহ নেই যে বাদানুবাদ যত বাড়বে, মেরুকরণও বাড়বে। নিজেকে যেভাবে নিরাপদ রাখবেন করোনাভাইরাস থেকে করোনাভাইরাস ঠেকাতে যে সাতটি বিষয় মনে রাখবেন নতুন করোনাভাইরাস কত দ্রুত ছড়ায়? কতটা উদ্বেগের? কোথায় কতোক্ষণ বেঁচে থাকে কোভিড-১৯ এর জীবাণু, নির্মূলের উপায় নির্বাচনী বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন ট্রাম্প কিন্তু এই সঙ্কটের মাঝে কেন চীনকে নিয়ে এতটা পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ? অনেক পর্যবেক্ষক এর পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির সংবাদদাতা ডেভিড উইলিস বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলতে চেয়েছেন যে, চীন উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ভাইরাসের কথা অনেকদিন চেপে রেখেছিল যাতে এর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। মার্কিন পত্র-পত্রিকায় খবর বের হতে শুরু করেছে, যেভাবে সরকার করোনাভাইরাস সামলাচ্ছ তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে যার প্রভাব নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। অর্থনীতি, কাজের সুযোগ বাড়ানোই ছিল মি. ট্রাম্পের রাজনীতির মুখ্য শক্তি, কিন্তু করোনাভাইরাস প্যানডেমিকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্দশা নির্বাচনের বছরে তাকে কোণঠাসা করে ফেলছে। চীন তাকে নির্বাচনে হারাতে চাইছে এই কথা বলার দিনই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরীণ একটি নির্বাচনী জরিপ নিয়ে তার পরামর্শকদের বেশ গালমন্দ করেন বলে জানা গেছে। ঐ জরিপে বলা হয়েছে, ফ্লোরিডা, উইসকনসিন বা অ্যারিজোনার মত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে জেতা মি. ট্রাম্পের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। 'করোনাভাইরাস মোক্ষম সুযোগ' তবে কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে চীনকে কম-বেশি ইস্যু করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে কোন অজুহাতে চীনকে ঘায়েল করা এখন আমেরিকার জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) গ্রহণ করে, সেখানে চীনকে তারা তাদের প্রধান শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। "যে কোন সুযোগেই চীনকে কোণঠাসা করা, দুর্বল করার চেষ্টা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ওয়াশিংটনকে নতুন আরেকটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে।" বেইজিং-এ দম্পতির বিয়ের প্রস্তুতি: চীন করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ড. আলী বলেন , সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নেয়, তাতে পরিষ্কার বলা আছে, আর কোনদিনই বিশ্বের কোথাও তারা এমন কোন শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। "অনেকদিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতে সেই ধরণের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছে।" "বিশেষ করে এখন আমেরিকান প্রশাসনের মধ্যে এমন একটি আশঙ্কা হয়তো দেখা দিয়েছে যে কোভিড-১৯ প্যানডেমিক মোকাবেলায় তাদের দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে বিশ্বের কাছে তাদের মর্যাদা, প্রতিপত্তি আরো ক্ষুণ্ণ হবে, এবং সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে চীন।" কিন্তু মৌখিক যুদ্ধ ছাড়া চীনকে আর কীভাবে শায়েস্তা করতে পারে আমেরিকা? ড মাহমুদ আলী মনে করেন, আমেরিকা তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাথে নিয়ে চীনকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে একঘরে করার চেষ্টা করতে পারে। আর সেই সাথে সামরিক শক্তির মহড়া দেখিয়ে বেইজিংয়ের ওপর স্নায়ু চাপ বাড়ানোর পথও যে আমেরিকা নিতে পারে তার লক্ষণ এ সপ্তাহেই দেখা গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস রোনাল্ড রেগান (ফাইল ফটো)। মঙ্গল এবং বুধবার পরপর দুইদিন দক্ষিণ চীন সাগরের যে এলাকাটির ওপর চীন তাদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে, মার্কিন নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ সেখানে গিয়ে মহড়া দিয়েছে। চীন কীভাবে চাপ সামালাবে? ড. আলী মনে করেন, কূটনীতিই এখন চীনের কাছে সর্বোত্তম উপায়। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বহুজাতিক ফোরামকে ব্যবহার করে বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোকে সাথে নিয়ে একটা কূটনৈতিক জোট তৈরির পথে যেতে পারে চীন। তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের সাথে ৬০টিরও বেশি দেশ রয়েছে, যাদের সাথে এই কূটনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করতে পারে চীন। "তবে চাপের কাছে নতি স্বীকারের মত কোন কিছু আমরা দেখবো না। চীনের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে আমি একটি মনোভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করছি যে তারা বাইরের কোন চাপ আর মেনে নিতে রাজি নন।" সাম্প্রতিক সময়ে চীনা কূটনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তারা খোলাখুলি বলছেন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সময়মত ব্যবস্থা নেয়নি এবং সেই ব্যর্থতার দায় চীনের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। চীনের সরকারি বার্তা সংস্থা ৬ই এপ্রিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সরকারের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপের একটি টাইমলাইন প্রকাশ করেছে। সেটা দেখিয়ে চীনা সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কোন কিছুই গোপন করা হয়নি। চীনের সরকারপন্থী দৈনিক 'চায়না ডেইলি' তাদের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, "অনর্থক চীনকে দোষারোপ করা বন্ধ করতে হবে আমেরিকাকে। একটি প্যানডেমিক নিয়ে রাজনীতি করলে মানুষের প্রাণহানি বাড়বে ছাড়া অন্য কোন লাভ হবেনা।" চিংডাও বন্দর: চীনের বানিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বদলে যাবে বিশ্ব বাণিজ্য তবে লন্ডনে অর্থনীতিবিদ ড. মুশতাক খান মনে করছেন, করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের পরিণতিতে ভবিষ্যতে চীনের ওপর পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা