title
stringlengths 10
148
| text
stringlengths 14
34.6k
| summary
stringlengths 1
7.08k
|
---|---|---|
নার্সকে বেল্ট দিয়ে পেটানোর অভিযোগ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে | মানিকগঞ্জে কোমর থেকে বেল্ট খুলে একজন সিনিয়র স্টাফ নার্সকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার সকালে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় মানিকগঞ্জ সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী নার্স মো. শাহীনুর রহমান শাহীন।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. বাহাউদ্দিন মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে তাকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে প্রথমে গালিগালাজ এবং একপর্যায়ে কোমর থেকে বেল্ট খুলে পেটাতে থাকেন। তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশে স্টাফ নার্স সাইফুল ইসলাম তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক আউট সোর্সিংয়ের কর্মচারীদের ডেকে এনে তাকে মেরে লাশ গুম করার নির্দেশ দেন। খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ সদর থানার পুলিশ সদস্যরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। আহত অবস্থায় তিনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে গেলে তিনি তাতেও বাঁধা দেন। ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর জরুরি বিভাগে গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধসহ ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করেন তিনি। আবারও হামলার আশঙ্কায় হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি আইনি সহায়তা চেয়েছেন।
নির্যাতিত সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. শাহীনুর রহমান বলেন, 'হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক হাসপাতালে কম আসেন। তিনি কিছু দুর্নীতিবাজ স্টাফদের নিয়ে হাসপাতালে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন। তার লোকজনের দায়িত্বে অবহেলার কারণে রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা স্থানীয় বলে রোগীরা সবসময় আমাদের কাছে ছুটে এসে নানা অভিযোগ করেন। এসব ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক স্যারের কাছে অভিযোগ দিলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাদের সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করেন। কেউ তার ভয়ে কিছু বলতে সাহস পায় না। এর প্রতিবাদ করি বলেই আমি তার টার্গেটে পরিণত হয়েছি।'
'২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি আমি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বদলি হয়ে আসি। তখন আরএমও (আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার) স্যার ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি আমাকে প্রতিসাক্ষরের মাধ্যমে ১১ জানুয়ারিতে যোগদানের নির্দেশ দেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক স্যার এসে আমাকে যোগদান থেকে বিরত রাখেন। পরে দেনদরবার করে ২০ হাজার টাকা এবং ১০ কেজি হাজারি গুড় কিনে দেওয়ার পর ১৯ জানুয়ারি আমাকে যোগদান করান।'
তিনি আরও বলেন, 'লোকবলের অভাবে হাসপাতালের কিডনি ডায়ালসিস ইউনিট দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরে আমিসহ হাসপাতালের ১০ জন স্টাফকে নিয়ে নিজের টাকা খরচ করে প্রতিদিন ঢাকায় গিয়ে জাতীয় কিডনি হাসপাতালে ১৫ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ নেই। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে আমি দায়িত্ব নিয়ে নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদের সেবা দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে সেখান থেকে সড়িয়ে তার পছন্দের লোকদের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তারা সময়মতো হাসপাতালে না আসার কারণে রোগীরা যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মেডিসিন ওয়ার্ডের অবস্থাও একই রকম। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরাও সময়মতো হাসপাতালে আসেন না। এসব বিষয়ে কেউ কথা বললেই তার শত্রু হয়ে যান। আমিও তাই হয়েছি। তিনি কথায় কথায় আমাকে মা-বাপ তুলে গালাগালি করেন। এর প্রতিবাদ করলেই বিএনপি-জামাত বানিয়ে চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন। তিনি বড় চাকরি করেন। আমি তার অধীনস্ত ছোট কর্মচারী। আমাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আর তো পারছি না। গরিবের কি কেউ নেই নাকি?'
'ডিইটি রোস্টার অনুযায়ী আমি আজ সকালে হাসপাতালে এসেছি। তিনি আমাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি আমাকে দায়িত্ব পালন করতে দিবেন না। আমি ছোট হলেও নবম গ্রেডের একজন স্টাফ। তিনি কি আমাকে সরকারি দায়িত্বপালনে বাঁধা দিতে পারেন?', বলেন শাহীনুর।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক ডা. বাহাউদ্দিন বলেন, 'বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে এখন কোনো কথা বলা সমীচীন হবে না।'
মানিকগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাবিল হোসেন বলেন, 'আমি ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিনিয় স্টাফ নার্স—দুজনেই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেব।'
| মানিকগঞ্জে কোমর থেকে বেল্ট খুলে একজন সিনিয়র স্টাফ নার্সকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। |
খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু: সেই হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ | রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ওই হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আজ বুধবার বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া নোটিশে বলা হয়েছে, 'আহনাফ তাহমিন আয়হান নামের শিশুর সুন্নতে খতনা অপারেশনের সময়ে মৃত্যু সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে ও জে এস হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখান জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।'
| রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ওই হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। |
ছাত্ররাজনীতি, বুয়েট ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ | ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের সেরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে আবারও দলীয় রাজনীতি শুরু করার। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া নোটিশের ওপর 'স্থগিতাদেশ' দিয়েছেন হাইকোর্ট। অপরদিকে, বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালুর বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন—যার পেছনে রয়েছে বলিষ্ঠ, বেদনাদায়ক ও যৌক্তিক কারণ।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সর্বশেষ বলি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। বুয়েট ছাত্রলীগ নেতারা ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তার ওপর রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অসহনীয় ব্যথা ও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে আবরারের।
আবরারের এই মৃত্যু বুয়েট শিক্ষার্থীদের মনে যে দগদগে ঘা তৈরি করেছে, তার আর পুনরাবৃত্তি চায় না তারা।
কুষ্টিয়ায় মায়ের কোল থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে আসার কয়েক ঘণ্টা পরেই আবরারের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। তার একমাত্র 'অপরাধ' ছিল ফেসবুকে সমালোচনামূলক পোস্ট দেওয়া।
এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল ছাত্রলীগকে জবাবদিহি ও নজরদারির বাইরে রাখার কারণে তৈরি হওয়া এক সংস্কৃতির ফল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি ছাত্রলীগ একটি প্রশাসন তৈরি করে, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবন, বিশেষ করে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের। কোনো শিক্ষার্থী হলের সিট পাবে কি না, পেলে কোন হলের কোন সিট পাবে, দলীয় কার্যক্রমে তাদের কতটা অংশগ্রহণ করতে হবে এবং কতবার ও 'কীভাবে' নেতাদের 'সম্মান' জানাতে হবে, সেটাও নির্ধারণ করে দেয় এই প্রশাসন।
হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটি ছিল কার্যত একটি টর্চার সেল, যেখানে অবাধ্য শিক্ষার্থীদের ধরে এনে বাধ্য করা হতো। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও একই কাজ করেছে। এ কারণে, সেইসব দিন আবারও ক্যাম্পাসে ফিরে আসার সামান্যতম সম্ভাবনাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
বুয়েটে যা চলছিল, সেটাকে কি ছাত্ররাজনীতি বলা যায়? এটা কি কোনো দিক থেকে আমাদের ছাত্ররাজনীতির গৌরবান্বিত অধ্যায়ের ধারক বা বাহক, যা নিয়ে আমরা গর্ব করি? এ সময়ের ছাত্রনেতাদের কি আমাদের অতীতের ছাত্ররাজনীতির মশালবাহী বলা যায়? কোথায় সেই দিকনির্দেশনা, আদর্শ ও আত্মত্যাগ? আজ ছাত্ররাজনীতির মুখোশের আড়ালে কেবল ক্ষমতা, সম্পদ ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি। ছাত্ররাজনীতির সংস্কার না হলে আমাদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলোর কি কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে?
চল্লিশের দশকের শেষের দিকে (পাকিস্তানের জন্মের পর), পঞ্চাশ ও ষাটের দশক এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় (মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা আলাদা রাখলে) আমাদের ছাত্ররাজনীতির ভিত্তি ছিল আদর্শ, অঙ্গীকার, আত্মত্যাগ, সততা ও জনগণের সেবা। ভাষা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল যেকোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে অনেক বেশি।
একই কথা আইয়ুব ও ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবিকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বের দাবিদার যতটা আওয়ামী লীগ, ঠিক ততটাই ছাত্রলীগ।
ঊনসত্তরের ১১ দফা কর্মসূচি দিয়েছিল মূলত বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো, কিন্তু এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে এই আন্দোলন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রআন্দোলন ও গণআন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে ও সার্বিকভাবে সমাজে পরিবর্তন আনার বিষয়টি সামনে আসে, যা যেকোনো রাজনৈতিক দলের চিন্তাধারার চেয়ে সুদূরপ্রসারী ছিল।
স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আমাদের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য শুধু গৌরবান্বিত ও অনুপ্রেরণাদায়কই নয়, বরং ছাত্ররা কীভাবে গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের মতো মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি দরিদ্র ও সব ধরনের সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে, তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
সেইসময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা পালন করেছে ছাত্ররাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা বাধ্য হয়েছে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিগুলোকে গ্রহণ করতে।
বাস্তবতা হলো, এখন আর এর কিছুই নেই।
তিন বছর আগে আমরা স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করেছি। অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে অর্থনীতি ও অবকাঠামোতে। সেতু, সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও অন্যান্য জরুরি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে কোন ধরনের ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন, তা নির্ধারণের কাজটি শুরু হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ আহ্বান থেকে—'ডিজিটাল বাংলাদেশ' থেকে 'স্মার্ট বাংলাদেশে' রূপান্তর।
'স্মার্ট বাংলাদেশে' স্মার্ট শিক্ষার্থী প্রয়োজন। স্মার্ট শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক এবং স্মার্ট শিক্ষকদের প্রয়োজন স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়। যাতে তারা মুক্ত, সৃজনশীল ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশে কাজ করতে পারেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক, সমালোচক, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও নেতা তৈরি করতে পারেন। তারা পারবেন একুশ শতকের হাত ধরে আসা সব ধরনের সুযোগকে বাস্তবতায় রূপান্তর করে আমাদের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে।
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা কী আমরা কল্পনাও করতে পারি?
