Kobi কবি Bhab
Collection
I am developing the world's first Bengali poet large language model (LLM) by training a custom tokenizer for Gemma 2. #AISprint
•
4 items
•
Updated
•
1
poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শাহ মুহম্মদ সগীর | ভক্তিমূলক | প্রথমে প্রণাম করি এক করতার।
যেই প্রভুর জীবদানে স্থাপিলা সংসার।।
দ্বিতীয়ে প্রণাম কঁরো মাও বাপ পাত্র।
যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায়।।
পিঁপড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিতে।
কোল দিয়া বুক দিয়া জগতে বিদিত।।
অশক্য আছিলুঁ দুর্বল ছাবাল
তান দয়া হন্তে হৈল এ ধড় বিশাল।।
না খাই খাওয়াএ পিতা না পরি পরাএ।
কত দুক্ষে একে একে বছর গোঞাএ।।
পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন।
কনে না সুধিব তান ধারক কাহন।।
ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়।
দোসর-জনম দিলা তিঁহ সে অাহ্মার।।
আহ্মা পুরাবাসী আছ জথ পৌরজন।
ইস্ট মিত্র আদি জথ সভাসদগগণ।
তান সভান পদে মোহার বহুল ভকতি।
সপুটে প্রণাম মোহর মনোরথ গতি।।
মুহম্মদ সগীর হীন বহোঁ পাপ ভার।
সভানক পদে দোয়া মাগোঁ বার বার। |
জামিল আশরাফ | শোকমূলক | দেয়ালে টাঙ্গানো যে ঘুড়িটি,
তা আর উড়বে না আকাশে।
দেখতে দেখতে সাদা রঙ্গা সে
ঘুড়িটি হয়ে যাবে ফ্যাকাশে।
আস্তে আস্তে জমবে ধূলো তাতে,
এক সময় বার্ধক্যের মত চিড়
ধরে তা হয়ে যাবে ধ্বংস-নিবিড়;
এইযে দেখছেন এই ঘুড়িটি,
তা আর উড়বে না আকাশে।
কারণ, এ ঘুড়িটি যে উড়াতো
সে-ই উড়ে গেছে আকাশে। |
প্রণবকুমার চট্টোপধ্যায় | মানবতাবাদী | তোমরা পেরেছ ভাই ,আমরা পারি নি! লজ্জায় লজ্জারও মাথা কাটা যায়
ভয়ের জানালাগুলো খুলে দিতে বড় ভয়, চোখ বড় বড় করা জল্লাদবাহিনী
শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে; তবু দ্বিধাহীন যে মানুষগুলো আজ পথের উপর
এক হয় মানবতা বোধে ,আমরা কী পারি তাকে দূরে ঠেলে দিতে?
কিছুই পারি না তবু, ভেসে যাচ্ছে সব চোখ জলের ধারায়…ভুলে গেছি কাঁটাতার, ভুলে গেছি অভেদ্য পাঁচিল
আমরা মানুষ শুধু একই মা-ভাষা নিয়ে এই পৃথিবীর
যে সব অসভ্য লোক ধর্মের ছুরি নিয়ে ঘোরে
আমরা রয়েছি সব চেতনা-মশাল নিয়ে হাতে
রুখে দিতে ব্যাভিচার; যত তারা শক্তিমানই হোক
পদ্মা-মেঘনা ছুঁয়ে ভাগীরথী আজ উতরোল
ধন্য শাহবাগ আর ধন্য সব তরুণ-তরুণী
আমৃত্যু তোমার পাশে আছে দোস্তো আমার দু`হাত
এটুকু সম্বল আর এটুকুই নাও আজ ,সেলাম তোমায় শাহবাগকলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | মানুষের চোখ থেহে গড়িয়ে পড়া চোখের জল
ভালো লাগে না আমার
সবচেয়ে বড় অপচয়ের নাম চোখের জল
অসহ্য, সরিয়ে নাও তোমার চোখ, আমি তাকাব নাখেতে দিতে না পেরে বাবা চলে গেলেন, মেঘলা আকাশ
মায়ের চোখ ফেটে সারাদিন শুধু জল নয়
যেন একজন নারী গলে গলে বেরিয়ে আসত ।
পাঁচ বছর বাদে ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ
মা, আমার অসহ্য লাগে চোখের জল । চুপ করো ।চোখের জলে লাগল জোয়ার, কথাটা দারুণ
কিন্তু মানে কি ?
একটা মানুষ চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়
দেয়াল থেকে হাতে তুলে নেয় টাঙ্গি
তারপর তুলে ধরে আকাশের দিকে
আকাশে কে থাকে ? ভগবান ?
পরিষ্কার একটা কথা বলি শোনো : তুমি গরিব
তোমার জন্য কোন ভগবান নেই
শনি পুজো না করে সেই টাকায়
কনডোম্ কেনো রাসকেল । রাতারাতি ভারতবর্ষ পাল্টে যাবে ।চোখের জলে কিছু হয় না
একটা জাতি উঠে দাঁড়ায় তিনটি কারণে :
মাথার জোরে, গায়ের জোরে, মনের জোরে ।
তোমরা যারা ভালো করে খেতে পাও না
তাঁদের চোখে এতো জল আসে কি করে ?মাকেও দেখতাম যেটুকু খাবার জুটতো
ভাইবোনদের খাইয়ে নিজে চাঁচি মুখে দিয়ে
বাসন মাজতে মাজতে কাঁদতেন
গরিবের কি চোখের জল বেশি হয় ?চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া চোখের জল
সহ্য করতে পারি না আমি
বাইপাসের ধারে একটা নগ্ন মেয়ের চোখ থেকে
জল গড়িয়ে পড়ল গালে
গাল থেকে একটা বিন্দু গিয়ে পড়ল স্তনের বোঁটায়
আমি অবচেতনের ঐশ্বর্য লিখতে আসিনি
আমার জামাটা খুলে তাঁকে দিই, বলি ওঠো
একটা কুলাঙ্গার তোমাকে ভালবেসে ফেলে চলে গেছে
তার জন্য তোমার জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে না ।একটা জাতি উঠে দাঁড়ায়
একটা মানুষ উঠে দাঁড়ায় পরিষ্কার তিনটি কারণে
দরকার যেকোনো একটা জোর
হয় গায়ের নয় মাথার নয় মনের ।
তাজ বেঙ্গলের উল্টোদিকে, মাঝরাত্রে, একটি বালক
হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে
এই শালা কাঁদছিস কেন রে ?
ছুটে গিয়ে ভেতরে ঢুকে কামড়ে দিতে পারছিস না ? |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | আমি আমেরিকায় গিয়ে শুনে এলাম
লোকে ওখানেও বলছে:
দিনকাল যা পড়েছে
তুমি তোমার খাবারের কাছে ঠিক সময়ে
পৌঁছতে না পারলে
অন্য একজন পৌঁছে যাবে।
আরে, এ তো আমাদের দেশে
গরিব লোকেরা করত।
এখন বছরে তিনবার ধান হয় বলে
একজন ভিখিরি, একজন পাগলের খাবার
কেড়ে নেওয়ার আগে দুবার ভাবে।
তবে গতকাল শুনলাম
মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করতেন অংশুমান
রায়
কী ভাল, তার অফিস তাকে সপরিবারে
মরিশাস পাঠাল বেড়াতে।
দশদিন বাদে ফিরে এসে দেখল
তার চেয়ারে বসে আছে তার
থেকে একটু ফর্সা
তার থেকে একটু লম্বা
তার চেয়ে একটু ঘন চুল অন্য এক
অংশুমান রায়। |
সুবোধ সরকার | প্রেমমূলক | তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচলে নদীর
আত্মজীবনী লেখা রইল |
বিচানার নীচ থেকে কয়েক লক্ষ কর্কট
বিছানা-সমেত
তোমাকে তুলে নিয়ে চলেছে মহাকাশযানে |
ম়ৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে তাও তুমি কাজল
পড়েছ,
কাজল ও কান্নার মাঝখানে তোমার
মুখে এক চামচ জল
হ্যাঁ, আমি এক চামচ জল হয়ে
এক চামচ অন্তর্জলী হয়ে, এক চামচ
অঞ্জলি হয়ে,
তোমার ভেতরে একটা পূর্ণিমায়
ভেসে যাওয়া
বিমানবন্দরে আমি বসে থাকতে চেয়েছিলাম
|
আমি বলেছিলাম এটা বিমানবন্দর নয়
এটা একটা গ্রাম,
লোকে বিরহী বলে ডাকে
এখানেই আমরা জীবনে প্রথম চুম্বন
করেচিলাম
তুমি ছিলে চাবুকের মত তেজি এবং সটান
বেতস পাতার মতো ফার্স্ট ইয়ার
এবং সেনসুয়াল কাঠবেড়ালি
বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে আন্তিগোনের
মতো দেখাত |
আমি ছিলাম গাঙচিল,
দু’লাইন কাফকা পড়া অসংগঠিত আঁতেল |
তুমি যমুনার একটা অংশ চেড়ে চলে যাচ্ছ
ডাক্তার তোমার হাতের
শিরা খুঁজে পায়নি |
দোষ তোমার নয়, ডাক্তারের
এতবার তোমার শরীর ফুটো করেছিল ওরা
ইরাকের মৃত্তিকাও অতবার বার
ফুটো করেনি আমেরিকা
কিন্তু তোমার ধমনী আসলে একটা নদীর
আত্মজীবনী
তুমি তিস্তার একটা ঢেউ
ছেড়ে চলে যাচ্ছ
আমার মাছরাঙা সেই ঢেউয়ের ভেতর
আটকে গেছে |
সেই মাছরাঙার ঠোঁটে তোমার সংসার
বোরো যেখানে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
না পড়ে পড়ছে সাতটি তারার
.
তিমির
|
কিন্তু আমি নদীর পলিমাটি মেখে ,
হারে রে রে রে রে
একদিন শহরে ঢুকে পড়েছিলাম
কার্জন পার্কে শুয়ে কালপুরুষের
সঙ্গে তর্ক করেছি
এসে দাঁড়ালেন বাত্সায়ন এবং নিৎসে
কালপুরুষ বলল, নাও, দুই মহান খচ্চর
এসে গেছে,
যৌনতা এবং মৃত্যু
ওরা দুই সহোদর,
কে তোমাকে বেছে নেয় সেটাই
তোমার
. সেমিফাইনাল
ডব্লু, ডব্লু, ডব্লু ড্যাশ ডটকম |
রাত দুটোর এ্যাম্বুলেন্সের ভেতর
বসে আমি তোমার
হাত দুটি ধরে বলেছিলাম, বলো কোথায়
কষ্ট ?
তুমি বলেছিলে, কৃষ্ণচূড়ায়, পারমানবিক
পলিমাটিতে
তোমার অসংখ্য জুঁইফিলে জ্বালা করছে |
হাত থেকে একটানে চ্যানেল
খুলে ফেলে বললে,
আমাকে বাঁচাও, ভালবাসা,
আমি বাঁচতে চাই |
পৃথিবীতে আমি একটু শিউলির গন্ধ
পেতে পারি ?
আমার নাক থেকে রাইস টিউব সরিয়ে দাও
|
আমি বললাম এটা ইনটেনসিভ কেয়ার
ইউনিট,
এখানে কোনও শিউলি গাছ নেই |
তুমি বললে, ছেলেটা কোথায় গেল, কার
সঙ্গে গেল ?