যে কমবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। "চীন ভাইরাসের কথা গোপন রাখুক আর নাই রাখুক সেটা অন্য বিতর্ক, কিন্তু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের অর্থনীতি যে একটা চাপে পড়তে চলেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।" গত কয়েক দশকে পশ্চিমের দেশগুলো তাদের অনেক অতি-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্যও চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ড. খান মনে করেন, বর্তমান সঙ্কট কেটে গিয়ে অর্থনীতি সচল হওয়া শুরু হলে তখন অনেক দেশই চীনের বদলে অনেক কিছুই নিজেরাই উৎপাদনের পথে যাবে। "অন্তত তারা তাদের সরবরাহের জন্য শুধু চীনের ওপর ভরসা করবে না। আরো বিকল্প সূত্রের খোঁজ করতে শুরু করবে,'' তিনি বলেন। চীনের জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশই আসে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে। চীন সেখানে বড় ধরণের ধাক্কা খাবে বলে মনে করেন ড. খান। "এই সঙ্কটের পর পৃথিবী যেভাবে চলছিল সেভাবে যে আর চলবে না সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি। চীনকে সেই বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখনকার মত তাদের প্রবৃদ্ধি হয়তো আট শতাংশ হবে না, হবে পাঁচ শতাংশ।" করোনাভাইরাস সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এই রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক সঙ্কট চীন কীভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করবে, তা হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হবে যখন ২২শে মে চীনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের সভা শুরু হবে।
করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে, যা বিশ্বের মোট মৃতের সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। দুই দশক ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যত না আমেরিকান মারা গিয়েছিল, গত ছয় সপ্তাহে একটি অদৃশ্য ভাইরাসে তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে সেদেশে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আমরণ সংগ্রাম করেছেন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। ছয় দশক ধরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁর আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বহু ঘটনার কেন্দ্রেই ছিলেন মওলানা ভাসানী, যাকে তাঁর ভক্তরা "মজলুম জননেতা" বলে সম্বোধন করতেন। আবদুল হামিদ খান ভাসানী জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। অল্প কিছুকাল স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়া ছাড়া তিনি অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি। শৈশবে পিতামাতা হারানো আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কড়াকড়ি পছন্দ করতে পারেননি। ১৯০৭ সাল থেকে দুবছর তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। কিন্তু সেখানে বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী রাজনৈতিক চেতনায় বেশি দীক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় টাঙ্গাইলের কাগমারি স্কুলের শিক্ষক হিসাবে ১৯০৯ সালে। ১৯০৭ সাল থেকে দুবছর মওলানা ভাসানী দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। তাঁর জীবনযাপন ছিল খুবই অনাড়ম্বর। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক অতি সাদামাটা ঘরে। উনিশশ' দশ থেকে উনিশশ' সাতচল্লিশ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত বাংলা ও আসামের কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে। চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তিনি প্রবেশ করেন ১৯১৭ সালে তার জাতীয়তাবাদী দলে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য হন তিনি। সেই সময়ই তিনি প্রথমবারের মত কিছুদিনের জন্য কারাবাস করেছিলেন, যখন অনেক খ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। আসামের ধুবড়ী জেলার ভাসানচরে তিনি এক বিশাল কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। যার পর লোকমুখে তিনি "ভাসানচরের মওলানা" বা "ভাসানীর মওলানা" হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে "ভাসানী" শব্দটি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যুক্ত হয়ে যায়। উনিশশ' সাতচল্লিশ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত বাংলা ও আসামের কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে। লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানী যে ভূমিকা রেখেছিলেন তার দুটি পর্যায় ছিল। "এর একটি ছিল ১৯৪৭ পূর্ব সময়ে অর্থাৎ ১৯১০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে আন্দোলনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল আসাম। সেখানে তিনি বাংলাভাষী কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করেন। শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই শুধু সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয় তাঁরই নেতৃত্বে।" "তিনি ১৯৩৭ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদের বাইরে রাজপথে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আসামের কুখ্যাত 'লাইন প্রথার' বিরুদ্ধে তাঁর যে সংগ্রাম, তা দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয়," বলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। মওলানা ভাসানী ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখালিতে বঙ্গ-আসাম প্রজা সম্মেলন নামে এক ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন। ওই সম্মেলনে জমিদারি উচ্ছেদ, খাজনার নিরীখ হ্রাস, নজর-সেলামি বাতিল, মহাজনের সুদের হার নির্ধারণসহ বহুবিধ প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার ফলে ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় কৃষি খাতক আইন পাশ হয়েছিল এবং ১৯৩৭ সালে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপিত হয়েছিল। "মজলুম জনতার" মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৩০ সালে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান জন্মের দু বছরের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,'' বলেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। "তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ- পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, যুবক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ভাষা আন্দোলনে লড়াই করেছে।" তিনি সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হকের যৌথ নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। উনিশশ আটচল্লিশ সালে উত্তর টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর থেকে আজীবন তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। এই ছবিতে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখা যাচ্ছে ১৯৫৩ সালে খালি পায়ে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রভাত ফেরীতে অংশ নিতে। শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। "তিনি চেয়েছিলেন সকল জনগণের মুক্তি। তাই অসাম্প্রদায়িক একটা রাজনীতি গড়ে তোলার প্রয়োজনে পরে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেবার পক্ষে ছিলেন। বলা যায় তাঁর উদ্যোগেই শব্দটি পরে বাদ পড়ে।" মি. চৌধুরী বলেন গোটা পাকিস্তান শাসনামলে তাঁর রাজনীতির দুটি বড় উপাদান ছিল স্বাধীনতা অর্জন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং এই দুই প্রশ্নেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের বিরোধ তৈরি হয়। ''এ কারণেই পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আর থাকতে পারেননি।" মওলানা ভাসানী এরপর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় করে ১৯৫৭ সালে একটি নতুন দল গঠন করেন যার নাম দেন ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। "মওলানা ভাসানী নিজে একজন মওলানা ছিলেন। তিনি পীরও ছিলেন। কিন্তু তিনি ওইখানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিল না। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা। স্বাধীনতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সমাজে বৈষম্য দূর করা," বলেছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। মওলানা ভাসানী ১৯৬৮-৬৯ সালে আরেকবার জাতীয় রাজনীতির কাণ্ডারী হিসাবে আর্বিভূত হন। ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৬৯এ মওলানা ভাসানী যে গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা পরবর্তীতে মুক্তি সংগ্রামের জন্য ভিত রচনা করেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুরু থেকেই তিনি তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় আন্দোলনের পথ নেন মওলানা ভাসানী। এর ফলে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান এবং ওই রাতেই ভাসানীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন তিনি। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ আটষট্টির সেই ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে। উনিশশ' সত্তর সালের ২৩শে নভেম্বর পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণা দেন, যার পর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রাম। তিনি চলে যান ভারতে। কিন্তু সেখানে তিনি কার্যত নজরবন্দি ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটা গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। সেইসময় যেসব নির্যাতন নিপীড়ন হতো তিনি তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছেন, বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ। "তিনি যখন লক্ষ্য করলেন প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের ওপর কিছু কিছু শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, তিনি তারও প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি ভারতকে বন্ধু হিসাব পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সমতার ভিত্তিতে, সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে। ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ দিল এবং তার ফলে বাংলাদেশে মরুকরণের আশংকা তৈরি হল, তখন তিনি আন্দোলন মিছিল সংগঠিত করেন।" দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর একটি ঘটনা ছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লং-মার্চ। সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অন্তিম দিনগুলোতেও তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের সাথে ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর মওলানা ভাসানী মারা যান ঢাকায়। তাঁকে কবর দেওয়া হয় টাঙ্গাইলের সন্তোষে।
দু'হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় নবম স্থানে আসেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী।। আজ তাঁর জীবন-কথা।
নিউ ইয়র্কে খোলা জায়গায় স্কুল: শীতকালে এই স্কুল খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু শিশুরা শীত উপেক্ষা করেই স্কুলে যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যক্ষ্মায় ইউরোপ আর আমেরিকায় মারা যেত প্রতি সাতজনে একজন। এ তথ্য আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, সিডিসির। যক্ষ্মার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয় ১৯২১ সালে। সেই প্রতিষেধক বিশ্বের সব দেশের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে যায় আরও বেশ কিছু বছর। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চারা যাতে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে তার সমাধান হিসাবে জন্ম নেয় খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থা। ওপেন এয়ার স্কুল প্রথম চালু হয় জার্মানি ও বেলজিয়ামে ১৯০৪ সালে হালকা ওজনের টেবিল ও চেয়ার বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়। টিচাররা মাঠে বসে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, ভুগোল বা শিল্পকলা বিষয়ের ক্লাস নিতে শুরু করেন। এই আইডিয়া প্রথমে চালু হয় ১৯০৪ সালে জার্মানি আর বেলজিয়ামে। অল্পদিনের মধ্যেই এটা একটা আন্দোলন হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে অন্য দেশে। উন্মুক্ত স্থানে শিক্ষাদান বিষয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে লিগ ফর ওপেন এয়ার এডুকেশন নামে। ১৯২২ সালে এই গোষ্ঠী প্যারিসে তাদের প্রথম অধিবেশন ডাকে। আমেরিকায় খোলা মাঠে শিক্ষাদান শুরু হয় ১৯০৭ সালে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখছে সে বছর রোড আইল্যান্ডের দুজন ডাক্তার প্রস্তাব দেন শহরের খোলা জায়গাগুলোতে স্কুল বসাতে। পরের দুবছরে এরকম ৬৫টি স্কুল খোলা হয়। খোলা চত্বরে, উঁচু ভবনের ছাদে এবং এমনকি পরিত্যক্ত নৌকায়। শরীর ও মন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রক্তস্বল্পতা এবং অপুষ্টির পাশাপাশি শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য একটা বড় ঝুঁকি ছিল যক্ষ্মা আরও পড়তে পারেন: করোনাভাইরাস: স্কুল বন্ধে শিক্ষা কার্যক্রম ছাড়াও কী হারাচ্ছে শিশুরা? করোনা দুর্যোগের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে কী ভাবা হচ্ছে শিশুশিক্ষায় বইয়ের বোঝা কেন? জার্মানি ও বেলজিয়ামের ইএএএল স্কুলের মত ব্রাজিলেও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক গঠনের জন্য তৈরি হয় খোলা মাঠে স্কুল - ছবিতে দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলের এরকম একটি স্কুল যক্ষ্মার সংক্রমণের ধরন ছিল কোভিড-১৯এর থেকে আলাদা। যক্ষ্মা বায়ুবাহিত রোগ। যক্ষ্মার জীবাণু নি:শ্বাসের সাথে শরীরে ঢুকলে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। সিডিসি বলছে যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসে মিশে থাকে এবং তা সক্রিয় থাকে অনেক ঘন্টা ধরে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কোভিড ছড়ায় আক্রান্ত কোন ব্যক্তির নাক-মুখ থেকে বেরনো অপেক্ষাকৃত বড় শ্লেষ্মাকণার মাধ্যমে- তার সরাসরি সংস্পর্শে এলে বা করোনাভাইরাস সংক্রমিত কোন বস্তু ধরলে। যদিও সংস্থাটি সম্প্রতি স্বীকার করেছে যে, করোনাভাইরাসও সূক্ষ্ম কণার আকারে বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে বলে তথ্যপ্রমাণ সামনে আসছে। "রক্তস্বল্পতা এবং অপুষ্টির পাশাপাশি সে সময় শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি ছিল যক্ষ্মা," বলেছেন সাও পাওলোতে ফেডারেল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আন্দ্রে ডালবেন। বিশেষ করে অনেক দেশে যেসব শিশু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হতো তাদের জন্য যক্ষ্মায় আক্রান্ত হবার বড় ঝুঁকি থাকত। অধ্যাপক ডালবেন বলছেন, খোলা মাঠের স্কুলগুলোর আরেকটা মিশন ছিল লেখাপড়ার সুযোগ চালু রেখে শিশুদের মানসিক গঠনের পাশাপাশি বাইরে খোলামেলা পরিবেশে ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের শারীরিক উন্নতি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। 'নতুন ভাবনা' সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যখন নতুন করে ভাবনা চিন্তা হচ্ছে তার মধ্যেই খোলা মাঠে শিক্ষাদানের বিষয়টি প্রসার লাভ করে সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ইতিহাস বিষয়ক অধ্যাপক ডায়ানা ভিডাল বলেছেন খোলা মাঠে পাঠদানের স্কুলগুলো প্রসার লাভ করেছিল দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। তখন সমাজ ও শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। শিক্ষকরা প্রথাগত শিক্ষার কাঠামো ভেঙে এমন স্কুল গড়ার চিন্তাভাবনা করছিলেন যার লক্ষ্য হবে "বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে গণতন্ত্র চর্চায় উৎসাহ" দেয়া, যাতে "একটা শান্তিকামী এবং পরস্পরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা নিয়ে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়", বলছেন মিজ ভিডাল। অধ্যাপক ডালবেন নথিপত্র ঘেঁটে দেখেছেন ব্রাজিলে ১৯১৬ থেকে ১৯২০ ও ৩০এর দশকে এরকম বহু স্কুল তৈরি হয়েছিল। ঐতিহাসিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ইএএএল স্কুলকে সাও পাওলো কর্তৃপক্ষ আদর্শ স্কুলের স্বীকৃতি দিয়েছিল ব্রাজিলের ইএএএল নামে খোলা মাঠের একটি স্কুলের কাছ থেকে পাওয়া উপরের ঐতিহাসিক ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে গাছপালার মধ্যে বসে স্কুলে পড়ানো হতো। ১৯৩০এর দশকের শেষ দিকে সাও পাওলোর ওই স্কুলে এলাকার বিত্তশালী পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়ত। তবে অধ্যাপক ডালবেন বলছেন, ব্রাজিলে খোলা মাঠের সেসব স্কুল সমাজের একটা কঠিন সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিক পরিবেশে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলের সাথে তার খুব একটা তফাৎ ছিল না। "স্কুলের সাবেক কিছু শিক্ষার্থী আমাকে বলেছেন মাস্টাররা খুবই কড়া ছিলেন।" ১৯৬০এর দশকে এই স্কুলটি উঠে যায়। অধ্যাপক ভিডাল বলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি এবং সহনশীল ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে একটা সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে খোলা মাঠে আন্তরিক পরিবেশে শিক্ষাদানের বিষয়টি জনপ্রিয়তা লাভ করে তবে অধ্যাপক ডালবেন এবং অন্য গবেষকরা বলছেন, বাইরে খোলা জায়গায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের আশংকা যেহেতু কম বলেই এ পর্যন্ত গবেষণায় জানা গেছে, তাই কোভিড যতদিন আমাদের সাথে আছে, ততদিন এধরনের স্কুলে পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। উন্মুক্ত জায়গায় শিক্ষাদানে সাফল্য ভারত প্রশাসিত কাশ্মীরে উন্মুক্ত স্থানে পাঠদান ইতোমধ্যেই একটা সমাধান হিসাবে চালু হয়ে গেছে। হিমালয়ের বরফ ঢাকা পাহাড়ি পরিবেশে খোলা জায়গায় স্কুলে বাচ্চারা লেখাপড়া করছে। সিঙ্গাপুরে বহু বছর ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া শেখানোর চল রয়েছে। দেশটি শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে তোলার জন্য খোলা জায়গায় পাঠদানে সাফল্য পেয়েছে। কোভিড-১৯এর পর কাশ্মীরে ছেলেমেয়েদের ক্লাসে ফিরতে উৎসাহিত করার জন্য উন্মুক্ত জায়গায় ক্লাস নেয়া হচ্ছে। ফিনল্যান্ডে জঙ্গলে স্কুল বেশ জনপ্রিয়। দেশটিতে বনেজঙ্গলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে লেখাপড়া শেখার সংস্কৃতি বহুদিনের। ডেনমার্কেও