বেশিরভাগ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষকদের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। সেখানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেন না, বরং শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতিকরণের অবশ্যম্ভাবী ও ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে প্রকৃত শিক্ষাবিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন 'রাজনৈতিক' শিক্ষাবিদরা। চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি, লাভজনক পদায়ন, বৃত্তি, বিদেশ সফর, সরকারের সুরে সুর মেলানো 'পলিটিকালি কারেক্ট' শিক্ষাবিদদের লেখা বইয়ের প্রচারণা—সবকিছু মিলে সার্বিকভাবে আমাদের সৃজনশীলতাকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে, 'জ্ঞানের বিশ্বে' উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে যে ধরনের উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা বা স্বীকৃতি প্রয়োজন, তা খুব কম মানুষই অর্জন করতে সক্ষম হয়।
এই সার্বিক পরিস্থিতির কারণেই সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উঠছে বুয়েট নিয়ে, যেটি আমাদের একমাত্র এমন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার কথা আমরা বড় গলায় বলতে পারি। এটাই আমাদের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে ভারতের আইআইটির (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) তুলনা চলে। আমরা জানি, সারা বিশ্বে ভারতের নাম ছড়িয়ে দিতে আইআইটি কতটা অবদান রেখেছে।
বিশ্বের সব সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিনিধিরা নিয়মিত ও নির্ধারিত সময়ে নির্বাচিত হন এবং নির্ধারিত মূলনীতি ও আইন মেনে চলেন। এই প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় শিক্ষক, ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত ও কার্যকর আলোচনা করেন।
আমাদেরকেও যদি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়, তাহলে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে আবারও চিন্তা করতে হবে এবং একে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্বে সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে গেলেও আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতি তাদের মূল রাজনৈতিক দলের স্বার্থে নিবেদিত। এটাই মূল সমস্যা। এখানে এসেই আমাদের ছাত্ররাজনীতি আধুনিকায়নের চিন্তাগুলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের কাছে হেরে যায়।
আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যোগ দিতে যাচ্ছি। যার ফলে শিগগির দেশে যোগ্য মানবসম্পদের চাহিদা বড় আকারে বাড়বে। আমাদের কি সেই ধরনের জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র আছে, যেখান থেকে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম শিক্ষাবিদ তৈরি হবে?
বুয়েটকে আরও উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে, আমাদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী মানবসম্পদ সরবরাহ করার জন্য একইমানের আরও কয়েক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
এখন যে ধারার ছাত্ররাজনীতি চলছে, সেটা আমাদেরকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে না। যেহেতু বুয়েটে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালু হতে যাচ্ছে, আমরা কি ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেখানে এমন কিছুর সূত্রপাত করতে পারি, যা বিশ্বের অন্যান্য বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে চালু আছে?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত আদেশের পর কার্যত বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে আর কোনো বাধা নেই। এখন আমাদের প্রবল ও আন্তরিক আশা হলো, পূর্ণাঙ্গ রায়ে ছাত্ররাজনীতির নামে কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না—সে বিষয়ে যেন সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকে।
রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের অধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি হাইকোর্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতন এবং যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিষয়ে সাবধান করে দিতে পারে। তেমনটি হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ে পক্ষের বহুল প্রতীক্ষিত ক্যাম্পাস রাজনীতির সংস্কার শুরু হতে পারে।
এখনই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে নতুন করে চিন্তা শুরু করার, সেটি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
আরওমাহফুজ আনামের লেখা: ‘অপরাধী’ ড. ইউনূস ও কিছু তথ্য
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
| ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের সেরা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে আবারও দলীয় রাজনীতি শুরু করার। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া নোটিশের ওপর 'স্থগিতাদেশ' দিয়েছেন হাইকোর্ট। অপরদিকে, বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালুর বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন—যার পেছনে রয়েছে বলিষ্ঠ, বেদনাদায়ক ও যৌক্তিক কারণ। |
১৪ জন মানুষকে হত্যার শাস্তি ৫ বছরের জেল! | মহাসড়ক মানেই এখন হত্যার মহাযজ্ঞ। গত ১৬ এপ্রিল ফরিদপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হওয়ার রেশ না কাটতেই এর ঠিক পরদিন ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্তে গাবখান চ্যানেলের ওপর নির্মিত পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর টোল প্লাজায় বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেছে প্রাইভেট কার ও অটোরিকশার অন্তত ১৪ যাত্রীর। আরও অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন—ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
সড়কে বড় কোনো প্রাণহানির পরে যে বিষয়গুলো জানা যায় তার মধ্যে আছে, বাসের ফিটনেস ছিল না, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না, চালকের হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্স থাকলেও ট্রাক বা বাসের মতো ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স ছিল না, যিনি ট্রাক বা বাসটি চালাচ্ছিলেন তিনি চালকের বদলে চালাচ্ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঝালকাঠিতে প্রাণহানির জন্য দায়ী বাসচালককে আটকের পরেও জানা গেছে, আল আমিন নামে যিনি ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন, তিনি ওই ট্রাকের মূল চালক নন। বদলি হিসেবে ট্রাক চালাচ্ছিলেন এবং তার ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই।
পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে আল আমিন জানিয়েছেন, খুলনা থেকে ট্রাকে সিমেন্টের বস্তা উঠিয়ে তিনি নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন এবং এই গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা তার ছিল না। তার হালকা যান চালানোর লাইসেন্স ছিল। ঘটনার সময় ব্রেকফেল হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি দাবি করেন।
প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে যেসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়, বস্তুত এর অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড। আরেকটু খোলাসা করে বললে 'সিস্টেম্যাটিক হত্যাকাণ্ড'। কেননা, দুর্ঘটনা বললে সেখানে কাউকে দায়ী করা যায় না। এটা অনেকটা নিয়তিনির্ভর।
ধরা যাক, আপনি নিয়ম-কানুন মেনে রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন। সড়কটিও ত্রুটিমুক্ত। আপনার গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে, নিবন্ধন আছে এবং গাড়ি চালানোর জন্য আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো, কিংবা কুয়াশায় পথঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না বলে আপনার গাড়িটা রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেলো। এটি দুর্ঘটনা। অথবা আপনার দ্রুতগতির গাড়ির সামনে দিয়ে হঠাৎ একটি কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী দৌড় দিলো এবং আপনি তাকে বাঁচাতে গিয়ে অথবা নিজেকে সুরক্ষিত করতে গিয়ে রাস্তার পাশের খাদে নামিয়ে দিতে বাধ্য হলেন কিংবা গাড়ির ব্রেক ফেল করলো। এটিও দুর্ঘটনা।
কিন্তু আপনি নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ির ফিটনেস আছে, আবহাওয়া ভালো, সড়কেও ত্রুটি নেই। বিপরীত দিক থেকে অথবা পেছন থেকে আরেকটা গাড়ি এসে আপনাকে সজোরে ধাক্কা দিলো। যে গাড়িটি আপনাকে ধাক্কা দিলো, সেই গাড়ির চালকের বেপরোয়া আচরণে আপনার জীবন বিপন্ন হলো। পরে জানা গেলো, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গাড়ির চালকের লাইসেন্সও ছিল না। তিনি গাড়ি চালানোয় দক্ষ নন। হতে পারে যে তিনি মদ্যপও ছিলেন। তাহলে এটি কি দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড? এই ঘটনার জন্য ওই চালকের কী শাস্তি হওয়া উচিত?
সুতরাং, কোনটি দুর্ঘটনা আর কোনটি হত্যাকাণ্ড, সেটি আগে পরিষ্কার হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের বিদ্যমান আইনে সেটি পরিষ্কার করা হয়নি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের ফলে একটি আইন হলো। কিন্তু তার নাম দেওয়া হলো 'সড়ক পরিবহন আইন'। সেখানে 'নিরাপত্তা' কথাটিই নেই। অথচ নাগরিক সমাজের দাবি ছিল, আইনটির নাম হবে 'সড়ক নিরাপত্তা আইন।'
পরিবহন মাফিয়াদের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। উপরন্তু চালকের খামখেয়ালি ও বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা এবং অনুমোদনহীনভাবে গাড়ি চালানোর জন্য কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে সেটিকে হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করে যাতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়—সেই দাবিটিও আমলে নেওয়া হয়নি।
বরং সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হইলে বা তাহার প্রাণহানি ঘটিলে, উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ০৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।'
তার মানে ঝালকাঠিতে ট্রাকচালকের বেপরোয়া আচরণে যে ১৪ জন মানুষের প্রাণ গেলো, সেই ঘটনায় ওই চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে পাঁচ বছরের জেল! তাও যদি সঠিক বিচার হয়। অথচ এই ট্রাকচালকই যদি ছুরি দিয়ে একজন মানুষকেও খুন করতেন এবং আদালতে যদি তার অপরাধ প্রমাণিত হতো, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হতো। কিন্তু শুধুমাত্র আইনি দুর্বলতার কারণে তিনি ১৪-১৫ জন মানুষকে হত্যা করেও পাঁচ বছরের বেশি জেল খাটবেন না।
সড়ক মহাসড়কে কেন প্রাণহানি থামছে না—তার অনেকগুলো কারণ আছে। কিছু দুর্ঘটনা সত্যিই দুর্ঘটনা। অর্থাৎ যে ঘটনার জন্য চালক দায়ী নন। কিন্তু অধিকাংশ প্রাণহানির পেছনেই থাকে চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা।
কাদের হাতে আমরা গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দিচ্ছি? তার ভেতরে জীবনকে ভালোবাসার অনুভূতি আর মানবিকতাবোধ কতখানি আছে? চলন্ত পথে যার হাতে আমাদের জীবন; গণপরিবহনের যে চালকেরা আমাদের নিয়ে যান মাইলের পর মাইল; গভীর রাতে ফাঁকা মহাসড়কের যে চালক অর্ধশত মানুষকে বহন করে নিয়ে যান, তার দায়িত্ববোধ, মানবিকতাবোধ কতটুকু আছে, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ কতটুকু আছে, সেই হিসাব আমরা কখনও করেছি কি না? এতগুলো মানুষের জীবন যার হাতে, সেই মানুষটিকে জীবন ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে কখনও জ্ঞান দেওয়া হয়েছে কি না? সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এই চালকদের জীবনের মূল্য ও মানবিক মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন করেছে কি না? বিআরটিএর লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় কি তার মানসিকতা, জীবনবোধ ও অন্যের জীবনের প্রতি দায় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়? পরীক্ষা নেওয়া হয়?
বিশেষ করে বাস ও ট্রাকচালকদের অধিকাংশেরই যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কম এবং তাদের বিরাট অংশই যেহেতু আসেন সমাজের প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত পরিবার থেকে, ফলে তাদের বেড়ে ওঠার মধ্যেই যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তার পক্ষে নিয়ম-কানুন মেনে এবং মানুষের জীবনকে মূল্য দিয়ে গাড়ি চালানো আদৌ সম্ভব কি না?