ওকে একটু দেখো,রাত
করে বাড়ি ফিরো না |
নার্সিংহোমের বারান্দায়
বলে আমি একা, একেবারে একা
‘দ্য এম্পারার অফ অল ম্যালাডিজ’ পড়ছিলাম
|
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার,
তুমি ঠিক বলেছ
অন্ধকারে দাবা খেলছেন সারা পৃথিবীর
অনকোলজিস্ট
উল্টোদিকে এ্যান্টিচেম্বার ড্রাগ-
মাফিয়ারা বসে আছে
মানুষের গভীরতম দুঃখ যাদের ব্যবসা |
তুমি আমাকে বারবার বলতে সিগারেট
খেও না
আমি উড়িয়ে দিয়ে বলতাম, আমরা সবাই
চিমনি সুইপার
আমরা কার্বনের সঙ্গে প্রণয় আর প্রণয়ের
সঙ্গে
মেটাস্টেসিস বহন করে চলেছি |
কে একদিন
রাস্তা থেকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে আসবে
তার আগে আজ, এখনই, আমি প্রজাপতিদের
সঙ্গে দৌড়তে চাই,
আজ, এখনই মিলন করতে চাই, আশিরনখ মিলন
দেবতা না চড়ুই, কে দেখে ফেলল, কিছু
যায় আসে না |
মনে নেই আমরা একবার
ভাঙা মসজিদে ঢুকেছিলাম
প্রচুর সাপের ভিতর
আল্লা পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছিলেন |
বললেন, আয় পৃথিবীতে যাদের কোনও
জায়গা নেই
আমি তাদের জুন্নত এবং জাহানারার
মাঝখানে
এখটা বিকেল
বাঁচিয়ে রেখেছি ভালবাসার জন্য
গাছ থেকে ছিড়ে আনা আপেলে কামড়
দিবি বলে |
তুমি তমসার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচল ধরে টানছে ছেলের
উচ্চমাধ্যমিক |
ছেলে বলছে, মা,
আমাকে কুজ্ঝটিকা বানান
বলে দিয়ে যাও
আইসিইউ-তে কেউ কুজ্ঝটিকা বানান
বলতে পারে না |
ছেলের বাবা বসে আছে, মেডিক্যাল
বোর্ড বসেছে বারোতলায়
যেন হাট বসেছে বক্সিগঞ্জে,
পদ্মাপারে |
কে যেন বলল, আরে বেরিয়ে আসুন
তো ফার্নেস থেকে,
এরা পিঁপড়ে ধরতে পারে না, কর্কট
ধরবে ?
একটা পানকৌড়ি ডুব দিচ্ছে গগনবাবুর
পুকুরে
কেমোথেরাপির পর তোমাকে গোয়ায়
নিয়ে গিয়েছিলাম |
একটা কোঙ্কনি কবিকে বললে,
‘পানকৌড়ি দেখাও’,
একটা পর্তুগিজ
গ্রামে গিয়ে কী দেখেছিলে আমাকে বলনি |
তুমি জলঢাকার একটা অংশ
ছেড়ে চলে যাচ্ছ
যে বড় বড় টিপ পরতে তারা গাইছে, আমায়
মুক্তি আলোয় আলোয় |
তুমি সুবর্ণরেখার একটা অংশ
ছেড়ে চলে যাচ্ছ
তোমার লিপস্টিক বলছে, আমাদের
নিয়ে চলো আয়না |
তুমি রোরো নামে একটা চাইবাসার
নদী ছেড়ে চলে যাচ্ছ
সে বলছে, মা দাঁড়াও, স্কুল
থেকে এক্ষিনি মার্কশিট তুলে আসছি |
তুমি ভল্ গা নামে একটা নদীর অংশ
ছেড়ে চলে যাচ্ছ
পারস্যের রানি আতোসা তোমায় ডাকছে
পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্তন ছিল
রানি আতোসার
কাটা হয়েছিল খড়গ দিয়ে, কেটেছিল এক
গ্রিক ক্রিতদাস |
ইস্তানবুলের নদী বসফরাস
ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ
তোমার এক পা ইউরোপ, এক পা এশিয়া |
তুমি জিপসিদের হাটে তেজপাতা-
মোড়ানো ওষুধ আনতে চলেছ
ইহুদি মেয়েরা তোমাকে নিয়ে গুহায়
ঢুকে গেল |
জিপসিরাই পৃথিবীতে প্রথম ব্যথার ওষুধ
কুড়িয়ে পেয়েছে
তোমার বিশ্বাস ছিল শেষ ওষুধটাও ওরাই
কুড়িয়ে আনবে |
শেষ একটা ওষুধের জন্য
গোটা মানবজাতি দাঁড়িয়ে আছে
য়ে সেটা কুড়িয়ে আনবে, সে বলবে,
দাঁড়াও
আমি একটা আগুনের মধ্যে দিয়ে আসছি
বাবাকে বারণ
করো হাসপাতালে বসে রাত জাগতে |
আমাকে য়দি কোনও ম্যাটাডোর
বা মার্সিডিজ ধাক্কা না মারে
ভোর হওয়ার আগে আমি যে করে হোক
শহরে ঢুকব |
এমন একটা অসুখ যার কোনও ‘আমরা ওরা’
নেই
ভিখিরি এবং প্রেসিডেন্টকে একই ড্রাগ
নিতে হবে |
ডাক্তার, ভাল যদি নাই পারোষ এত সুঁচ
ফোটালে কেন ?
সুঁচগুলো একবার নিজের
পশ্চাতে ফুটিয়ে দেখলে হত না ?
তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ,
সত্যি চলে যাচ্ছ—–
রোরো তোমার আঁচল ধরে আছে,
আমি তোমার রোদ্দুর | |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | আগে আপনাকে ভালো লাগত, রামবাবু
এখন আপনি বদলে গেছেন।
কখনও কখনও আপনাকে কংগ্রেস মনে হত
কখনও সি.পি.এম
কখনও সি.পি.আই
মার্কিন সেনেটে আপনার নাম উঠেছিল
কিন্তু ভিয়েতনামের পক্ষে
আপনি বালিদ্বীপ পর্যন্ত ছুটে গেছেন।বিহারের লছমনপুরে আপনাকে প্রথম দেখি
ততদিনে আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে গেছেন
বিহারের গ্রাম
আপনি তো ভালোই জানেন, খুব সুবিধের জায়গা নয়
ওখানকার লোকেরা বলে
পাতাল প্রবেশ হল স্রেফ ধাপ্পা
আপনি নাকি
উত্তরপ্রদেশের গ্রামে একটা কুয়োর ভেতর
বউকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন।
এখনও সেই কুয়োর ভেতর বসে
মা সীতা কাঁদেন,
তখন গোটা বিহারের মেয়েরা
উত্তরপ্রদেশের মেয়েরা
রান্না করতে করতে কাঁদে
আর চোখ মছে।আগে আপনাকে ভালো লাগত, রামবাবু
কত রাত্রে আমি না খেয়ে
মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছি
শুধু আপনার তীর ধনুকের গল্প শুনতে শুনতে।
ছোটবেলায় আপনার ভাইকেও আমার খুব ভালো লাগত
কী সুন্দর ভাই
এক ডাকে সাড়া দেয়
যে কোনও দরকারে দাদা বললে
ভাই একপায়ে খাড়া।
পরে বড় হয়ে দেখলাম
আপনার ভাই বীর হতে পারে তবে বড্ড মেনিমুখো
দাদার সমস্ত অর্ডার
সাপ্লাই দেওয়াতেই তার সুকৃতি।
আমি যদি আপনার ভাই হতাম
ও.বি.সি-দের মেরে ফেলার আগে বলতাম
দাদা, এ কাজ করিস না,
লঙ্কা পোড়ানোর আগে আমি বলতাম
ঠিক হচ্ছে না, দাদা, ফিরে চল।আপনি এবং আপনার হনুমান
শুধু ভারতবর্ষে নয়
গোটা উপমহাদেশে হয়ে উঠলেন সোশ্যালিজম
মার্কস এঙ্গেলস এলেন
মাও-সে-তুং হো-চি-মিন এলেন
এল শিল্পায়ন পোখরান
কিন্তু আপনি এবং হনুমান এখনও পর্যন্ত
উত্তম-সুচিত্রার চেয়েও জনপ্রিয় জুটি।
কোভালাম বিচ থেকে বনগাঁর সেলুনে
আপনাদের জোড়া ক্যালেন্ডার।আগে আপনাকে ভাল লাগত, রামবাবু
ত্রিপুরায় উপজাতিরা ঢুকে পড়ল
আপনি হনুমানকে দিয়ে খাদ্য পাঠালেন
মরিচঝাঁপি তৈরি হল
আপনি পানীয় জলের ব্যবস্থা করলেন
বাংলাদেশ থেকে পিল পিল করে পিপীলিকারা
চলে এল শিয়ালদায়
আপনি আপনার বৈমাত্রেয় বোন
ইন্দিরার পাশে দাঁড়ালেন, জলপাইগুড়িতে দাঁড়ালেন
অন্ধ্রে গিয়ে দাঁড়ালেন।তখনও আপনি দাঁড়াতেন
আপনাকে নিয়ে লেখা
তুলসীদাসের রামচরিতমানস
আপনিও শুনতেন তখন
আপনার চোখেও বাষ্প ঘনিয়ে আসত।কিন্তু এখন আপনি আর
আপনি নেই, আপনি
আদবানীকে ভুজুং দিচ্ছেন
জয়ললিতাকে ফুচুং।
পাকিস্তান নামে সবচেয়ে বড় বিষফোঁড়াটাকে বলছেন ফুসকুড়ি?
আমি বলব আপনিই নষ্টের গোড়া
বাল্মীকি আপনাকে যতই নরশ্রেষ্ঠ বলুক
নির্মল জলের মত বলুক
আমার সন্দেহ আছে
ওরা যখন অযোধ্যায় গেল
আপনার বাধা দেওয়া উচিৎ ছিল।
বম্বে থেকে বাঙালিকে ধরে ধরে
ফেরত পাঠাল মহারাষ্ট্র
তাহলে উড়িষ্যা থেকে মালয়ালিদের
ফেরত পাঠাক কলিঙ্গরাজ।
কর্ণাটক থেকে তামিলদের
পাঞ্জাব থেকে মারাঠিদের।
সারা দেশ জুড়ে লেগে যাক ফেরত আর ফেরত
এই ফেরত দেওয়ার মারি ও মড়ক
আপনি সামলাতে পারবেন, রামবাবু?বনে থাকার দিনগুলো ভুলে যাবেন না
আপনার বাবার ভুলের জন্য
মনে মনে আপনি বাবাকে ক্ষমা করেননি কোনও দিন
আমি জানি
জঙ্গলে থাকতে আপনার ভালো লাগত না
সেই খারাপ দিনগুলো আপনি মনে করুন
তারও চেয়ে খারাপ দিন
আমাদের সামনে, আপনার হাত কাঁপছে না, ভয় করছে না
আপনার নামে ভারতবর্ষে
হাজার হাজার বালকের নাম
তারা বড়বাজারে, মেটিয়াবুরুজে, চাঁদনিচকের
দোকানে দোকানে কাজ করে
দিনান্তে বাড়িতে আটা কিনে নিয়ে যায়
ধোঁয়াভর্তি উনুনে বসে
তাদের মা রুটি ভেজে দেয়।সারা ভারতবর্ষ জুড়ে
সন্ধে সাড়ে আটটায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে
যে বালকেরা এখন
দুটো রুটি নিয়ে বসেছে খাবে বলে
তাদের কে রাম কে রহিম
সেটা আপনার দেখার কথা ছিল নাবাল্মীকির সাথে দেখা হলে বলবেন
রামায়ণের পরবর্তী সংস্করণের আগে
অর্থাৎ প্রেসে পাঠাবার আগে
উনি যেন নতুন করে আর একবার লিখে দেন । |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি দামিনীসারা দেশ জুড়ে আমরা কেঁদেছি, সারা দেশ জুড়ে আমরা ফুঁসেছি।
ভারত রাষ্ট্র বাঁচাতে পারেনি তোমাকে।
জন জোয়ারের চাপে মাথা নত করেছে অশোকস্তম্ভ
দেশের বাইরে পাঠিয়ে তোমাকে ফেরৎ আনতে পারিনি, ফেরৎ আনতে পারিনি তোমাকে দামিনী।
ফেরৎ এসেছে রজনীগন্ধা কফিন, ফেরৎ এসেছে আমার ভারত কন্যা।
আমার মেয়েটি তের দিন ধরে মৃত্যু সরাতে সরাতে
তের দিনে হল অনন্যা।
কফিন ভর্তি সে এক রজনীগন্ধা
রাইফেলে ডাকা যমুনা যখন রাত্তিরে হল জামিনী,
আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারিনি দামিনী।
কেন তের দিন গুমরে মরেছে?