উন্মুক্ত স্থানে বিশেষ দিনে ক্লাস করার প্রথা চালু রয়েছে। বহু শিক্ষক এবং স্কুল নিয়মিতভাবে এই বিশেষ দিনে বাইরে স্কুলশিক্ষার আয়োজন করেন। ডেনমার্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড-১৯এর মধ্যে এই সংস্কৃতিকে আরও উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে শান্তিনিকেতনে উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির সাহচর্যে, আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের শিক্ষাদান। অধ্যাপক ভিডাল বলছেন বাইরে খোলা মাঠে স্কুল করলে শুধু প্রকৃতির সাথেই যে নিবিড় একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাই নয়, তাতে ছেলেমেয়েরা শেখার ব্যাপারে আরও আগ্রহী হয়, তাদের শারীরিক তৎপরতা বাড়ে এবং মানসিকভাবেও তারা সমৃদ্ধ হয়। তিনি বলছেন এধরনের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষক পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নিজের অভিজ্ঞতা ও মনন শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। "খোলা মাঠে পাঠদান বদ্ধ পরিবেশে লেখাপড়া শেখার থেকে অনেক বেশি সুফল বয়ে আনতে পারে," তিনি বলছেন। ডেনমার্কে বহু স্কুলে নিয়মিতভাবে বাইরে খোলা জায়গায় ক্লাস নেবার প্রথা চালু আছে। নিউ ইয়র্কে কোভিড-১৯এর মধ্যে বাইরে ক্লাস নেয়া হচ্ছে অধ্যাপক ডালবেন বলছেন খোলা মাঠে স্কুল প্রতিষ্ঠার যেসব অতীত অভিজ্ঞতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে সেগুলো আমলে নিয়ে এখন কোভিড পরবর্তী যুগে উন্মুক্ত জায়গায় লেখাপড়া শেখানোর বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। "এমনকী শহরেও এধরনের স্কুলের কথা ভাবা যেতে পারে। এধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য পার্ক ও জনসাধারণের জন্য খোলা জায়গাও কীভাবে বাড়ানো যায় সেটাও ভাবা উচিত।" তিনি বলছেন অতীতের মডেলেই যে এসব স্কুল তৈরি করতে হবে, তা নয়। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে প্রেরণা নিয়ে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খোলা পরিবেশে কীধরনের স্কুল কাজ করবে, ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় বাড়তি মাত্রা যোগ করবে সেটা ভাবার সময় এসেছে। করোনা ভাইরাস: মহামারির প্রভাবে শিক্ষার সুযোগ হারাবে 'প্রায় এক কোটি' শিশু
একশ বছর আগের একই পরিস্থিতির মুখে আজকের বিশ্ব। প্রাণঘাতী কোভিডের প্রার্দুভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার নাজেহাল অবস্থা। শিশুরা কীভাবে সংক্রমণের আশংকা এড়িয়ে স্কুলে যাবে? প্রতিষেধক টিকা এখনও দুরস্ত। তাহলে, শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান শিক্ষার সময়টা যাতে নষ্ট না হয়- তার দিকে কি এখন তাকানোর সময় এসেছে? সে প্রশ্ন নিয়েই এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বিবিসি নিউজ ব্রাজিলের পলা অ্যাডামো আইডোটা।
ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে তুরস্কে কোভিড১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা কম। চীন এবং ব্রিটেনের তুলনায় বেশ দ্রুত গতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তুরস্কে। অনেকে আশংকা করেছিল যে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা অনেক বাড়বে। তুরস্কের অবস্থা হয়তো ইটালির মতো হয়ে উঠতে পারে - এমন আশংকাও ছিল। কিন্তু প্রায় তিন মাসের মাথায় এসেও সেটি ঘটেনি। এমনকি তুরস্কে পুরোপুরি লকডাউনও দেয়া হয়নি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ৪৩৯৭ জন। কিন্তু অনেক চিকিৎসক মনে করেন প্রকৃত অর্থে মৃতের সংখ্যা এর দ্বিগুণ হতে পারে। কারণ, যারা পরীক্ষার মাধ্যমে কোভিড১৯ রোগী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে সেটিকে পরিসংখ্যানে দেখানো হয়। কিন্তু তারপরেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ংকর দিনগুলোতে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। অস্বাভাবিক লকডাউন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, তুরস্কের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ, বহু দেশে এখনে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তবে ব্রিটেনের কেন্ট ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজির শিক্ষক জেরেমি রসম্যান বলেন, তুরস্ক বেশ পরিষ্কারভাবেই একটি বড় ধরণের দুর্যোগ পাশ কাটিয়ে গেছে। "যে কয়েকটি দেশ মোটামুটি দ্রুততার সাথে টেস্ট করেছে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের সনাক্ত করার মাধ্যমে তাদের আলাদা করেছে, তদের মধ্যে তুরস্ক অন্যতম," বলেন মি: রসম্যান। তিনি বলেন, যে কয়েকটি দেশ সংক্রমণের বিস্তার কমাতে সক্ষম হয়েছে তুরস্ক তাদের মধ্যে অন্যতম। তুরস্কে পুরোপুরি লকডাউন দেয়া হয়নি, তবে নানা বিধি-নিষেধ ছিল। তুরস্কে যখন সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল তখন দেশটিতে বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। এর মধ্যে ছিল - গণ পরিবহনসহ বিভিন্ন জায়গায় বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার, রেস্টুরেন্ট ও কফি-শপ বন্ধ করা, জনবহুল জায়গায় শপিং বন্ধ রাখা এবং মসজিদে জমায়েত বন্ধ করা। যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং ২০ বছরের কম তাদের পুরোপুরি বাসায় আটকে রাখা হয়েছিল। এছাড়া ছুটির দিনগুলোতে কারফিউ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বড় শহরগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইস্তাম্বুল শহর। এই শহরটি তার ছন্দ হারিয়েছে - হৃৎস্পন্দন ছাড়া হৃদপিণ্ডের মতো অবস্থা হয়েছে ইস্তাম্বুল শহরের। কিভাবে ভাইরাস খুঁজে বের করা হয়েছে? তুরস্কে ধীরে ধীরে বিধি-নিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। তবে চিকিৎসক মালিক নূর আসলান এখনো বেশ সতর্ক। ইস্তাম্বুল শহরের পুরনো অংশে জনবহুল এলাকায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তিনি। আক্রান্ত ব্যক্তি কাদের সংস্পর্শে এসেছেন সেটি খুঁজে বের করার কাজ করে এমন একটি দলের নেতৃত্বে দিচ্ছেন মালিক নূর আসলান। তুরস্কে এ ধরণের ৬০০০ দল আছে। তিনি বলেন " আমরা মনে করি, আমরা একটা যুদ্ধের ভেতরে আছি। আমাদের সদস্যরা বাড়িতে