পরিবহন খাতের বিদ্যমান 'যত ট্রিপ তত পয়সা' পদ্ধতির কারণে চালকদের মধ্যে যে বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা গড়ে ওঠে—সেটিও সড়ক অনিরাপদ করে তোলার একটি বড় কারণ। অথচ সড়ক পরিবহন আইনে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বিধান নেই। যতটুকু আছে, তাও মানা হয় না। বরং অপরাধ প্রমাণিত হলেও বড় কোনো শাস্তি হবে না—এই আত্মবিশ্বাসও সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
তার সঙ্গে আছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ঐক্য—যে ঐক্যের কারণে সরকার যখনই সড়ক নিরাপত্তায় কোনো কঠোর আইন বা নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়, সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি আসে।
আবার সরকার চাইলেও এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ প্রতিটি সরকারই বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচাল করার জন্য এই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরকেই কাজে লাগায়। যার কাছ থেকে আপনি অন্যায্য সুবিধা নেবেন, তার অনেক অন্যায়ও আপনাকে হজম করতে হবে।
দেশের পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা না ফেরার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সব আমলে সব সরকারই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত এই খাত থেকে যে বিপুল পরিমাণ চাঁদা তোলা হয়, তার ভাগ রাষ্ট্রের কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়, সেটি অনেকেই জানেন।
তার মানে সরকার-সরকারি দল-পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা যখন অভিন্ন স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত—সেখানে সাধারণ মানুষের জীবন সুরক্ষিত থাকবে সেটি খুব কঠিন। তাছাড়া পরিবহন মাফিয়াদের কারণে যে দেশে একটি কঠোর আইন পর্যন্ত করা যায় না—সেই দেশের সড়কে মানুষের জীবন নিরাপদ হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
| মহাসড়ক মানেই এখন হত্যার মহাযজ্ঞ। গত ১৬ এপ্রিল ফরিদপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হওয়ার রেশ না কাটতেই এর ঠিক পরদিন ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্তে গাবখান চ্যানেলের ওপর নির্মিত পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর টোল প্লাজায় বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেছে প্রাইভেট কার ও অটোরিকশার অন্তত ১৪ যাত্রীর। আরও অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন—ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। |
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস কেন ‘খ’ শ্রেণিতে | আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। এ দিনটিতে দেশের একটি উপজেলায় ছুটি থাকে। এবারও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৭ এপ্রিল শুধু মুজিবনগরে ছুটি ঘোষণা করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুজিবনগর দিবসের গুরুত্বের সীমানা কি শুধু একটি উপজেলায় আবদ্ধ? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ঘোষিত জাতীয় দিবসগুলোর তালিকাতেও দিনটিকে অবহেলা করা হয়েছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। মুজিবনগর দিবসের স্থান জাতীয় দিবসগুলোর 'ক' শ্রেণির মর্যাদায় হয়নি, হয়েছে 'খ' শ্রেণিতে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির নেপথ্যে যে কয়টি গর্বের দিবস আছে তার মধ্যে ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস অন্যতম। এই দিনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে শপথ নিয়েছিল। এ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বহুমুখী সমন্বয়ের সফল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও তিনিই ছিলেন সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি, অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জায়গাটির নামকরণ করেছিলেন মুজিবনগর, এটি বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী।
দিবস মানেই ছুটি দিতে হবে, এমন ধারণা হয়ত সঠিক নয়। কারণ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর আগের ২৩ বছর পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন জমা হয়েছে। এসব দিনে যদি সবাই ছুটির চিন্তা করেন সেটা যৌক্তিক হবে না। দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার উদ্যোগ নিলে ছুটির প্রয়োজনও হয় না। তবে ১৭ এপ্রিলের মতো ঐতিহাসিক দিনকে কেন্দ্র করে ছুটির কথা চিন্তা করলে সেটা জাতীয়ভাবে হওয়ার দাবি রাখে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দিবসটি জাতীয়ভাবে পালনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তবে শুধু মুজিবনগরের জন্য ছুটি ঘোষণার উদ্যোগ কি দিবসটির গুরুত্ব বিবেচনায় যথাযথ সম্মান দেখানো হয়?
যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে মুজিবনগর ইতিহাসের অংশ হয়েছে, সেই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। তারপরও মুজিবনগর দিবসের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন?
১৭ এপ্রিল যারা সরকার গঠন করেছিলেন তাদেরকে সুরক্ষিত জেলখানায় হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। নৃশংস ঐতিহাসিক জেলহত্যার দিনটি বাংলাদেশের জাতীয় দিবসে এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ক, খ, গ, এই ক্যাটাগরিতে যেসব দিবসকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেখানে অনেক ব্যক্তির নাম থাকলেও নাম নেই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামদের।
১৭ এপ্রিল, ৩ নভেম্বরের মতো দিবসগুলোকে যথাযথ সম্মানের দাবিতে গত কয়েক বছর যাবত মানববন্ধন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ।
মুজিবনগর তথা প্রথম সরকারের প্রতি অবহেলার আরও কিছু চিত্র দেখা যায়। উপজেলাটির ওয়েবসাইটে যা রয়েছে তা রীতিমতো ভিমরি খাওয়ার মতো। 'মুজিবনগর উপজেলার মৌলিক তথ্য' অংশে বলা হয়েছে উপজেলাটির 'নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা নেই'। কী বিষ্ময়কর কথা! উপজেলার নামকরণ জাতির পিতার নামে, তা 'জানা নেই'। নামকরণ কীভাবে হয়েছে সেটা জেলা, উপজেলা প্রশাসন জানে না? ওয়েবসাইট যারা তদারকি করেন তারা জানেন না?
সেই ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে 'অস্থায়ী সরকার' উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক ইতিহাস 'প্রথম সরকার'।
রাজনীতিতে বিরোধীদের দিকে ইতিহাস বিকৃতির আঙ্গুল সহজেই তোলা যায়। কিন্তু সরকারি দলিলে তথ্য বিকৃতি থাকলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর এই দায় কে বহন করবে?
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার শত্রুমুক্ত করার জন্য। আর তাদের সেই উজ্জ্বলতম ঐতিহাসিক ক্ষণটিকে মুজিবনগরের ১১২ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটারের ছুটিতে আবদ্ধ রাখা কতটা সঠিক?
লেখক: সংবাদকর্মী
| আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। এ দিনটিতে দেশের একটি উপজেলায় ছুটি থাকে। এবারও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৭ এপ্রিল শুধু মুজিবনগরে ছুটি ঘোষণা করেছে। |
‘দিদি’ না ‘মোদি’ | ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে আগামী ১৯ এপ্রিল। ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেখানে রাজ্যস্তরে বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসরকার তৈরি হয়। আর লোকসভা বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হয় কেন্দ্রীয় সরকার।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা জাতীয় দলের সরকার থাকলেও কেন্দ্রে আছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দুত্ববাদী সরকার। যার নেতৃত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
৫৪৩ আসনের লোকসভা নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য দরকার হয় ২৭২টি আসন। সাত ধাপে ৪৪ দিন ধরে চলবে এই নির্বাচন। ১৯ এপ্রিল ভোট শুরু হয়ে শেষ হবে ১ জুন। ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা হবে ৪ জুন।
প্রথম ধাপে ১৯ এপ্রিল ভোট হবে ১০২ আসনে, দ্বিতীয় ধাপে ২৬ এপ্রিল ৮৯ আসনে, তৃতীয় ধাপে ৭ মে ৯৪ আসনে, চতুর্থ ধাপে ১৩ মে ৯৬ আসনে, পঞ্চম ধাপে ২০ মে ৪৯ আসনে, ষষ্ঠ ধাপে ২৫ মে ৫৭ আসনে এবং শেষ ধাপে ১ জুন ৫৬ আসনে।
১৮তম লোকসভা নির্বাচনে ভারতের কেন্দ্র সরকার গঠনের জন্য ভোট দেবেন প্রায় ৯৭ কোটি ভারতীয়। সেই অর্থে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম জাতীয় নির্বাচন।
লোকসভা নির্বাচনে আজকের আলোচ্য বিষয় পশ্চিমবঙ্গ। বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যার পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৪২টি লোকসভা আসন। উত্তর প্রদেশের ৮০টি ও মহারাষ্ট্রের ৪৮টি আসনের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম সংসদীয় আসনের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ।
এই রাজ্যের বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ২০১৩ সাল থেকে টানা তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় রাজনীতিতে উল্কাসম, আন্দোলনের মাঠ গরম করতে কীর্তিমান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে লড়াই করছে বিজেপি। বিধানসভার ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র দাপট থাকলেও লোকসভায় গত নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে বিজেপি ১৮টি আসন পেয়ে সবাইকে চমকে দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ইতিহাস: ঘরকা না ঘাটকা
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পায় ৩৪টি আসন, ভোট পায় ৩৪ শতাংশ। ২০১৯ সালে পরের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পায় ২২টি আসন, ভোট পায় ৪৩ শতাংশ।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পায় দুটি আসন, ভোট পায় ১৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পায় ১৮টি আসন, ভোট পায় ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৩৪টি আসন পেলেও ২০১৯ সালে তার আসন সংখ্যা কমে হয় ২২টি। বিজেপি ১৮টি আসন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে তার জাগরণ জানান দেয়।
কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস একাধিপত্য বজায় রাখে।
বিধানসভা নির্বাচনে ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ২১১টি আসন ও ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট এবং ২০২১ সালে ২১৩টি আসন ও ৪৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পায়।
বিধানসভা নির্বাচনে ২০১৬ সালে বিজেপি তিনটি আসন ও ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট এবং ২০২১ সালে ৭৭টি আসন ও ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট পায়।
ভোটের এই হিসাবে দেখা যায়, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ও আসন সংখ্যা বাড়লেও তা রাজ্যে তৃণমূলের একাধিপত্যকে খর্ব করতে পারেনি। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ও আসন সংখ্যা তৃণমূলকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে বাম ও কংগ্রেস ভোটব্যাংক খুইয়ে ফেলেছে। তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনে তারা পশ্চিমবঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপি ও তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে জোরেসোরেই। তরুণদের একাংশকে তারা রাজনীতিতে উৎসাহী করে তুললেও তাদের সম্মিলিত ভোট লোকসভায় নিজেদের আসন লাভ নিশ্চিত করবে, নাকি বিজেপি কিংবা তৃণমূলকে লাভবান করবে, সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়েই রয়েছে।
'মোদি' ব্র্যান্ড বনাম 'দিদি' ব্র্যান্ড