কেন তের রাত কষ্ট?
মা তুই কেন যে তখনি মরে গেলিনা ?
জীবনে প্রথম বিমানে উঠলি, উঠার মজাটা পেলি না!
তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি দামিনী
মোমবাতি গুলো একটু একটু গলছে, গলে যাওয়া মোমবাতি থেকে ভারতবর্ষ জ্বলছে
তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি দামিনী, তোমাকে আমরা মারতে পারিনি দামিনী।
আমরা দেখছি, দামিনী নামের জন জোয়ারকে দেখছি।
হাজার হাজার মেয়েরা আজ রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
তুমি যে তাদের আগুন… দামিনী
তুমি যে তাদের আলো। |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | রূপমকে একটা চাকরি দিন—এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু’-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে |তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় |
তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে |
মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে
আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল
রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন |
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল :
রূপমকে একটা চাকরি দিন |
কে রূপম?
রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে | |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।আলমারির প্রথম থাকে সে রাখলো সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটা কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, ‘ তোর নাম অভিমান’
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিন দিক থেকে ছুটে আসা সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কি করে এক জীবনে পড়বে ?কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা
সন্ধের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে ।
কাপড়ে মুখ বাঁধা তিনটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডান দিকে ।
যাকে বলে এল ।
পড়ে রইলো খাবার, চিলি ফিস থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে ।
-এর নাম রাজনীতি, -বলেছিল পাড়ার লোকেরা ।বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছতলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে ।
শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে সে একা ।কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও’
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা ।বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা…. |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | বাবা জার্মান, মা থাকত এন্টালির গলিতে
জন্মের সময় ওজন : ২১/২ পাউন্ড, ডাকনাম জিনা
বাড়ির মেয়েরা ডাকে ফুচু, ফুচুমণি, ফুচান…
গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, লেজ নেই।দিনের বেলায় আট টুকরো গরুর মাংস
রাতে একবাটি দুধ। এখন বয়স তিন
আজ পর্যন্ত কাউকে কামড়ায়নি।শুধু গেল বার ভোটের আগে
ধুতিপরা এক ভদ্রলোক এসেছিলেন
করজোড়ে ভোট চাইতেজিনা তাকে তেড়ে গিয়েছিল রাস্তা পর্যন্ত
কামড়ায়নি, কামড়ালে, জিনার বায়োডেটা বলছে :
জিনা নিজেই পাগল হয়ে যেত। |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | রবীন্দ্ররচনাবলীর নবম খন্ড দিয়ে চাপা দেওয়া সুইসাইড নোট,
ছেলেকে লেখা | লিখে, হাতে ব্লেড নিয়ে
বাথরুমে ঢুকেছিলেন মাস্টারমশাই
দুপুরবেলা কাজের লোক দরজার তলা দিয়ে
রক্ত আসছে দেখে চিত্কার করে ওঠে |
ছেলেকে লেখা এই তার প্রথম এবং শেষ চিঠি :
‘অরণি,
আমি বিশ্বাস করি সন্তান পবিত্র জলের মতো
যদিও তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো নয়
তবু তোমাকেই লিখে রেখে যাই
গত দু’বছর তোমার মায়ের চিকিত্সাবাবদ
আমার যত্সামান্য সঞ্চয় আপাতত নিঃশেষিত
চিকিত্সার ব্যয়ভার আমি আর নিতে পারছিলাম না |
জীবনে তোমার টাকা ছুঁইনি, মরেও ছোঁব না |
আমি আজীবন ছাত্র পড়িয়েছি, জ্ঞানত কোনও অন্যায় করিনি |
গত মাসে আমার স্কুলে এক অভিভাবক এসে
ঝুলোঝুলি করেন তাঁর ছেলেকে নেবার জন্য
আমি প্রথম দিন ফিরিয়ে দিই
দ্বিতীয় দিন ফিরিয়ে দিই
তৃতীয় দিন পারিনি | তিনি আমাকে একটা বড় খামে
তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে চলে যান |
সেই টাকায় এই মাসে তোমার মায়ের চিকিত্সা চলছে
জানি না তিনি বাড়ি ফিরবেন কি না কোনও দিন
ফিরলে বোলো, পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার অধিকার চলে গেছে |
ইতি বাবা’
যখন সারাটা দেশ দাঁড়িয়ে আছে টাকার ওপর
তখন রবীন্দ্ররচনাবলী দিয়ে চাপা দেওয়া একটা সুইসাইড নোট |
হাসপাতালে গাছের তলায় গা ছমছম করছিল
এগিয়ে গেলাম সাদা কাপড়ে ঢাকা মাস্টারমশাইয়ের দিকে
একটু বেরিয়ে থাকা পা দুটোর দিকে——ওই একটু বেরিয়ে থাকা পা দুটি যেন ভারতবর্ষের শেষ মাটি | |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | হিন্দু ভারত, জৈন ভারত, বৌদ্ধ ভারত, খ্রিস্টান ভারত,
এতগুলো ভারতের মাঝে দাঁড়িয়ে
আমি ফিরোজা একটি ভারতীয় মেয়ে ।
আপনারা বলতে পারেন, আমি কি দোষ করেছি ?
পৃথিবীর যে কোন দেশের
যে কোন একটি মেয়ের মতো আমি একজনকে
ভালবেসেছিলাম ।
প্রথম যেদিন ওর চোখে চোখ পড়েছিল আমার
আমি জানতাম না ও কে
বিকেল বেলার কলেজ ক্যাম্পাসে যে আলো এসে পড়েছিল
ওর চুলে, তার কোথাও লেখা ছিল ওর ধর্ম ।হিন্দু ভারত, জৈন ভারত, বৌদ্ধ ভারত, খ্রিস্টান ভারত
আপনারা বলতে পারেন আমি কি দোষ করেছি ?আমি যেদিন হাতে মোমবাতি নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম
আমি যেদিন বলে ফেললাম, আমি শরিয়ৎ মানি না
আমি যেদিন বুঝিয়ে দিলাম ভারতবর্ষের মাটিকে
মা বলে জানি, ভারতবর্ষের আকাশকে আকাশ
সেদিন থেকেই শুরু হল অত্যাচার ।হিন্দু ভারত, জৈন ভারত, বৌদ্ধ ভারত, খ্রিস্টান ভারত
আপনারা বলতে পারেন, আমি কি দোষ করেছি
ছেলেটাতো আপনাদের
সে কি দোষ করল ?
আমাকে ভালবাসাই তার দোষ ?ছেলেটার বাড়িতে আপনারা ঢিল ছুঁড়লেন
পার্সেল করে ছেঁড়া চটি পাঠালেন
ওকে হাতে মেরে, ভাতে মেরে
বাড়ির দেয়ালে বড় বড় করে লিখে দিলেন,
‘এসব চলবে না।’লজ্জা করে না আপনাদের, আপনারা এগিয়ে থাকা মানুষ
এম এ পাশ, বি এ পাশ, ডাক্তার, এঞ্জিনিয়র
আমলা, মাস্টার, আপনারাই গণতন্ত্র নিয়ে ভাষণ দেন
আর প্রয়োজন মতো
গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরেন ।
ধিক আপনাদের !আমি কি ছোটবেলায় ভোরের আলোয় সরস্বতী পুজোর ফল
. কাটিনি ?
আমি কি স্কুলের বারান্দায় বসে
রাত জেগে আলপনা দিইনি ?
আমি কি পাশের বাড়ির হিন্দু বাবার জন্য রক্ত দিইনি ?
ওদের বাড়ির উঠোনে বসে ওদের ছেলেদের অ আ ক খ
. শেখাইনি ?
আমি আরবি শিখিনি, ফারসি শিখিনি, উর্দু শিখিনি
বাংলাই আমার ভাষা, এই ভাষা আমার ভাত, আমার রুটি
আমার চোখের কাজল, আমার পায়ের ঘুঙুর ।
এই ভাষা আমার গোপন চিঠি, যার অক্ষরে অক্ষরে লেগে আছে
আমার চোখের জল ।আমরা যেদিন বিয়ে করি
সেদিন কফিহাউস গিয়েছিলাম, ও সেদিন
আমাকে ঝোলা ভর্তি করে রবীন্দ্রনাথ কিনে দিয়েছিল
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে কানে কানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন
ফিরোজা, তুমি আমার মৃন্ময়ী, তুমি আমার লাবণ্য
তুমি আমার সুচরিতা ।সেদিন রাত্রে কি হয়েছিল জানি না
কি ঘটেছিল ওদের বাড়িতে, কি ঘটেছিল ওদের পাড়ায়, কি
. করেছিল ওদের
বাবাকাকা – সেটা আজও আমি জানি না
কিন্তু তার পরের দিন ওকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি
ও কোথায় চলে গেল আমি জানতে পারিনি ।এই আপনাদের ভারতবর্ষ ?
এই আমাদের ভারতবর্ষ ?আমি একজন সাধারণ মেয়ে
অথচ বাড়িতে পাড়ায় অফিসে পুজোর প্যান্ডেলে
বিয়ে বাড়িতে অন্নপ্রাশনে এখনো আমাকে নিয়ে ফিসফাস
ডাক্তারের কাছে যাই – ফিসফাস
কলেজে ঢুকি – ফিসফাস
বাজারে যাই – ফিসফাস
যে হাউসিং –এ থাকি সেখানেও চলতে থাকে অবিরাম লুকোচুরি ।
ওটা লুকোচুরি নয়, ওটা ফিসফাস নয়
ওটা আপনাদের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক-একটা সুপ্ত গুজরাট ।
যদি আপনাদের হৃদয়
বড় না করেন
আকাশের দিকে আপনারা যদি না তাকান
এই পোড়া দেশে আরও, আরও, আরও
অনেকগুলো পোড়া গুজরাট তৈরি হবে । |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | ভারত মহাসাগরের তীরে আমি ইয়ার্কি মারতে আসি নি
আহা মেঘ, ওহো মেঘ কী যে মেঘ |
আমি ন্যাকামি করতে আসিনি
আমি কয়েকটা ঝাড়া হাত-পা সত্যি বলতে চাই |দাদা, সত্যি সবাই বলে, চেপে যান
চেপে যাওয়ার আগে শুনুন আমার কী হয়েছিল
মাথার বাঁদিকটা ঘর্ ঘর্ করত, ডানদিকে আশ্বিন মাসএক শিঙওলা ভদ্রলোক ভিড় বাসের ভেতর
একটা স্কুলের মেয়েকে ঘষছিল |
আমি প্রতিবাদ করেছিলাম
সে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল বাঁ গালে!আমার ব্রহ্মতালু গরর্…গরর্…গরর্…গরর্…
একটা বালককে দিয়ে বাসন মাজিয়ে গা টিপিয়ে নিয়ে
পেছনে লাথি মেরে তিনি বললেন, এই ৬০ টাকা
একটা পাঁইট আনবি, তারপর খেতে বসবি, যা |
আমি আর পারিনি, কলার টেনে ধরে তুললাম
কিন্তু সে আমার মুখে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল
থুতুতে কী ছিল জানি না, অসংখ্য ডুমুর ফুল
এসে আমার মুখের সামনে নাচতে লাগল |পার্টি অফিস থেকে একটা ছেলে এসে বলল
আপনার ভূগোল বদলে দেব |
আমি পার্টি অফিসে গিয়ে বললাম
সম্পাদক বললেন, হুম, ছেলেটিও আমাদের
আপনিও আমাদের, মানিয়ে নিন |পরের দিন সেই ছেলেটি আমাকে রাস্তায় বলল
মুখে রড ঢুকিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে
বের করে আনব, শালা দেড়েল!বিটগাজর যখন রগে উঠে যায়
ভারত মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখে
আপনি কী বলবেন?