যাওয়া ভুলে গেছে। আমরা বলি ঠিক আছে - আধঘণ্টা শেষ। কিন্তু তারা বাড়িতে যাবার চিন্তা করেনা। কারণ, তারা জানে এটা তাদের কর্তব্য যাতে ভাইরাস অন্য কারো মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে।" বাড়িতে বসে কোভিড-১৯ চিকিৎসা: যে ছয়টি বিষয় মনে রাখবেন করোনাভাইরাস চিকিৎসার ওষুধ আমরা কবে পাবো? মৃত্যুফাঁদ পেরিয়ে ইতালিতে যাওয়া এক বাংলাদেশীর গল্প করোনাভাইরাস ঠেকাতে যে সাতটি বিষয় মনে রাখবেন ড. মালেক নূর আসলান তারা মার্চের ১১ তারিখ থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা লোকজনদের খুঁজে বের করার কাজ শুরু করেছেন। দেশটিতে হাম রোগে আক্রান্তদের খুঁজে বের করার কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা আছে তুরস্কের। "পরিকল্পনা তৈরি করা ছিল। আমরা সেগুলো শুধু বের করে কাজে লাগানো শুরু করেছি।" ইস্তাম্বুল শহরের পুরনো অংশে দুজন চিকিৎসকের সাথে আমরা গিয়েছিলাম। আমারা পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট পরিধান করেছি। সাথে ছিল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণর অ্যাপ। সরু একটি রাস্তার ভেতরে একটি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম আমরা। এই ভবনের একটি ফ্ল্যাটে দুজন কোয়ারেন্টিনে আছেন, যাদের বন্ধু কোভিড১৯ পজিটিভ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টেস্টের ফলাফল দেয়া হয়েছে। আমরা যাবার পর তারা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। তাদের দুজনের বয়স ২০ বছরের কিছু বেশি হবে। দু'জনের মুখেই ছিল মাস্ক। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দু'জনের নমুনা সংগ্রহ করা হলো এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেটার ফলাফল জানা যাবে। তাদের দু'জনের মধ্যে যখন মৃদু সংক্রমণ দেখা দিল তার একদিনের মধ্যেই পরীক্ষা করা হলো। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তুরস্ক প্রধান ড. ইরশাদ শেখ মনে করেন, তুরস্কের কাছ থেকে কিছু শেখার আছে। "প্রথম দিকে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। প্রতিদিন ৩৫০০ সংক্রমণ ছিল। টেস্ট করার বিষয়টি কাজে লেগেছে। টেস্টের ফলাফলের জন্য পাঁচ-সাতদিন অপেক্ষা করতে হয়নি," বলছিলেন মি: শেখ। এছাড়া কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন এবং কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে আক্রান্ত রোগীদের যেভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে সেটি নিয়ে এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি বলে মনে করেন তিনি। কোভিড১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-এর ব্যবহার করছে তুরস্ক। কোভিড১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-এর ব্যবহার নিয়ে এরই মধ্যে বিশ্বে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তুরস্কে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ওষুধ নিয়ে পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরলেও সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক গবেষণায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে কোভিড১৯ এর ওষুধ হিসেবে বাতিল করে দিয়েছে। কোভিড১৯ রোগীদের ঝুঁকি বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ওষুধকে তাদের তালিকা থেকে স্থগিত করেছে। চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে কোভিড১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করলে হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এতে ভালোর চেয়ে খারাপ বেশি হতে পারে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তুরস্কের একটি হাসপাতালে ঢোকার জন্য আমাদের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। যে হাসপাতালটিতে আমরা গিয়েছি সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েক হাজার কোভিড১৯ রোগীর ক্ষেত্রে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করা হয়েছিল। এই হাসপাতালটির নাম ড. শেইট ইলহান ভারাঙ্ক হসপিটাল। সরকারি এ হাসপাতালটি দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ প্রশস্ত এবং উজ্জ্বল এই হাসপাতালটিতে কোভিড১৯ চিকিৎসা দেয়া হয়। এই হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক নুরেটিন ইইত বলেন, একেবারে শুরুতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলেন, "অন্যান্য দেশ বেশ দেরিতে এই ওষুধ ব্যবহার করছে। বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমরা এটা শুরুতেই ব্যবহার করি। এ ওষুধের ব্যাপারে আমাদের কোন দ্বিধা নেই। আমরা বিশ্বাস করি এটা কার্যকরী, কারণ আমরা ফলাফল পেয়েছি।" চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় হাকিম সুকুক। প্রধান চিকিৎসক নুরেটিন ইইত বলেন, শুরুতেই চিকিৎসা দেবার মাধ্যমে ভাইরাসের আগে হাঁটতে চায় তুরস্ক। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পাশাপাশি অন্যান্য ওষুধ এবং প্লাজমা থেরাপি ও অক্সিজেন দেয়া হয়। ড. ইইত বলেন, তার হাসপাতালে কোভিড ১৯ রোগে মৃত্যুর হার এক শতাংশের নিচে। এই হাসপাতালটির আইসিইউ'র বেড খালি রয়েছে। তারা রোগীদের আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটরের বাইরে রাখার চেষ্টা করে। এখনো শেষ হয়নি তুরস্কের সরকার কোভিড১৯ মহামারিকে যেভাবে মোকাবেলা করেছে সেটি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে দেশটির মেডিকেল এসোসিয়েশনের। সংস্থাটি বলছে সরকারের অনেক ভুল ছিল। এসব ভুলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দীর্ঘ সময় যাবত সীমান্ত খোলা রাখা। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তুরস্কের কিছু প্রশংসা করেছে। তুরস্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মি. শেখ বলেন, সংক্রমণ এখনো পুরো মাত্রায় উঠেনি। সামনের দিনগুলো আরো মানুষ আক্রান্ত হবে। কোভিড১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য তুরস্কের কিছু সুবিধা রয়েছে। দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ এবং হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা অনেক। তুরস্ককে একটি সফল উদাহরণ হিসেবে দেখা হলেও এখনো চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। কারণ ঘটনাপ্রবাহ এখনো শেষ হয়নি।