পশ্চিমবঙ্গে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দৃশ্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ৩৫টির বেশি আসন নেবে বলে নির্বাচনী প্রচারণা জোরদার করেছে। বিজেপির প্রধানতম শক্তি হচ্ছে, কেন্দ্রে তাদের সরকার রয়েছে। ফলে সরকারের সব এজেন্সিকে তারা নির্বাচনে ব্যবহার করার সুযোগ গ্রহণ করেছে।
সরকারের দুর্নীতি বিরোধী সব তদন্ত সংস্থা (ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগ ইত্যাদি) পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মন্ত্রী, নেতাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতা দুর্নীতির অভিযোগে কারা অন্তরীণও রয়েছেন।
বিজেপি আর্থিকভাবেও শক্তিশালী। তারা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিপুল অর্থকে এই নির্বাচনে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সর্বভারতীয় দল হিসেবে বিজেপির সাংগঠনিক ক্ষমতা যথেষ্ট সংহত, সেই সুযোগকে তারা পশ্চিমবঙ্গেও ব্যবহার করছে।
ভারতের অন্যত্র কংগ্রেস, বামপন্থী, তৃণমূলসহ আঞ্চলিক দলগুলোর সমবায়ে গঠিত 'ইন্ডিয়া জোট' বিজেপির মোকাবিলা করলেও পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। এখানে সম্মিলিত বিরোধীদের 'ইন্ডিয়া জোট' ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে লড়তে ব্যর্থ হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের সঙ্গে ঐক্য করতে রাজি হননি। এখানে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট যৌথভাবে নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে।
বিজেপি দলীয় কর্মসূচিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা রামরাজ্যের রাজনৈতিক তরজাকে কাজে লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদিকেই নির্বাচনের মুখ করেছে। 'প্রার্থী নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেই ভোট দিন'—এটাই বিজেপির মুখ্য প্রচারণা। মোদিই স্থিতিশীল হিন্দু ভারতের প্রতীক—সেটাই বিজেপি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
এর বিপরীতে তৃণমূল কংগ্রেসও বাংলার মেয়ে, মা-মাটির প্রতীক, লড়াকু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নির্বাচনে মুখ্য ফোকাস হিসেবে নিয়ে প্রচারণায় নেমেছে। বহিরাগতদের ঠেকাতে স্থানীয় দিদি মমতাই পশ্চিমবঙ্গের ভরসা, একমাত্র মমতাই পারে বিজেপিকে ঠেকাতে—এটাই তৃণমূল কংগ্রেসের মূল আপিল ভোটারদের কাছে। ফলে 'ব্র্যান্ড মোদি'র বিপরীতে 'ব্র্যান্ড দিদি'ই লড়ছে।
ধর্ম না কর্ম: যা ঘটতে পারে
১. তৃণমূলের প্রধান হাতিয়ার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। এসব জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ১০ বছর ধরে চলছে। নির্বাচনে তাদের প্রচারণা হচ্ছে, রাজনীতি হবে কর্মের ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের বাইরে তৃণমূলের বড় টার্গেট সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটব্যাংক।
২. বিজেপি কাজে লাগাতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, বিশেষত গ্রামের মানুষের। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ১৩ বছরের ক্ষমতাসীন বিরোধিতার হাওয়া কাজ করছে। বিজেপি মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করেছে।
৩. তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্যা মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। তাদের দ্বিতীয় সমস্যা দুর্নীতি। তবে সেটা যতটা শহরাঞ্চলে, ততটা গ্রামে নয়। কারণ, গ্রামের মানুষের বড় অংশই মনে করেন, তৃণমূল দুর্নীতি করলেও প্রকল্পের টাকা মানুষের হাতে পৌঁছায়।
৪. অন্যবারের মতো এবারও সব হিন্দুভোট নিজেদের দিকে টানতে বিজেপি ভরসা রাখছে ধর্মের ওপরে। গত ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর দেশজুড়ে একটা সার্বিক ধর্মীয় আবহাওয়া তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছে বিজেপি। লাখো মানুষকে অযোধ্যায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তা দেখাতে। যাতে তারা ফিরে সমাজকে জানাতে পারেন অযোধ্যায় দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, বাংলায়ও এই পরিবর্তন আনতে হবে। এই সাম্প্রদায়িক হাওয়াকে নির্বাচনের আগে বহু গুণে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)।
৫. পাড়া, গ্রাম, পঞ্চায়েত বা ব্লক পর্যায়ের স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভসহ নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তৃণমূলের জন্য যেমন সংকট তৈরি করতে পারে, আবার বুথ পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতাও জনরায়কে গুছিয়ে এনে নিজেদের ভোটবাক্সে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, রাষ্ট্র ও রাজ্য পর্যায়ে বিজেপির হৈ চৈ সবল থাকলেও নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিটিয়ে বুথ পর্যায়ে যোগ্য কর্মী সংগ্রহ করে জনরায় নিজেদের পক্ষে আনার সাংগঠনিক ক্ষমতা কতটা দেখাতে পারবে, সেটাও বিবেচ্য।
৬. বরাবরই লোকসভায় কেন্দ্রীয় দলের কিছু বিশেষ সুবিধা থাকে। বিজেপি ২০১৪ সালের পরে এ সুবিধা পাচ্ছে। এ কারণে লোকসভায় বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ভোটের ফারাক কমছে। বিজেপির লোকসভা নির্বাচনে ভোট বৃদ্ধির স্বাভাবিক কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্যই ভোট বাড়ছে লোকসভায়। একে অভিহিত করা হচ্ছে 'নরেন্দ্র মোদি ফ্যাক্টর' নামে।
৭. কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট একত্রে লড়ছে পশ্চিমবঙ্গে। ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেস এখানে কতটা শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে, সেটা দেখার বিষয়। তবে বামফ্রন্ট তরুণদের সংগঠিত করে একঝাঁক লড়াকু তরুণকে প্রার্থী করেছে। নানা উপনির্বাচনের ফল ও স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল বলে, বামপন্থীরা ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছে মরিয়া হয়েই।
সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোটপ্রত্যাশী বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস। এই ভোট ভাগাভাগি কোন আসনে কাকে লাভবান করবে, সেটা একটা জটিল হিসাব। তবে, মুসলমান ভোট কাটাকাটির সম্ভাবনা সবসময় বিজেপিকেই লাভবান করতে পারে।
ফলাফল: কী হবে…
যেকোনো নির্বাচনের আগে এটাই বড় প্রশ্ন। ফলাফল কী হবে? পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে কে জিতবে? দিদির তৃণমূল না মোদির বিজেপি?
যদিও পুরো ভারতবর্ষের নির্বাচনের নিরিখেই কেন্দ্রে গঠিত হবে সরকার, তবে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের লোকসভা নির্বাচনের গুরুত্বও অসীম। কেননা ৬০ বছরের কংগ্রেস শাসনের তথাকথিত প্রগতিশীল ভারতের রাজনীতি এখন হিন্দুত্ববাদের নতুন ন্যারেটিভের কাছে পরাভূত। হিন্দুরাষ্ট্র না উদার ভারত—সেটাই এই নির্বাচনের বড় এজেন্ডা।
বলা যায়, ভারতে বিজেপি এখন পিকফর্মে রয়েছে। অর্থ-সংগঠন-নেতৃত্ব-রাজনীতি সবক্ষেত্রেই গোটা ভারতে বিজেপিকে রুখবার ক্ষমতা এককভাবে অন্যকোনো রাজনৈতিক দলের নেই। বিজেপিবিরোধী জোটবদ্ধতার আক্রমণকেও বিজেপি নানাভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।
আঞ্চলিক স্বার্থ, অর্থ, পদলাভ ইত্যাদি বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে ভারতব্যাপী বিজেপির জয়লাভ ঠেকানো সহজ নয়। তবুও, বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি একক ভূমিকা নিয়েছেন।
কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন আর লোকসভা নির্বাচনে ভোটের মনস্তত্ব এক নয়। কেন্দ্রে স্থিতিশীল সরকার দেখতে চাইলে বিজেপির বিকল্প মুখ কার্যত অনুপস্থিত। উন্নয়ন-ধর্ম-ভারতইমেজ বিবেচনায় ভোটারদের কাছে আপাতত বিজেপির বিকল্প পাওয়া বেশ কঠিন হলেও পশ্চিমবঙ্গে মমতা শক্তিমান ভরসার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন।
তবে—
১. পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রশাসনকে যদি বিজেপি কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিংবা নিরপেক্ষ রাখতে পারে, বুথে যদি তাদের কর্মীরা শক্তভাবে টিকতে পারে, তাহলে এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ভিন্নরকম হতে পারে।
২. ১০টির বেশি আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। সেখানে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের জোট কতটা ভোট কাটতে পারবে সেটাই ভোটের ফলাফলে ভূমিকা রাখবে। এর লাভ যেতে পারে বিজেপির কাছে।
৩. পশ্চিমবঙ্গে পুরো সাত ধাপেই ভোট হবে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ও রাজ্যপ্রশাসন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। যদি তৃণমূলের মাঠপর্যায়ের বিস্তৃত শক্তিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বিজেপি, সেটা তাদের পক্ষে যাবে।
৪. 'জিতে যাচ্ছে' এই হাইপ তোলার চেষ্টা করছে বিজেপি—নানারকম এক্সিট পোলের ফল ও নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া দিয়ে। সেই হাইপ ঠিকমতো প্রভাব ফেললে, সংখ্যালঘু মুসলমান ভোট একাট্টা হতে পারে। এই 'বিজেপিফোবিয়া' কাজ করলে মুসলমান ভোটের এই মনোভাব তৃণমূলের দিকেও যেতে পারে।
এসব নানাবিধ 'যদি', 'কিন্তু' বিবেচনায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের এবারের লোকসভা নির্বাচনে ৪২টি আসনের অর্ধেক ২০-২১টি বিজেপির ভাগ্যে জুটতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেস আগের বারের ২২টি আসন থেকে দু-একটি হারিয়ে ২০-২১টি আসন পেতে পারে। কংগ্রেস-বামফ্রন্ট দু-একটি আসন পেতে পারে।
এ বিবেচনায় বলা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে 'দিদি' পুরো পর্যুদস্ত না হলেও ভারতবর্ষে 'মোদি' আবার নতুন শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে পারেন।
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
| ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে যাবে আগামী ১৯ এপ্রিল। ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেখানে রাজ্যস্তরে বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসরকার তৈরি হয়। আর লোকসভা বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হয় কেন্দ্রীয় সরকার। |
মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয় | প্রতি বছর জাতীয় জীবনে 'মুজিবনগর দিবস' ফিরে আসে এবং এ বছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের ৫৩তম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে কত কথা আমার মানসপটে ভাসছে। পঁচিশে মার্চ দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, 'ভালো থেকো। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।'
পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা ছিলাম মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে। রাত ১২টায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত 'অপারেশন সার্চলাইট' নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচন্ড গোলাগুলি। এক রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
ছাব্বিশে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে 'বিশ্বাসঘাতক' আখ্যায়িত করে বলেন, 'শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরও আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি।' 'দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিসড।'
তারপর কারফিউ জারি হয় এবং ছাব্বিশে মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত 'স্বাধীনতার ঘোষণা'র কথা বারবার প্রচার করে বলছেন,"বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'স্বাধীনতার ঘোষণা' প্রদান করে বলেছেন, 'এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে'।"
এরপর দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানিগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব; মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি সহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী সাহেব এবং কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব।