গুরু গুরু মেঘ গরজে গগনে গগনে…. |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | বড়লোক কখনও ভোরের
আলো দেখতে পায় না
গরিব তেমনি “সুপ্রভাত” বলে না কাউকে |
বড়লোকের মেয়েরা গায়ে রোদ
লাগাতে মরিশাস যায়
গরিবের উঠোন
রোদে পুড়ে নৌকো হয়ে থাকে |
বড়লোকেরা রাত বারোটার
আগে ঘুমোতে পারে না
খালি পেটে ছোটলোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে সন্ধে সাতটায়
|
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন
দেখে খালি পেটের ভেতর একটা বস্তি
ভরা পেটের ভেতর
একটা চোদ্দোতলা বাড়ি |
বস্তি বলছে চোদ্দোতলাকে, তুই
ভেঙে পড়, তোর
দরজা খুলে বস্তিতে লাগাব
চোদ্দোতলা বলছে, “তুই পুড়ে যা, তোর
উপর চোদ্দোতলা তুলবো” | |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | [যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিবসের অষ্টম ভাগে শাক রন্ধন করে সেই সুখী ]ইনি কে? হেলিকপ্টারের পাশে ওকে ঘিরে এত সংবাদিক?
ইনি অর্জুন থ্যাকারে, বম্বে চালান, ক্রিকেট বন্ধ করে দেন
বক বললেন, ইনিই তা হলে তোমার দ্বিতীয় ভাই?ইনি কে? কী লম্বা, কী পেশী! কালো কুচকুচে গা!
আমেরিকায় থাকেন, ব্ল্যাকদের সঙ্গে মারামারি করেন
ভারতীয় চামড়ার দোকান আছে, এন আর আই
পুজো দেখে, আশ্বিন দেখে, আশ্বিনেই ফিরে যান
বক বললেন ইনি তোমার প্রবাসী ভাই, কুন্তিপুত্র ভীম?কুল আর দেব রবীন্দ্রভারতী থেকে এম.এ. কোরে
বরিশাল থেকে লেবার নিয়ে গিয়ে
কুয়ালালামপুরে বিক্রি করেন—ওরা এখন আদমব্যাপারী |তোমার স্ত্রী কোথায়?দিনে আটবার এই প্রশ্ন আমাকে শুনতে হয়
কি জানতে চান আপনি?আমার স্ত্রী যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যান
সেদিন আমি কারখানার গেটে
পরের দিন থেকে লক আউট
তিনদিন বাদে পুলিশে যাই |
থানা কখনও স্ত্রী ফেরত দেয় না, দেয় একটা নম্বর
এই সেই নম্বর, দেখবেন?আমি বক আমি ধর্ম, আমি নম্বর বুঝি না
বলো সে কোথায়?পুলিশ বলল, লিলুয়া ঘুরে আসুন
লিলুয়ার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসছিল
সেদিনই বুঝেছিলাম ওদের জন্য কোন হোম নেইলোকাল কমিটি বলল, খেতে না পেলেও
তোর বউ চালাক ছিল, ডাঁসা ছিল
সে কাজ পেয়ে গেছে, তুই একটা বিয়ে করে নে |হে ধর্ম, হে বক, হে অনিল বিশ্বাস
আমি শাকান্ন রান্না করে খাই, টিনের চাল উড়ে যাওয়া
নিজের ঘরে থাকি, মুদির কাছেও ধার নেই
আমাকে কেউ ভিসা কার্ড দেখিয়ে বলে নি, গো গেট ইটএবার আপনি বলুন আমি না আমার ভায়েরা ভাল আছে?
সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ভালো
না সারা ভারতবর্ষব্যাপী আমি, চালের কলে আমি
কয়লার খনিতে আমি, বস্তিতে বস্তিতে আমি
কে বেশি ভালো আছে, বলুন ধর্ম
কে তাহলে সুখী হয়েছে বলুন? |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | পলাশপুর থেকে পড়তে আসা ছেলেটির গলায় তুলসীর মালা
প্রথম ক্লাসের পর জিনস্ পরা একটি মেয়ের সে কী হাসি !
রাত্রে ছেলেটি চিঠি লিখল, শ্রীচরণেষু মা,
আমি ভালোভাবে হোস্টেলে উঠিলাম, কিন্তু
তুলসীর মালা খুলিয়া রাখিয়াছি |এক সপ্তাহ বাদে জিনস্ পরা মেয়েটি
ছেলেটির চারটে বোতাম একটানে ছিঁড়ে দিয়ে বলল,
এ যে গত শতাব্দীর জামা | আবার সেই হাসি
রাত্রে লিখল, শ্রীচরণেষু মা, কিছু টাকা প্রয়োজন
নতুন জামা কিনিতে হইবে |অফ্ পিরিয়ডে ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু চরিত পড়ছিল
ওটা কেড়ে নিয়ে একটা পেপারব্যাক ধরিয়ে
মেয়েটি হাসতে হাসতে চলে গেল |
পলাশপুরের ছেলেটি এই প্রথম মেয়েটিকে দেখল
একটি মেয়ের চলে যাওয়া দেখল |
রাত্রে চিঠি, শ্রীচরণেষু মা, আমি হ্যারল্ড রবিন্স পড়িতেছি
পলাশপুরে কি বৃষ্টি আসিতেছে ?
কতদিন বকফুল ভাজা খাই নাই |জিনস্ পরা, শাড়িপরা, স্কার্টপরা, সালোয়ার পরা চারজন
একদিন ওকে জোর করে নিয়ে এল একটা বাড়িতে
খুব সুন্দর একটা বাড়িতে
স্টিরিওতে বেজে উঠল গমগমে জ্যাজ, আফ্রিকান ড্রাম
পাশের বাড়ি থেকে চার জন নর্থ স্টার এসে দাঁড়ালঅন্ধকার করে শুরু হল নাচ
এবার সবাইকে নগ্ন হতে হতে, পলাশপুর, পলাশপুর
কাম অন, আমি, আমি, টাচ মি হিয়ার !
অন্ধকারে একটা চাপা কান্না শোনা গেল
সুইচ অন, দেয়ালে পিঠ দিয়ে
নগ্ন পলাশপুর কাঁদছে
তার পুরুষত্ব পান করছে সালোয়ার কামিজ
যেন প্রাচীন গ্রিসের কোনও ছবি |সেদিন রাত্রে সে লিখল, শ্রীচরণেষু মা, কেমন আছ ?
আমি আজ তোমার জন্য কাঁদিতেছিলাম, গ্রীষ্মের ছুটিতে
বাড়ি যাইব না, অনেক গ্রন্থ এখনো পড়া হয় নাই |
পলাশপুর, আমিও তোমার মতো গ্রামের ছেলে
তুমি পড়তে এসেছ, আমি পড়াতে
তোমার মতো আমিও আমার মাকে লিখি
শ্রীচরণেষু মা, টাকা পাঠাইলাম, ঠিকমতো ওষুধ কিনিও
গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়
এখনো অনেক গ্রন্থ পড়া হয় নাই | |
সুবোধ সরকার | প্রেমমূলক | থানার বড়বাবু আমায় বলতো পাঁঠা
ছােটবাবু পেছনে লাথি মেরে বলতাে, যা তাে সিগারেট নিয়ে আয়
যেদিন মাইনে পেতাম, আমার দাদা এসে
সব টাকা কেড়ে নিয়ে যেত
আর তুমি, তােমার সঙ্গে আমার ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হল
একদিনও আমাকে ভালােবাসলে না, আদর করলে না।।গােলাপ টোলাপ না, আমার রাইফেল দেখতে খুব ভালাে লাগত
কী লম্বা, মুখটা ছুঁচলাে, গুডুম গুডুম
ভয় লাগত, ভালােও লাগত।
বড়বাবু যখন কোমর থেকে রিভলবার খুলে টেবিলে রাখত
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, কী সুন্দর দেখতে!কিন্তু কী যে হল সেদিন সন্ধেবেলায়, কী করে ফেললাম।
কোথা থেকে কে যেন একটা মেয়েছেলেকে ধরে আনল
বড়বাবু আমাকে দিয়ে মদ আনাল
ছােটবাবু আমাকে বলল যা মেয়েছেলেটার ঘরে যা
আমি গেলাম, সত্যি বলছি তােমাকে, তুমি আমার বউ
মেয়েছেলেটার গায়ে কী জোর, আমি পারছিলাম না
তারপর বড়বাবু এল, মেয়েছেলেটার ঘাড়ে মারল
অজ্ঞান হয়ে শুয়ে পড়ল, তারপর আমি ওর কাপড় খুললাম।পরের পরের দিন কাগজে কাগজে আমার ছবি
মেয়েছেলেটা আমাকেই দেখিয়ে দিল।
তুমি বিশ্বাস কর, তুমি আমার কতদিনের বউ
মাইরি বলছি, আমার মনে মনে ইচ্ছে হয়েছিল
উঠেও বসেছিলাম মেয়ে ছেলেটার বুকের উপর।
হঠাৎ তার মুখটা দেখে কষ্ট হল
একবার চোখ খুলে মেয়েলােকটা আমাকে দেখল
কি চোখে বাবা, আমার গা গুলিয়ে উঠল।তারপর বড় বাবু আর ছােট বাবু আমাকে সরিয়ে দিয়ে
বলল, তুই একটা ছাগল, যা, গেটে গিয়ে দাড়া
আমি এক ঘন্টা, দুঘণ্টা গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম
আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বসে পড়েছিলাম টুলে
টুলে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।তারপর তুমি সব শুনেছ, কাগজে আমার ছবি দেখেছ।
লোকে বলে আমার চাকরি চলে গেছে।
জেল হবে।
কতদিন তোমাকে দেখতে পাবো না।আমি খুব বোকা বলে তুমি আমাকে একদিনও আদর করনি।
আমি যখন জেলে থাকব, একদিন, অন্তত একদিন।
আমাকে দেখতে এসো।
একটু এঁচোড়ের তরকারি নিয়ে এসো, কত দিন ভালো কোন
খাবার খাইনি। বুড়ো মা-টাকে একটু দেখাবে।
তোমরা ভালো থেকো। তুমি ভালো থেকো।ইতি
তোমার নিধিরাম |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | বত্রিশ বছর আগে একবার আমার ঠোটে
একজন আমাকে চুম্বন করেছিল
এবং
আরো বত্রিশ বছর আগে
আমার প্রথম জন্মদিনে ঠিক একই জায়গায়
তিলের পাশে আমার বাবা
চুম্বন করেছিলেন।
আমার এখন ৬৫, ছেলে আমেরিকা
মেয়ে মাসে একবার দেখা করে যায়
১৩ নম্বর ঘরে।
মাত্র দুটো চুম্বন। দুটোই দারুণ।
আমি প্রতিদিন কাগজ পড়ি। খোঁজ রাখি পৃথিবীর।
আর অপেক্ষা করি ছেলে আমেরিকা থেকে
ঝাড় খেয়ে ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবে
জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়বে।
হ্যাঁ, আমি মা, খোকন রে আমি এখনও তোর মা।
|
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | তুমি যেদিন প্রথম এসেছিলে আমার কাছে
তোমার হাতে মায়াকভ্ স্কি
আর চোখে
সকালবেলার আলো |বিহার থেকে ফিরে এসে তুমি আবার এলে
গলা নামিয়ে, বাষ্প লুকিয়ে
তুমি বলেছিলে বিহারের কথা
খুন হয়ে যাওয়া বাবার কথা
আমি দেখতে পেলাম তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণতা |আবার এলে একদিন, আবারও এলে, আবার, আবার
একদিন চিন নিয়ে কথা হল
একদিন ভিয়েৎনাম
একদিন কম্বোডিয়া
একদিন কিউবা
তোমার চোখে সকালবেলার আলো
তুমি চে-গুয়েভারার ডায়েরি মুখস্ত বলেছিলে |কিন্তু কী হল তোমার ?
আসা বন্ধ করে দিলে কেন ?