তুরস্কে করোনাভাইরাস সংক্রমণের অস্তিত্ব জানা গিয়েছিল ১১ ই মার্চ। এরপর থেকে বেশ দ্রুত দেশের প্রতিটি জায়গায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। একমাসের মধ্যেই তুরস্কের সবগুলো প্রদেশ আক্রান্ত হয়।
চীন কি তার অর্থনীতিকে আরো 'সবুজ' করে তুলতে এক বিরাট পদক্ষেপ নেবে? মনে করা হচ্ছে - এখানে হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাকে একটি অন্যতম গুরুতর লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরবে চীন। চীন শুধু যে অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি তাই নয় - দেশটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী। তাই মনে করা হয়, কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য জোরদার কিছু পদক্ষেপের রূপরেখা থাকবে সেই পরিকল্পনায়। কিন্তু এ নিয়ে একটা উদ্বেগও আছে। সেটা হলো, কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে গেলে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতির ওপর। তাই খুব বেশি "সবুজ" অর্থনীতির দিকে চীনের এগিয়ে যাবার পথে সেটা একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পাঁচসালা পরিকল্পনাটা কি? সেই ১৯৫৩ সাল থেকে চীন এরকম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রকাশ করে আসছে। এটি হচ্ছে একটি পরিকল্পনার দলিল - যাতে আগামী অর্ধ দশকের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন আর পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যগুলো কী তা বলা থাকে। মূলত: এটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। এই পরিকল্পনায় যে কাঠামো তুলে ধরা হয় - সেটিই সরকার ও শিল্পখাতের সকল নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। বিবিসি বাংলায় আরো পড়ুন: জলবায়ু ইস্যুতে নেতৃত্ব দেবে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ দশকের মধ্যেই চীন হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি করোনার পর যেভাবে চীনের অর্থনীতি আবার পুরো সচল চীনের অধিকাংশ বিদ্যুত কেন্দ্রই কয়লাভিত্তিক, আগামী কয়েক বছরও তাই থাকবে দশকের পর দশক ধরে এই পরিকল্পনা ফসিলজাত জ্বালানিকে ভিত্তি করে চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছে। এর ফলে চীনের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। এ পরিকল্পনার গুরুত্ব কোথায়? কার্বন নির্গমনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, গোটা পৃথিবীই হুমকির মুখে পড়ছে। তাই চীনের জন্য মূল প্রশ্নটা হলো, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটাতে হবে, অন্যদিকে কার্বন নির্গমনও সীমিত করতে হবে। এ দুটো একসাথে কীভাবে সম্ভব? গত সেপ্টেম্বর মাসে এক ঘোষণা দিয়ে সারা পৃথিবীকে চমকে দেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি ঘোষণা করেন - তার দেশ ২০৬০ সাল নাগাদ নেট কার্বন নির্গমন শূণ্যে নামিয়ে আনবে এবং ২০৩০ সালের আগেই তাদের কার্বন-ব্যবহারকে শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে যাবে। নেট কার্বন নির্গমন শূণ্যে নামিয়ে আনার অর্থ হচ্ছে গ্রিনগাউস গ্যাস নির্গমন যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা এবং এর পরের অতিরিক্ত নির্গমনগুলোর সাথে ভারসাম্য রেখে বায়ুমণ্ডল থেকে সমানুপাতিক পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারণ করা। নতুন এই পাঁচসালা পরিকল্পনা হচ্ছে সেটা অর্জনের পথে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তা ছাড়া এই লক্ষ্যগুলো কতটা বাস্তবসম্মত - তারও একটা ধারণা এ থেকে বিশ্লেষকরা পাবেন। আগামী পাঁচ বছরের পদক্ষেপগুলোর রূপরেখা দেবার সাথে সাথে চীন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও করছে। এর অংশ হিসেবে আছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা। চায়না ডায়ালগ সাময়িকীর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিনিয়র উপদেষ্টা ইসোবেল হিলটন বলছেন, "এখানে দেখা যাচ্ছে যে চীন ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। " "এতে আছে লো-কার্বন প্রযুক্তিসমূহ। তারা অর্থনীতিকে বাজারের উচ্চ স্তরের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, চেষ্টা করছে একটা ভিত্তি স্থাপনের - যাতে চীন নিম্নমাত্রায়-কার্বন-নির্গত-করে এমন পণ্য এবং প্রযুক্তির সরবরাহকারী হয়ে উঠতে পারে। " নতুন পরিকল্পনায় কী থাকবে? এখানে থাকবে কিছু মৌলিক লক্ষমাত্রা - যা বিশ্লেষকরা পরিকল্পনাটি কতটা উচ্চাভিলাষী তার বিচার করতে ব্যবহার করবেন। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে - সমগ্র অর্থনীতি জুড়ে প্রবৃদ্ধির সংখ্যাসমূহ, কিন্তু এর সাথে আরো থাকবে জিডিপির প্রতি ইউনিটে কি পরিমাণ কার্বন ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জলবায়ু পরিবর্তন রোধ সম্পর্কে চীনের লক্ষ্য তুলে ধরেছেন এখানে হয়তো আরো থাকবে সামগ্রিকভাবে মোট যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহৃত হবে তার মধ্যে 'জীবাশ্ম-জাত' নয় এমন অর্থাৎ নন-ফসিল জ্বালানির পরিমাণ কতটা হবে - তার একটা লক্ষ্যমাত্রা । এক্ষেত্রে যেসব সংখ্যা দেয়া হবে তা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আঞ্চলিক সরকার ও শিল্পগুলোর প্রতি কী বার্তা বা সংকেত দেয়া হচ্ছে - সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লরি মিলিভির্তা হচ্ছেন সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এ্যান্ড ক্লিন এয়ার নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিশ্লেষক। বিবিসি বাংলায় আরো পড়তে পারেন: মুসলিম উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনা কার্যক্রমকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিলো কানাডা উইঘুর নারীরা যেভাবে গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন চীনের বন্দী শিবিরে শিনজিয়াংএ উইঘুরদের সংখ্যা কমাতে চাকরি দেয়া হচ্ছে বাড়ি থেকে বহু দূরে তিনি বলছেন, "চীনের যেসব প্রদেশ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কয়লার ওপর নির্ভরশীল - তাদেরকে তাদের অর্থনীতি ও ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনা এবং ফসিলজাত জ্বালানিক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করাতে হবে। এই দুই উদ্দেশ্য অর্জনে একটা ভিত্তি স্থাপন করা আগামী পাঁচ বছরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।" অন্য আরেকটি পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির জন্য একটা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা - যাতে এই সেক্টরটি এ দশকের শেষ দিকের প্রয়োজন মেটানোর মত সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কার্বন নির্গমনের শীর্ষবিন্দু চীন বলছে, ২০৩০ সালের আগেই তাদের কার্বন নির্গমন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাবে - অর্থাৎ তার পর থেকেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে নতুন পাঁচসালা পরিকল্পনায় এমন কিছু লক্ষ্য থাকবে যাতে চীন তার খানিকটা আগেই সেই শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যেতে পারে। তবে এসব লক্ষ্য হয়তো এই পরিকল্পনার দলিলে ধাকবে না, এমন সম্ভাবনাও আছে। বিশ্বব্যাপী উইন্ড টারবাইনের প্রধান সরবরাহকারী হলো চীন সাধারণত: জলবায়ু ইস্যুতে যেটা দেখা যায় তা হলো - চীন প্রতিশ্রুতি কম দিয়ে, অর্জন বেশি করতেই পছন্দ করে। লরি মিলিভির্তা বলছেন, "সম্ভবত: ফসিলজাত নয় এমন জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা এমন হবে যাতে কার্বন নির্গমন বছরে ১% করে বাড়তে পারে।" "তবে যদি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী হয়, এবং সার্বিকভাবে জ্বালানির চাহিদার প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যাশার চাইতে কম হয় - তাহলে হয়তো ২০২৫ সালের আগেই চীনের নির্গমনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাবে।" অন্য অনেকে অবশ্য এমন সম্ভাবনার কথা আরো বেশি জোর দিয়েই বলছেন। "আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী চীন নিশ্চয়ই ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছাবে" - বলছেন গ্রিনপিস ইস্ট এশিয়ার লি শুও। বিবিসি বাংলায় আরো পড়তে পারেন: উহান যেভাবে চীনের সবচয়ে জনপ্রিয় পর্যটন নগরী উহানে লকডাউনের এক বছর: কীভাবে মহামারি সামাল দিল চীন? তার কথায় - " চীনের জন্য এখনো তাদের কার্বন নির্গমনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানোর সময়সূচি ২০২৫ সালের আগে নিয়ে আসার ভালো সম্ভাবনা আছে বলে আমরা মনে করি। চীনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষকদের বেশিরভাগই এই মতের সমর্থক বলে আমাদের ধারণা।" যদি তা হয়, তাহলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রাকে এই শতাব্দীতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রয়াসে এটা হবে বড় উৎসাহব্যঞ্জক অর্জন। কারণ, ১.৫ ডিগ্রি এবং ২ ডিগ্রিকে দীর্ঘদিন ধরেই "বিপদজনক" স্তরের বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দ্বার বলে মনে করা হচ্ছে। কয়লার ভূমিকা চীনে কয়লার ব্যবহার ভবিষ্যতে কী পরিমাণ হবে - তা সারা বিশ্বের জন্যই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ কয়লা উৎপাদিত হয় তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় চীনে। পৃথিবীতে ২০২০ সালে যতগুলো কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে - তার তিন চতুর্থাংশই ছিল চীনে। পানির ওপর সৌর বিদ্যুতকেন্দ্র এখন চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র নেতারা চাইছেন দেশকে কয়লা-নির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের আঞ্চলিক সরকারগুলো আরো বেশি করে চাকরি সৃষ্টি করতে চায় এবং তারা আরো অনেকগুলো কয়লা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। লরি মিলিভির্তা বলছেন, "মনে হচ্ছে যে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের জন্য যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দরকার - চীনের তা নেই।" "কাজেই আগামীতে খুব সম্ভবত যা ঘটবে তা হলো - নতুন আরো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যোগ হতে থাকবে, কিন্তু উৎপাদনে শূণ্য বা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি - যার মানে হবে অব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।" কোভিড কতটা প্রভাব ফেলেছে? এই সপ্তাহেই প্রকাশিত কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি যেভাবে ঝিমিয়ে পড়েছিল - সেই মন্দাবস্থা থেকে দেশটি দ্রুতগতিতে ফিরে এসেছে। তার ফলে সেখানে ২০২০ সালে কার্বন নির্গমনের মোট পরিমাণও ছিল ২০১৯ সালের তুলনায় বেশি। লি শুও বলছিলেন, "২০২০ সালে ইস্পাত, সিমেন্ট ও এ্যালুমিনিয়ামের মত কিছু প্রধান শিল্প উৎপাদন ২০১৯ সালের স্তর ছাড়িয়ে গেছে। এটা রীতিমত বিস্ময়কর।" "করোনাভাইরাস মহামারি থেকে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এ পর্যন্ত যতটা হয়েছে, তার মধ্যে 'সবুজ' বলতে প্রায় কিছুই ছিল না।" "তাই আসন্ন পাঁচসালা পরিকল্পনাটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল -সেখানে দেখার বিষয় হবে চীন কিভাবে নতুন এবং পুরোনোকে একসাথে মেলাচ্ছে।" অন্যরা বিশ্বাস করেন অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব বা 'সবুজ' নীতির পথে চীনের যাত্রা হয়তো - আগে যা ভাবা গিয়েছিল - তার চেয়ে ধীরগতির হবে। "চীন হয়তো জ্বালানি ও কার্বন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যতামূলক লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিতে পারে। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধির মাত্রার তুলনায় তা অনেক কম হবে বলেই মনে হয়" - বলছেন ড্রাওয়েল্ড জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রের ঝ্যাং শুয়েই। রয়টার্সকে তিনি বলেন, "আমার মনে হয় এটা খুবই সম্ভব যে নীতিনির্ধারকরা কম উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেবেন - অন্তত জ্বালানি ও কয়লা ব্যবহারের ক্ষেত্রে - এবং এর কারণ হলো জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ।"
চীন তার ১৪তম পাঁচসালা পরিকল্পনা তুলে ধরতে যাচ্ছে শুক্রবার। এটিই হবে আগামী কয়েক বছরের জন্য তাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিধারার রোডম্যাপ।