আমাদের এই যাত্রাপথ আগেই ঠিক করা ছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে নির্বাচিত এমসিএ (member of constituent assembly) ডাক্তার আবু হেনাকে বঙ্গবন্ধু যে পথে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন, সেই পথেই আবু হেনা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টাল-বাহানা শুরু করে তখন '৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, 'সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।'
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'এখানে তোমরা থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।' ২৯ মার্চ কেরানিগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ এপ্রিল আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন-পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী-জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে 'বাংলাদেশ গণপরিষদ' গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে 'মুজিবনগর' নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' তথা 'Proclamation of Independence'। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও যা ঘোষিত হয় তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে 'সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।'
রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় 'ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা', 'একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করিলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের' ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়।
এছাড়াও যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, 'কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।' 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' মোতাবেক জাতীয় নেতা উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী. জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়।
'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র'-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা 'বাংলাদেশ গণপরিষদ' সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, 'আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ছাব্বিশে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।' অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেই দিন থেকে কার্যকর হবে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ১০ এপ্রিল ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে। সেসময় তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন সেখানে পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম।
বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন, এককাতারে দণ্ডায়মান। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, একটা গাড়িতে করে রাত তিনটায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওয়ানা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিকছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু 'জয় বাংলা' রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত।
আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন।দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা আমাদের সাথে সমস্বরে গগনবিদারী কণ্ঠে মুহুর্মুহু 'জয়বাংলা' রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহন করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে 'গার্ড অব অনার' প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী।
উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র 'জয়বাংলা' পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ'র উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল 'স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র' পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে মুক্তির বাণীসমূহ পাঠ করা হয়।
আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। উপস্থিত সকলেই তাদের সাথে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, 'ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তাঁর পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।' এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, 'আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।'
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, 'পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।'
মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, 'আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড়ো জাতির বন্ধুত্ব।' 'বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয়বাংলা।' ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তাঁরা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত এমসিএ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকগণ, পাবনার জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে, সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত 'স্বাধীনতার ঘোষণা'। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা '৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত করে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন নিয়ে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, 'বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।' মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, 'জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।' আমরা বলতাম, 'আমরা দু'টোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।' ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু' লক্ষ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।
প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এই মহান দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের অমর স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জাতীয় চার নেতা জীবনে-মরণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু বেঈমানী করেননি। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে আত্মদান করেছেন সেই আত্মদানের ফসল আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয় নেতৃবৃন্দের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সর্বত্র স্মরণ করা উচিত। জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।
| প্রতি বছর জাতীয় জীবনে 'মুজিবনগর দিবস' ফিরে আসে এবং এ বছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের ৫৩তম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল। |
হাওরে আলপনার পক্ষ-বিপক্ষ | কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় হাওরের বুক চিরে নির্মিত বহুল আলোচিত ও সমালোচিত অলওয়েদার সড়কের মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়কে দৃষ্টিনন্দন আলপনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
বাংলা বর্ষবরণের অংশ হিসেবে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম এই আলপনা আঁকা হয়েছে। বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড এই উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে আলপনাটি আঁকা হলেও এই কার্যক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনও যুক্ত৷
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে আলপনাটি জায়গা করে দেওয়ার জন্য আবেদন করা হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, হাওরের বুক চিরে রাস্তাটি নির্মাণের শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করেছিলেন৷ তাদের যুক্তি ছিল, এই ধরনের সড়ক হাওরের প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এটি এখন ওপেন সিক্রেট যে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত 'স্বপ্ন' বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার এই সড়কটি নির্মাণ করে এবং এর বিরুদ্ধে যাতে কোনো শক্ত আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হয়।
আশার কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা এই সড়কের কুফল বুঝতে পারছেন এবং ভবিষ্যতে হাওরের বুকে এরকম সড়ক নির্মাণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বহুল আলোচিত এই সড়কটি নতুন করে আলোচনায় এলো বর্ষবরণের আলপনা ইস্যুতে।
প্রশ্ন হলো, হাওরের বুক চিরে গড়ে তোলা একটি পরিবেশবৈরি সড়কে কেন দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকতে হলো? এর উদ্দেশ্য কি মানুষের মনকে নববর্ষের রঙে রাঙিয়ে তোলা, নাকি আয়োজকদের ব্র্যান্ডিং—সেটি বোঝার জন্য বড় কোনো জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই আলপনা আঁকতে কত গ্যালন রঙ ব্যবহার করা হলো? কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষমাত্রই জানেন এই রঙের চূড়ান্ত গন্তব্য হচ্ছে হাওরের পানি।
গ্রীষ্মের তাপে রঙ ফিকে হয়ে আসবে। সেজন্য সময় লাগবে। কিন্তু এর মধ্যে বৃষ্টি হলেই এই রঙ ধুয়ে যাবে এবং হাওরের বিশুদ্ধ পানিতে মিশে যাবে। মাছ সেই রঙ খাবে মাছ। মাছ খাবে মানুষ। পানির সিঁড়ি বেয়ে এই রঙ মিশে যাবে আশেপাশের মাটিতে। ফলে কেমিক্যালমিশ্রিত এই রঙ ফসলি জমির কী পরিমাণ ক্ষতি করবে সেটি পরিবেশবিদরা ভালো বলতে পারবেন।
অলওয়েদার রোডের এই আলপনার ছবি দিয়ে এরইমধ্যে পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
পরিবেশ, জলবায়ু ও বায়ুমান নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, 'হাওরের রাস্তায় এই রঙের খেলায় নববর্ষ উদযাপন আসলে প্রকৃতি হত্যার উৎসব ছাড়া কিছু নয়। এই বিশাল পরিমাণ রঙে আছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল যেমন বেনজেন, টলিউন ইত্যাদি। আছে ভারী ধাতু যেমন ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি, যা দ্রুত হাওরের প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবেশবিধ্বংসী এই ধরনের কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।'
গিনেজ বুকে নাম ওঠানোর জন্য লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া নিয়ে কোনো সমালোচনা হয়নি। বরং দলমত নির্বিশেষে সবাই এর প্রশংসা করেছেন।
এমনকি প্রতি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বিশাল এলাকাজুড়ে যে আলপনা আঁকা হয়, তা নিয়েও কোনো সমালোচনা নেই। কারণ এখানে ব্যবহৃত রঙ নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে গিয়ে পড়ে না। বরং রৌদ্রের তাপ, বৃষ্টি ও যানবাহনের চাকার ঘষায় রঙ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়।
কিন্তু মানিক মিয়া এভিনিউয়ের আলপনা আর হাওরের বুক চিরে বানানো রাস্তার ১৪ কিলোমিটারজুড়ে আঁকা আলপনা এক নয়। একই জিনিস ঢাকার রাস্তায় যতটা সুন্দর, পরিবেশের জন্য স্পর্শকাতর হাওরের রাস্তায় সেটি সুন্দর নয়, বরং চরম অসুন্দর ও প্রাণ-প্রকৃতিবিরোধী চিন্তা। আমাদের মনে রাখতে হবে, সাদাচোখে যা কিছু সুন্দর, বাস্তবে তার সবকিছু সুন্দর নাও হতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে এই আলপনা নিয়ে সমালোচনার বিপরীতে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন এই বলে যে, দখল, দূষণ, কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে যেখানে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল বিপন্ন হচ্ছে, সেখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটারের আলপনায় হাওরের আর কতটুকুই বা ক্ষতি হবে?