একদিন ফোন করেছিলাম, তোমার বাড়ি থেকে
আমায় বলল, তিনদিন বাড়ি ফেরনি তুমি
এরকম তো ছিলে না তুমি ? কী হয়েছে তোমার ?এইমাত্র জানতে পারলাম
তুমি আমূল বদলে গেছ
তুমি আর আমাকে সহ্য করতে পার না
মায়াকভ্ স্কি পুড়িয়ে ফেলেছ
ভারতের গো-বলয় থেকে গ্রাস করতে ছুটে আসা
একটা দলে তুমি নাম লিখিয়েছ |আমি কোন দোষ করিনি তো ?
লিখিয়েছ, লিখিয়েছ |
তুমি কেন আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলে ?
আমি কি তোমাকে জোড় করে
কার্ল মার্কস পড়াব ?
ঘোড়াটিকে পুকুর পর্যন্ত ধরে আনা যায়
তাকে কি জোড় করে জল খাওয়ানো যায় ?
ওগো সকালবেলার আলো, তুমি একদিন
আবার কাছে ফিরে আসবে, দরজা খোলা থাকবে আমার
ভালোবাসা নিয়ো | |
সুবোধ সরকার | মানবতাবাদী | প্রিয়তমাসু
আমি তিনদিন খাইনি। কেউ কোনও খাবার দিয়ে যায়নি।
কী করে দেবে? গুহার বাইরে প্রচন্ড বরফ পড়ছে।
যে কোনও দিন আমি গুলিতে মারা যাব। যে কোনও দিন
তুমি টিভির পর্দায় আমার মুখ দেখতে পাবে।আমি
গুহার ভেতর সারারাত কম্পিউটরের সামনে বসে। কতদিন
আমি বকুল ফুলের গন্ধ পাইনি। কতদিন আমি গরম রুটি
খাইনি। কতদিন আমি তোমার ঘাসে হাত দিইনি।
কালো ঘাস। আঃ! ভাবলেই চে গুয়েভারা ছুটে বেড়ায়
শরীরে। স্টালিনকে হাতের মুঠোয় ধরে বসে থাকি।
তার মুখ দিয়ে গরম বেরিয়ে আসে। আঃ, গরম।
আমার স্টালিন ভালো আছে। তোমার সাইবেরিয়া?
হা,হা,হা… এখানে কেউ আমার জন্মদিন কবে
জানে না।আমি পড়াশুনায় ভাল ছিলাম। অধ্যাপক বাবার ছেলে।
কম্পিউটরে আমার চাইতে কেউ ভাল ছিলনা। আজ আমি
গুহায় বসে আছি।কিন্তু কেন? প্রিয়তমাসু,মাই লাভ,তুমি
এর উত্তর পাবে যদি অত্যাচারের ইতিহাস পড়ো। কত হাজার
কোটি ডলার খরচ করে ওরা গরিবকে আরও গরিব
করে চলেছে। ১১ বছরের একটি
বালককে একটি পাউরুটি কিনে দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম,
তোর কি হয়েছে রে? সে গোগ্রাসে পাউরুটি কামড়
দিয়ে বলেছিলঃ আমার বাবা-মাকে ওরা পুড়িয়ে
দিয়েছে,জ্যান্ত। ছেলেটা খেতে খেতে কর গুনছিল,
বাবা-মা, দুই ভাই, তিন বোন…এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ…
হ্যাঁ, এগারো জন। ছেলেটার নাম বলব না। কে খোঁজো। আজীবন
খুঁজে যাও।প্রিয়তমা, আমাকে আর বেশি দিন ওরা বাঁচিয়ে রাখবেনা।
তার আগেই আমি ওদের দু’দুটো ঘাঁটি উড়িয়ে দেব।
ওদেরতো পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায়না, ওরা
আবার জন্মায়, আবার গনতন্ত্র বানায়, আবার পার্লামেন্টে
যায়।আবার প্রেস মিট করে। একটা সত্যি কথা লিখি,
ওরা গনতন্ত্র দিয়ে যা করায়, আমরাও AK-47 কে,
দিয়ে তাই তাই করাই। ওদেরটা দোষ নয়, আমাদেরটা দোষ।
আমি মারা যাব। তার আগে একবার, যদি
একবার তোমাকে দেখতে পেতাম। তোমার হাত ধরতে
পারতাম।যদি একবার তোমার ভেতরে ঢুকতে পারতাম, যেভাবে
বরফ ঢোকে গুহায়,যেভাবে শিকড় ঢোকে পাথরে,যেভাবে
ভাইরাস ঢোকে কম্পিউটরে।আজ আমি একজন টেররিস্ট। হয়তো এটাই আমার শেষ চিঠি।
বলতো,কেন আমার মত ছেলে টেররিস্ট হবে?
কেন আমি ঘর-বাড়ি ছেড়ে,মায়ের হাতের খাবার ছেড়ে,
ভাল চাকরী ছেড়ে;গুহার জীবন,জঙ্গলের জীবন,
বরফের জীবন বেছে নিলাম?আমি মাতাল হতে পারতাম।লম্পট হতে পারতাম। একজন
মাতালকে মেনে নেয় সমাজ। একজন লম্পটকে মেনে নেয় রাষ্ট্র।
একজন মাফিয়া বিধায়ককে মেনে নেয় এসেম্বলি। কিন্তু
একজন টেররিস্টকে মেনে নেয়া যায়না।
কতদিন তোমার স্নান করা চুলের গন্ধ পাইনি।
চোখ ভরে আসে জলে। পাউরুটি খাওয়া শেষ করে
১১ বছরের ছেলেটি বলেছিল,আর আছে? আমি আর
একটা পাউরুটি কিনে দিয়ে বলেছিলাম; শোন্ তুই বড় হয়ে
কী করবি? সে বলেছিলঃ বদলা নেব।
ছেলেটার মুখ ভেসে ওঠে যেই মনে হয় আমার সামনে
অনেক অনেক কাজ। অনেকগুলো খারাপ কাজ। ভুল
বললাম,অনেক,অনেক,ভালো কাজ।আমাকে ক্ষমা করো। মা’কে একবার দেখে এসো। বোকা মেয়েটা
আমার মা হয়ে কোনও অন্যায় করেনি।ইতি-
কোন নাম নেইপুনশ্চঃ আমি মরে গেলে, আমাকে তুমি ‘আকাশ’ বলে ডেকো। |
বিমল গুহ | চিন্তামূলক | বলো, কার প্রতীক্ষায় আছো হে আমার দুঃখী শব্দাবলী?
আমার ভেতরে নিশিদিন অগণিত শিশু
পাঠশালা যায় আসে বানায় রঙিন স্বপ্ন কবিতার বই
নিপুণ বাঁধাই জরিমোড়া।
নিশিদিন আমার ভেতরে শব্দ নিয়ে লুফোলুফি হয়
কৌতুক জলসায় মাতে গ্রাম্যবধুরা লোকালয়ে, স্বার্থপর
পারিনি তাদের আমি পরাতে এখনো কোনো
সুনিপুন পোশাক-আশাক, পারিনি দুলাতে আজো
কর্ণমূলে লোভনীয় কোনো মণিহার।
কার প্রতীক্ষায় কাটে বেলা? আমার আকাশে ওঠে
অগণিত জ্বলজ্বলে তারা, ওঠে চাঁদ মধ্য-রজনীতে
কোনোদিন ঢেলে দেয় জোৎস্না ঘরময়,
কুয়াশায় ভিজে বুক নাভিমূলে কোমল-কোমল পেলবতা
আড়ষ্ট কপোল-জোড় ভেজাই আদরে নির্দ্বিধায়,
বুলাতে পারিনি তবু পরিত্যক্ত শিয়রে তাদের
কোনোদিনও মোমের আঙুল।
বলো কার প্রতীক্ষায় হে আমার শব্দাবলী গনগনে
জাগ্রত শিশুর কান্না শুনে কাটাও রজনী অবিশ্রাম?
ভেতরে আমার নিশিদিন পদধ্বনি বেজে ওঠে কার,
কার নিত্য আগমন আমাকে ভুলিয়ে রেখে বেশ
নিয়মিত ঘর-গেরস্থালী সাজায় আদরে,বলো
কার প্রতীক্ষায় আছো হে আমার দুঃখী শব্দাবলী
ঘুমহীন?
|
দেবব্রত সিংহ | মানবতাবাদী | তারা বললেক গপপোটা আজকার লয় হে
ইটা বহুত পুরোনো গপপো,
তেল চুকচুকা বাঁশে বাঁদর উঠে আর নামে
যতবার চায় উঠতে
ততবার যায় পড়ে,
কী করে উঠবেক বাঁশটাতে যে আচ্ছা করে লগাড়ে মাখাইছে
কাঁচা সরষার তেল
কারা মাখাইছে কেনে মাখাইছে
সে বুঝতে গেলে মাথা লাগবেক হে
বহুত মাথা লাগবেক।
তিনি বললেন না-না-তা-না
ব্যাপারটা কি জানেন
ব্যাপারটা হল ধারাবাহিকতার অভাব,
অন্য আর কিছু না
ধারাবাহিকতার অভাবে বহু সাক্ষর ফের নিরক্ষর।
তখন একজনা ধানকাদামাখা মানুষ
মাখা খাড়া করে উঠে দাঁড়াই বললেক,
আমি বিজয় রুইদাস
মিটিঙে মিছিলে গেলে পার্টিবাবুরা বলে
কমরেড বিজয় রুইদাস
আর পুরন্দরপুর মোড়ে শিরিষতলায় জুতা সেলাই করলে
বলে বিজা মুচি
মাপ করবেন লেতাবাবু
গপপোটা যে কী
সেটা তাহালে খুলে বলি,
তখেন মনসাথানের সানবাঁধানো নিমতলায়
আমাদের মুনিষকামীনদে পাড়ায়
সাক্ষরতা সেন্টার
পার্টিবাবুরা বললেক তোদিকে নবসাক্ষর করব
মিছা নাই বলব
কথাটা শুনে ফুরতি লাগেছিল খুব,
কী বলব আঁইজ্ঞা,
সবে দিনটা কতেক চলেছে মাত্তক
তাবাদে হুট করে অ্যাকদিন মাস্টর বললেক,
যা হইছে বহুত হইছেে
ইবার তোদের মূল্যায়ন হবেক
মূল্যায়নের পরে নবসাক্ষর
নবসাক্ষরের পরে পূর্ণসাক্ষর।
বললাম, হে মাস্টরই যে গোটা বইটাই বাকি হে
পথম পাতাটা ছাড়া তুমি আর ত কিছু শিখাও নাই।
মাস্টর বললেক, যা শিখেছিস বহুত শিখেছিস ।
তাবাদে আর কী
নিরক্ষাররা সাক্ষর হােক বা না হােক
পোস্টারে ফেস্টুনে পতাকায় শ্লোগানে
গোটা জেলা পূর্ণসাক্ষর।
বললাম, বঠে মাস্টর তুমরা দেখালে বঠে
তবে শুনঅ,
আমরা কিন্তুক জানথম
সব জানথম
তুমরা যে আর কিছু শিখাবে নাই
সেটা আমরা জানথম
কেনে শিখাবে নাই তাও জানথম
মাস্টর বললেক, কী জানতিস ?
বললম, শুনঅ তাহালে
আমরা যদি সব শিখে ফেলি
আমরা যদি সব জানে ফেলি
তাহলে তুমাদে চেয়ারগুলানই ত উলটে যাবেক
তখেন তুমরা বসবে কুথায়,
আমরা যদি সব শিখে ফেলি
আমরা যদি সব জানে ফেলি
তাহালে তুমাদে গদিগুলানই ত উলটে যাবেক
তখেন তুমরা দাঁড়াবে কুথায়
তুমরা তখেন দাঁড়াবেটা কুথায়। |
দেবব্রত সিংহ | মানবতাবাদী | কেঁদুলির মেলা পেরাই তখেন আমাদে রাঙামাটির দেশে
ফাগুনা হাওয়া বইছে,
কচি পলাশের পারা রোদ উঠেছে ঝলমলা,
সেই রোদ ধুলা পথে কানা বাউলের আখড়ায় যাতে যাতে
থমকে দাঁড়ালেক মাস্টর,
কিষ্টনগরের সুধীর মাস্টর,
বললেক, ‘তুই হরিদাসীর লাতি কানুবাগাল না?”