যুক্তি হিসেবে এটি খারাপ না। কিন্তু ডাকাতি ঠেকানো যাচ্ছে না বলে চুরির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না—সেটিও কোনো কাজের কথা নয়।
তাছাড়া এরকম একটি বিতর্কিত সড়কে নববর্ষের আলপনা আঁকার মধ্য দিয়ে সড়কটিকে গ্লোরিফাই করার রাজনীতিটাও বোঝা দরকার। বাঙালির সর্বজনীন ও চিরায়ত উৎসবগুলো যাতে মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ যেকোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে না যায়, সেজন্য সতর্ক থাকা দরকার। এরইমধ্যে অনেক কিছুই আর আমাদের হাতে নেই। ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা, চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখী মেলা, হালখাতার মতো আয়োজনও কোনো না কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নামে হয়ে যাবে। আমাদের কাছ থেকে আমাদের নিজস্বতাগুলো কেড়ে নেওয়ার যেকোনো আয়োজন ও উৎসবের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
হাওরের মতো সংবেদনশীল স্থানে এরকম রঙের খেলার চিন্তাটা যার বা যাদের মাথা থেকেই আসুক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য যে নববর্ষের রঙে মানুষের মনকে রাঙানো নয়, সেটি বোঝা দরকার। সেইসঙ্গে হাওরের পানিকে কোনো ধরনের বাধা বিঘ্ন ছাড়া চলতে দেওয়া এবং সেখানে মৎস্যসম্পদ ও কৃষির সুরক্ষায় কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ না করাই যে প্রকৃত উন্নয়ন, সেই উপলব্ধিটাও জরুরি।
সুতরাং, নববর্ষের আলপনা ইস্যুতে হাওরের অলওয়েদার সড়কটি যেহেতু নতুন করে আলোচনায় এলো, অতএব এই রাস্তা হাওরের মানুষের কী কাজে লাগছে আর এই রাস্তা হওয়ার ফলে হাওরের কৃষি, মৎস্য সম্পদ আর মানুষের জীবন-জীবিকার কী উপকার হলো এবং কী ক্ষতি হলো—সেটি নিরূপণ করাও জরুরি।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
| কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় হাওরের বুক চিরে নির্মিত বহুল আলোচিত ও সমালোচিত অলওয়েদার সড়কের মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়কে দৃষ্টিনন্দন আলপনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। |
পাহাড়ে ফরেস্টার খুন এবং সুইমিং পুল ও বাস্কেট বল মাঠ | পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতির খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেও এই মুহূর্তে দেশের পাহাড়গুলো আলোচনায় আছে অন্য তিনটি ঘটনায়।
১. কক্সবাজারে পাহাড় বাঁচাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় বন কর্মকর্তা খুন
২. পাহাড় কেটে সুইমিংপুল; সাজেকের 'মেঘপল্লী' রিসোর্টকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
৩. কুমিল্লায় পাহাড় কেটে নির্মিত হচ্ছে বাস্কেটবল মাঠ
প্রথম খবরে নজর দেওয়া যাক।
কক্সবাজারের উখিয়ায় রাতের আঁধারে কোথাও না কোথাও অবৈধভাবে পাহাড় কাটা চলে। এই অপতৎপরতা ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান চালায় বন বিভাগ। সেই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ মার্চ রোববার সেহেরির সময় ডাম্পারযোগে পাহাড়ের মাটি পাচার করার খবরে সেখানে অভিযানে যান উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান সজল।
মোটরসাইকেল চালিয়ে তিনি এবং তার সহকর্মী মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলে গিয়ে ডাম্পারটি থামানোর সংকেত দিলে মাটিভর্তি ডাম্পার গাড়িটি তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সজলের। আহত হন সঙ্গে থাকা মোহাম্মদ আলী।
শোনা যায়, পাহাড়ে ডাম্পার চালকদের বেশির ভাগ অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। প্রতিদিন তাদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত দুই বছরে অন্তত ১০ জন খুন হয়েছেন ডাম্পারের ধাক্কায়।
প্রশ্ন হলো, যারা পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তাদের নিরাপত্তা কতটুকু? নিরাপত্তারক্ষীদের জীবন যখন অনিরাপদ, তখন তারা কী করে দুর্বৃত্তদের হাত দেশের পাহাড় ও বনজ সম্পদ বাঁচাবেন?
বন ও পাহাড় সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের সুরক্ষা সামগ্রী পর্যাপ্ত কি না; সেই প্রশ্নটি বেশ পুরোনো। তাছাড়া দিনের পর দিন সুন্দরবন ও পাহাড়ের বিচ্ছিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধাই বা কতটুকু—সেই প্রশ্নও আছে।
যদিও বন ও পাহাড় সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত অনেকের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেচে দেওয়া বা দুর্বৃত্তদের সহযোগিতার অভিযোগ আছে।
যেমন: এক-এগারোর সরকারের সময়ে বনখেকো ওসমান গনি একটি আলোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তার বাসার বালিশের ভেতর থেকে বিপুল টাকা উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু বন বিভাগের সকলেই ওসমান গনি নন।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, নিহত বন কর্মকর্তা সজল কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বরং পাহাড় থেকে মাটি ও গাছ কেটে নেওয়া ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতেন বলে তিনি স্থানীয় দস্যুদের রোষানলে ছিলেন—এমনটিও শোনা যাচ্ছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
বাস্তবতা হলো, যে দেশে শত কোটি বা হাজার কোটির নিচে এখন কোনো রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্প হয় না, সেখানে দেশের সম্পদ বাঁচানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের 'নিধিরাম সর্দার' বানিয়ে রাখলে পাহাড়-বন-নদী সবই বেহাত হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় খবরের ঘটনাস্থল দেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেক।
রাঙামাটির পর্যটন উপত্যকা সাজেকে পাহাড় কেটে সুইমিং পুল তৈরি হচ্ছে—এমন একটি ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পাহাড় কেটে সুইমিংপুল নির্মাণের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট হয়।
এরপর সম্প্রতি 'মেঘপল্লী' রিসোর্টে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন। তারা ওই সুইমিং পুল তৈরির কাজ বন্ধ করে দেয় এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা করে।
প্রশ্ন হলো, পাহাড় কেটে সুইমিং পুল বানাতে হবে কেন? সাজেকে যারা ঘুরতে যান, তারা কি পাহাড় দেখতে যান নাকি সাঁতার কাটতে? সাজেক ভ্রমণকারীদের প্রধান আকর্ষণ বর্ষায় মেঘ ও পাহাড়ের মিতালি। সেখানে সুইমিং পুলের উপযোগিতা কতটুকু?
'মেঘপল্লী' নামে ওই রিসোর্ট মূলত পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা এবং আরও বেশি টাকায় এর রুম ভাড়া দেওয়া জন্যই যে এখানে সুইমিং পুল বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সৌন্দর্যবর্ধন এবং ব্যবসা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা যে ফৌজদারি অপরাধ—সেই বোধটুকু হয়তো কর্তৃপক্ষের মনে ছিল না।
তবে প্রশাসন যে কাজ বন্ধ করে দিয়ে জরিমানাও করেছে, এটি একটি ভালো উদাহরণ তৈরি হলো এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতে সাজেকে আর কেউ এই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সাহস পাবেন না।
তৃতীয় খবরটির কুমিল্লার।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে আবারও পাহাড় কাটা হচ্ছে। আর এই পাহাড় কাটা হচ্ছে বাস্কেটবল খেলার মাঠ বানানোর জন্য। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটিকে 'পাহাড় কাটা' বলতে নারাজ। তারা এটিকে বলছেন 'পাহাড় ড্রেসিং'।
দেশের মানুষের কাছে 'পাহাড় ড্রেসিং' শব্দটা খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে এটা যতটা না অদ্ভুত তার চেয়ে বেশি উদ্ভট। কারণ, পাহাড় ড্রেসিং করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কেউ দেয়নি বা এই ধরনের অনুমতি দেওয়ার সুযোগও নেই।
পাহাড় একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। সে তার মতো থাকবে। এখানে ড্রেসিংয়ের নামে তার মাটি কেটে ফেলা কিংবা পাহাড়ের বড় গাছ কেটে ফুলের গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনও পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
'পাহাড় ড্রেসিং' শব্দটির সঙ্গে 'নদী শাসনের' মিল আছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো শাসন, খনন, সংস্কার ও উন্নয়নের নামে কী দশা করা হয়েছে, তার অনেক ভয়াবহ উদাহরণ এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মগজে শাসন ব্যাপারটি এতই শক্তভাবে প্রোথিত যে, তারা মানুষ তো বটেই, নদীকেও শাসন করতে চান। অথচ শব্দটি হওয়ার কথা ছিল নদী ব্যবস্থাপনা। নদীকে শাসন করার আপনি কে? আপনি কি নদীর অভিভাবক? নদী তার আপনবেগে চলবে। মানুষের সুবিধা অনুযায়ী বড়জোর সেটিকে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনবে। কিন্তু যখনই বলা হয় নদী শাসন, তখনই বোঝা যায়, কর্তৃপক্ষ নদীর গতিপথ ও চরিত্র বদলে তার সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করতে চায়। কেননা তার মাথার ভেতরে প্রকল্প। 'পাহাড় ড্রেজিং' শব্দটির সম্ভবত একটি আমলাতান্ত্রিক পরিভাষা।
প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য পরিবেশের জন্য সংবেদনশীল স্থান কেনে বেছে নিতে হবে? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট আয়তনের দেশে প্রতিটি বিভাগে একাধিক এবং পারলে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে কেন?
একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের মানেই হলো বিপুল পরিমাণে কৃষিজমি অধিগ্রহণ। নদী-খাল-পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করে সেখানে উঁচু উঁচু দালান নির্মাণ। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে এরকম হাজার হাজার বা লাখ লাখ ভবন বানাতে বানাতে একটা সময়ে ফসল আবাদের মতো কোনো জমি থাকবে কি না; মাছের জন্য কোনো নদী ও জলাশয় থাকবে কি না; পাহাড়ের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য গাছ ও ভূমির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পাহাড় থাকবে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন।
তবে আশা জাগাচ্ছে চট্টগ্রাম।
সাম্প্রতিক খবর হলো, চট্টগ্রামের টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তার মাঝের ঢালে এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের যে প্রস্তাব করেছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, আন্দোলনের মুখে তা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে সিডিএ।
অর্থাৎ নাগরিকদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছে তারা। আন্দোলনকারীদের দাবি, টাইগারপাস-সিআরবি এলাকার দ্বিতল সড়ক নষ্ট করে এবং গাছ কেটে ওই স্থানে কোনো র্যাম্প তারা চান না।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিউমার্কেট-কদমতলি এলাকা থেকে যেসব যানবাহন উঠবে, সেগুলোর জন্য টাইগারপাস-সিআরবির দ্বিতল সড়কে একটি র্যাম্প নির্মাণ করার প্রস্তাব আছে সিডিএর প্রকল্প পরিকল্পনায়। বিষয়টি জানার পর আন্দোলনে নামে চট্টগ্রামের একাধিক নাগরিক সংগঠন।
পরিশেষে, মানুষকে জাগতে হবে। প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। নদী, পাহাড়, বন ও প্রাকৃতিক সব সম্পদের মালিক যে রাষ্ট্রের জনগণ, সেই মালিকানার বোধটি জাগ্রত করতে হবে।
বিপুল জনসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ ছোট্ট আয়তনের একটি দেশের লাইফ লাইন নদী, পাহাড়, বন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ বেহাত হয়ে গেলে কিংবা বিপন্ন হলে যে আখেরে দেশের মানুষই বিপন্ন হবে—সেই উপলব্ধিটা জরুরি।
নদীর পলি জমে জন্ম বলে যে দেশের নাম নদীমাতৃক; অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর উর্বর জমির কারণে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৮ কোটি বা তারও বেশি যে মানুষ অন্তত খেয়েপরে বেঁচে আছে; কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কারণে দেশে যে অন্তত খাদ্য সংকট নেই—সেই দেশ থেকে নদী, জলাশয়, বন, ফসলের জমি নষ্ট করে কোনো ধরনের শিল্প-কারখানা, কোনো রাস্তা, কোনো অবকাঠামো গড়ে তুলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বসবাস অনুপযোগী দেশ গঠন প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে এখনই পাড়ায়-মহল্লায় সচেতন নাগরিকদের প্লাটফর্ম গড়ে তোলা দরকার।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
| পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতির খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেও এই মুহূর্তে দেশের পাহাড়গুলো আলোচনায় আছে অন্য তিনটি ঘটনায়। |
বুয়েট শিক্ষার্থীদের মতো আমিও ছাত্ররাজনীতি চাই না, তবে... | বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা বাতিল চেয়ে ছাত্রলীগ মিছিল-সমাবেশ করেছে। তারা বুয়েট কর্তৃপক্ষকে সময় বেঁধে দিয়ে বলেছে যে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। তারা তাদের সমর্থকদের নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে মহড়াও দিয়েছেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এই সুযোগে সেখানে হিযবুত তাহরির, শিবির ও মৌলবাদী সংগঠনগুলো ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে সংগঠনের কাজ করছে। তাহলে তারা কেন সংগঠন করতে পারবে না?
বুয়েটে কেন সংগঠন নিষিদ্ধ? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই সময় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময়ে এই হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ২০ নেতাকর্মীর মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
যিনি খুন হয়েছেন এবং যারা খুন করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বাবা-মাই সন্তানকে প্রকৌশলী বানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তারা খুনের মামলার দণ্ডিত আসামি। এই অধপতিত ছাত্ররাজনীতির কারণে ২৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুনের মামলার আসামি হতে হবে, সেটা কারো কাম্য ছিল না। এমনটা কেউ আশাও করেনি।
ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলছে, এর নাম যদি রাজনীতি হয়, তার বন্ধ আমিও চাই। আমি তাদের ভাষা বুঝেছি। তাদের ক্ষোভ-ক্রোধ, চাওয়া বুঝেছি যে, কেন তারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়েছে, কোন পরিস্থিতিতে তা চেয়েছে।
যে রাজনীতি তাদের পড়তে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না, শান্তিতে থাকতে দেয় না, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, মতপ্রকাশ করতে দেয় না, চাঁদাবাজি, হল দখল করে, হলে হলে টর্চার সেল তৈরি করে, ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করা সেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক, আমিও চাই! তাদের সঙ্গে আমি একমত। তারা আরও একটু বুঝলে, পরিপক্ব হলে আরও অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করার কথা বলত। সেটা বলছে না!
কেন আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল? ভারতের সঙ্গে সরকারের পানি চুক্তির বিরোধিতা করে সে তার মত প্রকাশ করেছিল। কোথায় মত প্রকাশ করেছিল? ফেসবুকে। তাহলে তাকে মূলত হত্যা করা হয়েছে মতপ্রকাশের কারণে? তাই না? মত প্রকাশ কি নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সংবিধানে কি মত প্রকাশ নিষিদ্ধ? খুন হলো মতপ্রকাশের কারণে, খুন করলো ছাত্রলীগ, আর নিষিদ্ধ করা হলো সব ছাত্রের রাজনীতি করার অধিকারকে, সেটা কি ঠিক?
আবরারকে হত্যা করেছে কারা? ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা! তাহলে এর জন্য দায়ী কে? ছাত্রলীগ। তাহলে শাস্তি হওয়া উচিত ছাত্রলীগের। তাদের কি শাস্তি হয়েছে? তাদের অপকর্ম কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। কিন্তু আপনারা শাস্তি দিতে চাইছেন কাদের? সব ছাত্র সংগঠনকে? সব ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন কেন? একের দায় কি অন্যের ওপর চাপানো যায়? কেন আপনারা এক সংগঠনের দায় অন্য সংগঠনের ওপর দিচ্ছেন? এটা কোন যুক্তি ও ন্যায়ের কথা বলতে পারেন?
মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি করতে কেউ বাধ্য নয়। কিন্তু কেউ যদি সংগঠন ও রাজনীতি করতে চায়, তাকে বাধা দেওয়া হবে কেন? আপনি তাকে বাধা দেওয়ার কে? যার ইচ্ছে রাজনীতি করবে, যার ইচ্ছে হয় করবে না। কিন্তু কারো আচরণ-অধিকার বেঁধে দেবেন কোন ক্ষমতায়? কেন অনির্দিষ্টকাল তা বন্ধ থাকবে? এই সিদ্ধান্ত কি সংবিধান ও মৌলিক মানবাধিকার বিরোধী নয়?
ছাত্রলীগের এরকম কর্মকাণ্ড কখন ছিল না? ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ স্বাধীনতার আগে-পরের অনেক ঘটনাই আছে। ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক ধারা সবসময়ই ছিল। পরিস্থিতির পরিবর্তনে যুক্ত হয়েছে তার মাত্রাগত তারতম্য শুধু। পচন শুধু ছাত্র রাজনীতিতে নয়, পতন-পচন সমাজ-রাজনীতির সর্বত্রই হয়েছে। সেই সময় যদি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হতো, তাহলে কি স্বাধীনতা আসত? নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান হতো? ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন হতো? এসব না হলে আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন, তারা কি তা করতে পারতেন?
ছাত্ররাজনীতির আদর্শিক ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান না থাকার কারণেই আবরার হত্যার ঘটনা ঘটছে। ছাত্ররাজনীতি নয়, এর দায় আদর্শিক ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান না থাকার। ক্ষমতাকেন্দ্রীক সেই অন্যায়-অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-শিবির যে যখন ক্ষমতায়-অবস্থানে থাকে, তখন অন্যদের রাজনীতি করতে দেয়নি, দেয় না। আপনারও কি তাই করছেন না? পার্থক্য কোথায়? এটাও কি দখলদারিত্ব নয়?
বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই ভাবনা ধর্মান্ধ সংগঠন ও জঙ্গীবাদের জন্ম দেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নেই। কিন্তু সেখানে জঙ্গী তৈরি হচ্ছে কীভাবে? হলি আর্টিজানের হামলায় কারা অংশ নিয়েছিল? তারা কোথায় জঙ্গীবাদের প্রশিক্ষণ পেয়েছে, বলতে পারেন? সেটা কি ছাত্ররাজনীতির কারণে হয়েছে? মাদ্রাসায় ছাত্রী-শিশু ধর্ষণসহ ভয়াবহ ও নৃসংশ ঘটনা ঘটে। এজন্য কি মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করতে হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি-শিক্ষক-প্রশাসকদের নিয়োগ দিচ্ছে কে? পত্রিকার নানা খবর নিশ্চয়ই দেখছেন। জাতীয় রাজনীতিতে যে পচন ধরেছে, তাকে কি বন্ধ করতে পারছেন? বুয়েট বাংলাদেশের বাইরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভোগ করবেন আর ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ চাইবেন, তা কী করে হয়? আপনার যে প্রতিবাদ করছেন, সেটাও ছাত্ররাজনীতিরই ফল।
শিক্ষকরা যে রাজনীতি করছেন, তারা নানা বর্ণে বিভক্ত, সেটা কি বন্ধ করতে পারছেন? এসব আবেগ ও বিরাজনীতিমূলক অবস্থান প্রত্যাহার করে সুস্থ ধারার রাজনীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি বাড়িয়ে দিয়ে দরিদ্র-মেধাবীদের লেখা-পড়ার সুযোগ বন্ধ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে আলাপ-প্রতিবাদ করুন। ছাত্রলীগের কারণে যেমন শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, ছাত্রদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, সেই একই সমীকরণে তো জাতীয় রাজনীতিও নিষিদ্ধের কথা বলতে হয়। সেই দাবি কি করতে পারবেন?
বুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। আমরা শুধু চাই না, ক্ষমতার লোভ ও অপচর্চা আবারও এসে আমাদের শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ফেলুক।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা সবাই গর্বের সঙ্গে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার চর্চা আমাদের অন্তরে লালন করি। আমরা হিযবুত তাহরীরের সম্পূর্ণ বিপক্ষে এবং কারও শিবির-সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বহিষ্কার চাই।
ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যাওয়া নয়—ভালো কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শটা কি? মুক্তিযুদ্ধের চাওয়া ও দেশপ্রেম তাহলে কী? সেটা কি তাহলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া? ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি না থাকলে কি মুক্তিযুদ্ধ হতো? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। সেই আকাঙ্ক্ষার একটি প্রধান বিষয় মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার অধিকার। তাকে অস্বীকার করে কি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়? দেশপ্রেম ও রাজনীতির বিরোধ কোথায় বলতে পারেন?