গরুবাথানের গোরুপাল খুলে
গাছতলাতে বাঁশি ফুঁকতে যাইয়ে
আমি ফিক করে হাস্যে ফেলেছি।
মাস্টর বললেক, ‘শুন তোকে একটা কাজ করতে হবেক’।
বললম, কাজ টো কি বঠে?
বললেক, ‘তোকে একটা ছবি আঁকে দিতে হবেক’,
ই বাবা! ছবি আবার কী আঁকব হে
আমি গােরুবাগালি আর বাঁশি ফুঁকা ছাড়া
আর ত কিছু জানি নাই ।
মাস্টর নাছোড়,
ঝোলা হাতড়ে বললেক, ‘এই লে রং, এই লে তুলি
এই লে কাগজ।’
সক্কাল বেলা গোরুবাথানের মাঠে এক পাল গাইগোরুর মাঝে
আমি হা হয়ে ভাল্যে,
বললম, বাবুদে ইসকুলডাঙাতে দেখগা যাইয়ে
আমার পারা কত ছেলেপিলেরা
বসে বসে ছবি আঁকছে,
দেদার ছবি।
মাস্টর শুনলেক নাই কিছুই।
বললেক, ‘উয়াদে ছবি অনেক আছে আমার ঝোলাতে
লে লে দেরি করিস না
তুই একটা গাছের ছবি আঁক দেখনি
অজয়ের পাড়ে এত ফুল ফুটেছে পলাশের
তুই আমাকে একটা পলাশ গাছের ছবি আঁকে দে।”
আমি আর কি করি
অত বড় মানুষ অমন করে বলছে
ই দেখে শেষতক কাগজ নিয়ে বসে গেলম
গরুবাথানের ধুলাতে
হেলাবাড়ি ছাড়ে বাঁশি ফেলে তুলি ধরলম হাতে,
তাবাদে ভাবতে ভাবতে একসমতে
অজয় লদীর পাড়ের একটা আদ্দা পলাশ গাছ’কে
উপড়াই লিইয়ে আস্যে
কৌটা ভর্তি রঙে চুবাই
বসাই দিলম মাস্টরের কাগজে,
কি হইছে কে জানছে
বললম, হেই লাও তুমার ছবি।
ছবি দেখে চোখের পাতনা লড়ে নাই মাস্টরের
আলোপনা মুখে মাস্টর বললেক,
‘তুই ই কি করলি
ই কি ছবি আঁকলি?’
বললম, কেনে, কি হইছে।
মাস্টর বললেক, পলাশ ফুলের গাছ টা না হয় বুঝলম
গাছের তলায় মাটির ভিতরে
তুই ই সব আঁকিবুকি কি আঁকলি?’
বললম, উগুলা শিকড় বঠে হে মাস্টর
চিনতে লারছ,
তুমি শিকড় চিনতে লারছ!
মাস্টর তখন ঝোলা উবুড় করে
যত ছবি সব দিলেক ঢাল্যে,
দেখলম কতরকমের সব গাছের ছবি
তার একটাতেও শিকড় নাই,
আমি অবাক,
বললম, হে মাস্টর,
ই গুলা কি গাছ বঠে হে-?
বাবুদে ঘরের স্কুলে পড়ে ছেলেপেলারা ইসব
কি আঁকছে?
মাস্টর কোনো রা নাই কাড়লেক
আমার আঁকা ছবির দিকে ভালতে ভালতে
একটা কথা শুদালেক,
‘তুই গাছের সঙ্গে শিকড় কেনে আঁকলি ?
বললম, ই বাবা, বড় আশ্চয্যি শুনালে বঠে
গাছ আছে শিকড় নাই
ই কখনঅ হয় নাকি?
তুমি বলঅ,
শিকড় ছাড়া কি গাছ বাঁচে?
জানঅ মাস্টর, বাপ বলথক
‘ছােটোলােক মােটোলােক যে যা বলছে বলুক
আমরা কি জানিস,
আমরা হলম শিকড়ের লোক
আমরা হলম শিকড়ের লোক।’ |
দেবব্রত সিংহ | মানবতাবাদী | ‘মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।’কাগজওয়ালারা বইললেক,
“উঁ অতটুকু বইললে হবেক কেনে?
তুমি এবারকার মাধ্যমিকে পত্থম হইছ।
তোমাকে বইলতে হবেক আরো কিছু।”পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি-
সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার
কোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,
হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেক
তখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।
কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখে
চোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।
-একি স্বপন দেখছি নাকি-
স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে।
কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।আজ বাপ বেঁইচে থাইকলে
আমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-
আমার বুকের ভিতর
যে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা।
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।
সেটো দেখাইতে পাইত্থম।আপনারা বইলছেন বটে
“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”
কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু
উঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই।
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।
বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।
যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি
“বিটি না মাটি’
ঠাকুমা বইলথক্,
পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্
“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।
শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালে
আর এক কানে বার কইরে দিবি।’তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।
ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।
মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মা
চুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।
মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।
আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলাম
ইতিহাস…
কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।
মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!
আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।
ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।
শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাই
মায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,
সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,
দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসন
আমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম
“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”
বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-
“কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,
তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কাল
আমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালো
আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”
বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।
তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”
কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেড়োই চইলে আইলম।”তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।
বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলে
দুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা
সাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।মা কুনো রা কাড়ে নাই।
আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলে
গা-হাত-পা সেঁকছিল মা।একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটা
ঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।
আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।
বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকে
মাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।
শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।
বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।
তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,
তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।
যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াই
নিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।
এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।
না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,
কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়ে
কাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপে
আগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।
‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতে
বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,
“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,
তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।
তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসে
তার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।
– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।
শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,
আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–
এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,
ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,
ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।
গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।
আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-
“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারা
যে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।
গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।
ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-
“ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,
তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।
বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”বইল্ লম –
“ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।
আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিন
অন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারা
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“ |
অনিতা অগ্নিহোত্রী | চিন্তামূলক | গঞ্জের ধ্বনি আর সারি সারি চালা শেষ হলে
সমুদ্র রয়েছে। নীলাভ সবুজ। অপার্থিব।
আকাশের কাছাকাছি অথচ বিযুক্ত, বেদনায়।।
সমুদ্রের দিন রাত মিলেমিশে একটিই জলকণ্ঠস্বর।উল্টানো নৌকার কাছে গিয়ে বসি। সন্ন্যাসী কাঁকড়া।
পরিবার দ্রুত হাঁটে গরম বালুর অপসৃয়মানতায়।
আমার চিবুকে নুন, গালে নুন, ওষ্ঠাধর লবণে স্থবির
রাত্রি নামার আগে আমার ফেরার আছে গঞ্জের দোকানে।হিসাব মেলাবো বলে রাতে এসে দেখি সদ্য ভেজা
বধির খাতার মধ্যে শুয়ে আছে শঙ্খ, কড়ি, সৈন্ধবলবণ
ঘুমের অনেক নীচে সমুদ্রের স্বর মালা, সমুদ্রের
সকাতর প্রেম।
গৃহস্থালি জমে ওঠে: অতিথিরা ভাত-গন্ধ দ্রব
কারো থাকে না মনে: কিছু দূরে, প্রহরায়, সমুদ্র রয়েছে।গঞ্জের ধ্বনি আর সারি সারি চালা শেষ হলে
সমুদ্র রয়েছে। নীলাভ সবুজ। অপার্থিব।
আকাশের কাছাকাছি অথচ বিযুক্ত, বেদনায়।।
সমুদ্রের দিন রাত মিলেমিশে একটিই জলকণ্ঠস্বর।উল্টানো নৌকার কাছে গিয়ে বসি। সন্ন্যাসী কাঁকড়া।
পরিবার দ্রুত হাঁটে গরম বালুর অপসৃয়মানতায়।
আমার চিবুকে নুন, গালে নুন, ওষ্ঠাধর লবণে স্থবির
রাত্রি নামার আগে আমার ফেরার আছে গঞ্জের দোকানে।হিসাব মেলাবো বলে রাতে এসে দেখি সদ্য ভেজা
বধির খাতার মধ্যে শুয়ে আছে শঙ্খ, কড়ি, সৈন্ধবলবণ
ঘুমের অনেক নীচে সমুদ্রের স্বর মালা, সমুদ্রের
সকাতর প্রেম।
গৃহস্থালি জমে ওঠে: অতিথিরা ভাত-গন্ধ দ্রব
কারো থাকে না মনে: কিছু দূরে, প্রহরায়, সমুদ্র রয়েছে।গঞ্জের ধ্বনি আর সারি সারি চালা শেষ হলে
সমুদ্র রয়েছে। নীলাভ সবুজ। অপার্থিব।
আকাশের কাছাকাছি অথচ বিযুক্ত, বেদনায়।।
সমুদ্রের দিন রাত মিলেমিশে একটিই জলকণ্ঠস্বর।উল্টানো নৌকার কাছে গিয়ে বসি। সন্ন্যাসী কাঁকড়া।
পরিবার দ্রুত হাঁটে গরম বালুর অপসৃয়মানতায়।
আমার চিবুকে নুন, গালে নুন, ওষ্ঠাধর লবণে স্থবির
রাত্রি নামার আগে আমার ফেরার আছে গঞ্জের দোকানে।হিসাব মেলাবো বলে রাতে এসে দেখি সদ্য ভেজা
বধির খাতার মধ্যে শুয়ে আছে শঙ্খ, কড়ি, সৈন্ধবলবণ
ঘুমের অনেক নীচে সমুদ্রের স্বর মালা, সমুদ্রের
সকাতর প্রেম।
গৃহস্থালি জমে ওঠে: অতিথিরা ভাত-গন্ধ দ্রব
কারো থাকে না মনে: কিছু দূরে, প্রহরায়, সমুদ্র রয়েছে।গঞ্জের ধ্বনি আর সারি সারি চালা শেষ হলে
সমুদ্র রয়েছে। নীলাভ সবুজ। অপার্থিব।
আকাশের কাছাকাছি অথচ বিযুক্ত, বেদনায়।।
সমুদ্রের দিন রাত মিলেমিশে একটিই জলকণ্ঠস্বর।উল্টানো নৌকার কাছে গিয়ে বসি। সন্ন্যাসী কাঁকড়া।
পরিবার দ্রুত হাঁটে গরম বালুর অপসৃয়মানতায়।
আমার চিবুকে নুন, গালে নুন, ওষ্ঠাধর লবণে স্থবির
রাত্রি নামার আগে আমার ফেরার আছে গঞ্জের দোকানে।হিসাব মেলাবো বলে রাতে এসে দেখি সদ্য ভেজা
বধির খাতার মধ্যে শুয়ে আছে শঙ্খ, কড়ি, সৈন্ধবলবণ
ঘুমের অনেক নীচে সমুদ্রের স্বর মালা, সমুদ্রের
সকাতর প্রেম।
গৃহস্থালি জমে ওঠে: অতিথিরা ভাত-গন্ধ দ্রব
কারো থাকে না মনে: কিছু দূরে, প্রহরায়, সমুদ্র রয়েছে। |
কায়কোবাদ | প্রেমমূলক | ( ১ )
কে তুমি? — কে তুমি?
ওগো প্রাণময়ী,
কে তুমি রমণী-মণি!
তুমি কি আমার, হৃদি-পুষ্প-হার
প্রেমের অমিয় খনি!
কে তুমি রমণী-মণি?( ২ )
কে তুমি?—
তুমি কি চম্পক-কলি?
গোলাপ মতি
তুমি কি মল্লিকা যুথী ফুল্ল কুমুদিনী?
সৌন্দর্যের সুধাসিন্ধু,
শরতের পূর্ণ ইন্দু
আঁধার জীবন মাঝে পূর্ণিমা রজনী!
কে তুমি রমণী-মণি?( ৩ )
কে তুমি? —
তুমি কি সন্ধ্যার তারা, সুধাংশু সুধা-ধারা
পারিজাত পুষ্পকলি
বিশ্ব বিমোহিনী
অথবা শিশির স্নাতা, অর্ধস্ফুট, অনাঘ্রাতা
প্রণয়-পীযূষ ভরা,সোনার নলিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?( ৪ )
কে তুমি?—
তুমি কি বসন্ত-বালা, অথবা প্রেমের ডালা,
প্রাণের নিভৃত কুঞ্জে
সুধা-নির্ঝরিনী!
অথবা প্রেমাশ্রু-ধারা, শোকে দুঃখে আত্মহারা
প্রেমের অতীত স্মৃতি,
বিধবা রমণী!
কে তুমি রমণী-মণি?( ৫ )
কে তুমি?—
তুমি কি আমার সেই
হৃদয়-মোহিনী?
সেই যদি,—কেন দূরে? এস, এই হৃদি-পুরে
এস’ প্রিয়ে প্রাণময়ী,
এস’ সুহাসিনী!
এস’ যাই সেই দেশে,—ফুল ফুটে চাঁদ হাসে
দয়েলা কোয়েলা গায়
প্রাণের রাগিণী!
জরা নাই—মৃত্যু নাই, প্রণয়ে কলঙ্ক নাই
চল যাই সেই দেশে
এস’ সোহাগিনী!
কে তুমি রমণী-মণি? |
কায়কোবাদ | চিন্তামূলক | “সুখ সুখ” বলে তুমি, কেন কর হা-হুতাশ,
সুখ ত পাবে না কোথা, বৃথা সে সুখের আশ !
পথিক মরুভূ মাঝে খুঁজিয়া বেড়ায় জল,
জল ত মিলে না সেথা, মরীচিকা করে ছল !
তেমতি এ বিশ্ব মাঝে, সুখ ত পাবে না তুমি,
মরীচিকা প্রায় সুখ, – এ বিশ্ব যে মরুভূমি !
ধন রত্ন সুখৈশ্বর্য কিছুতেই সুখ নাই,
সুখ পর-উপকারে, তারি মাঝে খোঁজ ভাই !
‘আমিত্ব’কে বলি দিয়া স্বার্থ ত্যাগ কর যদি,
পরের হিতের জন্য ভাব যদি নিরবধি !
নিজ সুখ ভুলে গিয়ে ভাবিলে পরের কথা,
মুছালে পরের অশ্রু – ঘুচালে পরের ব্যথা !
আপনাকে বিলাইয়া দীনদুঃখীদের মাঝে,
বিদূরিলে পর দূঃখ সকালে বিকালে সাঁঝে !
তবেই পাইবে সুখ আত্মার ভিতরে তুমি,
যা রুপিবে – তাই পাবে, সংসার যে কর্মভূমি ! |
কায়কোবাদ | প্রেমমূলক | ( ১ )
আবার, আবার সেই বিদায়-চুম্বন,
আলেয়ার আলো প্রায়,
আঁধারে ডুবায়ে যায়,
স্মৃতিটি রাখিয়া হায় করিতে দাহন!( ২ )
বিদায়-চুম্বন,
উভয়েরি প্রাণে করে অগ্নি বরিষণ,
উভয়ে উভয় তরে,
আকুলি ব্যাকুলি করে,
উভয়েরি হৃদিস্তরে যাতনা-ভীষণ!
এমনি কঠোর হায় বিদায়-চুম্বন!( ৩ )
প্রণয়ের মধুমাখা প্রথম চুম্বনে,
শুধু সুখ সমুল্লাস ;
এতে ঘন হাহুতাশ,
কেবলি যে বহে হায় উভয়েরি মনে!( ৪ )
সে চুম্বনে এ চুম্বনে কি দিব তুলনা,
সে স্বর্গের পরিমল,
এ মর্তের হলাহল,
তাহাতে উল্লাস, এতে কেবলি যাতনা!( ৫ )
সে যে শরতের স্নিগ্ধ সুধাংশু-কিরণ,
মুহুর্তে মাতায় ধরা,
এ যে শুধু ক্লেশ ভরা
বৈশাখের ঘন ঘোর ঝটিকা ভীষণ! |
কায়কোবাদ | প্রেমমূলক | (১)
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে
ফুলরাণী বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?(২)
প্রথম চুম্বন!
মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!
কত প্রেম কত আশা,
কত স্নেহ ভালবাসা,
বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!(৩)
হায় সে চুম্বনে
কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!
কত হাসি, কত ব্যথা,
আকুলতা, ব্যাকুলতা,
প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!(৪)
সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন! |
কায়কোবাদ | ভক্তিমূলক | কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!
আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।
হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে,
কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-
কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।
নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।
ভ্রমরের গুণ-গানে সেই সুর আসে কানে
কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।
ভূধরে, সাগরে জলে নির্ঝরণী কলকলে,
আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি।
আহা যবে সেই সুর সুমধুর স্বরে,
ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,
প্রাণ করে আনচান, কি মধুর সে আযান,
তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।
নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবই মরা,
এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে,
মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে
কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!
জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।
আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী। |
কায়কোবাদ | চিন্তামূলক | হে পান্থ, কোথায় যাও কোন্ দূরদেশে
কার আশে? সে কি তোমা করিছে আহ্বান?
সম্মুখে তামসী নিশা রাক্ষসীর বেশে
শোন না কি চারিদিকে মরণের তান!
সে তোমারে ওহে পান্থ, হাসিমুখে এসে,
সে তোমারে ছলে বলে গ্রাসিবে এখনি |
যেয়োনা একাকী পান্থ, সে দূর বিদেশে,
ফিরে এসো, ওহে পান্থ, ফিরে এসো তুমি |
এ ক্ষুদ্র জীবন লয়ে কেন এত আশা?
জান না কি এ জগত্ নিশার স্বপন?
মায়া মরীচিকী প্রায় স্নেহ ভালবাসা—
জীবনের পাছে ওই রয়েছে মরণ
হে পান্থ হেথায় শুরু আঁধারের স্তর ;
মৃত্যুর উপর মৃত্যু, মৃত্যু তার পর! |
কায়কোবাদ | স্বদেশমূলক | কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী?
এ দেশের লোক যারা,
সকলইতো গেছে মারা,
আছে শুধু কতগুলি শৃগাল শকুনি!
সে কথা ভাবিতে হায়
এ প্রাণ ফেটে যায়,
হৃদয় ছাপিয়ে উঠে – চোখ ভরা পানি।
কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী!
এ দেশের লোক যত
বিলাস ব্যসনে রত
এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা।
দেশ গেল ছারেখারে,
এ কথা বলিব কারে?
ভেবে ভেবে তবু মোর হয়ে গেছে সারা!
প্রাণভরা হাহাকার
চোখ ভরা অশ্রুধার,
এ হৃদি যে হয়ে গেছে মরুভূমি-পারা! |
কায়কোবাদ | স্বদেশমূলক | ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা আমার জন্মভূমি।
গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,
যাহার চরণ চুমি।
ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,
যাহার পূণ্য-গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!
আমার মায়ের সবুজ আঁচল
মাঠে খেলায় দুল!
আমার মায়ের ফুল-বাগানে,
ফুটছে কতই ফুল!
শত শত কবি যাহার
গেয়ে গেছে গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!
আমার মায়ের গোলা ছিল,
ধন ধান্যে ভরা!
ছিল না তার অভাব কিছু,
সুখে ছিলাম মোরা!
বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে,
ঘুমিয়ে রব আমি!
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা জন্মভূমি!’ |
কায়কোবাদ | চিন্তামূলক | ১
আঁধারে এসেছি আমি
আধারেই যেতে চাই !
তোরা কেন পিছু পিছু
আমারে ডাকিস্ ভাই !
আমিতো ভিখারী বেশে
ফিরিতেছি দেশে দেশে
নাহি বিদ্যা, নাহি বুদ্ধি
গুণ তো কিছুই নাই !
২
আলো তো লাগে না ভাল
আধারি যে ভালবাসি !
আমিতো পাগল প্রাণে
কভূ কাঁদি, কভূ হাসি !
চাইনে ঐশ্বর্য-ভাতি, চাইনে যশের খ্যাতি
আমিযে আমারি ভাবে মুগ্ধ আছি দিবানিশি !
৩
অনাদার-অবজ্ঞায়
সদা তুষ্ট মম প্রাণ,
সংসার-বিরাগী আমি
আমার কিসের মান ?
চাইনে আদর স্নেহ, চাইনে সুখের গেহ
ফলমূল খাদ্য মোর
তরুতলে বাসস্থান !
৪
কে তোরা ডাকিস মোরে
আয় দেখি কাছে
কি চাস আমার কাছে
আমি যে ভিখারী হায় !
ধন নাই, জন নাই,, কি দিব তোদেরে ভাই,
আছে শুধু ‘অশ্রু-জল’
তোরা কি তা নিবি হায় !
৫
শোকে তাপে এ হৃদয়
হয়ে গেছে ঘোর কালো ;
আঁধারে থাকিতে চাই
ভাল যে বাসিনে আলো !
আমি যে পাগল কবি, দীনতার পূর্ণ ছবি,
সবি করে ‘দূর ‘দূর’
তোরা কি বাসিস্ ভাল ? |
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য | নীতিমূলক | মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।ছোট পাখি, ছোট পাখি
কিচিমিচি ডাকি ডাকি
কোথা যাও বলে যাও শুনি।এখন না কব কথা
আনিয়াছি তৃণলতা
আপনার বাসা আগে বুনি।পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।শীতের সঞ্চয় চাই
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিলপিল চলি। |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | অজস্র জন্ম ধরে
আমি তোমার দিকে আসছি
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।
তোমার দিকে আসতে আসতে
আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়
পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত।
আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো
শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,
এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার দুঃখ,
তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে
আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।
আরেক জন্মে
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম তোমার উদ্দেশ্য।
পথে বেরিয়েই আমি পলি মাটির উপর আকাঁ দেখি
তোমার পায়ের দাগ
তার প্রতিটি রেখা
আমাকে পাগল করে তোলে।
ঐ আলতার দাগ,আমার চোখ,আর বুক আর স্বপ্নকে
এতো লাল করে তুলে,
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ন ভুলে যাই
ঐ রঙ্গীন পায়ের দাগ প্রদক্ষীন করতে করতে
আমার ঐ জন্মটা কেটে যায়।
আমার দুঃখ !
মাত্র একটি জন্ম
আমি পেয়েছিলাম
সুন্দর কে প্রদক্ষীন করার।
আরেক জন্মে
তোমার কথা ভাবতেই-
আমার বুকের ভিতর থেকে সবচে দীর্ঘ
আর কোমল,আর ঠাণ্ডা নদীর মত
কি যেন প্রবাহিত হতে শুরু করে।
সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে
আমি একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে
কাটিয়ে দেই সম্পুর্ন জন্মটা।
আমার দুঃখ ,আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিল
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ
আমার ষোঁড়শ জন্মে
একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে,
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি-
উঁচুতে ! উঁচুতে !! আরো উঁচুতে !!!