তাদের আরেকটি বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমি শিবিরের রাজনীতি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। কিন্তু তাদের সংগঠন-রাজনীতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। তাহলে তাদের কোনো সদস্য যদি এই আন্দোলনে যুক্ত থাকে, তাকে কেন বহিষ্কার করা হবে? সেটা কোন যুক্তিতে? শিবির করলে কি তারা কোনো দাবি করতে পারবে না? কোনো আন্দোলনে অংশ নিতে পারবে না? এই বক্তব্য আসলে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মতোই ফ্যাসিবাদী ও বিপদজনক ভাবনা। আমি তাই কোনোটাকেই সমর্থন করি না।
ঘোষণা ছাড়াও সংগঠন করা যায়। মিছিল-মিটিং না করা মানেই রাজনীতি না করা নয়। হয়তো সেখানে পেশিশক্তির মহড়া থাকে না। কিন্তু রাজনীতি হয় এবং হচ্ছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সংগঠন গড়ে তুলছে। সেক্ষেত্রে বলা যায় তাদের রাজনীতি বন্ধ নেই। কখনো ছিলও না। তারা যদি সে কাজ করতে পারে, তাহলে অন্যান্য সংগঠন কেন তা করতে পারবে না? কোনো সংগঠন যদি সন্ত্রাস, সমাজ ও দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তা যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য হুমকি হয়, তাকে নিষিদ্ধ করাসহ নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাদের কারণে অন্যদেরও অভিন্ন দণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়।
বুয়েটে ছাত্র বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'আমি রাজনীতি করি, সেজন্য বুয়েটে আমি যেতে পারব না? এটা কোন ধরনের আইন?' তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। কিন্তু একই দাবি যদি বিএনপি পক্ষ থেকে করা হয়, তখন ওবায়দুল কাদের কি তাদের সেই কথা মেনে নেবেন? বা তিনি মানলেও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কি সেটা মানবে? রাজনীতির এই স্ববিরোধী অবস্থান ও চরিত্র আগে ঠিক করুন, তারপর এমন নীতিকথা বলুন।
সবশেষে যে কথা বলতে চাই, কোনো সংগঠন ও তার সদস্যদের আচরণ, কর্মকাণ্ড যদি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী হয়, সেজন্য প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নীতিমালা ও আচরণবিধি প্রণয়ন করুন। শিক্ষার পরিবেশ পরিষদ গঠন করুন। সব সংগঠনের সমন্বয়ে নিয়মিত বৈঠকের ব্যবস্থা করুন। সেখানে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন। এই বিষয়ে কঠোর হোন, কিন্তু ছাত্ররাজনীতি ও মতপ্রকাশের অধিকার বন্ধের সিদ্ধান্ত পরিহার করুন।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
| বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা বাতিল চেয়ে ছাত্রলীগ মিছিল-সমাবেশ করেছে। তারা বুয়েট কর্তৃপক্ষকে সময় বেঁধে দিয়ে বলেছে যে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। তারা তাদের সমর্থকদের নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে মহড়াও দিয়েছেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এই সুযোগে সেখানে হিযবুত তাহরির, শিবির ও মৌলবাদী সংগঠনগুলো ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে সংগঠনের কাজ করছে। তাহলে তারা কেন সংগঠন করতে পারবে না? |
অন্যায় যে করে, তারে আর দহে না কিছুতেই | দুর্নীতি আর অসঙ্গতিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শেখা মানুষগুলো কিন্তু আমরাই। নারী যখনই সমাজে যৌন হয়রানির নালিশ করে, তখনই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয়। নালিশ করার আগ পর্যন্ত একই নারী একই সমাজে গ্রহণযোগ্য থাকে।
বুদ্ধিমত্তার চেয়ে সৌন্দর্যের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে। নারী যখন বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেক বোধের সঙ্গে আবির্ভূত হয়, সমস্যা তখনই শুরু হয়।
শিক্ষক কিংবা গুরুকে একটা সময়ে পিতামাতা ও রক্ষকের স্থানে রাখা যেত। এই সময়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে তারা বিব্রত হন না। আগেও এরকম ঘটনা ঘটত। আমরা জানতাম না, জানা যেত না। এখন সহজে জানা যায়। কারণ মেয়েরা চুপ থাকে না। লজ্জা এখন আর শুধু একটি জেন্ডারের ভূষণ না। আশার কথা হলো সাহসী মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও শিক্ষার্থীদের দিকে কুনজর দেন। মাদ্রাসার নাবালক এবং সাবালক শিক্ষার্থীদের মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা অসংখ্য। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী প্রয়াত নুসরাত জাহান রাফি আগুনে পুড়ে আমাদের জন্য জ্বলজ্বলে উদাহরণ রেখে গেছেন। ১৮ বছর ধরে অধ্যক্ষের আসনে থাকা শিক্ষকই ভক্ষক হয়ে মেয়েটির শ্লীলতাহানি করেন।
কেন এমন মৃত্যু? এমন প্রশ্ন হাজারো মানুষের মতো আমারও। এর একটাই জবাব—স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দলীয় নেতাদের স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক লাখো টাকার দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করার লোকের যখন অভাব হয়, আর অর্থের কাছে যখন প্রশাসন বিক্রি হয়ে যায়, তখন আমরা হেরে যাই।
এ কারণেই মুনিয়ারা ফ্যানে ঝোলেন। অবন্তিকাও একইভাবে ফ্যানে ঝুলে পড়েন। তনুর মরদেহ পড়ে থাকে ঝোপে। অভিনেত্রী শিমুর লাশও ঝোপে মেলে। মডেল তিন্নি হত্যার বিচার ২০ বছর পরও ঝুলে থাকে। শারমীন রীমার লাশ পড়ে মিজমিজি গ্রামে (৯ এপ্রিল ১৯৮৯)। তবে ব্যতিক্রম হলেও বিচার হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ডের। আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ২৭ জুলাই। কারণ, এ ক্ষেত্রে তথাকথিত সমাজ নারীকে পাগল প্রমাণ করতে পারেনি। হয়তো ধনীর দুলালের কুকীর্তিকে ঢেকে রাখার মতো পয়সাখোর পয়দা হয়নি তখনো। হলেও বিচারব্যবস্থা হয়তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে যৌন নিপীড়কদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিসহ নিপীড়ক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। অপরাধীর অপরাধের প্রকৃতি ও ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে যৌন অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর অপরাধীদের বিভিন্ন স্তরে শ্রেণিবিভাগ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যৌন অপরাধীরা কোথায় বাস করবে, এ ব্যাপারে কি রাষ্ট্র সীমাবদ্ধতা তৈরি করে দেয় না? এখানকার সভ্য সমাজে বাস করার যোগ্যতা অর্জন করে, প্রমাণ করে একজন রেজিস্টার্ড অপরাধী সমাজে বাড়ি কিনে বা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারে। এটা নির্ভর করে অপরাধী ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশনস, জুভেনাইল রিহ্যাবিলিটেশন বা কাউন্টি প্রবেশনের তত্ত্বাবধানে আছে কি না। যদি এসব অপরাধীরা তত্ত্বাবধানে থাকে, তবে তাদের শাস্তি ভোগ করে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে সংশোধন বিভাগ বা সাজা প্রদানকারী আদালত তাদের ওপর নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা বা বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে থাকতে পারে—বসবাসের বিধিনিষেধ, শিশুদের আশেপাশে না থাকা, অ্যালকোহল পান কিংবা মাদক গ্রহণ না করা ইত্যাদি। যদি তারা তাদের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের জেল বা কারাগারে পুনরায় ফেরত পাঠানো হতে পারে।
যেসব অপরাধী সংশোধন বিভাগ বা আদালতের তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের সাজার সময় শেষ করে, তারা কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই তাদের পছন্দের জায়গায় থাকতে পারে। কোনো সেক্স অফেন্ডার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আছে কি না, তা জানতে স্থানীয় ডিওসি (ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশন) অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
কোনো পরিচিত অফেন্ডারের নাম লিপিবদ্ধ তালিকায় না দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেন। এসব কাজে কেউ গড়িমসি করলে তার চাকরি থাকে না। যৌন অপরাধী নীতি বোর্ড যৌন অপরাধীদের মুক্তি এবং আবাসন সম্পর্কিত নীতিগুলোর ওপর সমীক্ষা চালায়, গবেষণা করে, প্রকৃত সংখ্যাসহ সব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে অবগত রাখে।
সদিচ্ছা থাকলেই আমাদের দেশেও উন্নত চিন্তাপ্রসূত এই কাজগুলো করা সম্ভব। দেশ তখনই উন্নত হয়, যখন আমাদের চিন্তাভাবনা উন্নত হয়। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি নিশ্চিতের আগে শিক্ষক কিংবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আর টাকার অঙ্ক দেখার সঙ্গে তাদের চারিত্রিক ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয় কি? অপরাধীদের তালিকা তৈরি করা হয় কি? কে জানে!
প্রতি বছর বহুতল ভবনের অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি, নির্বাচনে অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া, যোগ্য শিল্পীর সময়মতো রাষ্ট্রীয় পদক না পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' করার মতো যোগ্য লোক নেই বলে। লোক থাকলেও অর্থ ও ক্ষমতার কাছে আত্মসম্মান বিক্রি হয় বলে।
রাষ্ট্র তখনই সফল হয়, যখন চাহিদা অনুসারে সময়মতো বৈধভাবে নাগরিক সেবা পৌঁছে দিতে পারে, নিরাপত্তা দিতে পারে, সম্পদের বণ্টন সুষম হয়, বাক স্বাধীনতার চর্চা থাকে, দুর্নীতি নিম্নমুখী আর অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়। রাষ্ট্র অসফল অকার্যকর হয় উল্টোটা হলে। বাংলাদেশে বাস্তবে কী ঘটছে তার ব্যাখ্যাটুকু পাঠকদের চিন্তা-চেতনার ওপর ছেড়ে দিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ শিক্ষা নিয়েছে। ধবধবে সাদারাই (সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ক্ষমতা বেশি যাদের) বেশি বলে এখানে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার'। পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। অনিয়মের ঘটনা ঘটলে তারা স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়গুলোর স্তরে স্তরে উপযুক্ত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দেয়। নজরদারি বাড়ায়। সময়মতো খবরদারি করে। কাউন্টারব্যালেন্স করে। ভারসাম্য ঠিক রাখে। একটি সংস্থা বা সিস্টেম যেন কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, নিয়ন্ত্রিত না হয়, তা নিশ্চিত করে। সমাজকে অবহিত করে। অক্ষম হলে লজ্জা পায়। ক্ষমতা ছেড়ে নতি স্বীকার করে। তবু জবাবদিহিতার জায়গায় নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে।
সভ্যতার ছাপ তখনই স্পষ্ট হয় যখন ব্যক্তি তার কৃতকর্ম এমনকি অপারগতার দায়টুকুও নেয়; আত্মসম্মান বজায় রাখে। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সভ্য সমাজ শিক্ষা নেয়। সচেতন হয়।
যেকোনো ঘটনা ঘটলে আমরা তার উল্টোটা করি। চায়ের কাপে ঝড় তুলে আড্ডায় গল্পে চর্চা করে দায় শেষ করি। আত্মসম্মানের সংজ্ঞা পাল্টে যায়। অপরাধ করার পর জবাবদিহি দূরের কথা; অপরাধ ঢাকতে আরও অপরাধ করি। হত্যার দায় এড়াতে সরকারকে কিনে ফেলা, সাংবাদিকদের পকেটে পুরে ফেলা, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো সহজ এখন। নারীকে নির্যাতন করা দেখলে তাকেসহ তার চৌদ্দগোষ্ঠীকে পাগল প্রমাণ করতে উদ্যত হয় পুরো পুরুষসমাজ (সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতা যাদের)। সবকিছুতে উল্টোস্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে পরাজয় স্বীকার করে তনু, নুসরাত, অবন্তিকারা।
বহুকাল ধরে দেখে আসছি, অন্যায় যে করে তারে আর দহে না কিছুতেই। তাই বলে অন্যায় যে সহে, তাকেও কি তা দহে না?
শাহনাজ রহমান: এমপিএইচ, মিল্কেন ইনস্টিটিউট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, দ্য জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি; এমবিবিএস, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ
[email protected]
| দুর্নীতি আর অসঙ্গতিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শেখা মানুষগুলো কিন্তু আমরাই। নারী যখনই সমাজে যৌন হয়রানির নালিশ করে, তখনই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয়। নালিশ করার আগ পর্যন্ত একই নারী একই সমাজে গ্রহণযোগ্য থাকে। |