আর এক সময় ঝড়ে যাই চৈত্রের বাতাসে।
আমার দু:খ মাত্র একটি জন্ম
আমি গোলাপের পাপঁড়ি হয়ে
তোমার উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পরতে পেরেছিলাম।
এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে
টলমল করছে একটি অশ্রু বিন্দু।
ঐ অশ্রু বিন্দু পেরিয়ে এ জন্মে হয়তো
আমি তোমার কাছে পৌঁছুতে পারবনা;
তাহলে ,আগামী জন্ম গুলো আমি কার দিকে আসবো ? |
হুমায়ুন আজাদ | মানবতাবাদী | আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে। |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | মূলঃ হেনরিক হাইনে
আমার অশ্রু এবং কষ্টরাশি থেকে
ফুটে উঠে ফুল থরে থরে অফুরান,
এবং আমার দীর্ঘশ্বাসে
বিকশিত হয় নাইটিংগেলের গান ।
বালিকা, আমাকে যদি তুমি ভালোবাসো,
তোমার জন্য সে ফুল আনবো আমি—
এবং এখানে তোমার দ্বারের কাছে
নাইটিংগেলেরা গান গাবে দিবাযামি । |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | তুমি ভাঙতে পারো বুক শুষে নিতে পারো সব রক্ত ও লবণ
বিষাক্ত করতে পারো ঘুম স্বপ্নময় ঘুমের জগত
তছনছ ক’রে দিতে পারো তুমি বন উপবন
উল্টেপাল্টে দিতে পারো সব সিঁড়ি লিফট্ রাজপথ
মিশিয়ে দিতেও পারো সঙ্গীতের সুরেসুরে বিষ
আমাকে প্রগাঢ় কোনো আত্নহত্যায় উৎসাহিত ক’রে দিতে পারো
ম’রে যাবে ধানক্ষেত ঝ’রে যাবে পাখিদের শিস
তোমার ক্ষমতা আছে পারো তুমি আরো
আমাকে মাতাল ক’রে ছেড়ে দিতে পারো তুমি গলির ভেতরে
সমস্ত সড়কে তুমি জ্বালতে পারো লাল সিগনাল
বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ ক’রে দিতে পারো জীবনের সবগুলো ঘরে
এর বেশি আর তুমি কি পারো তমাল? |
হুমায়ুন আজাদ | চিন্তামূলক | আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে। |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল,
তা নয়। তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর। কারো কষ্টের
কথা এখানে চাপা থাকে না। শুনেছি আমাকে
ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে
তোমার। পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা
তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম।
যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি কি জানো না গাধারা কখনো
অগ্নিগিরিতে চড়ে না?
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যূৎ আছে, তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যূতে
দপ ক’রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যূৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলে সে নাকি ভাবে
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না। আমি জানি তোমার কতোটা দরকার
শারীরিক তাপ। গাধারা জানে না।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু’টি ভয়ংকর ত্রিভুজ। সে-খবর
পায় নি গাধাটা। গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম
জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।
তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক। তুমি যেখানে
নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না। গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!
তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে? ভেবেছিলে গাড়ি, আর
পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে, আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?
শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্ত কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই। |
হুমায়ুন আজাদ | চিন্তামূলক | একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,
প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থক ঝিনুক।
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়
আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোন দিকে-
না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমীরসহ
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।
আকষ্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত।
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,
নিজেকে-ব্যাধিকে-যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে-
একরত্তি নিটোল মুক্তোয়! |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | মুলঃ হেনরিক হাইনে
ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়
ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,
অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি ।
নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি
আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,
তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে
আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর ।
সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ,
তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে
জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ ।
তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা-
একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো;
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে
ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত । |
হুমায়ুন আজাদ | মানবতাবাদী | আগাছা ছাড়াই, আল বাঁধি, জমি চষি, মই দিই,
বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর
দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালি
খেত ভ’রে, আসলে রক্ত ঢেলে দিই
নোনা পানিরূপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হলে
খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।
খরা, বৃষ্টি, ঝড়, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে
প্রকৃতির কৃপা হ’লে এক সময়
মুখ দেখতে পাই থোকাথোকা সোনালি শস্যের।
এতো ঘামে, নিজেকে ধানের মতোই
সিদ্ধ করে, ফলাই সামান্য, যেনো একমুঠো, গরিব শস্য।
মূর্খ মানুষ, দূরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে
দিনরাত লেফ-রাইট লেফ-রাইট করলে ক-মণ শস্য ফলে
এক গন্ডা জমিতে? |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | মূলঃ হেনরিক হাইনে
প্রিয়তমা, তুমি হাতখানি রাখো আমার গুমোট বুকে।
শুনতে পাচ্ছো শব্দ? কে যেনো হাতুড়ি ঠুকে চলছে?
সেখানে এক মিস্ত্রি থাকে,যে বানিয়ে চলেছে
এক শবাধার ।
কার জন্যে জানো?—– আমার, আমার ।
উল্লাসে বিদ্বেষে নিরন্তর সে হাতুড়ি
ঠুকছে দুই হাতে,
কিছুতে ঘুমোতে পারছিনা আমি,
দিনে কিংবা রাতে।
মিস্ত্রি, দ্রুত করো, তুমি কাজ
শেষ করো তাড়াতাড়ি,
যাতে আমি অবশেষে শান্তিতে ঘুম যেতে পারি ।। |
হুমায়ুন আজাদ | শোকমূলক | খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন,
মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে হবো না চৌচির।
তরঙ্গে তরঙ্গে ভ্রষ্ট অন্ধ জলযান
এখন চলবে জলে খুব ধীরস্থির।
অন্য কেউ ঢেলে নিচ্ছে ঠোঁট থেকে লাল
মাংস খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হীরেসোনামণি;
এই ভয়ে কাঁপবে না আকাশপাতাল,
থামবে অরণ্যে অগ্নি আকাশে অশনি।
আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ,
খুব সুস্থ হয়ে উঠবে জীবনযাপন।
অন্নে জলে ঘ্রাণে পাবো অবিকল স্বাদ,
চিনবো শত্রুর মুখে কারা-বা আপন।
বুঝবো নিদ্রার জন্যে রাত্রি চিরদিন,
যারা থাকে ঘুমহীন তারা গায় গান।
রঙিন রক্তের লক্ষ্য ঠাণ্ডা কফিন;
খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন। |
হুমায়ুন আজাদ | প্রেমমূলক | আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল, তা নয়।
তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর।
কারো কষ্টের কথা এখানে চাপা থাকে না।শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে তোমার।
পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম
সৃষ্টি করেছিলাম।যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম।তুমি কি জানো না গাধারা কখনো অগ্নিগিরিতে চড়ে না?
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যুৎ আছে,
তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যুতে দপ ক’রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যুৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলে
সে নাকি ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না।
আমি জানি তোমার কতোটা দরকার শারীরিক তাপ।
গাধারা জানে না।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু’টি ভয়ংকর ত্রিভুজ।
সে- খবর পায় নি গাধাটা।
গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক।
তুমি যেখানে নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না।
গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে?
ভেবেছিলে গাড়ি, আর পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে,
আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্তু কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই। |
হুমায়ুন আজাদ | চিন্তামূলক | এই তো ইস্কুল থেকে ফিরলাম এই তো পাখির পালক
কুড়িয়ে আনলাম এই তো মাঘের দুপুরে
বাসা ভাঙলাম শালিকের সাঁতরিয়ে এলাম পুকুরে
এই তো পাড়লাম কুল এই তো ফিরলাম মেলা থেকে
এই তো পেলাম ভয় তেঁতুলতলায় এক সাদাবউ দেখে
এই তো নবম থেকে উঠলাম দশম শ্রেণীতে
এই তো রাখলাম হাত কিশোরীর দীঘল বেণীতে
এই তো নিলাম তার ঠোঁট থেকে রজনীগন্ধা ।
এরই মাঝে এতো বেলা ? নামলো সন্ধ্যা ? |
হুমায়ুন আজাদ | মানবতাবাদী | তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখি না এ লাশ
আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই। |
হুমায়ুন আজাদ | মানবতাবাদী | আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি
আমার অচেনা
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার
মায়েদের আমি
মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো
গরিব পিতার ঘরে
বেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণী
বালিকারূপে ধীরেধীরে;
দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের
মতো ফুটেছেন
ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রে
তুলেছেন মাতা
ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল
ভয়েরই কারণ।
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে
দিয়েছেন
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব
ঘরে;
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে
জুটেছে কখনো, তবে
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য,
পীড়ন, খণ্ড
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয়
স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন।
বঙ্গীয় নারীর
আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে
পুত্রকন্যা,
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন
ঢাকাই
শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে
উপহার
দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক
কৃশকায়
রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার
শুষ্ক বুক
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র
জলের উচ্ছ্বাস।
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি
আপনাকে মুগ্ধ
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের
স্নিগ্ধ মুখ,
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও
চেয়েছেন জানি
আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত
মানুষ। তাকে
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে
না সততার
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়,
পীড়নে বা
প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা
করবে না।
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা
নয়, আপনি
আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র
যদি হতো
সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন
শ্রমিক, কিংবা
তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি
উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে পারেন নি
সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক,
এখানে মোহর
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও
জোটে না। তবে এতে
আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি;
কারণ আপনি
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও
রকম কিছুই
চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার
পুত্র হোক
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ।
আপনার সমস্ত
পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক’রে
বিশশতকের এই
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র
কী হয়েছে
আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা
দরিদ্র জননী?
কেনো আপনি পুত্রকে
পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের
এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে
কৃষক এসে লিপ্ত
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের
রাখাল তার
নদী আর মাঠ হ’য়ে ওঠে হাবশি
গোলাম?
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার
পুত্র শহরের
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ?
আপনি এখন
তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন,
আপনার পুত্রের দিকে
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না
চোখে, শুধু
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে।
দশকে দশকে
যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা
দিয়েছেন মুঘলদের
এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের
প্রত্যেকের
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে
পৃষ্ঠদেশ জুড়ে
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার
পৃষ্ঠদেশ
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;-
মরুভূমিতে কিম্ভুত
বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায়
তাকে।
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম
মজলিশের
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও
তার ইয়ারেরা
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন,
ঐতিহাসিক গোলামদের
গৌরব হরণ ক’রে তারা আজ মশহুর
গোলাম
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার
তুলতে পারে না,
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও
একটি
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ
কুঁজটিকেই মাথা
ব’লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর
স্বাভাবিক পদ্ধতিও
বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের
পাদুকার তলে
প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া
আর কিছুতেই
পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র,
একদা আপনার
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে
জীবন ধারণ
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে
শত্রু পাখি
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি
সে আপনার
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য
দুঃক্ষ করি না, কতোই
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে
শতকে শতকে।
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব
কৃষক-কন্যা, দুঃক্ষী
মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে
বড় বেশি
দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের
গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা
পৌঁছে গেছে তিতাসের
জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে,
লাউয়ের
মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের
উঠানের কোণে।
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল
ক’রে
ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে’; মাঠে
পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে’;
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি
থেকে
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের
গর্ভধারিণীর
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’,
প্রতিবেশী
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত
ক’রে কলকণ্ঠে
বলে, ‘দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে।’ এমন কি
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা
শুনতে পান
‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’
স্বর ঘিরে ফেলছে
চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম
বিশ্রাম
নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো
মাটি ফুঁড়ে
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের
কানে কানে ব’লে
যাবে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক
গর্ভধারিণী
গোলামের।’ ভিজে উঠবে মাটি
ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।
কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে
দশমাস
ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ
না গোলাম? |
হুমায়ুন আজাদ | স্বদেশমূলক | যখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপতে থাকে
দশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,
যখন আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;
আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ
মাইলের কথা: তার রাজনীতি
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যম-লী
জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন
করে আমাকে পীড়ন কোরো না
তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে। |
হুমায়ুন আজাদ | প্রকৃতিমূলক | ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো। |
হুমায়ুন আজাদ | স্বদেশমূলক | শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।
লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের
মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:
আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,
চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস
আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।
শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে
তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।
সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ
যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার
হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল
তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন
তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো
তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম
শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি
আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,
তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;
ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি
ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,
তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;
এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি
আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের
একমাত্র গান। |
হুমায়ুন আজাদ | স্বদেশমূলক | আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারন করতে চেয়েছিলাম আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতো করেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে বলতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবত গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।
আমি মাংসের টুকরা থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্য পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্য নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সবকিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছে তাকে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জরিয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম
অন্যদের সময়ে। |
হুমায়ুন আজাদ | মানবতাবাদী | গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়। |